নতুন সকাল পর্ব-০৩ এবং শেষ পর্ব

0
1663

নতুন সকাল
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
শেষ পর্ব

কষ্টমাখা এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গালিব সাহেব বলতে শুরু করলেন,
“ভালোবাসার মানুষটার বিয়ের সাক্ষী হওয়ার মতো ভয়ংকর পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলাম পরদিন। সকাল সকাল বড় খালা এসে হাজির হলেন আমাদের বাড়িতে। তার একমাত্র ছেলে রবিনের বিয়ে সেদিন। বাড়ি আসার পর মায়ের কাছে শুনেছিলাম রবিনের বিয়ের কথা। আমাকে বলেছিলেন যাওয়ার কথা। আমি পরীক্ষার বাহানা দিয়ে যাইনি। এতদিন বাদে ছেলে বাড়ি গেছে, ছেলেকে একা ফেলে মা ও যাননি। ভেবেছেন বিয়ের দিন যাবেন। মা না যাওয়ায় খালা এসেছেন নিতে। মা আমাকে তৈরি হতে বললেন। আমার মানষিক অবস্থা ভালো না থাকায় আমি যেতে রাজি হলাম না। খালা জোরাজোরি করলেন, মা ও সামিল হলেন। মায়ের অনুরোধ ফেলতে পারলাম না। মাকে নিয়ে চলে গেলাম কোর্টে। কোর্ট ম্যারেজ হবে। যাওয়ার পর খালা রবিন ভাইয়ের হবু বউয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। হবু ভাবিকে দেখে আমার অন্তরাত্মা বহিরাত্মা দুটোই কেঁপে উঠলো। কারণ আমি যাকে ভাবি বলে ডাকবো সে আর কেউ না আমার প্রেয়সী নিন্তিকা। আমার উনিশ বছর জীবনের কাল বৈশাখী ঝড়টা তখনই হানা দিয়েছিল মনে। ভেতরটায় তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল। আমার সামনেই নিন্তিকা লাল বেনারসি পড়ে বসে ছিল। সাজটা আমার জন্য নয়, অন্যকারো জন্য। দুজনার চোখাচোখি হলো, জলে জলে ভরে উঠলো দু’জোড়া চোখ। আমি দৃষ্টি সরালাম। বাহানা দিয়ে পালিয়ে বাঁচতে চাইলাম কিন্তু খালার কড়া নজর আর অনুরোধে পারলাম না। আমি লুকিয়ে কাঁদার একটু জায়গা খুঁজছিলাম কিন্তু কাঁদার সুযোগ পাইনি। জড়পদার্থের মতো দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আমার কোন পথ ছিলো না। কালবৈশাখী ঝড় বয়ে যাওয়া মন নিয়ে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সবাই বিয়ের তাড়া দিলো, আমার সামনেই আমার দিকে তাকিয়ে অশ্রুসজল চোখে কাঁপা হাতে অন্যকারো নামে সে সাক্ষর করলো আমার প্রেয়সী । আমি নিরব দর্শক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম সবটা। গলা পাকিয়ে কান্না আসছিলো কিন্তু কাঁদতে ও পারি নি। আমার অধিকারহীন কান্নার কোন অর্থ নেই। কারণ সে তখন আমার প্রেয়সী নয়, আমার ভাইয়ের স্ত্রী, আমার ভাবি। বিয়ের সাক্ষীহিসেবে আমাকে সাক্ষর দিতে বলা হলো। আমার পুরো শরীর তখন কাঁপছিল, শ্বাস আটকে আসছিল। আমি সাক্ষর দিতে অপারগ প্রকাশ করলেন। রবিন ভাই জোর দিলেন। অগত্যা আমি কাঁপা হাতে সাক্ষীর সাক্ষর করলাম। আমার তখনকার অনুভূতির কথা ভাবলে এখনো গা শিউরে উঠে।”

গালিব সাহেব দীর্ঘ বক্তব্যের পর থামলেন। গলা কাঁপছে তার। কেমন যেন হাঁসফাঁস করে উঠলেন। চোখে মুখে ফুটে উঠেছে রাজ্যের বিষন্নতা। আকস্মিক উঠে দাঁড়ালেন। কাঁপা গলায় বললেন,
” আমি কি একটা সিগারেট খেতে পারি?”

মিহিকা বাকরুদ্ধ। চোখ ছলছল। গলা কাঁপছে তার। গা শিউরে উঠছে বারবার। কী কঠিন পরিস্থিতি! আল্লাহ রক্ষা করো। গালিব সাহেবের জীবনবৃত্তান্ত জানার পর নিজের দুঃখ গুলোকে দুঃখ মনেই হচ্ছেনা। গালিব সাহেবের পাতানো দুঃখের গালিচায় গড়াগড়ি খাচ্ছে সে। এমতাবস্থায় গালিব সাহেবের কথা তার কর্ণকুহরে পৌঁছেনি।

গালিব সাহেব আবার জিজ্ঞেস করলেন। ধ্যানভঙ্গ হলো মিহিকার। গালিব সাহেব নিজের ভিতরে বয়ে যাওয়া ঝড় ধোঁয়ায় ছাড়তে সিগারেট খেতে চাইছেন। তাছাড়া তিনি সিগারেট খেয়ে নিজেকে কিছুটা রিল্যাক্স করতে চাইছেন। মিহিকা মাথা নাড়িয়ে সিগারেট খাওয়ার অনুমতি দিলো। যদিও সিগারেটের গন্ধ তার সহ্য হয় না। এই সিগারেট নিয়ে শ্রাবণের সাথে কত খুনসুটির স্মৃতি আছে তার! ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মিহিকা।

