নভেম্বরের শহরে পর্ব-০২

0
1144

#নভেম্বরের_শহরে
লেখক-এ রহমান
পর্ব ২

সবে সূর্য উঠেছে। জানালা ভেদ করে তার তির্যক রশ্নি পাতানো বেঞ্চটাতে পড়ছে। এখনও তেমন তেজ নেই। সাদা পোশাক পরিহিত লোকজন ছুটাছুটি করছে এদিক সেদিক। মৌ ফিকরে ফিকরে কেদেই যাচ্ছে। নুহা দরজার ছোট্ট কাঁচের ভেতর দিয়ে মায়ের নিথর দেহটা দেখার চেষ্টা করছে। এক হাতে স্যালাইন ঝুলছে। আরেক হাতের আঙ্গুলে লাগান অক্সিলমিটার। মনিটরে টুটটুট শব্দে আঁকা বাকা রশ্নি থেমে থেমে মিলিয়ে যাচ্ছে। ডক্টর ঘর থেকে বের হওয়ার আগেই নুহা দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো। মাসুদ ডক্টর কে দেখে কাছে এসে বললেন
–কি হয়েছে স্যার? উনি ঠিক আছেন তো?

নুহা ওড়নার মাথা খামচে ধরে অপেক্ষা করছে ডক্টরের উত্তরের জন্য। ডক্টর কোন উত্তর দিলেন না। মনোযোগ দিয়ে সালেহার রিপোর্ট গুলো দেখছে। নুহার এবার বুকের ভেতরের ধুকধুকানি বেড়ে গেলো। কোন খারাপ কিছু হল নাতো তার মায়ের? ডক্টর রিপোর্ট থেকে মুখ তুলে গম্ভীর গলায় বললেন
–ব্রেইন স্ট্রোক!

ডক্টরের কথা শুনে সবাই আঁতকে উঠলো। ডক্টর কিছুক্ষন থেমে আবার বললেন
–কোন কারনে শক পেয়েছেন উনি। আর তার ফলেই এরকম হয়েছে। ট্রিটমেন্ট চলছে। এখনও কিছু বলা যাচ্ছে না। আমরা যতটা সম্ভব চেষ্টা করছি। বাকিটা উপর ওয়ালার হাতে।

ডক্টরের কথা শুনে নুহার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। মাসুদ খুব ভালো মতো কথার মানে বুঝতে পেরে অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকলো। সালেহার বাবা মা ডুকরে কেদে উঠলেন। মাসুদ নিজেকে শক্ত রেখে তাদের দিকে এগিয়ে বললেন
–দয়া করে এখানে এভাবে কাদবেন না। শান্ত হন। এখানে এভাবে কাদা নিষেধ।

শব্দ করে কান্না বন্ধ করলেও একেবারেই কান্না আটকাতে পারলেন না তারা। মেয়ের এই বিপদে বাবা মা কিভাবে ঠিক থাকতে পারে। একদিকে জামাইয়ের কোন খবর পাওয়া যাচ্ছে না। আর একদিকে মেয়ে মৃত্যুর দার প্রান্তে দাড়িয়ে। মেয়ে দুটো কি তবে এতিম হয়ে যাবে? কি অদ্ভুত নিয়তির খেলা।
–বড় আব্বু?

মৌ চেচিয়ে কথাটা বলতেই সবাই সেদিকে তাকাল। মাসুদ বড় ভাইকে দেখে নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারলেন না। জড়িয়ে ধরে নিশব্দে চোখের পানি ফেললেন। কাল থেকে প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে তার। দেখানোর মতো কেউ ছিল না। কিন্তু আজ বড় ভাই আনিসুর রহমান কে দেখে নিজের সেই কষ্ট কিছুতেই আর আটকে রাখতে পারলো না। আনিস মাসুদকে পিঠে হাত বুলিয়ে ধির কণ্ঠে বলল
–কাদিস না। শক্ত হ।

মাসুদ ভাইকে ছেড়ে দিলো। চোখের পানি মুছে নিয়ে কাদ কাদ কণ্ঠে বলল
–এনামুল ভাই সম্পর্কে এখনও কোন খোজ পাওয়া যায়নি। কোথায় যে চলে গেলো কে জানে?

