নভেম্বরের শহরে পর্ব-০১

0
1915

#নভেম্বরের_শহরে
লেখক-এ রহমান
সূচনা পর্ব

নুহার বিয়ের এক সপ্তাহ আগে হঠাৎ করেই ঘটে গেলো এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা। যার ফলে বিয়েটা হবে কিনা সেটা নিয়ে সংশয় দেখা দিলো। তার বাবাকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। সব আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে খোজ নিয়ে জানা গেলো তিনি কোথাও জান নি। এই শহরে তার বাবা মা ত্রিশ বছর আগে এসেছেন। ফলে আশে পাশে প্রায় সবাই তাদেরকে চেনে। একটা ছোট কাপড়ের দোকান করতো তার বাবা। এর সুবাদেই শহরে পরিচিতিটা আরও বেশী। মধ্যবিত্ত পরিবারে সেই দোকানের খরচ দিয়ে অনায়াসেই দিন পার হয়ে যেতো। নুহা আর মৌ দুই বোন। বর্তমানে তারা যে বাড়িতে থাকে সেখানেই দুজনের জন্ম হয়। নুহা সদ্য কলেজ পেরিয়ে ভর্তির প্রস্তুতিতে ব্যস্ত আর মৌ ক্লাস নাইনে। দুইবোন লেখাপড়ায় বেশ ভালো। বাবার কষ্টের উপার্জন করা টাকা তারা বিফলে যেতে দেয়নি। দুই বোন সারাক্ষন বই হাতে নিয়ে গুনগুন করে পড়তো। আশে পাশের লোকজন তাদের ছেলে মেয়েকে এই দুই বোনের উদাহরন দিতেন। দুই মেয়েকে নিয়ে বাবা মায়ের বেশ গর্ব হতো।

যদিও বা এখন নুহার বিয়ে দেয়ার কোন ইচ্ছা ছিল না তার বাবা মায়ের। কিন্তু কলেজে যাওয়া আসার পথে নুহা মিসেস রেহানা বেগমের চোখে পড়ে যান। আর সেখান থেকেই তিনি নিজের ছেলের জন্য প্রস্তাব পাঠান। নুহার বাবা মা অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হয়ে যান। কারন মেয়ের সৌন্দর্য আর গুনের বলে এমন ঘর এসেছে। নাহলে মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের এমন ভাগ্য কি হয়?

কিন্তু হয়তো নুহার ভাগ্য এতো প্রসন্ন নয়। যার ফলে এই অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে গেলো। আর পুরো এলাকায় এমন ভাবে সোরগোল পড়ে গেলো যে চেয়েও তারা গোপন রাখতে পারলো না। নুহার দাদুর বাড়ির সব আত্মীয় স্বজন এসেছে। সবাই ব্যস্ত। একেকজন একেক জায়গায় ফোন দিচ্ছে। হুট করেই একটা জলজ্যান্ত লোক উধাও হয়ে যাবে? এটাও কি সম্ভব?

নুহার মার প্রেসার বেড়ে গেছে। তিনি অচেতন অবস্থায় বিছানায় শুয়ে আছেন। হাতে ঝুলছে স্যালাইন। তার পাশেই বসে ফিকরে ফিকরে কাঁদছে মৌ। নুহা শুভ্র রঙের টাইলসের দিকে নিজের দৃষ্টি স্থির রেখেছে। অস্থির গোলমেলে চিন্তা তার মাথায়। সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো। কি হচ্ছে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না সে।

কলিং বেলের আওয়াজে ভাবনার সুতো ছিঁড়ল তার। চোখের পলক ঝাপটিয়ে পানি আড়াল করে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। সেদিকে পা বাড়াতেই তার মেজ চাচা মাসুদ বলল
–তুমি ঘরে যাও। আমি দেখছি।

নুহা মাথা নামিয়ে চলে গেলো। সে বড়দের উপরে কোন কথা বলে না। বাবা মা আজ পর্যন্ত যা বলেছে সেটাই শেষ কথা। নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছা কোনদিন জাহির করেনি। ঘরে গিয়ে মায়ের পাশে বসলো। মৌ তাকে দেখে কাদ কাদ কণ্ঠে বলল
–কে এসেছে আপা?