এই মুহুর্তে সব বাদ দিয়ে গালিব সাহেবকে স্বাভাবিক করতে চাইছে। তার যে এখনো গল্পের বাকি অংশ শোনা বাকি! মিহিকার অনুমতি পেয়ে প্রায় সাথে সাথে বারান্দায় চলে গেলেন গালিব সাহেব। পকেট থেকে গোল্ড লিফ সিগারেট আর লাইটার বের করলেন। তারপর সিগারেট ধরালেন। লম্বা এক টান দিয়ে চোখ বন্ধ করে ধোঁয়া ছাড়লেন। সিগারেটে কয়েক টান দেয়ার মাঝামাঝি সময়টায় নিজেকে সামলে নিলেন।

সিগারেট ফেলে রুমে এসে আগের জায়গায় বসলেন। তারপর বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। মিনিট খানেক পর নড়েচড়ে বসলেন। মিহিকার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালেন। হেসে বললেন,
“তা আমরা কোথায় ছিলাম?” তার স্বরে বিষন্নতার লেশমাত্র নেই, একবারে শান্ত, পরিশ্রান্ত।

অল্প সময়ে গালিব সাহেবের নিজেকে সামলে নেয়ার ব্যাপাটায় মিহিকা বেশ অবাক হলো। খানিক আগেই এই মানুষটাকে সবচেয়ে দুঃখী আর হতাশাগ্রস্ত মানুষ মনে হয়েছে। অথচ মিনিট দুয়েকের ব্যবধানে নিজেকে সামলে নিয়ে নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করছেন যেন উনার মনে কোন দুঃখ নেই! আশ্চর্য! মিহিকার অবাক চাহনি দেখে হাসলেন গালিব সাহেব। হেসে বললেন,
“অভিনয় করতে করতে পাক্কা অভিনেতা হয়ে গেয়েছি। এখন নিজেকে সুখী দেখাতে পারি অনায়াসে। তারপর বলো, কোথায় ছিলাম আমরা?”

মিহিকা নিজের বিস্ময়ী ভাব চেপে বলল,
“আপনার প্রেয়সীর বিয়েতে ছিলাম।”

গালিব সাহেব শব্দ করে হেসে বললেন,
“তুমি ছিলে না, আমি ছিলাম। তাও আবার সাক্ষী হিসেবে। ”
গালিব সাহেবের এই কৌতুকে অদ্ভুত এক কষ্টের আভাস পেল মিহিকা। এত কষ্ট বুকে চেপে এমন কৌতুক করায় বিরক্ত সে। তাই বিরক্ত কন্ঠে বলল,
“বিয়ের পরে কী হলো?”

গালিব সাহেব হাসি থামালেন। শান্ত, স্বাভাবিক স্বরে বললেন,
“কী আর হবে? হাসি খুশি আমিটা অনুভূতিহীন জীবন্ত লাশে পরিণত হলাম। ওই ঘটনার পর অনেকবার মরে যেতে ইচ্ছে হয়েছিলো কিন্তু মায়ের মায়ের কথা ভেবে আর সাহস হয় নি। ভাবলাম প্রেয়সীর ভালোবাসার বিচ্ছেদে না মরে, যে মা জীবন দিয়েছে সেই মায়ের ভালোবাসার জন্য বাঁচি!

মায়ের সাথে সময় কাটাতে লাগলাম। মায়ের সাথে যতক্ষণ থাকতাম মায়ের আন্তরিকতা আর প্রতিটা কথা আমার হৃদয় স্পর্শ করতো। কতটা নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসে আমার মা! নিজের অনুভূতির কথা না ভেবে আমার অনুভুতির কথা ভাবে সবসময়। মায়ের সাথে কাটানো মুহুর্ত গুলোতেই মনে খুব সাহস আসতো। মন একটাই কথা ভাবতো, যে নেই তার কথা না ভেবে যে আছে তার কথা ভাবো। আমি নিজেকে নিয়ে ভাবনা ছেড়ে দিলাম। কারণ নিজেকে নিয়ে ভাবতে গেলেই নিন্তিকার কথা মনে উঠতো। দুটো একি সুতোয় বাধা ছিলো কি না! আমি মাকে নিয়ে ভাবতে লাগলাম,ঘুরে দাঁড়ালাম। মনকে শক্ত করে পরীক্ষা দিলাম, ভালো ফলাফল আসল। আমার ফলাফল শুনে মা খুশিতে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। মায়ের সেই খুশিটা আমার নজর কেড়েছিলো সেদিন।আত্মহত্যা না করার সিদ্ধান্তকে স্যালুট জানিয়েছিলাম তখন। মায়ের হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে একটা কথাই ভাবলাম, মায়ের মুখে এই হাসিটা দেখার জন্যই বোধহয় আমি বেঁচে আছি, আমার বেঁচে থাকা সার্থক।
তারপর কেটে গেলো অনেক গুলো বছর। পড়াশোনা শেষ করে রাজশাহীতে ব্যবসা শুরু করলাম। ভালো পর্যায়ে গিয়ে মাকে নিয়ে আসলাম শহরে। মায়ের জোরাজোরিতে বিয়ে নামক ফর্মালিটিতে নিজেকে জড়ালাম। এই তো স্ত্রী সন্তান মাকে নিয়ে খুব সুখে আছি এখন। ”

