#পর্ব১৩
#নতুন_ভোরের_আগমন
#অর্ষা_আওরাত
দুপুর শেষ হয়ে বিকেলের আভা ফুটে ওঠেছে চারিদিকে। রোদ্রভাব কেটে ধরনীর বুকে শান্ত আমেজ ধরা দিলো। পাখিরা গাছে গাছে বসে কিচিরমিচির আওয়াজ করে যাচ্ছে। আজানের আওয়াজ প্রতিধ্বনিতো হতে লাগলো চারিদিকে। ইনসিয়া নামাজ পড়া শেষ করে মাথার ঘোমটা খানি ভালো মতন টেনে দিয়ে হাসপালের ছাঁদে ওঠলো! ওখানে ইনশাদের সামনে থাকতে থাকতে যেনো তার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। ছাঁদে ওঠে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে এক স্বস্তির নিশ্বাস নিলো ইনসিয়া! তারপর কিঞ্চিৎ সময় অতিবাহিত হলো সে প্রখর দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে ছাঁদ থেকে দূরের একটি গাছের মধ্যে দু’টো পাখি কিভাবে বসে রয়েছে। তার দৃষ্টি এখন সেখানেই প্রখর ভাবে নিপাত করছে। হঠাৎই পাখি দু’টো উড়ে গেলো খোলা মুক্ত আকাশে। ইনসিয়া সেদিক পানে তাকিয়ে রইলো অপলক ভাবে। তারপর একটু একটু করে অসীম আকাশে পাখিগুলো হারিয়ে গেলো। ইনসিয়া উল্টো দিকে ঘুরে বিশাল নদীর বুকে বয়ে চলা ট্রলার গুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো এক ধ্যানে।
–“পালিয়ে বেড়াচ্ছো আমার থেকে ইসু পাখি?”
হঠাৎই কারো ডাক শুনে বিস্মিত নয়নে তাকালো ইনসিয়া! কন্ঠস্বর বহু পরিচিতো মানুষের ঠেকলো! মানুষটিকে চিহ্নিত করতে পেরে কম্পন ধরা দিলো হৃদমাঝারে! ওষ্ঠদ্বয় কেঁপে ওঠছে বারংবার! ভয় গ্রাস করে ফেলেছে মনের অন্তঃপুরী। কি বলবে বলার ভাষা হারিয়ে ফেলছে বারংবার! আবারো সেই প্রশ্ন করে তুললো!
–“পালিয়ে বেড়াচ্ছো বারংবার আমার থেকে? নাকি দূরে ঠেলে দিচ্ছো ভয়ংকর অতীতের মতন আবারো?”
ইনসিয়া যেনো কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। হাত কাপঁছে থরথর করে। কি জবাব দিবে সে? কোনো উওর নেই তার কাছে! মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে! সঙ্গে সঙ্গে রিহান আবারো তার প্রশ্নের ঝুড়ি নিয়ে বসলো,
–“সে’দিন কোনো দোষই ছিলো না আমার। তুমি নিজের হীনমন্যতার কারনে দূরে ঠেলে দিয়েছিলে। ভেবেছিলে আমি হয়তো তোমার সাথে থাকতে পারবো না। কতো কথাই না বলেছিলে?”
ইনসিয়া চুপচাপ নির্বাক হয়ে সবকিছু দাঁড়িয়ে শুনছে। ইনশাদের কথায় অতীতের তিক্ত স্মৃতি গুলো সামনে ভেসে ওঠছে বারংবার! ডুব দিলো ভাবনার গভীর অতলে!