নুহা মায়ের দিকে তাকিয়েই ছোট্ট করে বলল
–জানিনা।

মৌ নিজের কৌতূহলী স্বভাব দমিয়ে রাখতে পারলো না। উঠে গিয়ে দরজার পর্দাটা টেনে দিলো। একটু ফাকা করে নিজেকে আড়ালে রেখে বাইরে উকি ঝুকি মেরে দেখতে লাগলো কে এসেছে।
–আপা তোমার শ্বশুর বাড়ি থেকে লোক এসেছে।

মৌ ফিস্ফিসিয়ে বলতেই নুহার বুকের ভিতরে ধক করে উঠলো। বাবাকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই মুহূর্তে কোন মেয়েই মানসিক ভাবে বিয়েতে প্রস্তুত না। কিন্তু তারপরেও এই বিয়েটা যদি ভেঙ্গে যায় তাহলে পুরো দায় ভার এই মেয়েটার উপরে পড়বে। ছেলেরা বিয়ের আসর থেকে চলে গেলেও তাদের বিয়ে সম্ভব। কিন্তু মেয়েদের দেখতে এসে বিয়ে ঠিক না হওয়াটাও দোষ। বারবার একটা মেয়েকে দেখতে আসলেও শোনা যায় তাচ্ছিল্যের কথা। মেয়েটার নিশ্চয় কোন দোষ আছে। নাহলে এতো ছেলে আসলো তবুও কেউ পছন্দ করলো না কেন?

নুহার চোখে পানি টলমল করে উঠলো। চোখের পাতা পিটপিট করে আড়াল করে নিলেও বুকের ভিতরে ভয়টা কিছুতেই কমলো না। মৌ দরজার কাছেই দাড়িয়ে শুনতে চেষ্টা করছে বাইরে কি নিয়ে কথা হচ্ছে। কিন্তু তেমন কিছুই কানে আসছে না। মৌ এক প্রকার দৌড়ে এসে বলল
–আপা তোমার শাশুড়ি আসছে।

নুহার চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেলো। তারপরেও মাথার ওড়নাটা বড় করে টেনে দিলো। বিছানা থেকে উঠে মায়ের পায়ের কাছে দাঁড়ালো। রেহানা বেগম পর্দা সরিয়ে ভিতরে ঢুকলেন। নুহা মৌ দুজনেই সালাম দিলেন। তিনি অত্যন্ত অন্যমনস্ক হয়ে সালামের উত্তর দিলেন। থম্থমে মুখে কিছুক্ষন চেয়ে থাকলেন বিছানায় সালেহার নিথর দেহটার দিকে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভিতরে ঢুকলেন। মৌকে কাছে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। কোন কথা বললেন না। বিছানার পাশে দাড়িয়ে সালেহা বেগমের হাত ধরে কিছু একটা বুঝতে চেষ্টা করলেন। নুহা পাশে চেয়ার এগিয়ে দিলেন। রেহানা বসে নুহার দিকে তাকাল। হাত ধরে বিছানায় বসাল। মৃদু সরে বলল
–আমরা সরবচ্চ চেষ্টা করছি তোমার বাবাকে খুঁজতে। একদম ভেবনা। ইনশাহ আল্লাহ তাকে খুব তাড়াতাড়ি খুজে পাওয়া যাবে।

নুহা নিশব্দে চোখের পানি ফেলল। রেহানা নুহার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো তার মনের অবস্থা। তাই তাকে থামাতে চেষ্টা করলো না। কখনো চোখের পানি মানুষকে একটু হলেও শান্তি দেয়। সালেহার দিকে তাকিয়ে বলল
–ডক্টর কি বলেছে? তোমার মার অবস্থা কি আসলেই ভালো নাকি তাকে হসপিটালে নিতে হবে?

নুহা কাপা কাপা গলায় বলল
–জি মোটামুটি। ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছে।

রেহানা মাথা নাড়ালেন। পিছনে দাড়িয়ে থাকা একজন মহিলাকে উদেশ্য করে বললেন
–আমাদের পরিচিত ডক্টরকে জানিয়ে রাখো। সব রকম প্রস্তুতি নিয়ে রাখা দরকার। বলা যায়না। যদি হসপিটালে ভর্তি করাতে হয়।