“স্ত্রীকে ভালোবাসেন? আর প্রথম ভালোবাসা ভুলতে পেরেছেন?” মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে যাচ্ছিল মিহিকা। গালিব সাহেবের কথা পরে প্রশ্ন করল আনমনে। গালিব সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“প্রথম ভালোবাসা ভোলা যায় না। তা মনের কোণে রয়েই যায়। আমি ও ভুলতে পারি নি। আজো তেমনি ভালোবাসা কাজ করে তার জন্য। যদিও তা নিষিদ্ধ। অনুভুতি নামক সিস্টেমটা তার যাওয়ার পর থেকে অনেকটা অকেজো হয়ে গেছে। তবে সীমা মানে আমার স্ত্রীকে আমি নিন্তিকার মতো ভালো না বাসলেও মায়া নামক বন্ধনে জড়িয়ে আছি তার সাথে। মায়ার জাল সেই বিছিয়ে দিয়েছে। সে আমাকে খুব বুঝতে পারে,খুব ভালোবাসে। সুখ দুঃখ সব সময় আমাকে আর আমার পরিবারকে আগলে রাখে। দিনশেষে যখন বাসায় ফিরি তখন স্ত্রীর হাসিমাখা মুখ,মেয়ের ‘বাবা’ বলে জড়িয়ে ধরা আর মায়ের ‘খোকা’ বলে আগলে নেয়া দেখে সব ক্লান্ত ভুলে যাই। মৃত অনুভূতি গুলো মাথা চারা দিয়ে উঠে না তখন। আমার কাছে একটা পূর্ণ পরিবার আর সবার নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আছে। সুখী হওয়ার জন্য আর কী লাগে!”

গালিন সাহেব শুকনো হাসলেন। মিহিকা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। একটা মানুষ এত দুঃখকে বুকে চেপে ঘুরে দাঁড়াতে করতে পারে! এতটা বছর ধরে অনুভূতি নামক দাবানলের আগুন জ্বলে পুড়ে ও কী সুন্দর হাসিখুশি জীবনযাপন করছেন! মিহিকা ভাবতে লাগলো, উনার তুলনায় আমার সমস্যা অতি নগন্য। তাও আমি সহ্য করতে পারছিনা। উনি কিভাবে সহ্য করেছেন! উনার জায়গায় থাকলে আমি কী করতাম? আমি তো মরেই যেতাম। এভাবে জীবন্ত লাশের মতো চলা যায়? আমার সাথে এমন কিছু হলে আমি পারতাম সহ্য করতে? প্রশ্ন ভাবনায় আসতেই কেঁপে উঠলো মিহিকা। হাকচেকিয়ে উত্তর দিলো,
“না আমি কোনভাবেই সইতে পারতাম না। এই দুঃখ সহ্য করার চেয়ে মৃত্যু অনেক সহজ। আমি মরেই যেতাম।”

মিহিকার কথায় গালিব সাহেব ভ্রু কুঁচকালেন। তারপর বললেন,
” মরে যাওয়া এত সহজ! এতই! মানুষ নিজেকে হত্যা করে জীবনের কষ্টদায়ক মুহুর্ত থেকে পরিত্রাণ পেতে। অথচ তারা জানেই না তারা সাময়িক কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য স্থায়ী কষ্টকে বেছে নিচ্ছে। মৃত্যু তাদের জন্য কষ্ট লাঘব নয় বরং কষ্ট গ্রহণ, জাহান্নাম নামক উপহার গ্রহন। আত্মহত্যা কারীর শাস্তি কী জানো? বছরের পর বছর তেমন ভাবেই জাহান্নামের আগুনে পুড়বে যেমনভাবে সে আত্মহত্যা করছিলো।”
থেমে ফিরতি প্রশ্ন করলেন,

” আচ্ছা, একটা কথা বলো তো তোমাকে পায়ে যদি একটা কাঁটা বিধে তবে তুমি কাঁটা উঠাবে নাকি পা টাই কেটে ফেলবে?”

অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নে বিরক্ত হলো মিহিকা। কপালে বিরক্তির ভাজ ফেলে উত্তর দিল,
” অবশ্যই কাঁটা উঠাবো। এই সামান্য কারণে আমি আমার পা কেনো কাটবো?”
“কাটবে না? ” অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করলেন গালিব সাহেব। মিহিকা তড়িৎ উত্তর দিল,
“না।”
“কেনো?”
“কারণ, এই সমস্যার সমাধান আছে আমার আছে। আমি সমস্যার সমাধান উপায়ই বেছে নিবো। পা কাটলে পরবর্তীতে কষ্টটা আমাকেই করতে হবে। সারাজীবন এই কাটা পা নিয়ে চলতে হবে। এতে কষ্ট কমার বদলে বাড়বে। খুবই কষ্টদায়ক হবে সেটা।”