___________________________________
ইনসিয়া যখন কলেজে উঠেছে সবে সবে তখনই সেই কলেজে সিনিয়র স্টুডেন্ট ছিলো ইনশাদ। তখন ও ইনসিয়া সুস্থ স্বাভাবিক ছিলো আর পাঁচটা মেয়ের মতন। একদিন কলেজে বৃষ্টির সময় পা পিছলে মাঠে পড়ে যায় ইনসিয়া! আর পুরো কলেজের স্টুডেন্ট মিলে তার উপর হাসে। কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি সেদিন একমাত্র ইনশাদই সাহায্য করতে এসেছিলো ইনসিয়াকে। তারপরে আস্তে আস্তে বন্ধুত্ব হতে থাকে দু’জনের। বন্ধুত্ব একদিন গভীর প্রণয়ের রুপ নিলো কিন্তু সেই প্রণয়ের কথা কেউ কাউকে বলার সুযোগ পায়নি। সেই প্রণয়ের কথাই প্রকাশ করার জন্য একদিন ইনশাদ ইনসিয়াকে ফোন করলো, ইনসিয়া প্রথমে সালাম দিলো। ইনশাদ সালামের জবাব নিয়ে বললো,
–“কিছু কথা ছিলো যেগুলো তোমাকে কলেজে বলতে পারিনি। কিন্তু অতীব প্রয়োজনীয় কথাগুলো। সময় থাকতে আমি তোমাকে আমার মনের সুপ্ত কুঠিরে লুকিয়ে রাখা অব্যক্ত অনুভুতি গুলো প্রকাশ করতে চাই। তুমি কি শুনবে আমার কথাগুলো?”
সেই মুহুর্তেই থম মেরে বসে পড়ে ইনসিয়া। ফোনটা কেটে দিলো ইচ্ছে করে। লজ্জায় নিজেকে দেখেই আবার মুখ লুকাচ্ছে! ইনশাদের কথায় তখন সে নিজেও বুঝতে পেরেছে ইনশাদ হয়তো তাকে তার মনের কথাগুলো বলে দিবে। সে একই অনুভুতি যে ইনসিয়ারও হতো ইনশাদের জন্য মনের গভীরে। কাল বিলম্ব না করে মুঠোফোনে মেসেজ করে দিলো সে আসবে ইনশাদের কথা শুনতে।
ইনশাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য আলাদা করে নিজেকে সাজ সজ্জায় সজ্জিত করলো। পরনে তার সাদা রঙের শুভ্র একটি শাড়ি তার সাথে ম্যাচ করে গহনা আর একটু মেক-আপ এর আস্তরন করেছে মুখশ্রীতে। সব মিলিয়ে ইনসিয়াকে একটি শুভ্র পরী বললেও ভূল হতো না। ইনসিয়া গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে প্রায় ঘন্টাখানেক এর মতন দেরি হয়ে গেলো। ওদিকে ইনশাদ নীল রঙের একটি পাঞ্জাবি পড়ে অপেক্ষা করছে ইনসিয়ার জন্য। বিকেল চারটা বাজে আসতে বলেছিলো প্রায় ছয়টা বেজে যাচ্ছে এখনো ইনসিয়া আসছে না দেখে এগিয়ে দেখতে গেলো। রাসাতায় ফুটপাতে দাঁড়াতেই ইনসিয়াকে দেখতে পেলো! ওখানেই দাঁড়িয়ে থেকে এক পলক চোখ বুলালো সাদা রঙের শুভ্র পরীর দিকে। ইনসিয়াও তার প্রিয়কে দেখতে ব্যস্ত। অতিরিক্ত গাড়ি জন্য ইনসিয়া রাস্তা পারাপার করতে পারছে না বিধায় সে রাস্তার অপর পাশের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
হঠাৎই ইনশাদ ফোন করে বললো,
–“দেখে শুনে রাস্তা পার হয়ে তারপর আসবে। রাস্তায় অনেক গাড়ি চলছে সাবধানে আসবে।”
অপেক্ষার তর সইতে পারলো না ইনসিয়া ইনশাদের কথা শুনবে বলে এতোই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো যে রাস্তায় গাড়ি চলছে তাও রাস্তা পার হতে গেলো! আচমকা বিপরিতগামী একটি বড়ো মালবাহী ট্রাক এসে ইনসিয়াকে ধাক্কা মেরে দিলো! ইনসিয়া ট্রকটিকে খেয়াল না করলেও ইনশাদ ঠিকই খেয়াল করেছিলো বিধায় ইনসিয়াকে আঘাত করবার আগেই ইনশাদ ইনসিয়াকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো! কিন্তু ধাক্কা দেওয়ার ফলে ট্রাকের পরেও অন্য একটি গাড়ি এসে ইনসিয়ার পা দু’টোকে পিষে দেয়! ইনসিয়ার মাথাটা ছিলো ফুটপাতের দিকে আর পায়ের অংশ ছিলো মেইন রাস্তায় যার ফলে গাড়ি এসে ইনসিয়ার পা দু’টোকে পিষে দিয়ে চলে যায়। ওদিকে ইনশাদ ইনসিয়াকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেই যখম হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে! তবুও ইনশাদ ফুটপাতে যখন রক্তাক্ত অবস্থায় ইনসিয়াকে দেখতে পেলো নিজের আঘাতের কথা ভুলে গিয়ে ইনসিয়াকে ডাকতে লাগলো,
–“ইসু পাখি ওঠো বলছি? আমার না বলা কথাগুলো বলি শুনবে না তুমি?”