হসপিটালের কথা শুনে নুহার চোখের পানির বেগ বেড়ে গেলো। হসপিটাল মানেই তার কাছে খুব সিরিয়াস কিছু। ভয়ে হাত পা কাপছে তার। লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু রেহানা অত্যন্ত বিচক্ষন মহিলা। তিনি সবটা বুঝে গেলেন। নুহার হাত শক্ত করে ধরে বললেন
–ভয় নেই। হসপিটাল নিলেই খুব সিরিয়াস কিছু হয়না। বরং ভালই হয়। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ফিরবে।

নুহা বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়াল। রেহানা বললেন
–আমি এখন আসি। ফোন করে আবার খবর নিবো।

নুহা উঠে দাঁড়ালো। ঘরের দরজা পর্যন্ত পিছন পিছন যেতেই রেহানা নুহাকে বলল
–তুমি এখানেই থাক। খেয়াল রেখো। তুমি কিন্তু ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। মনে রেখো।

নুহা মাথা নাড়াল। রেহানা আবারো থেমে গেলো। পিছনে ঘুরে বলল
–ও হ্যা। আর বিয়েটা এখন আর হচ্ছে না।

রেহানার ফোন বেজে উঠলো। ফোন ধরে কথা বলতে বলতে বাইরে চলে গেলো। নুহা জানতো রেহানা এমন কথা বলবে। তাই সে মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলো। রেহানা এসে তার মার প্রতি এমন দায়িত্ববোধ দেখিয়ে গেলো এতেই সে ভীষণ খুশী। কজনই বা এমন করে। রেহানাকে দেখে তার বেশ ভালো মানুষ মনে হল। আর বিয়ে তো পুরটাই ভাগ্যের ব্যাপার। এসবের উপরে কারো হাত নেই। তাই বিয়ে না হওয়ার জন্য রেহানাকে দোষ দেয়াটা বোকামি। নুহা ঘুরে দাড়াতেই টলমল চোখে মৌ বলল
–তোমার বিয়ে হবে না আপা?

নুহা শুকনো ঢোক গিলে পরিস্থিতি সামলাতে বলল
–বিয়ে নিয়ে ভাবার মতো পরিস্থিতি কি আছে? আগে বাবাকে খুজে বের করতে হবে।

মৌ বোনের দিকে তাকিয়ে থাকলো অসহায় চোখে। বিশ্বাস করতে পারলো না তার বোনকে। সে তো নিজের কানেই শুনল বিয়ে এখন আর হবে না। নুহা যতই লুকাতে চেষ্টা করুক। সে কিছুতেই বোনের কথায় নিজেকে বুঝ দিবে না।

—————-
সারা রাত অতিরিক্ত চিন্তায় ছটফট করে ভোর বেলা ফজরের আজান কানে এলো নুহার। উঠে তড়িঘড়ি করে বসলো। চোখের পাতা এক মিনিটের জন্যও এক করতে পারেনি। মায়ের ঘরেই মেঝেতে শুয়েছিল সে। কখন মায়ের জ্ঞান ফিরে আসে সে আশায়। কিন্তু এখনও জ্ঞান ফিরেনি তার। খুব চিন্তা হচ্ছে নুহার। মৌ তার পাশে শুয়ে বেঘরে ঘুমাচ্ছে। নুহা উঠে ঘর থেকে বাইরে বেরল। সামনে তাকাতেই চোখে পড়ল তার চাচা মাসুদ সোফায় বসেই ঘুমাচ্ছে। নুহা এগিয়ে গেলো। চোখের নিচে বসে গেছে। হবেই না বা কেন? ভাইয়ের নিখোঁজ হওয়ার কথা শুনে তিনি চলে এসেছেন। আর তখন থেকেই এলোমেলোভাবে পুরো বাড়িতে পায়চারি করছে। একে ওকে ফোন করে খবর নিচ্ছে। ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়েছে হয়তো। নুহা তার দিকে তাকিয়েই আছে। মাসুদের ঘুম খুব পাতলা। কারো ছায়া মুখের উপরে পড়তেই চোখ খুলে ফেলল। নুহাকে দেখে খানিকটা বিচলিত হলেও নিজেকে সামলে নিয়ে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল
–কিছু বলবে আম্মু?

নুহা মৃদু সরে বলল
–ঘরে গিয়ে ঘুমান চাচ্চু।

মাসুদ নড়েচড়ে বসলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল
–ঘুম আসবে না। এমনি একটু চোখ লেগে গেছিল।

নুহা কিছুক্ষন চুপ থেকে মৃদু সরে বলল
–চা খাবেন তো?