মিহিকার কথায় গালিব সাহেব হাসলেন। হেসেই বলল,
“মিহিকা তোমার বলা কথাতেই তোমার সব সমস্যার সমাধান আছে। জীবনের কোন সমস্যাই স্থায়ী এবং সমাধানহীন নয়। সব সমস্যারই সমাধান থাকে। নিকষ কালো ভূতড়ে আঁধার রাতের পরেই কিন্তু সুন্দর একটা সকাল থাকে। ভয়ংকর রাত পেরুলেই তুমি সেই সকালের দেখা পাবে। অন্যথায় পাবে না। তেমনি আমাদের জীবনে সমস্যা গুলো হচ্ছে আঁধার রাতের মতো খুবই ভয়ংকর। মনে হয় পার করতে পারবো না। কিন্তু খানিক সাহসের সঞ্চার হলে ঠিকই আমরা রাত কাটিয়ে ভোরের দেখা পাই। তুমি বুঝো তোমার পায়ে কাঁটা ফুটলে কাঁটা উপড়ে ফেলবে তাও পা কাটবে না। কারণ পা কাটলে পরবর্তীতে তোমাকেই কষ্ট পেতে হবে। পা কাটার পরিণতি ভয়ানক হবে। এটা জেনে তুমি পা কাটার কথা ভাবতে পারছো না। অথচ কাঁটার মতো সামান্য সমস্যার জন্য তুমি তোমার একটা সুন্দর জীবনকেই উপড়ে ফেলতে চাইছো! তুমি কিন্তু চাইলেই তোমার সমস্যাগুলোকে কাঁটা ভেবে উপড়ে ফেলতে পারো। আর আঁধার রাত ভেবে সামান্য শক্তি নিয়ে রাত পার করে সকালের দেখা পেতে পারো। সমাধান কিন্তু তোমার কাছেই আছে। তুমি পা থেকে কাঁটা উঠাও,পা কেটো না।এতে কষ্টটা তোমাকেই ভোগ করতে হবে। সমস্যা নামক কাঁটা উপড়ে না ফেলে যদি সুন্দর জীবনটাকেই উপড়ে ফেলো তবে, পরিণাম হবে জাহান্নাম। জ্বলতে পারবে বছরের পর বছর জাহান্নামের ওই আগুনে?”

আজ মিহিকা মনোযোগী শ্রোতা হিসেবে গালিব সাহেবের সব কথা শুনছে। সে মিনমিনে গলায় গালিব সাহেবের কথার উত্তর দিলো,
“কিন্তু এভাবে কি বাঁচা যায়? ”

গালিব সাহেব দৃঢ় কন্ঠে বললেন,
” বাঁচা যায় বলেই তো আমি আজো বেঁচে আছি।শুনো মিহিকা, মৃত্যু কখনোই কোন কিছুর সমাধান হতে পারে না। বরং মৃত্যু থেকে সমস্যার শুরু হয়। তুমি তো একজন মানুষের কথা ভেবে মরে যাবে কিন্তু যারা সবসময় তোমার কথা ভেবে আসছে তাদের কী হবে ভাবতে পারছো? যারা সবসময় তোমাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসে যাচ্ছে সেই বাবা মায়ের কী হবে? তারা তোমাকে হারিয়ে থাকবে কিভাবে, বলতে পারো! মৃত্যুর মতো ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সবাই যদি মিনিট খানেকের জন্য ও তাদের বাবা মায়ের দিকে তাকাতো তবে সে তার সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারতো না। মিহিকা, তুমি কি একবারো তোমার বাবা মায়ের জন্য ভাবছো না? তুমি শুধু নিজের ভালোবাসার কথা ভাবলে তোমার জন্মপূর্ব ভালোবাসার কথা ভাবলেনা কেনো! তাদের ভালোবাসার কোন মূল্য নেই? প্রিয়জনের বিচ্ছেদের কষ্ট তো তুমি অনুভব করছো। মৃত্যুর পথ বেছে নিয়ে নিজের বাবা মাকে ও যেই কষ্ট অনুভব করাতে চাইছো? তোমার বাবা মা সেই কষ্ট সইতে পারবে? আর তুমি যার বিচ্ছেদে নিজেকে মারতে চাইছো তোমার মৃত্যুতে সে কি তোমার কাছে ফিরে আসবে?”

উত্তরের আশায় মিহিকার দিকে তাকালেন গালিব সাহেব। মিহিকা উত্তর দিতে পারল না। কারণ সে জানে শ্রাবণ ফিরে আসবে না, তার মৃত্যুর কথা শুনে একটু ও কাঁদবেনা, জানাযায় ও আসবেনা।
মিহিকার নিরবতার মাঝে উত্তর খুঁজে নিলেন গালিব সাহেব। স্মিত হেসে বললেন,
” তুমি জানো, সে আসবে না। জানা সত্ত্বেও কার জন্য মরতে চাইছো! যার কাছে কিনা তোমার অনুভূতির কোন মূল্য নেই তার জন্য! যার কাছে তোমার জীবনের মূল্য নেই তার জন্য? তুমি মারা গেলে ক্ষতি তোমারই হবে। সে তো আপদ বিদায় হয়েছে ভেবে মজা করবে। তোমার জানাজায় অবধি উপস্থিত হবে না সে। তুমি এমন একজনের জন্য মরতে চাইছো?”

গালিব সাহেব প্রশ্নবোধক চাহনি দিয়ে মিহিকার দিকে তাকিয়ে আছেন। মিহিকা মাথা নিচু করে রইলো, কিছুই বললো না। বলার মতো কোন কথা, বা ভাষা নেই তার কাছে।
গালিব সাহেব বললেন,
“জীবনটা খুব সুন্দর। এই সৌন্দর্যের পিছনে সুখ দুঃখ দুটোই আছে। দুঃখ গুলোকে চেপে সুখ গুলোকে প্রকাশ করতে পারলেই তুমি সুখী। আজ যদি তুমি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত বাতিল করে সামনে আগাও তবে আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি কম হলেও একশোটা সময় তুমি উপলব্ধি করবে যে আত্মহত্যা না করে ভালো করেছো, আত্মহত্যা করলে জীবনের এই সুন্দর মুহুর্তটার সম্মুখীন হতে পারতেনা।