আনিসুর রহমান নুহার দিকে তাকাল। কাছে এসে বলল
–কান্নাকাটি করেনা আম্মু। সব ঠিক হয়ে যাবে।

একটু থেমে মৌয়ের দিকে তাকিয়ে বলল
–সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। বোনকে নিয়ে বাসায় চলে যাও। খেয়ে নাহয় দুপুরে আবার আসিও। তোমার বড় আম্মু সাথে যাবে। আর নানা নানিকেও নিয়ে যাও। ওনারা এখানে থাকলে অসুস্থ হয়ে যাবেন।

নুহার একদম যেতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু উপায় নেই। কারন সে বড়দের কথার বিপরিতে কোন কথা বলে না। তাই মাথা নাড়িয়ে মৌয়ের দিকে এগিয়ে গেলো। তার হাত ধরে মৃদু সরে বলল
–চল বোন বাসায় যাই।

মৌ ফিকরে ফিকরে কাদতে কাদতে বলল
–না আপা আমি মায়ের কাছে থাকবো।

নুহা তার মাথাটা নিজের পেটে চেপে ধরে বলল
–কাদিস না বোন। মা ঠিক হয়ে যাবে। বাসায় চল। নানা নানি এখানে থাকলে অসুস্থ হয়ে যাবে। সকাল থেকে কিছুই খায়নি। আমরা না গেলে খাওয়াবে কে?

মৌ নুহার যুক্তি মেনে নিলো। মাথা তুলে চোখ মুছে বলল
–চল আপা।

নুহা মৌ এবং তাদের নানা নানি তার বড় আম্মু মনিরা বেগমের সাথে বাড়ির পথে রওনা দিলো। বাড়ি থেকে হাসপাতাল বেশী দূর নয়। সালেহা মাসুদের সাথে কথা বলতে বলতে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো। তারা বাড়িতেই কিছু সময় অপেক্ষা করে। পরিচিত ডক্টরকে আসতে বলে। ডক্টর এসে বলে দেয় হাসপাতালে নিতে হবে। তখনই তারা তাড়াহুড়ো করে হসপিটালে চলে আসে।

—————
গাড়ির হর্ন শুনে রেহানা বেগম জানালার ধার ঘেসে দাড়িয়ে নিচে তাকালেন। কুয়াশায় চারপাশ মুড়িয়ে যাচ্ছে। সাদা কুয়াশা বৃষ্টির মতো ঝিরঝির করে নিচে পড়ছে। মৃদু মন্দ বাতাসে উড়ছে জানালার পর্দা। শিরশিরিয়ে উঠছে শরীর। তবুও সরে গেলো না রেহানা। নিচের দিকে কালো রঙের প্রাডো গাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছেন নিস্পলক। সেই গাড়িটাতে তার স্বামী আসিফ শাহরিয়ার এসেছেন।

কালো রঙের গাড়ি থেকে নেমেই আসিফের আগে চোখ পড়ল জানালার দিকে। রেহানা তাকে জানালার দিকে তাকাতে দেখেই সরে দাঁড়ালো। আসিফ গাড়ি থেকে নেমে ড্রাইভারকে গাড়ি পার্ক করতে বলে সোজা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসলো। ভেতরে ঢুকে রুমে চলে গেলো। রেহানা ততক্ষনে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। এক পলক তাকিয়ে দেখে টাই খুলতে খুলতে বলল
–গায়ে কোন শিতের কাপড় নেই কেন? ঠাণ্ডা লাগছে না।

রেহানা শুনেও যেন না শোনার ভান করে শুয়ে থাকলো। কোন উত্তর দিলো না। আসিফ তার দিকে কিছুক্ষন চেয়ে থেকে কাছে গেলো। কপালে হাত রাখতেই রেহানা ঝটকা দিয়ে হাত সরিয়ে বলল
–ছোবে না আমাকে।

মৃদু হেসে আসিফ বলল
–কেন? এখন আর আমার ছোঁয়া ভালো লাগে না?