ইনসিয়া আধো আধো চোখ খুলে ইনশাদের দিকে তাকালো। চেহারায় রক্তে পরিপূর্ন। চেনাই যাচ্ছে না ইনসিয়াকে! অস্ফুট স্বরে বলে ওঠলো,
–“আমি মরেও শান্তি পাবো না যদি না আপনার মুখ থেকে না বলা কথাটি শুনি।”
ইনশাদ এক মুহুর্তও দেরি করলো না। ইনসিয়ার জন্য আনা গোলাপটি রাস্তায় গড়াগড়ি করছে সেখান থেকেই একটি গোলাপ ইনসিয়ার দিকে ধরে বলে দিলো,
—“ভালোবাসি ইনসিয়া! মনের গহীন থেকে বলছি ভালোবাসি আমি আমার ইসু পাখিকে। তার সঙ্গে সারাটা জীবন থাকতে চাই। মরতেও রাজি যদি সে বলে। শুধু ইসু পাখি যেনো আমাকে ছেড়ে না যায়। সে যদি চলে যায় আমিও থাকবো না আর।”
ইনসিয়া এতো আঘাতের মধ্যে হাসলো। যেনো তার এখন মরেও শান্তি। ইনসিয়া বললো,
–“এবার আমার মরেও শান্তি। আর কোনো আফসোস থাকবে না যদি মরে যাই আমি। আমিও আপনাকে অনে–
আর কিছু বলতে পারলো না তার আগেই জ্ঞান হারালো ইনসিয়া ইনশাদ দু’জনেই। রাস্তায় উৎসুক জনতা তাদের দিকে চেয়ে আছে। এম্বুলেন্সে খবর দিতেই এম্বুলেন্স এসে দু’জনকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়।
দু’দিন পর ভালোভাবে জ্ঞান ফিরে ইনসিয়ার! বসতে গিয়ে চেষ্টা করে দেখে তার একটি পা নেই! বিস্ময় নিয়ে বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো কিঞ্চিৎ প্রহর! প্রশ্নবিদ্ধ চেহারা নিয়ে সবাইর দিকে তাকিয়ে আছে। বাক শক্তি যেনো কাজ করছে না! এতোটাই শক্ড হয়েছে! মস্তিষ্ক মানতে পারছে না! তারপর তার ভাই বললো,
–“তোর পায়ে অনেকক্ষানি আঘাত লেগেছিলো বোন যার ফলে তোর একটি পা কেটে ফেলতে হয়।”
ব্যস ইনসিয়ার এই কয়েক বর্নের সম্মিলিত কথাটি শুনে যেনো পায়ের নিচে ভূমন্ডল কম্পিত হলো! সাথে সাথে গাল বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়লো দু গাল বেয়ে! মানতে পারছে না তার শরীরের একটি অতীব জরুরি অঙ্গই নেই তার সাথে! কয়েক প্রহর নিস্তব্ধ ভাবে রইলো কোনো কথা না বলে! তারপর ইনশাদ এলো দেখা করতে। ইনশাদকে দেখে আরো বিস্ময়ের পর্যায়ে চলে গেলো ইনসিয়া!
#চলবে?
বিঃদ্রঃ ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।