রুফাইদার যেদিন জন্ম হলো। সদ্যোজাত শিশুকন্যা কোলে নেয়ার পর আমি কেঁপে উঠেছিলাম। প্রথম বাবা হওয়ার অনুভূতির মুখোমুখি হয়ে আমি হাসিকান্নায় মেতে উঠেছি। রুফাইদাকে বুকে জড়িয়ে শুধু ‘আলহামদুলিল্লাহ ‘ পড়েছি। কোল থেকে রেখে ছুটেছি হাসপাতালের নামাযঘরে। দুই রাকাত নামায পড়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছি। এই জন্য না যে আমার সন্তান হয়েছে। বরং এই জন্য যে আমি সেদিন আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসতে পেরেছি। নাহলে বাবা হওয়ার মতো চমৎকার অনুভূতিতে অভিভূত হতে পারতাম না। রুফাইদা প্রথম যেদিন ‘বাবা’ বলে ডাকল, সেদিন ও আমি কেঁদেছি। হাসিকান্নায় মেতে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছি। বারবার একটা কথাই বলেছি, ” জীবনটা সুন্দর, যার একপিঠে দুঃখ তো অন্যপিঠ সুখে ভরা।”

গালিব সাহেব থামলেন। গলাটা শুকিয়ে গেছে। মিহিকা থেকে পানি চেয়ে নিলেন। মিহিকা চটজলদি পানি এনে দিল। পানি পান করে আবার বলা শুরু করলেন,
” আজ যদি তুমি আত্মহত্যা সিদ্ধান্ত বাতিল করো, কাল তোমার সামনে হাজারো সুন্দর মুহুর্তে এসে দাঁড়াবে যা দেখে তুমি আজকের দিন নিয়ে আফসোস করবে। শরীরে আগুনের আঁচ লাগলে মানুষ আগুনে ঝাপ দেয় না,বরং আগুন থেকে সরে আসে। তেমনি তুমি জীবনে সামান্যতম সমস্যার সম্মুখীন হয়ে জীবনটাকে শেষ করে দিও না। সমস্যার সমাধান করে ভালো পথে ফিরে আসো। সমস্যাটাকে বুড়ো আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দাও, বলে দাও, তোমার মতো সমস্যাকে ফেস করার ক্ষমতা রাখে মিহিকা। দেখবে নিজের বিজয় নিজেই দেখতে পাচ্ছো। ”

মিহিকা নিশ্চলভাবে বসে আছে। গালিব সাহেব তা দেখে এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। মনে মনে বললেন,আজকালকার ছেলেমেয়েরা বড্ড অবুঝ,হয়তো স্বার্থপর।

গালিব সাহেব আরো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পকেট থেকে ফোন বের করলেন। স্ক্রিন অন করে কিছু একটা দেখলেন। তারপর ফোন থেকে চোখ উঠিয়ে মিহিকাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“তোমার মা বা বাবার নাম্বারটা দাও তো?”

মিহিকা চমকে তাকালো। আংকেল বাবা মায়ের নাম্বার চাইছে কেনো! তাদের কি জানিয়ে দিবে? এ ভেবেই প্রশ্নবোধক চাহনি দিয়ে বলল,
“কেনো! তাদের নাম্বার দিয়ে আপনি কী করবেন? ”
“কথা বলবো। ”
গালিব সাহেবের কন্ঠ স্বাভাবিক। মিহিকা ভীত কন্ঠে বলল,
“কী বলবেন?”
“এই যে তুমি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছো সেই কথা বলব।”

মিহিকা হকচকিয়ে বলে ওঠল,
“না না, আমি আপনাকে নাম্বার দিবো না। আপনি বাবা মাকে জানিয়ে দিলে তারা কষ্ট পাবে। খুব ভেঙে পড়বে। বাবা হার্টের রোগী, এট্যাক করে বসবে। ”

গালিব সাহেব হেসে বললেন,
“বাহ! মা বাবা জন্য খুব চিন্তা তোমার! তারা কষ্ট পাবে তাই তাদের আত্মহত্যার খবর জানাতে চাইছো না। বাবার হার্ট অ্যাটাক এর চিন্তা আছে। বাবা মায়ের ক্ষতি চাইছো না অথচ নিজে মৃত্যু পথ বেছে নিয়ে তাদের ক্ষতির সাগরে ডুবাতে চাইছো! আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে এই চিন্তা তখন কোথায় ছিলো? একবারো ভাবলেনা মা বাবার কথা, আজ তুমি আত্মহত্যা করলে কাল তারা যখন তোমার মৃত্যুর খবর শুনবে, তোমার লাশ দেখবে তখন তাদের কী অবস্থা হবে? হার্টের রুগী তার আদরের মেয়ের লাশ দেখে সহ্য করতে পারবে?

একটা সত্য কথা কী জানো মিহিকা? ইয়াং জেনারেশন যারা প্রেমঘটিত কারণে বা ছোটখাটো কারণে আত্মহত্যা করে, তাদের মৃত্যুর আগে যদি বলা হয় তুমি তোমার বাবা মায়ের চোখের সামনে আত্মহত্যা করো। তোমার বাবা মা থাকবে শিকলে আবদ্ধ। চাইলে তারা তোমাকে বাঁচাতে পারবেনা। তবুও তারা বাবা মায়ের সামনে আত্মহত্যা করতে পারবেনা। সিদ্ধান্ত বাতিল করবে। তার কারণ কী জানো? তখন তারা বাবা মায়ের কষ্টমাখা মুখ দেখে সহ্য করতে পারবে না। নিজের ক্ষতি করতে গিয়ে বাবা মায়ের ক্ষতি হতে দিতে পারবে না। নিজের কারণে বাবা মাকে শিকলে আবদ্ধ হতে দেখতে পারবে না। এই কারণে তারা বদ্ধ রুমে সবার আড়ালেই আত্মহত্যা করে। কিন্তু তারা হয়তো ভাবেই না যে, তারা নিজেকে কষ্ট থেকে মুক্ত করতে গিয়ে বাবা মাকে কতটা কষ্টের সাগরে ডুবিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। আত্মহত্যা করার আগে যদি সবাই একবার প্রিয়জনহারা পরিবারের আর্তনাদ শুনতো,দেখতো তবে কেউ কখনোই আত্মহত্যা করার কথা মাথায় আনতো না। তারা যদি আত্মহত্যা করার আগে কয়েকঘন্টার জন্য মৃত্যুর ভান করে থাকতো তবে দেখতে পেতো তাদের মৃত্যুতে সবার অনুভূতি। তখন সে মৃত্যুর সিদ্ধান্ত নেয়ায় নিজেকেই ধিক্কার দিতো। যাক গে, মিহিকা তুমি মৃত্যুর আগে শেষ বারের মতো বাবা মায়ের সাথে কথা বলবে না?”

মাথা নাড়লো মিহিকা। গালিব সাহেব বললেন,
“সাহস নেই তো! আচ্ছা মৃত্যুর কথা বলা লাগবে না। শুধু তুমি কল দিয়ে তাদের কন্ঠস্বর শুনবে, কোন কথা বলবে না। আমি ও কিছু বলবো না, প্রমিজ।”

মিহিকা ভাবল কিছুক্ষণ। বাবা মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে, কথা বলতে ইচ্ছে করছে। সেই ইচ্ছে থেকেই রাজি হলো। বিছানা থেকে ফোন নিয়ে কন্টাক্ট লিস্টে সবার উপরে থাকা “মা” নামে সেভ করা নাম্বারটা ডায়াল করলো। রাত তখন সাড়ে তিনটা। মিহিকার সময়ের দিকে কোন খেয়াল নেই। সে ফোনের পর্দার দিকে তাকিয়ে আছে। একবার বাজলো ধরলো না। মিহিকা আবার দিলো। দু’বার রিং হওয়ার পর রিসিভ হলো। অপাশ থেকে ভেসে আসলো ঘুমজড়ানো এক নারী কন্ঠ,
“হ্যালো..

মায়ের কন্ঠটা শুনতেই রাজ্যের পানি এসে ভর করলো মিহিকার চোখে। মিহিকা ঠোঁট কামড়ে পানি আটকালো। চুপচাপ মা নামটার দিকে তাকিয়ে রইলো। মিহিকার নিরবরতায় অপাশের কন্ঠটা এবার উদ্ধিগ্নতায় ভরে গেলো,
” মিহি, মিহি আছিস তুই? এত রাতে কল দিলি? তুই ঠিক আছিস? কথা বলছিস না কেনো?”

মায়ের এমন চিন্তা দেখে মিহিকা এবার আর নিজের কান্না চেপে রাখতে পারলো না। শব্দ করে কেঁদে দিলো। মিহিকার কান্নায় মিহিকার মা ভড়কে গেলেন। হাকচেঁকিয়ে বললেন,
“মিহি কাঁদছিস কেনো! মিহি কী হয়েছে?বল কি হয়েছে? তুই ঠিক আছিস? কোথায় আছিস?”

মিহিকা কেঁদেই যাচ্ছে। এতদিনের জমানো সব কষ্ট যেন আজ মায়ের কাছে প্রকাশ করছে। ওদিক থেকে মিহিকার মায়ের কান্নাভেজা চিন্তিত গলা শুনা যাচ্ছে। তিনি চিৎকার করছে। তার মনে হচ্ছে তার মেয়ে কোন বিপদে আছে। খানিক পরেই অপাশে নারী কন্ঠের বদলে পুরুষ কন্ঠ শুনা গেলো।
“মামুনি কী হয়েছে তোমার? কাঁদছো কেন? সব ঠিক আছে তো? কোথায় আছো তুমি? বলো, আমরা আসছি।”
মিহিকা ‘বাবা’ বলে আবারো কেঁদে দিলো। এবার ফোনের অপাশে থাকা মিহিকার বাবার কন্ঠটাও কেঁপে উঠলো। তিনি বারবার বলতে লাগলেন,
“তুমি কোথায় আছো? বাসায় আছো?”

কান্নাভেজা গলায় মিহিকা উত্তর দিল,
“হু।”
“ওকে, আমরা আসছি। কান্না করো না। একটু সময় দাও আমাদের, আসছি আমরা।”

কথার মাঝে গালিব সাহেব মিহিকার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নিলেন। মিহিকা আহত চোখে গালিব সাহেবের দিকে তাকালো। ফোন কেটে গালিব সাহেব গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
” তুমি সামান্য কেঁদেছো বলে তারা এমন করছে। ভেবে দেখো তোমার লাশ দেখলে তারা কেমন করবে! আর আমি কিন্তু তোমার বাবা মায়ের কন্ঠস্বর শুনতে বলেছিলাম। অন্য কিছু না। তবে তুমি তাদের কাছে কান্না করে আসতে বাধ্য করছো কেনো? তারা আসলে তুমি আত্মহত্যা করবে কিভাবে? একটু পর তুমি আত্মহত্যা করবে, তারা এসে তোমার লাশ দেখবে?”