–তোমার ঐ নোংরা হাতের স্পর্শ আমার কখনই ভালো লাগে নি। বাধ্য হয়ে জীবন কাটাতে হয়েছে তোমার সাথে। তুমি একটা নোংরা লোক।

রেহানা তেতে উঠে কথা বলতেই আসিফ শান্ত ভাবে বলল
–এই নোংরা লোকটাই তোমার স্বামী রুহি। আর তোমার সন্তানের জনক।

রেহানা মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল
–আমাকে ঐ নামে ডাকবে না। রুহি অনেক আগেই মরে গেছে। আর সেই সন্তানের জন্যই এখানে পড়ে আছি। নাহলে আমাকে আটকে রাখার সাধ্য তোমার নাই।

আসিফ নিজের কাপড় ছাড়তে ছাড়তে তাছিল্যের সরে বলল
–তোমাকে আটকে রাখার ইচ্ছাও আমার নাই। এই সুখী পরিবারের নাটক তো সব আমার ঐ ছেলের কারনে। আমার কাছে আমার ছেলেই সব রুহি।

রেহানা প্রচণ্ড রাগে ফোঁসফোঁস করতে লাগলো। আসিফ ওয়াশ রুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। রেহানা চোখ বন্ধ করে ফেলল। চোখের পানি গালে গড়িয়ে পড়ল তার। বাবা মায়ের ভুল সিদ্ধান্তের স্বীকার আজ সে। আসিফ রেহানার বাবার বন্ধুর ছেলে ছিল। তিনি তার বন্ধুত্ত রক্ষা করতে মেয়েকে ঐ পরিবারে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। রেহানাও বাবার সিদ্ধান্তে অমত করেনি। বেশ ধুমধাম করে বিয়ে হয়েছিলো তাদের। সবাই খুব খুশী ছিলেন। রেহানার বাবাও যথেষ্ট সম্পদশালী ছিলেন। আর আসিফের বাবার সাথে ব্যবসার পার্টনার ছিলেন। বিয়ের পর রেহানাও বেশ ভালভাবে সংসার সামলে নিয়েছিলো। তাদের দিন খুব ভালো কাটছিল। হঠাৎ করেই একদিন জীবনে নেমে আসে কালো মেঘ। বিষিয়ে উঠলো জীবন। জানা হয়ে গেলো আসিফের জীবনের কালো অধ্যায়। বিদেশে পড়ার সময় বহু মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলো। বিয়ের পরও সেই সম্পর্ক অব্যহত রেখেছে। রেহানা সত্যি জানার পর যখন ভেঙ্গে পড়েছিলো। ঠিক সে সময় জীবনে আসে আরেক নতুন খবর। রেহানার জীবনে সেই খবর সুখের না দুঃখের সে বুঝতে পারলো না। সন্তান সম্ভবা রেহানা অকুল দরিয়ায় পড়ে গেলো। জানাতে চায়নি আসিফকে তার অনেগত সন্তানের কথা। কিন্তু কোনভাবে আসিফ জেনে যায়। তার নিজের সন্তানকে নিয়ে খুব আবেগ প্রবন হয়ে উঠে। তার আচরনে পরিবর্তন আসতে থাকে। রেহানা ভাবে আসিফ হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। তাই সে সন্তানকে নিয়ে আসিফের সাথে সম্পর্ক ভালো করার চেষ্টা করে। কিন্তু ঠিক সেই সময় আরেক বিপত্তি নেমে আসে। রেহানার বাবা হঠাৎ করেই মারা যান। তিন বোনের মধ্যে সব থেকে বড় হওয়ায় সংসারের দায়িত্ব রেহানার উপরে পড়ে। আর তার অভিভাবক হিসেবে পুরো দায়িত্ব নিয়ে নেয় আসিফ।

শুরু হয় রেহানার জীবনের নতুন মোড়। আসিফের বাবার অর্ধেক ব্যবসা তো ছিলই আর বাকি অর্ধেকও পেয়ে যায় তারা। রেহানা বুঝতে পারে এই লোভেই রেহানা কে তারা বাড়ির বউ করে নিয়ে আসে। কিন্তু অসুস্থ মা আর ছোট দুই বোনের ভবিষ্যতের কথা ভেবে রেহানা চুপ করে যায়। আসিফের সমস্ত অত্যাচার সহ্যও করে নেয়। আর আসিফও সুযোগ পেয়ে বসে। দিন দিন বেড়ে যায় তার আগ্রাসি আচরণ। এক সময় রেহানার গায়ে হাত তুলতে শুরু করে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল আসিফ রেহানার পরিবারের প্রতি দায়িত্তে কোনদিন অবহেলা করেনি। এমন কি রেহানার সাথেও করেনি। শুধু ছিল পর নারির প্রতি আকর্ষণ। আর সেসবের জন্য প্রতিবাদ করলে বিনিময়ে রেহানার গায়ে হাত তুলতেও দিধা করেনি সে।