মাসুদ হ্যা সুচক মাথা নাড়ল। নুহা বলল
–আমি নামাজ পড়ে চা বানাচ্ছি।

মাসুদ কোন কথা বলল না। নুহা বাথরুমের দিকে পা বাড়াতেই মাসুদ বলল
–তোমার মা এখন কেমন আছে?

–আগের মতই।

নুহা থেমে মৃদু সরে উত্তর দিয়ে চলে গেলো। মাসুদ একটু সময় নিয়ে ভাবল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা এলিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল। নুহা অজু করে এসে নামাজে দাঁড়াবে ঠিক সেই সময় কারো গোঙ্গানির সর কানে এলো। পিছন ফিরে তাকাল। সালেহা নড়াচড়া করছে আর নিজের মনে কি যেন বিড়বিড় করছে। নুহা দৌড়ে মায়ের কাছে এলো। ডাকল
–মা। শুনতে পাচ্ছ?

সালেহা চোখ মেলে তাকাল। অনুভুতিশুন্য দৃষ্টি নিয়ে জিজ্ঞেস করলো
–তোর বাবা এসেছে? কোথায়? আমার কাছে আসতে বল না।

নুহা শুকনো ঢোক গিলল। মাকে কি বলবে বাবা এখনও ফিরেনি। কোন খবর পাওয়া যায়নি। নাকি মিথ্যা বলে শান্তনা দিবে। বুঝতে পারছে না কিছুই। আবারো বিচলিত কণ্ঠে সালেহা বলল
–তোর বাবাকে আসতে বল না।

নুহা সাহস সঞ্চয় করে বলল
–বাবা আসেনি মা।

সালেহা করুন চোখে তাকাল। অনুভুতি শুন্য চোখে চেয়ে থেকে ডুকরে কেদে উঠলো। চিৎকার করে বলল
–তোর বাবা আসেনি আর তুই আমাকে বলছিস? তোর মতো মেয়ের দরকার নেই আমার। চলে যা আমার সামনে থেকে।

মায়ের এমন চিৎকার শুনে মৌ ধরফরিয়ে উঠে বসে বলল
–কি হয়েছে?

নুহা একবার ছলছল চোখে তার দিকে তাকাল। দৃষ্টি ফিরিয়ে মায়ের দিকে তাকাতেই মাসুদ দরজায় দাড়িয়ে পর্দার অপাশ থেকে জিজ্ঞেস করলো
–কি হল? এতো চিৎকার কিসের?

নুহা একটু গলা তুলে বলল
–ভিতরে আসেন চাচ্চু। মার জ্ঞান ফিরেছে।

মাসুদ ভিতরে এলো। মাসুদকে দেখে সালেহা উঠে বসতে চাইলে নুহা জোর করে চেপে ধরে বলল
–উঠবে না মা। শুয়ে থাক।

বলেই ছেড়ে দিয়ে উঠে চলে গেলো। মাসুদ পাশে বসলেন। সালেহা কাদ কাদ কণ্ঠে বলল
–তোমার ভাই…।

মাসুদ চোখ নামিয়ে নিলো। কাপা কাপা কণ্ঠে বলল
–নিশ্চয় খুজে পাওয়া যাবে ভাবি। আপনি একদম ভাববেন না। কালকের মধ্যেই কোন না কোন খবর আসবে।

নুহা জায়নামাজ নিয়ে বের হয়ে গেলো। ডাইনিঙে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পড়ে নিলো। শেষ করে রান্না ঘরে গেলো ভাবল সবার জন্য রুটি বানাবে। চায়ের পাতিলটাতে পানি দিলো। আটার ডাব্বাটা নামিয়ে হাতের কাছে রাখল। পাতিলটা চুলোতে চড়ানোর আগেই মৌ এর চিৎকার কানে এলো।
–আপা মা!

চায়ের পানি ভর্তি পাতিলটা মেঝেতে শব্দ করে ছিটকে পড়ে গেলো। এদিক সেদিক গড়াগড়ি খাচ্ছে। বেখেয়ালি ভাবে ঘুরতেই হাত লেগে আটার ডাব্বাটা নিচে পড়ে সব আটা ছড়িয়ে গেলো মেঝেতে।

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে