#পর্ব১৪
#নতুন_ভোরের_আগমন
#অর্ষা_আওরাত
দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার আভাস ফুটে ওঠলো ধরনীতে! সূর্য্য মামা ডুবে যাবে কিয়ৎক্ষন ভিতরেই। চারদিকে রক্তিম আভা ফুটে ওঠেছে। ইনসিয়া আগের ন্যায় চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে ছাদের এক কোনায়! মাগরিবের আজানের শব্দ কানে প্রতিধ্বনিত হতেই টনক নড়লো ইনসিয়ার। মস্তিষ্ক জানান দিলো নিচে যাওয়ার দরকার। ইনশাদের কোনো কথার উওর না দিয়ে তড়িঘড়ি করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলো ইনসিয়া! ইনশাদ ইনসিয়ার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রয়েছে এক গভীর দৃষ্টি মেলে! মন গহীনে কল্পনা করে যাচ্ছে কিয়ৎক্ষন পূর্বে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির মুখশ্রী । যার কিনা আগে কথার ঝুড়ি খুললে কথাই ফুরাতো না সেই মেয়েই আজ একদম চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে! সবকিছু ভেবে ভিতর থেকে চাপা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসলো ইনশাদের! মনের ভিতরের চাপা কষ্টগুলো যেনো আর বাধ মানলো না! কান্নায় রুপান্তর হয়ে অশ্রু কনা গড়িয়ে পড়লো ইনশাদের দু গাল বেয়ে। ছেলেদের যে কাঁদতে নেই সেই কথাটি ভুলেই যেনো মনের সকল বাধ ছেড়ে প্রান খুলে কাঁদছে ইনশাদ! প্রথম ভালোবাসার মানুষ এর কষ্ট অতি সহজে ভোলা যায়? কাঁদতে কাঁদকে স্মৃতির পাতায় চোখ বোলালো ইনশাদ। স্মৃতিগুলোই যেনো আজ তার কাছে একমাত্র ধরে রাখার মতন জিনিস যা তার কাছ থেকে কোনোদিনই যাবে না।
__________________________________
সেদিন ইনশাদ ইনসিয়ার পাশাপাশি একই হাসপাতালে যখম হয়ে ভর্তি হয়। ইনসিয়া ব্যাথা একটু বেশি পেয়েছিলো পায়ে। যার কারনে ওই দিন তার একটি পা কেটে ফেলে দিতে হয় ডাক্তার বাধ্য হয়ে। ইনশাদও কম যখম হয়নি সেদিন। ইনসিয়ার যখন জ্ঞান ফিরলো ওইদিন নিজের শরীরে পা না দেখে থম মেরে রইলো কিছুক্ষণ। এই অবিশ্বাস্য সত্যি যেনো তার হৃদয়স্থল থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না! কষ্টরা দলা পাকিয়ে কান্নায় রুপান্তরিত হয়ে অশ্রু বেয়ে পড়ছে অঝোড় ধারায়! ঠিক সেই মুহুর্তেই দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করলো ইনশাদ! এক মুহুর্তের জন্য মানুষটিকে দেখে থম মেরে রইলো ইনসিয়া! সেই সুন্দর নজরকাড়া মুখশ্রীতে অজস্র কাটা ছেড়ার দাগ! ললাটের এক পাশ স্থানে কেটে গেছে। হাত ভেঙে গেছে, মাথায়ও বেশ মোটা করে একটি ব্যান্ডেজ বাধা ইনশাদের। বুঝতে বাকি রইলো না আর মানুষটি কতোই না যন্ত্রনা পেয়েছে। ইনসিয়ার মন শুধু একটা কথাই বলতে লাগলো ওইদিন তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে মানুষটার আজ এই অবস্থা! সবকিছুর জন্য নিজেকে দায়ী মনে হতে লাগলো। ইনশাদকে দেখে এভাবে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকার কারনে ইনশাদ ইনসিয়াকে প্রশ্ন করবে ঠিক তার আগ মুহুর্তেই ইনসিয়ার ভাই নয়নকে অনুরোধ করে বাইরে যেতে বললো। নয়নও কোনো কিছু না বলে চুপচাপ বাইরে বেরিয়ে গেলো। নয়ন যেতেই ইনশাদ এবার তার প্রশ্ন খুলে বসলো,
–“অনেকক্ষন তো হলো আমি এসেছি কোনে কথা বলবে না ইনসিয়া? এভাবে পাথরের মতন চুপ করে আছো কেনো?”
ইনসিয়া ঘাড় উঁচু কে মাথা ফিরিয়ে কিঞ্চিৎ পরিমান তাকালো ইনশাদের মুখশ্রীর দিকে! বুকের ভেতর টা যেনো ফাঁকা ফাঁকা লাগছে ইনশাদকে এই অবস্থায় দেখে। ইনশাদ আবারো জিগেস করলো ইনসিয়াকে,
–“তুমি কি কোনো কথা বলবে নাকি আমি চলে যাবো এখান থেকে?”
ইনসিয়ার ইনশাদের দিকে তাকিয়ে রইলো ফ্যাল ফ্যাল করে। তার মলিন দৃষ্টিপাত জানান দিচ্ছে তার মনের অন্তঃপুরীতে বয়ে চলা ঝড়ের আভাস। হঠাৎই সে বলে ওঠলো,
–“চলে যান আপনি! কেনো এসেছেন এখানে?”
ইনশাদ স্তম্ভিত নয়ন নিয়ে ইনসিয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করলো ইনসিয়া এই সময়ে তাকে বেরিয়ে যেতে বলবে এটা তার কল্পনাতীত ছিলো। মনের কৌতুহল প্রকাশ করে জিগেস করলো,
–“কি হয়েছে তোমার? তুমি এরকম করছো কেনো?”
ইনসিয়ার নিজেকে দেখে তখন একটি কথাই ঘুরছে মস্তিষ্ক যে তুই একটি পঙ্গু মেয়ে! তোকে যায় না ইনশাদের মতন সুর্দশন যুবকের পাশে, বেমানান লাগবে তোকে। মানুষ তোর জন্য ইনশাদকে দেখে হাসাহাসি করবে। তোর জন্য ইনশাদকে সমাজে অপমানিতো হতে হবে। মানুষের কটু কথা শুনবি চারদিক দিয়ে ইনশাদ তোর কারনে সুখী হতে পারবে না। যখন এই কথাগুলো বারংবার মনে হতে লাগলো তখন নিজে না চাইতেও ইনশাদকে দূরে ঠেলে দিলো!
–“আপনি চলে যান বলছি এখান থেকে! আর একবারো এখানে আসবেন না ভুল ক্রমেও।”
ইনশাদের দিকে তাকিয়ে রাগান্বিত স্বরে কথাগুলো বললো ইনসিয়া! ইনশাদ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে ইনসিয়ার দিকে! বড্ড অচেনা লাগছে তার ইসু পাখিকে আজ।
–“তুমি এরকম কেনো করছো ইসু পাখি? এখন তো তুমি জানো আমি তোমাকে ঠিক কতোটা ভালোবাসি।”
–“ওসব ভালোবাসা চাই না আমার! ঘৃনা করি আমি আপনাকে। ভালোতোবাসিই না আর না থাকতে চাই আপনার কাছে। আপনি চলে যান বলছি।”
কয়েক বর্নের বাক্য গুলো ইনশাদের কর্নকুহুরে প্রবেশ করতেই ভু মন্ডল কেঁপে ওঠলো! ইনশাদ ভেবেছিলো ওইদিন ইনসিয়াও তাকে ভালোবাসে। কিন্তু আজ যে চিত্র সম্পুর্ন পাল্টে গেলো। ইনশাদের ভাবনার মাঝখানেই ইনসিয়া আবারো বললো,
–“আপনার কি কথা কানে যায় না নাকি? আমি আপনার সাথে থাকতে চাই না।”
ইনশাদ আবারো বুঝাতে প্রয়াস চালালো,
–“ইসু পাখি তোমার পা নেই বলে আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি তোমাকে নিয়েই কাটাতে পারবো সারাজীবন।”
ইনসিয়া এবার রাগান্বিত স্বরে ক্রোধ মিশিয়ে হাতে একটি ছুড়ি নিয়ে ইনশাদের দিকে চেয়ে বললো,
–“আপনি যদি না যান এখান থেকে বা কোনো রকমের যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন আমার সাথে ভবিষ্যতে তাহলে এই ছুড়ি দেখছেন তো এটা দিয়ে নিজেকে শেষ করে দিবো।”
ইনশাদ এবার ভয় পেয়ে গেলো! ইনসিয়া যে রকম করছে তাতে নিজের ক্ষতি করা অস্বাভাবিক কিছু না। ইনসিয়ার ভালো চেয়েই ওইদিন ইনশাদ হাসপাতাল থেকে চলে যায়। রাস্তায় এলোমেলো ভাবে হাঁটছে ইনশাদ মস্তিষ্কে শুধু ইনসিয়ার বলা কথা গুলোই বাজছে বারংবার! আনমনে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে তাকে পিছন থেকে একটি গাড়ি এসে পিষে দিয়ে গেলো সেটাও দেখলো না! সঙ্গে সঙ্গে তার নিথর দেহ রাস্তায় গড়াগড়ি খেলো! অনেকটা আহতো হয়েছে এবার।মানুষ ধরা ধরি করে এম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে গেলো! হাসপাতালে ডাক্তার রা ইনশাদকে চিকিৎসা করতে লাগলো! তারপর চব্বিশ ঘন্টার ভেতরে ইনশাদ কোমায় চলে গেলো! আগের আঘাত সেড়ে ওঠেনি আবারো এরকম একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে ধাক্কা সামলাতে না পেরে ইনশাদ একেবারে কোমায় চলে গেলো!
বহুদিন পর পিটপিট করে চোখ খুলছে ইনশাদ তাকিয়ে দেখলো এটা তার মাতৃভূমি নয়। মনে হচ্ছে বিদেশের কোনো স্থান এটা! কিন্তু জায়গা নির্নয় করতে পারলো না! সামনে মিতালী রহমানকে দেখতে পেয়ে জিগেস করাতেই উনি বলে ওঠলেন,
–“তোর মাথায় অনেক গুরুতর চোট পেয়েছিলিস যার ফলে কোমায় চলে গিয়েছিলি। তোর উন্নত চিকিৎসা করাতেই আমরা তোকে সিংগাপুরে নিয়ে এসেছি।”
ইনশাদ মনে করার চেষ্টা করলো সবকিছু তখনি তার মস্তিকে ইনসিয়ার প্রতিছবি দেখা দিলো। সাথে সাথে বাংলাদেশে যাবার জন ব্যস্ত হতেই মিতালী রহমান বললেন।
–“তুই এক দু দিন কোমায় ছিলি নারে? পুরো ছ’মাস কোমায় ছিলিস। আরো দু’দিন তোকে রেস্ট নিতে হবে তারপর পরশু দিন আমরা দেশে ফিরে যাবো।”
ইনশাদের আকুল মন তখন ইনসিয়া নাম রমনীতে মত্ত আছে। অপেক্ষার প্রহর গুনে ফিরে আসলো দেশে। দেশে আসতেই ইনসিয়াদের বাড়ি গেলো কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলো না ইনসিয়াকে। পাগলের মতন খুঁজে ছিলো কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। সব শেষে পরিবারের কাউকে কোনো কিছু না জানিয়েই জার্মানি চলে গেলো ইনশাদ! মিজানুর রহমান সহ সবাই জিগেস করলেই ইনশাদ বলতো বাংলাদেশে আর ভালো লাগছে না ওখানেই থাকতে চায়। ইচ্ছে হলে দেশে ফিরবে নতুবা না। যোগাযোগ ও করতো না ভালো করে কারো সাথে। এভাবে আড়াই বছর পেরিয়ে যাবার পর যখন সিদ্ধান্ত নিলো বাংলাদেশে এসে সবাইকে চমকে দিকে পুরোপুরি ভাবে তখন যেনো নিজেই চমকে গেলো সবটা দেখে!
#চলবে?
বিঃদ্রঃ ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।