মিহিকা ডুকরে কেঁদে উঠলো। গালিব সাহেব বললেন,
“একি ফোনটা যদি তুমি শ্রাবণকে করো তবে সে বিরক্ত হয়ে তোমাকে গালাগাল দিবে। যদিও তুমি তার জন্যই মরতে যাচ্ছো। কিন্তু তোমার সামান্য কান্না শুনে যাদের চোখের ঘুম উড়ে গেলো, তারা তোমার বাবা মা। তোমার চিন্তায় যারা মগ্ন, তারা তোমার বাবা মা। তোমার চোখের পানি যাদের সহ্য হয় না, তারা তোমার বাবা মা। তোমার মুখে হাসি ফুটাতে যারা সব করতে পারেন, তারা তোমার বাবা মা। তোমার বিপদে রাতদুপুরে কোন চিন্তা না করেই দুইশ পয়তাল্লিশ মাইল পাড়ি দেয়ার কথা যারা অনায়েসে ভাবতে পারেন, তারা তোমার বাবা মা। তুমি যাদের অনুভূতি আর পৃথিবী জুড়ে আছো, তারা তোমার বাবা মা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো যাদের পৃথিবী জুড়ে তোমার বাস। সেই তোমার, পৃথিবী জুড়ে তাদের চিহ্ন নেই,তাদের জন্য ভালোবাসা নেই,তাদের জন্য চিন্তা নেই। তুমি দুইদিনের ভালোবাসার জন্য তাদের কথা ভুলে মরতে দুবার ভাবছো না। তোমার কাছে শ্রাবণই সব, শ্রাবণের ভালোবাসাই সব। বাবা মায়ের ভালোবাসার কোন মূল্য নেই। মূল্য থাকবে কিভাবে, তুমি তো তাদের ভালোইবাসো না। তুমি….

গালিব সাহেবকে থামিয়ে মিহিকা উঁচু গলায় বলল,
” আমি মা বাবাকে ভালোবাসি। ভীষন ভালোবাসি। শ্রাবন থেকেও বেশি।”

গালিব সাহেব গম্ভীরমুখে বললেন,
“এই তোমার ভালোবাসা? ভালোবাসলে মা বাবাকে কষ্ট দিয়ে আত্মহত্যা করবে কিভাবে!”

মিহিকা মাথা চেপে চিৎকার করে বলে উঠল,
“করবো না। আমি মা বাবাকে কষ্ট দিতে পারব না। এতকাল বুঝিনি। এখন বুঝেছি পৃথিবীতে যদি কেউ নিঃস্বার্থ ভালোবেসে থাকে তবে তারা হলো মা বাবা।”

গালিব সাহেব মুচকি হাসলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে মিহিকার কাছে গেলেন। মিহিকার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
” কথা ছিল দশমিনিট থাকার। ঘন্টা পেরুলো। এখন আমার যাওয়া উচিত। আমি চলে যাচ্ছি। আত্মহত্যা করা, না করা তোমার উপর ছেড়ে দিলাম। তবে বলব, এতকাল নিজের অনুভূতির মূল্য দিয়ে জীবন যাপন করে এসেছো, এবার না হয় অন্যের অনুভূতির মূল্য দিলে! মা বাবা এবং যারা তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী তাদের অনুভূতির মূল্য দাও। ঘুরে দাঁড়াও। আজ তুমি মারা গেলে শ্রাবণের কিছু আসবে যাবে না। বরং সে তোমার সাথে প্রতারণা করে সুখে থাকবে। আজকাল প্রতারকরা সুখে থাকে। সে সুখে থাকতে পারলে তুমি ও পারবে। তুমি ঘুরে দাঁড়াও নিজেকে শক্ত করো। নিজেকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলে শক্ত অবস্থানে নিয়ে যাও। আর শ্রাবণকে দেখিয়ে দাও, তুমি নও, সে তোমার যোগ্য নয়। তাকে বলার সুযোগ আনো, ‘ তুমি আমার লাইফ থেকে চলে যাওয়ার কারণ আমার অযোগ্যতা নয় তোমার অযোগ্যতা। আমি তোমার চেয়ে ভালো কাউকে দাবি করি বলেই তুমি আমার জীবন থেকে চলে গেছো।’
তুমি নিজেকে মেরে নয় নিজেকে শক্ত করে তার মুখোমুখি হয়ে তাকে জবাব দাও। আমার বিশ্বাস, তুমি পারবে। জীবনটা অনেক সুন্দর, জীবনের সৌন্দর্য উপভোগ করো। মিছে মায়ায় পড়ে সুন্দর জীবনটাকে ধ্বংস করো না। আর হ্যাঁ, আমার জীবনের অনেক গোপন কথাই আজ তোমায় বলেছি যা আর কাউকে বলি নি। বেঁচে থাকলে কাউকে বলো না।”

গালিব সাহেব যাবার জন্য পা বাড়ালেন। তিনি মিহিকাকে একা ছেড়ে দিলেন। মেয়েটা ভাবুক,একটা সমাধানে আসুক। তবে যে টুকু বুঝিয়েছেন সে টুকুতে কাজ হবে, এতে বেশ আশাবাদী গালিব সাহেব।

বারান্দার দরজায় গিয়ে থেমে গিয়ে মিহিকাকে ডাকলেন। মিহিকা তখনো নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে। গালিব সাহেবের ডাকে মিহিকা তার দিকে তাকাল। গালিব সাহেব হেসে বললেন,
“কালো রাত অনেকটা কেটে গেছে। একটা নতুন সকাল তোমার অপেক্ষায় আছে। সে চাইছে তুমি তাকে উপভোগ করো। সে তোমার জীবনটাকে তার আলোয় আলোকিত করার অপেক্ষায় আছে। নতুন সকাল তোমার দুঃখগুলো গুছিয়ে দিবে। তার আক্ষেপ উপেক্ষা করো না, এটা আমার অনুরোধ। বেঁচে থাকলে হাস্যজ্বল মিহিকার সাথে আবার দেখা হবে এমন আশা নিয়ে চলে যাচ্ছি। ভালো থেকো।”

গালিব সাহেব যেভাবে এসেছিলেন যেভাবেই কোমর অবধি খোলা বারান্দার রেলিং টপকে চলে গেলেন। রুমে যেতে গিয়ে ও গেলেন না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলেন। দৃষ্টি তার পাশের বারান্দার দরজা বরবার বসা মিহিকার দিকে। তিনি অপেক্ষা করছেন তার দেয়া জ্ঞান নামক ওষুধ কেমন কাজ করছে তা দেখার। তার ওষুধ কাজ করলো ঘন্টাখানেক পর।
দীর্ঘ এক ঘন্টা হাটুতে মাথা গুজে বসে নিজের সাথে বোঝাপড়া করল মিহিকা। তারপর উঠে পড়ল।

গালিব সাহেব দেখলেন মিহিকা চোখ মুছতে মুছতে আর সিলিংয়ে আটকানো দড়ি খুলছে। তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। যাক, তবে দেয়াল টপকে ওখানে যাওয়া আর নিজের জীবন কাহিনি বলা সার্থক হলো। গালিব সাহেব মুচকি হেসে ঘরে প্রবেশ করলেন।

এয়ারপোর্টে পরিচিত লোক থাকায় সব ফর্মালিটি পূরণ করে ইমার্জেন্সিতে ভোরের ফ্লাইটে রাজশাহী চলে এলেন মিহিকার বাবা মাহবুব আলম এবং মা জয়নব আরা। মিহিকার ফ্ল্যাটে যখন আসলেন তখন সবে চারদিক আলো ফুটতে শুরু করেছে। মেয়েকে সুস্থ সবল দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তারা। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে হাজার চুমুতে ভরিয়ে দিলেন জয়নব আরা। মাহবুব সাহেব মেয়েকে বুকে জড়িয়ে রাখলেন কিছুক্ষণ। মিহিকা মা বাবা দুজনকেই জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদলো। আর বলল,
” স্যরি বাবা মা। আমি খুব ভালোবাসি তোমাদের। কখনো কষ্ট দিবো না। কখনো না।”

বাবা মা মিহিকার কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলেন বারবার। মিহিকা বলল, দুঃস্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছে। তাই ওভাবে কাঁদছিল।

মিহিকার পূর্ণজনম হলো সেদিন। শুরু হলো নতুন একটা সকাল। মিহিকা বাবা মায়ের মাঝে বসে সুন্দর সকালটা উপভোগ করল। জয়নব আরা মেয়ের পছন্দের ভুনা খিচুড়ি বানিয়ে হাতে তুলে খাইয়ে দিলেন, মাহবুব সাহেব মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে বের হলেন। পুরোটা সময় ভেজা চোখে চেয়েছিল মিহিকা।
আর খানিক পর পর রাতের সিদ্ধান্তের জন্য আফসোস করেছে। আর গালিব সাহেবকে ধন্যবাদ দিয়েছে সেই সাথে সিদ্ধান্ত বাতিলের জন্য নিজেকে ধন্যবাদ দিচ্ছে। ‘ভাগ্যিস আত্মহত্যা করি নি। করলে এত সুন্দর একটা সকাল আসতো আমার জীবনে! হয়তো এই সুন্দর সকাল থেকেই আমার জীবনের সৌন্দর্য শুরু হয়েছে। এসব ভাবতেই ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠছে।

গালিব সাহেবের কথাকে সত্য প্রমাণ করে জীবনের প্রতি পদে পদে সুন্দর সময় এসেছে, সে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আফসোস করেছে। ফিরে আসায় আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেছে। মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে শ্রাবণের উপরের পদে আসন গ্রহণ করে শ্রাবণকে তার যোগ্যতা দেখিয়ে দিয়েছে।

জীবনের সৌন্দর্য বাড়াতে প্রেম এলো তার জীবনে, এক ঝাক ভালোবাসা নিয়ে আরুন এসে হাজির হলো। তাকে আঁকড়ে নিল, ভালোবাসায় ভরে দিল। চমৎকার মানুষটার সাথে জীবনের একাংশ কাটিয়ে মিহিকা উপলব্ধি করল, ” অতীতের সমস্যাটার ঘনত্ব এতটাও বেশি ছিল না যে আত্মহত্যার পথ বেছে নিবে। শ্রাবণ এসেছিল, সুন্দর সময় কাটিয়ে তাচ্ছিল্য উপহার দিয়ে গেল এইজন্যই যে, সামনে চমৎকার কোন মানুষ তার জন্য অপেক্ষা করছে। জীবনটা সুন্দর, এর স্বাদ কখনো তিক্ত, কখনো মিষ্ট। দুটো মিলেই জীবন। তিক্ততায় বিষিয়ে জীবন শেষ করা উচিত নয়, তিক্ততার পরেই মিষ্টতা আসে। শ্রাবণের মতো মানুষ চলে গেছে বলেই আরুনের মতো চমৎকার মানুষ এসেছে তার জীবনে। রাঙিয়েছে তার জীবনকে, আঙুল তুলে দেখি দিয়েছে জীবনের সৌন্দর্য। ”
এখনো আফসোস হয় সেই সিদ্ধান্তের, আনন্দ হয় ফিরে আসতে পারায়। বারবার বিড়বিড় করে বলে, “জীবনটা সুন্দর”

(সমাপ্ত)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে