#নভেম্বরের_শহরে
লেখক – এ রহমান
পর্ব ৪
ক্যান্টিনের একটা টেবিলে বসে নিচের দিকে তাকিয়ে অনবরত হাত কচলাচ্ছে আনিস সাহেব। তার চেহারায় ঘোর অসস্তি। রেহানা ঠিক কি কথা বলতে তাকে এখানে ডেকে এনেছে সেটাই বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি।
— ভাই সাহেব যদি কিছু মনে না করেন তাহলে একটা কথা বলতাম। আসলে বাইরের একজন হয়ে আপনাদের পরিবারের বিষয়ে কথা বলাটা কতটুকু শোভনীয় সেটাই বুঝে উঠতে পারছিনা। তবুও না বলে পারলাম না। নুহার বাবার এভাবে হুট করে গায়েব হয়ে যাওয়াটা একটু অন্য রকম মনে হচ্ছে আমার কাছে। উনি কি কোথাও যেতে পারেন বলে আপনার মনে হয়?
রেহানার সন্দিহান কথা শুনে আনিস একটু নড়েচড়ে উঠলো। ঠিক কি ভেবে এমন কথা বলল রেহানা সেটা ভেবেই একটু কঠিন হয়ে গেলো আনিস। সরু চোখে তাকিয়ে বলল
— আপনি ঠিক কি বলতে চাইছেন বোন। আমি কিছু বুঝতে পারছিনা। একটু খুলে বলবেন?
রেহানা আনিসের কথা বলার ধরন শুনেই বুঝে গেলো তার কথাটা ভালো ভাবে নেন নি। একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন তিনি। সেরকম কিছু বলতেই চান নি। আসলে একেক জনের দৃষ্টি ভঙ্গী একেক রকম। তাই হয়তো এভাবে নিয়েছেন। অপ্রস্তুত ভাবে বললেন
— আপনি যা ভাবছেন আমি সেরকম কিছুই বলতে চাইনি ভাই সাহেব। আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমার মাথায় এটাই আসছে না যে একটা জীবন্ত মানুষ হুট করে কিভাবে গায়েব হয়ে যায়। আমিও আমার সাধ্য মতো চেষ্টা করছি ওনাকে খুজে বের করতে। ওনার বিষয়ে সব রকম তথ্য যদি পাওয়া যেত তাহলে হয়তো আমাদের খুঁজতে সুবিধা হতো।
আনিস নিশ্বাস ছাড়লেন। হতাশ মুখে বললেন
— চার ভাই বোনের মধ্যে এনামুল দ্বীতিয়। খুব সাদা সিধে একজন ছিল। মেয়েরাই তার প্রাণ। তাদের জন্য মূলত শহরে আসা। মেয়েদের ভালো করে পড়ালেখা করানো তার স্বপ্ন ছিলো। মেয়েরাও তাকে নিরাশ করেনি। এখানে এসে টিকে থাকার জন্য গ্রামের জমি জমাই যথেষ্ট ছিলনা। তাই সিদ্ধান্ত নেয় ঐদিকে কিছু জমি বিক্রি করে একটা দোকান কিনবে। আর সেই কাপড়ের দোকান দিয়েই সংসার চালাবে। আর কিছু জমি জমা আছে তা থেকে যা আসে সেটাতেই চলে যাবে। দোকান কেনার পর সব টাকা শেষ হয়ে গিয়েছিলো। এখন ব্যবসা শুরু করতেও তো পুঁজির দরকার ছিল। তাই একটু সাহস করে ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছিল। দোকানে যা আয় হতো সেখান থেকেই সব ঠিকঠাক ভাবে চলে যাচ্ছিলো।
বলেই তিনি থামলেন। চোখ ছলছল করে উঠলো। রেহানা জিজ্ঞেস করলেন
— আচ্ছা যেদিন উনি হারিয়ে যায় সেদিন ঠিক কি হয়েছিলো?
— সেদিন রাতে নাকি খাওয়া শেষ করে শোবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। হঠাৎ করেই একটা ফোন এসেছিল। ফোনটা ধরেই নাকি কিছু সময় কথা বলে বাইরে চলে গেছে। তারপর থেকে আর ফিরেনি। ফোনটাও বন্ধ।
গলা কেপে উঠলো তার। চোখের পানি আটকাতে পারল না। ভাইটা এভাবে হারিয়ে গেলো! রেহানা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন
— কাদবেন না ভাই সাহেব। আমি আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। আমি সব রকম চেষ্টা করবো ওনাকে খুজে বের করতে।
আনিস চোখের পানি মুছে তাকালেন। বললেন
— আপনার ঋণ কিভাবে শোধ করবো আমার জানা নেই বোন। কোন সম্পর্ক ছাড়াই আপনি এত ভাবছেন আমাদের নিয়ে।
রেহানা থামিয়ে দিলো। মৃদু হেসে বলল
— কি যে বলেন ভাই সাহেব। মানুষ হয়ে জন্ম নিলে দায়িত্ববোধ থাকবেই। আর সেখান থেকেই এসব করা। তাছাড়া আজ সম্পর্ক নেই তো কি হয়েছে একদিন তো হবে।
আনিস পুরনো দৃষ্টি মেলে তাকালো। মনোযোগ দিল রেহানার কথায়। রেহানা নিচের দিকে তাকিয়ে বলল
— এইসব ঝামেলা মিটে যাক তারপর নাহয় বিয়ে নিয়ে ভাবা যাবে। মেয়েটা এই অবস্থায় কিভাবে বিয়ের বিষয়ে ভাববে। এটা অন্যায় হয়ে যায় ওর সাথে। আমিও তো একজন মা আমাকেও ত মায়ের মতই ভাবতে হবে। তাই না?
আনিসের মনের মাঝে মৃদু বাতাস বয়ে গেলো। এতক্ষণের দমবন্ধ কর পরিস্থিতির মাঝে হঠাৎ করেই চোখে মুখে খুশি ঝলকে উঠলো। তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল
— আপনার তুলনা হয়না বোন। আপনাকে সৃষ্টিকর্তা কি দিয়ে তৈরি করেছেন? এতো ভালো মানুষ হয়?
রেহানা একটু লজ্জা পেলেন। লাজুক হেসে বলল
— আমি তাহলে আজ উঠি ভাই সাহেব। আমার ছেলে এসেছে অনেকদিন পর। কাল নাহয় একবার আসবো।
আনিস পূর্ণ হেসে বলল
— অবশ্যই। আপনার ছেলে কিন্তু বেশ ভালো।
— দোয়া করবেন ভাই সাহেব।
আনিস হাসলেন। রেহানা উঠে চলে গেলো। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে আনিসের কথা গুলোর পুনরাবৃত্তি করলো মনে মনে। সত্যিই তাকে সৃষ্টি কর্তা অনেক যত্ন করে তৈরি করেছে। নাহলে আসিফের মত এমন জল্লাদের সাথে এতো বছর একই ছাদের নিচে থাকতে পারতো না। ওই মানুষটাকে দেখলেই তার গা ঘিনঘিন করে উঠে। শুধু এই ছেলেটার জন্য মুখ বুঝে সব সহ্য করে নেয়। ছেলেটা তার বাবাকে খুব ভালোবাসে। কিন্তু যখন বাবার সম্পর্কে সব সত্যি কথা জানতে পারবে তখন কিভাবে নিবে সে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। সামিন একদৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে কি যেনো ভাবছে। মুচকি হাসি তার মুখে। রেহানা অনেক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। সামিন খেয়াল করলো না। রেহানা প্রশস্ত হেসে বলল
— এতো খুশি যে কি হয়েছে?
চমকে তাকাল মায়ের দিকে। একটু হেসে বলল
— কিছু না। তোমার কাজ শেষ? চলো বাসায় যাই। ভীষন টায়ার্ড!
রেহানা হেসে গাড়িতে উঠে বসলো। ছেলের মাথায় হাত দিয়ে বলল
— আমার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়। ভালো লাগবে।
—————–
অন্ধকার ঘর। নীলচে মৃদু আলো জ্বালানো। মাঝারি আওয়াজে একটা চেনা রবীন্দ্র সংগীত চলছে হোম থিয়েটারে। চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে আছে সামিন। রবীন্দ্র সংগীতের প্রতি তার একটা দুর্বলতা কাজ করে। দীর্ঘদিন বিদেশে থাকার পরও সেটা একচুলও কমেনি। এমন না যে সে ইংলিশ গান শুনে না। কিন্তু প্রতিদিন নিয়ম করে রবীন্দ্র সংগীত শুনতেই হয় তার। আর সেটা শোনার জন্য আছে তার নিজস্ব ঢং। তার মতে রবীন্দ্র সংগীতের সঙ্গে আত্মার একটা আধ্যাতিক সম্পর্ক আছে। আর সেই সম্পর্ক বজায় রাখতেই সেটা একটু অন্যভাবে অনুভব করতে হয়। দুনিয়া থেকে আলাদা হয়ে একটু অন্যরকম পরিবেশে। সামিন এটা বেশ উপভোগ করে। এই রবীন্দ্র সংগীতের অভ্যাসটা মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে সে। তার মা রবীন্দ্রনাথের বেশ ভক্ত। অদ্ভুত সুন্দর করে রবীন্দ্রসংগীত গাইতে পারেন তার মা। মায়ের গলায় এই গান যেনো কেমন মানিয়ে যায়। তাই ছোটবেলা থেকেই দুর্বলতা তৈরি হয়েছে তার।
ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজ করে দরজা হালকা খুলে গেলো। সামিন মৃদু চোখ খুলে তাকালো। একজন রমণী দরজা ধরে দাঁড়িয়ে ভেতরে তাকিয়ে আছে। অন্ধকারে শাড়ীর রংটা ভালোভাবে ঠাওর করা যাচ্ছে না। হালকা সাজ মুখে। সামিন নড়েচড়ে উঠে বসে বলল
— ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? ভেতরে আসো মা।
রেহানা ঘরে ঢুকে লাইট অন করে দিলো। ছেলের পাশে এসে বসলো। সামিন মাকে ভালোভাবে দেখে নিলো। হালকা সেজেছে। বেশ মানিয়েছেও তাকে। বাইরে বেরোবার সময় এসব বিষয়ে তার মা বেশ পরিপাটি। সামনের তো মনে হয় তার মা রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস পড়তে পড়তে সব নায়িকাগুলোকে নিজের মধ্যে ধারণ করে ফেলেছে। সেরকম করেই নিজেকে সাজাতে পছন্দ করে। আর মানিয়েও যায় বেশ। মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলো
— কোথাও যাচ্ছো মা?
রেহানা মৃদু হেসে বললেন
— ব্যাংকে যাচ্ছি। কিছু খাবে? বানিয়ে দিতে বলে যাবো?
— এখন খাবো না।
বলেই গা এলিয়ে দিলো বিছানায়। রেহানা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন
— বাবা তোমাকে কিছু বলার আছে।
রেহানার গলাটা অন্যরকম শোনালো। কণ্ঠে ভয় প্রকাশ পেলো। সামিন মনোযোগ দিলো মায়ের কথায়।
চলবে…..