#নভেম্বরের_শহরে
লেখক – এ রহমান
পর্ব ৩
রাত ৯ টা। রাস্তার হলদেটে নিয়ন বাতির আলো কুয়াশার আবরণে ঢেকে ঝাপসা হয়ে আসছে। সামনের ১০ ফিট চওড়া রাস্তায় একের পর এক গাড়ি ছুটে চলেছে। লম্বা একটা জার্নির পর সামিন এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে বাইরে দাড়ালো। এদিক সেদিক এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে অপেক্ষা করছে পরিচিত কারো দর্শনের। প্লেনে উঠার আগে বাবা বলেছিল গাড়ি পাঠাবে। কিন্তু কোথায় সেই গাড়ি। দূর দূরান্ত পর্যন্ত কোন পরিচিত মুখ দেখা যাচ্ছেনা।
— ছোট সাহেব!
বেশ পরিচিত সর। পিছনে ঘুরে তাকাতেই দেখলো তাদের পুরনো ড্রাইভার আলী। সাত পাঁচ না ভেবেই দৌড়ে এসে আলীকে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। অনেকদিন পর পরিচিত কাউকে কাছে পেলে যেমন শান্তি লাগে সামিন এর তেমনি অনুভূতি হচ্ছে। বেশ উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল
— কেমন আছো আলী আংকেল?
হুট করে সামিন এর এভাবে জড়িয়ে ধরায় বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেলো আলী। ছোট থেকে দেশে বড়ো হলেও পড়ালেখা করার জন্য বাইরে গিয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে। এতো বছরে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে। মালিক হয়ে এভাবে কর্মচারী গোছের লোককে জড়িয়ে ধরাটা কতটুকু শোভনীয় হবে সেটা ভেবেই অসস্তিতে পড়ে গেলো আলী। অপ্রস্তুত হেসে বলল
— ভালো আছি ছোট সাহেব। আপনি কেমন আছেন?
ছোট সাহেব কথাটা শুনে সামিন বেশ বিরক্ত হলো। এই শব্দটা তার মোটেই পছন্দ না। তার মতে নাম প্রতিটা মানুষের পরিচয় বহন করে। এই নাম মানুষের অহংকার। আর এই নাম বাদ দিয়ে অন্যকোন উপাধী নিয়ে ডাকার ব্যাপারটা তার মোটেও পছন্দ না। তার মাঝে মাঝে মনে হয় এদেরকেও অন্য কোন উপাধী ধরে ডাকলে তবে এরাও বুঝতে পারতো নামের গুরুত্ব। কতবার সে এই নিয়ে অভিযোগ করেছে তাকে এভাবে না ডাকতে। তারা কোনভাবেই কথা শুনতে রাজি না। তাই বলেও কোন লাভ নেই। পা থেকে মাথা পর্যন্ত আলীকে ভালো করে দেখে নিয়ে বলল
— আলী আংকেল তুমি তো বুড়ো হয়ে গেছো। তোমার চুল দাড়ি সব সাদা হয়ে গেছে।
সামিন এর কাজে একটু অপ্রস্তুত হলেও এখন এমন কথা শুনে না হেসে পারল না। এক গাল হেসে বলল
— কি যে বলেন ছোট সাহেব। আপনিও তো কত বড় হয়ে গেছেন।
সামিন হেসে বলল
— চলো আংকেল। আমরা বাসায় যাবো তো। বাবা মা বাসাতেই আছেন তাই তো?
— ম্যাডাম বাসায় নেই। আমি আসার সময় হাসপাতালে নেমে দিয়ে এসেছি।
সামিন চিন্তিত হয়ে বলল
— হাসপাতালে কেনো? মার কি হয়েছে?
আলী তার চিন্তা বুঝতে পেরে বলল
— না না ছোট সাহেব। ম্যাডামের কিছু হয়নি। ঐ…।
কথাটা শেষ করলো না। থেমে গেলো। সামিন মৃদু সরে বলল
— তাহলে কার কি হয়েছে?
— ঐ যে আপনার সাথে যেই বাড়ির সম্পর্ক হইতে যাচ্ছে। ঐ বাড়ির মানুষ অসুস্থ। তাই দেখতে গেছে।
আলীর কথা শুনে সামিন একটু ভাবলো।তারপর বলল
— আচ্ছা আংকেল আমরা যদি এখান থেকে সোজা হাসপাতালে যাই মার কাছে তাহলে কি খারাপ দেখাবে?
আলী প্রশস্ত হাসলো। কি যেনো ভাবলো খানিক্ষণ। তারপর মুগ্ধ সরে বলল
— খারাপ হবে কেন? ভালই হবে।
সামিন আর অপেক্ষা করলো না। গাড়িতে উঠে বসলো। শো শো শব্দে গাড়ি চলতে শুরু করেছে। খোলা জানালা দিয়ে হুহু করে বাতাস ভেতরে ঢুকছে। আলী চেচিয়ে বলল
— জানালা লাগান ছোট সাহেব। ঠাণ্ডা লাগবে।
সামিন হাসলো। সে শীত প্রধান দেশেই এতগুলো বছর কেটে এসেছে। সেখানকার অভ্যাস হয়ে গেছে। এই আবহাওয়া তেমন কাবু করতে পারছে না তাকে। কিন্তু আলীর কথার দিরুক্ত করলো না। জানালা বন্ধ করে দিলো। ঠোঁটের হাসিটা প্রশস্ত করে সামনে তাকাল। এই লোকগুলা তার বেশ খেয়াল রাখে। সেই ছোট বেলা থেকেই। সামিন ঠোঁট কামড়ে বলল
— আলী আংকেল মা আমার জন্য যে মেয়েটাকে পছন্দ করেছে তুমি দেখেছো? দেখতে কেমন?
আলী সামনের আয়নায় সামিন এর দিকে তাকাল। প্রশান্তির হাসি তার মুখে। বলল
— বেশ ভালো দেখতে। একদম কাটা কাটা চেহারা।
সামিন শব্দ করে হাসলো। কাটা কাটা চেহারা কথাটার মানে সে বুঝেনা কিন্তু এটা বুঝতে কষ্ট হলো না যে মেয়েটা আলীর বেশ পছন্দ। তাহলে মানতেই হয় তার মায়ের পছন্দ খারাপ না।
—————
তীব্র ফিনাইলের গন্ধ। মাথা ঘুরিয়ে দিচ্ছে। গা গুলিয়ে বমি হওয়ার উপক্রম। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে গিয়ে হাসফাস অবস্থা সামিন এর। একটু দাড়িয়ে বলল
— আর কতদূর আংকেল?
আলী থেমে গেলো। সামিন এর কাছে এসে বলল
— কি হয়েছে ছোট সাহেব? আপনার খারাপ লাগছে বুঝি? বাসায় গেলেই ভালো হতো।
সামিন নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
— না না ঠিক আছি। বলছিলাম আর কতদূর গেলে মায়ের দেখা পাবো।
আলী হেসে বলল
— এই তো কয়টা সিড়ি মাড়িয়ে উঠলেই পেয়ে যাবো।
সামিন উঠতে শুরু করলো। সত্যিই তাদের খুব একটা পথ অতিক্রম করতে হয়নি। কিছুদূর এগুতেই পেয়ে যায় রেহানা কে। এক ভদ্রলোকের সাথে দাড়িয়ে কথা বলছে। পোশাক আর সাজ সজ্জা দেখে মনে হচ্ছে তিনি ডাক্তার। আর পাশে আরো দুজন লোক দাড়িয়ে তাদের কথা শুনছেন। তাদেরকে সামিন চিনে না। রেহানা কথার ফাঁকে চোখ ফেরাতেই সামিনকে দেখতে পেলেন। চোখ ভরে উঠলো তার। এভাবে তার ছেলে যে হাসপাতালে এসে তাকে চমকে দেবে ধারণাও ছিলো না। সামিন হেসে মাকে জড়িয়ে ধরলো। মা ছেলের অতি সুখের আলিঙ্গন চললো খানিক্ষ্ন। রেহানা চোখ মুছে সামিন এর মুখে হাত বুলিয়ে বলল
— তুই এসেছিস বাবা?
সামিন তৃপ্ত হাসলো। মায়ের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল
— তোমাকে সারপ্রাইজ দেবো বলে বাসাতেই যাইনি। দেখো!
রেহানা হাসলো। গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। পানি মুছে দিয়ে সামিন আরো কিছুক্ষণ মাকে জড়িয়ে রাখলো। রেহানা ছেলেকে পেয়ে যেনো দুনিয়া ভুলে গেলো। বারবার সামিন এর মুখে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর ভাবছে এই তো তার দুনিয়া। এই ছেলেই তার সবটুকু জুড়ে আছে। সামিন বলল
— তোমার কাজ শেষ হয়নি? বাসায় যাবে না?