উচ্চ শব্দে ফোন বেজে উঠলো। নিজের চোখের পানি মুছে ফোনটা ধরে ফেলল রেহানা। অপাশ থেকে কোন খবর শুনে বিচলিত কণ্ঠে বলল
–আগে জানাও নি কেন? ঠিক আছে আমি আসছি।

আসিফ ওয়াশ রুম থেকে বের হতেই কথাটা কানে এলো। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো
–কোথায় যাচ্ছ?

রেহানা উঠে দাড়িয়ে নিজের শাড়ির আচল ঠিক করতে করতে বলল
–নিশ্চয় তোমার মতো আনন্দ প্রহর কাটাতে যাচ্ছি না।

শব্দ করে হেসে উঠলো আসিফ। তাচ্ছিল্যের সরে বলল
–আনন্দ প্রহর! বেশ ভালো কথা ফুটেছে তো। বেশ ভালো শব্দ বলতে শিখেছ।

আবারো হেসে উঠলো। আসিফের হাসির শব্দে রেহানার বিরক্তির শেষ নেই। ব্যাগটা হাতে নিয়ে বের হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে আবারো আসিফ বলে উঠলো
–বললে না কোথায় যাচ্ছ?

রেহানা গম্ভীর গলায় বলল
–প্রয়োজন মনে করছি না।

আসিফ হাসল। গম্ভীর সরে বলল
–জেখানেই যাও। ছেলে আসার আগে চলে আসিও।

ফিরে তাকাল রেহানা। বিস্ময় নিয়ে বলল
–সামিন আসছে? কিন্তু ওর তো কাল আসার কথা।

–হ্যা। কেন তোমাকে বলেনি?

আসিফের কথায় মৃদু সরে বলল
–নাহ!

–উপস! সারপ্রাইজটা তাহলে আমি নষ্ট করে দিলাম। যাই হোক। ও হয়তো তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছে। তুমি আবার বলে দিওনা যে আমি বলেছি তোমাকে।

রেহানা আসিফের কথার উত্তর না দিয়ে বলল
–আমি হসপিটালে যাচ্ছি। সামিন আসলে ওকে তাই বলো। আমি সময় মতো চলে আসবো।

–হসপিটালে?

আসিফের তির্যক চাহুনির প্রশ্নের উত্তরে রেহানা বলল
–সামিনের জন্য যে মেয়েটা পছন্দ করেছিলাম তার মা অসুস্থ তাকেই দেখতে যাচ্ছি।

আসিফ সন্দিহান চোখে তাকাল। কঠিন গলায় বলল
–এটা বেশী বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না রুহি? কি বুঝে ছেলের জন্য ওরকম একটা মিডিল ক্লাস মেয়ে পছন্দ করলে? তোমার বিদেশ ফেরত ছেলে ঐ মিডিল ক্লাস মেয়েটাকে পছন্দ করবে বলে তোমার মনে হয়?

–করবে। আমি বিয়ের কথা বলেছি আমার ছেলেকে। আর সে রাজি হয়েছে। আর দেশে ফেরার কয়দিনের মধ্যেই তাদের বিয়ে দেয়ার কথাও বলেছি আমি। সবটা মেনে নিয়েছে।

রেহানা উতফুল্য কণ্ঠে বলল। আসিফ তাছ্যিল্ল করে বলল
–ছেলেকে কি সবটা খুলে বলেছ কেমন মেয়ে পছন্দ করেছো তার জন্য? তাহলে কিভাবে বুঝলে ছেলে রাজি হবে?

এই প্রশ্নের উত্তর রেহানার কাছে নেই। তবে তার পছন্দের মেয়ে অপছন্দ করার মতো না। এখন সেটাই দেখার পালা ছেলের মনে কতটুকু জায়গা করে নিতে পারে সেই মেয়ে।

চলবে………।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে