#নভেম্বরের_শহরে
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৫
–তোমার সাথে একটু কথা আছে সামিন।
সামিন মনোযোগ দিলো। বলল
–কি কথা মা বল।
রেহানা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল
–বিয়েটা পেছানোর কারণটা আসলে ওর মার অসুস্থতা নয়। অন্য একটা কারন আছে।
সামিন খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–কি কারন? আমাকে খুলে বলতে পারো।
–মেয়েটার বাবা কিছুদিন আগে হুট করেই হারিয়ে যায়।
মায়ের কথা বুঝতে না পেরে সামিন কণ্ঠে অবাকের রেশ টেনে বলল
–হারিয়ে যায় মানে? উনি কি মানসিক ভারসাম্যহীন যে হারিয়ে যাবে?
–সেররকম কিছু না। আমিও ঠিক জানিনা কি হয়েছে। ওদের ভাষ্য মতে রাতে খাওয়া শেষ করার পর একটা ফোন আসে। আর সেই ফোন পেয়েই উনি বাইরে চলে যান। তারপর থেকে তার ফোন বন্ধ। কোন খবর পাওয়া যাচ্ছে না। এখনও কিছুই জানা যায়নি।
সামিন একটু ভেবে বলে
–খারাপ কিছু হয়নি তো?
রেহানা চিন্তিত হয়ে বললেন
–খারাপ মানে?
–মানে ফোন আসার পরে বের হয়ে যান। আমি বলছি না সেরকম হয়েছে। কিন্তু ক্যাল্কুলেশন যদি ঠিক থাকে তাহলে কেউ একজন তাকে ডেকে নিয়ে যান আর তারপরেই তিনি ফিরে আসেন না। বিষয়টা একটু ডিফারেন্ট!
রেহানা চিন্তায় ডুবে গেলেন। সামিন ভুল কিছু বলেনি। অনেক কিছুই হতে পারে। আর সেরকম কিছু যদি হয়ে থাকে তাহলে পরিস্থিতি খুব খারাপ হবে। সামিন চোখ বন্ধ করে দুই হাতে মাথা চেপে ধরল। রেহানা তার দিকে তাকাল। চিন্তিত গলায় বলল
–শরীর খারাপ লাগছে?
সামিন মৃদু হেসে বলল
–ওয়েদার টা একটু ডিস্টার্ব করছে। কিছুদিন লাগবে এডজাস্ট করতে।
–রেস্ট নে বাবা। আমি আসছি।
সামিন ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল
–দাড়াও মা আমিও তোমার সাথে যাব।
রেহানা সামিনের দিকে তাকিয়ে বললেন
–এখনই যেতে হবে? রেস্ট নীলে হতোনা?
সামিন একটু অনুরধের সুরে বলল
–অনেকদিন পর এসেছি। বন্ধুরা ব্যস্ত হয়ে গেছে দেখা করার জন্য। যেতেই হবে। সবাই অপেক্ষা করছে।
রেহানা কোন কথা বলল না। মৃদু হেসে সম্মতি দিলো। সামিন ফটাফট রেডি হয়ে চলে গেলো মায়ের সাথে।
———–
সারাটা দিন সূর্যের দেখা মিললো না। কুয়াশা প্রকৃতিকে এক প্রকার জাপটে ধরে আছে। ছাড়ার কোন নামই নিচ্ছে না। এতক্ষন রান্না ঘরে চুলোর আঁচে থাকার ফলে কিছুটা গরম ভাব ধরে গেছে শরীরে। টেবিলে খাবার সাজিয়ে গলা তুলে বলল নুহা
–মৌ গোসলে যা। আমি বাইরের বাথরুমে যাচ্ছি। খাবার নিয়ে হাসপাতালে যেতে হবে। তাড়াতাড়ি।
মৌ আদৌ গোসলে গেলো কিনা সেটা না দেখেই নিজে বাইরের বাথরুমে কাপড় নিয়ে ঢুকে পড়ল। তাড়াহুড়ো করে গোসল সেরে বেরিয়ে এসে আবারো ডাকল
–নানাভাই; দাদু; সবাই খেতে এসো।
এক ডাকেই সবাই উপস্থিত। ব্যস্ত ভঙ্গিতে টেবিলে খাবার বেড়ে দিলো নুহা। তাড়াহুড়ো করে নিজেও খেয়ে নিলো। এর মাঝেই মৌ এসে বলল
–তুমি এখন হাসপাতালে যাবে আপা?
নুহা টেবিল ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল
–হুম। তুই খেয়ে নে।
–আমিও যাব।
নুহা কিছু বলার আগেই। আনিস বলল
–যাবে। আগে খেয়ে নাও।
মৌ খুশী মনে খেতে বসলো। নুহা নিজের হাতের কাজ গুলো শেষ করে এসে আনিসের কাছে দাঁড়ালো। আনিস একবার চোখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে বলল
–কিছু বলবে আম্মু?
নুহা নত দৃষ্টিতে মৃদু গলায় বলল
–বলছিলাম কি বড় আব্বু। মা তো এখন একটু সুস্থ। আমরা কি এখন বাসায় আনতে পারবো না?
আনিস কিছুক্ষন নুহার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। ঠিক কি বলতে চাইছে বুঝতে চাইলেন। কিছুক্ষন পর নিজেই হাত ধরে পাশে বসালেন। মাথায় হাত দিয়ে বললেন
–তুমি অত্যন্ত বিচক্ষন একটা মেয়ে। আমি জানি তুমি কি ভাবছ। তুমি বড় হয়েছ। আর পরিবারের বড় মেয়ে হিসেবে তোমার এখন অনেক কিছুই জানা প্রয়োজন। তাছাড়া পরিস্থিতিও এখন অনুকুলে নেই।
থেমে আবার বললেন
–দেখ আম্মু তোমার দাদু এখনও বেঁচে আছেন। আর আমরা তার সিদ্ধান্তই শেষ সিদ্ধান্ত মনে করি। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। গ্রামের জমি গুলো সমান ভাগে ভাগ করে দিবে। আর তার জমানো কিছু টাকা আছে। জেগুলা তিনি তোমাদের হাতে দিতে চান। যাতে করে তোমার মায়ের চিকিৎসাটা ভালভাবে হয়। কিন্তু…।
নুহা ভ্রু কুচকে তাকাল। মৃদু সরে প্রশ্ন করলো
–কিন্তু কি বড় আব্বু?
–দোকানটার একটা ব্যবস্থা করা দরকার।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
–আমরা চেষ্টা করছি তোমার বাবার খোজ নিতে। কিন্তু এক সপ্তাহ পার হয়ে গেলো। এখনও কোন খবর পাওয়া গেলো না। আল্লাহ জানে! আমরা সবাই মিলে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তোমার মা আর তোমার মতামতের অপেক্ষায় আছি। দোকানটা বিক্রি করে দিলে কেমন হয় আম্মু?
নুহার বুকের ভেতরে চিনচিনে ব্যথা। এই কথার মানে কি? তাহলে কি তার বাবা আর ফিরবে না? হারিয়ে গেলো মানুষটা সারাজিবনের জন্য। জানা হল না আর কি হয়েছে তার সাথে? এরকমও কি হয়? চোখ পানিতে ছলছল করে উঠলো। দম বন্ধ হয়ে আসছে। কান্না আটকাবার চেষ্টা করেও পারলো না। গাল বেয়ে পানি গড়িয়েই পড়ল। হাহাকার নিয়ে কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল
–বাবা কি ফিরবে না?
আনিস কোন উত্তর দিলেন না। প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন
–তোমার মা সুস্থ হয়ে ফিরলেই এই বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলে একটা ব্যবস্থা করতে হবে। নাহলে দোকানটা কে দেখবে?
নুহা সাহস নিয়ে বলেই ফেলল
–বড় আব্বু বাবার স্বপ্ন ঐ দোকানটা। বিক্রি না করে আমি যদি ঐ দোকানটা চালাই? কাপড়ের দোকান তো। আর এখন তো কত মেয়েই মার্কেটে এভাবে ব্যবসা করছে। খারাপ কিছু নয় তো।
আনিস বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকালেন। বললেন
–তুমি?
নুহা মাথা নাড়াল। আনিস ক্লান্ত হেসে বললেন
–আম্মু তোমার এসবের মধ্যে যাওয়াটা কেউই পছন্দ করবে না। আর তাছাড়াও তোমার এখন উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। তুমি লেখাপড়ায় অনেক ভালো। ভালো জায়গায় ভর্তি হওয়াটা খুব দরকার। তাছাড়াও সামনে তোমার বিয়ে। এসব নিয়ে ভাবো আম্মু।
নুহা কোন কথা বলল না। কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না। সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। বাবা ফিরবে না ভাবতেই বুকের ভিতরে কেমন মোচড় দিয়ে উঠছে। আনিস আবারো বললেন
–রেডি হয়ে নাও আম্মু। আমাদের হাসপাতাল যেতে হবে। আমরা গেলে তারপর মাসুদ আসবে।
নুহা উঠে চলে গেলো। বাথরুমে গিয়ে কিছুক্ষন কেদে নিজেকে হালকা করলো। রেডি হয়ে বের হল। ততক্ষনে মৌ রেডি। দুজনেই সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে বের হল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।
————
গাড়ি চলছে আপন গতিতে মা ছেলে দুজনেই চুপচাপ বসে আছে। বেশ খানিক্ষন ওভাবে বসে থাকার পর রেহানা বলল
–আমি যে তোমার জন্য মেয়ে ঠিক করেছি তাতে কি তোমার কোন আপত্তি আছে?
সামিন কিছু একটা ভাবছিল। মায়ের কথা শুনে ফিরে তাকাল। স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–মেয়েটা কি সুন্দর?
রেহানা কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল
–ভালই দেখতে। তোমার পছন্দ হবে।
সামিন একটু হেসে বলল
–কাল তো গিয়েছিলাম। কই মেয়েটাকে তো দেখলাম না?
রেহানা হাসল। বলল
–মেয়েটা বড্ড লাজুক। সামনে আসতে চায়না। এখন তো আছোই। দেখবে কোন একদিন। আর তাছাড়াও কালকের পরিস্থিতিটা খুব একটা ভালো ছিলনা। ওরা নিজেদের সমস্যার জন্য খুব চিন্তিত।
থেমে একটু হতাশ গলায় বলল
–তোমার মায়ের উপর ভরসা আছে তো?
সামিন ভ্রু কুচকে বলল
–কেন বলছ এসব?
রেহানা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন
–এতো সমস্যার কথা জানলে হয়তো তোমার বাবা মেনে নেবেন না। তাই বলছিলাম।
–তুমি এখনও বাবাকে এসব জানাওনি? কেন বিয়ে হচ্ছে না সেটাও বলনি?
সামিনের এমন বিস্ময় নিয়ে বলা কথার উত্তর খুজে পেলনা রেহানা। তাদের সম্পর্ক তেমন স্বাভাবিক নয় যে একজন আরেকজনকে সব কথা বলবে। সামিন তো আর সেটা জানেনা। মাকে চুপ করে ভাবতে দেখে সামিন বলল
–কি হয়েছে মা? কোন সমস্যা? আই মিন বাবার সাথে কি তোমার ঝগড়া হয়েছে?
রেহানা চমকে গেলেন। নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বললেন
–না না। তেমন কিছু না। তোমার বাবা ব্যস্ত ছিল। তাই কথা বলার সুযোগ হয়ে উঠেনি। তুমি তো তোমার বাবাকে জানো।
সামিন মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। শান্ত কণ্ঠে বলল
–ঠিক আছে। তবে তুমি এখন সব কিছু বাবাকে খুলে বলবে। প্রতিটা মানুষের জীবনে প্রবলেম থাকতেই পারে। আই হোপ বাবা উইল গেট দ্যাট ইজিলি।
–হোপ সো।
রেহানা মৃদু সরে ছেলের সাথে তাল মিলিয়ে বললেন। কিন্তু গলার আওয়াজে তেমন জোর পাওয়া গেলো না। সামিন কারণটা বুঝতে পারলো না। কিন্তু আবার বুঝতেও চাইল না। কারন সে জানে বাবা মার মাঝে কিছু হয়েছে। কিন্তু সেটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যপার। নিজেরাই সামলে নিবে। হাত বাড়িয়ে সামিন ড্রাইভারকে বলল
-আঙ্কেল আমাকে সামনে নামিয়ে দাও।
গাড়ি একটু সামনে গিয়ে থামল। সামিন গাড়ি থেকে নেমে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তা পার হয়ে চলে গেলো। কিছুদুর হাটতে হবে তাকে। গাড়িতেই যেতে পারতো কিন্তু মায়ের উলটা পথ হয়ে যাবে আর দেরিও হবে। তাই সে হাটার রাস্তাটাই বেছে নিলো। রাস্তায় একা হাটার মাঝেও একটা অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করে। কিছুদুর হেটে যেতেই সামিনের চোখ সামনে আটকে গেলো। সেদিনের সেই মেয়েটা দাড়িয়ে এদিক সেদিক অস্থির দৃষ্টি ফেলছে। কাউকে খুজছে মনে হয়। সামিনের দুনিয়া যেন থমকে গেলো। বুকের ভিতরের দুরুদুরু কাপন বেড়ে গেলো। কি ভেবে গলা তুলে বলল
–এই যে শুনছেন মিস…।
আশে পাশের কয়েকজন ঘুরে তাকাল। কিন্তু এতো লোকজনের মাঝে যাকে ডাকছে সে কিভাবে বুঝবে? আর নামটাও তো জানেনা। এভাবে বোকার মতো চেচিয়ে কোন লাভ হবে না। একটু ভেবে আবারো চেচিয়ে বলল
–এই যে মিস নভেম্বরি!
এমন অদ্ভুত নাম শুনে আশে পাশের প্রায় সবাই ঘুরে তাকাল। সাথে সেই কাঙ্ক্ষিত নভেম্বরিরও দৃষ্টি মিলল। চোখে চোখ পড়ায় দৃষ্টি নামিয়ে নিলো মেয়েটি। সামিন দৌড়ে এগিয়ে গিয়ে বলল
–আপনাকেই ডাকছিলাম।
ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষন তার দিকে। দৃষ্টির মাঝে কৌতূহল আর বিরক্তি দুটোই স্পষ্ট। সামিন পলক ফেলতেই ভুলে গেলো কিছু সময়ের জন্য।
–কেন ডাকছিলেন?
ঝাঝাল গলায় কিছুটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পরে গেলো সামিন। একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল
–জানিনা তো।
বিরক্তিকর শ্বাস ছেড়ে মেয়েটি মাথার ওড়নাটা টেনে দিয়ে বলল
–আপনি জানলেও আমার কিছু যায় আসত না। কারন আমি আপনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক না। এক্সকিউজ মি।
বলেই হাটা ধরল। সামিন নির্বোধের মতো তাকিয়ে থাকলো। ডেকেছিল কেন? যা আবারো নামটাই তো জানা হল না। কি অদ্ভুত মেয়ে। এক মিনিট কথা বললে কি হতো।
চলবে………