রেহানা ভাবনা থেকে বের হলো। এদিক সেদিক কাউকে খুঁজলো। খুজে পেয়েই এগিয়ে গিয়ে দাড়ালো। বুক ভরা শ্বাস টেনে বলল
— ভাই সাহেব আমার ছেলে এসেছে। আজকেই তার ফ্লাইট ছিলো। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা হাসপাতালে এসেছে।
কথাটা বলেই সামিন কে হাত ইশারা করে ডাকলেন। সামিন এগিয়ে গিয়ে দাড়ালো। বয়স্ক দুজন ভদ্রলোক যাদের কিছু সময় আগেই দেখেছে। জানে না কে। তবুও অতি নম্র ভাবে সালাম বিনিময় করলো। কুশল বিনিময় করলো। আনিস ভালো করে খেয়াল করলো ছেলেটাকে। দেখতে বেশ। কিন্তু সব থেকে আশ্চর্য করছে এই ছেলের নম্রতা। বিদেশে বড়ো হওয়া বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে হিসেবে যেই অহংকার থাকা উচিত সেটা কোথাও দেখা গেলো না। বরং অতি নম্রতা এবং ভদ্রতা প্রকাশ পেলো। এমন ছেলে সচরাচর দেখা যায়না। বড়ো ভাগ্যবতী মেয়ে এমন ছেলের জীবনসঙ্গিনী হবে। ভাবতেই বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। তারা তো বলেই দিয়েছে এখন বিয়েটা হবে না। খানিক আগের ঝলমলিয়ে ওঠা চেহারাটা ম্লান হয়ে গেলো। রেহানা কিছু একটা আন্দাজ করে বলল
— ভাই সাহেব। যদি কিছু মনে না করেন আমি আপনার সাথে একটু আলাদা ভাবে কথা বলতে চাই। মানে আপনার যদি আপত্তি না থাকে।
আনিস বুঝতে পারলো না ঠিক কি বলবে রেহানা। তবুও জোর করে হেসে বলল
— আপত্তি কেনো থাকবে? ভাই সাহেব ডেকেছেন বোন। এমন কথা বলে আমাকে লজ্জায় ফেলবেন না।
রেহানা হেসে সামিন কে বলল
— আমি একটু আংকেলের সাথে কথা বলবো। তুমি চাইলে এখানে বসতে পারো নাহলে গাড়িতেও বসতে পারো। কি করবে?
সামিন চারিদিকে দৃষ্টি ফেরালো। অস্থির পরিবেশ চারিদিকে। তাছাড়াও এতো লম্বা জার্নির কারণে মাথাটাও ঝিমঝিম করছে। বলল
— আমি গাড়িতে বসছি মা। তুমি কথা শেষ করে আসো।
বলেই সিড়ি বেয়ে দ্রুত নেমে গেলো। সামিন প্রচন্ড এলোমেলো ভাবে পা ফেলে কোন রকমে গাড়ির কাছে পৌঁছালো। গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে বসে সিটে গা এলিয়ে দিলো। দরজা বন্ধ করলো না। চোখটা বন্ধ করতেই রাজ্যের ক্লান্তি গ্রাস করলো। হঠাৎ করেই একটা আওয়াজ কানে আসতেই চোখ খুলে ফেললো। দেখলো তার পায়ের কাছেই একটা মেয়ে নিচে বসে কি যেনো করছে। সামিন একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল
— কি করছেন?
মেয়েটি মুখ তুলে তাকাল। সাদা মাটা চেহারা। কিন্তু বেশ মায়াবী। চোখ দুটো প্রানবন্ত। অনবরত কি যেনো বলেই চলেছে। সেই ভাষা বোঝার সাধ্য সবার নেই। পাতলা ফিনফিনে ঠোঁট জোড়া সৃষ্টিকর্তার গোলাপী আভায় রাঙানো। সবুজ রঙের ওড়নাটা মাথায় টেনে দেয়া। সামনের অংশের ঢেউ খেলানো চুল গুলো চোখের পাশ দিয়ে ঝুলছে।
— আপনার গাড়ির দরজার সাথে ধাক্কা লেগে আমার হাত থেকে এগুলা পড়ে গেছে।
গোলাপি ঠোঁট জোড়া নড়েচড়ে উঠতেই সামিন হুশ ফিরে পেলো। কয়েকবার পলক ফেলে নিচে তাকিয়ে দেখলো। একটু ঝুঁকে পড়ে থাকা সবুজ রঙের ডাইরিটা হাতে তুলে নিল। একটা ছোট্ট কাগজের কিছু অংশ ডাইরির পাতা থেকে কিছুটা বেরিয়ে আছে। কৌতূহল বশতই সেটা টান দিয়ে বের করে নিলো। খুললো সেটা। মুক্তো ঝরা হাতের লেখা। লেখা আছে
‘ প্রিয় নভেম্বর,
এরকম এক নভেম্বরে কল্পনার শহর গড়বো। ভালোবাসার উষ্ণ নীল খামে পাঠানো উড়ো চিঠিতে তোমার আমন্ত্রণ থাকবে সেই নভেম্বরের_শহরে। সেখানকার এক মাত্র অতিথি শুধুই তুমি। আমি দু বাহু মেলে তোমার অপেক্ষায় থাকবো। তুমি আসবে! আমি জড়িয়ে নিবো উষ্ণ আলিঙ্গনে।’
প্রচন্ড ক্ষিপ্র গতিতে কাগজটা ছিনিয়ে নিলো মেয়েটি। সামিন আকাশসম বিস্ময় নিয়ে তাকাল। আরেক হাতে ধরে থাকা ডাইরিটাও ছিনিয়ে নিয়ে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। কয়েকবার প্রচন্ড গতিতে শ্বাস টেনে বলল
— ম্যানরলেস!
এক মুহূর্তও দাড়ালনা। দ্রুত পা ফেলে চলে গেলো। সামিন মুগ্ধ চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। তারপর বিড়বিড় করে বলল
— হোয়াট আ ওয়ার্ম ওয়েলকাম। আমেজিং!
চলবে……..