#পর্ব১২
#নতুন_ভোরের_আগমন
#অর্ষা_আওরাত
সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেছে। চারিদিকে সুর্য্য তার প্রখর উওাপ ছড়িয়ে দিচ্ছে! চক্ষু মেলে উপরের দিকে দৃষ্টিপাত করা যাচ্ছে না চোখ যেনো ঝলসে যাচ্ছে প্রখর রৌদ্রে। ইনসিয়া চোখ জোড়া মেলে ইনশাদের দিকে তাকাতে পারছে না! নতজানু হয়ে রয়েছে ইনশাদের সামনে। ইনশাদ ইনসিয়ার দিকে গভীর ভাবে দৃষ্টিপাত করে আছে। সময়ের স্রোতে স্রোতে মানুষটির মধ্যেও কেমন পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেলো। আগের মতন মুখশ্রীতে মায়া মায়া ভাবটা নেই। চেহারায় মলিনতার ছাপ। চক্ষু জোড়া কেমন গর্তের ভিতর ঢুকে জানান দিচ্ছে মেয়েটি ঘুমোয় না রাত্রে ভালো করে। চুলগুলোও কেমন উষ্কখুষ্ক ভাব ধারন করেছে। সবমিলিয়ে যেনো শ্যামবর্নের মায়াবতী মেয়েটি আর এখন নেই। সেই শ্যামবর্নের মেয়েটি মুখশ্রীতে চিন্তার আভাস। মেয়েটির দিকে দৃষ্টিপাত সরিয়ে কিয়ৎক্ষন আগে মেয়েটির বলা কথা কর্নকুহুরে নিলো! মস্তিষ্কে বাজতে লাগলো একটি কথা “আমার শশুর মশাই হাসপাতালে ভর্তি আছে তাকে দেখতে আসছি” ইনশাদের বুঝতে বেগ পেতে হলো না আর ইনসিয়ার বিয়ে হয়ে গেছে! কিছু অক্ষরের সম্মেলিত কথাটি তার মনে অস্থিরতার প্রভাব ফেলছে! মস্তিষ্কে ঘূর্নয়মান লাগছে বাক্যটি শুনে! কথাটি যেনো তার হৃদয়স্থল মেনে নিতে পারছে না! বিশ্বাস করতে পারছে না যে প্রিয়সীর জন্য এতোকাল সময় অতিবাহিত করছে সেই প্রিয়সীই আজ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অন্য কারো বউ হয়ে। চোখ থেকে নোনা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো দু গাল বেয়ে । সঙ্গে সঙ্গে অশ্রু হস্ত দাড়া মুছে নিলো। অস্ফুট স্বরে বলে ওঠলো,
–“তোমার বিয়ে হয়ে গেছে ইসু পাখি?”
ইনসিয়ার চোখে অশ্রু জলজল করছে পাপড়ি ফেললেই টুপ করে অশ্রু কনা গড়িয়ে পড়বে গাল বেয়ে। লজ্জায় ভয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইনসিয়া কিছু বলবে ঠিক সেই মুহুর্তেই সেখানে রিহান উপস্থিত হলো! রিহানকে দেখে ইনসিয়া হতভম্ব হয়ে গেলো! তাহলে কি রিহান সব শুনে ফেললো ওদের কথা? মনের মধ্যে এক অজানা ভয় গ্রাস করে চলেছে ইনসিয়াকে। রিহানের ইনশাদকে দেখে কিয়ৎক্ষন চেয়ে থাকলো। ভাবতে থাকলো দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি কি আসলেই আছে নাকি তার ভ্রম সবটা? কিছুক্ষণ ভাবার পরে মস্তিষ্ক জানান দিলো এটা তার ভ্রম নয় মানুষটি সত্যি ই এসেছে! রিহানের ইনশাদকে দেখতে পেয়ে চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক ফুটে ওঠলো। সঙ্গে সঙ্গে ইনশাদকে তার বাহু জড়িয়ে পরম আবেশে আলিঙ্গন করলো।
–“তুই এখানে এই সময়? আমি তো ভাবতেই পারিনি তুই আসবি এখানে? কিছু সময়ের জন্য মনে হয়েছিলো এটা ভ্রম আমার। তারপর ভালো করে দেখে বুঝলাম এটা ভ্রম নয় তুই সত্যিই এসেছিস।”
ইনসিয়া ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিপাত করে আছে দু’জনের দিকে! রিহানের বলা কথা গুলো কিছুতেই তার বোধগম্য হচ্ছে না! তবে এটুকু বুঝতে পারছে তারা চেনা পরিচিতো। ইনসিয়ার তাদের প্রতি গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করলো। কিন্তু সে দৃষ্টি বেশিক্ষন স্থায়ী করতে পারলো না। ইনশাদ রিহানকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠলো,
–“ভ্রম নারে রিহান আমি সত্যিই এসেছি। ভেবেছিলাম তোদের সবাইকে চমকে দিবো আচমকা এসে। কিন্তু এসে যে আমি নিজেই এতোটা চমকে যাবো সেটা ভাবিনি রে একবারো।”
ইনসিয়ার বুঝতে বেগ পেতে হলো না শেষের কথাটি তাকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে। লজ্জায় নতজানু হয়ে ইনশাদের বলা সকল কথাগুলো শুনে যাচ্ছে। ইনশাদ বলে ওঠলো,
–“হ্যাঁ আমরা কেউই আশা করিনি তুই এতো তাড়াতাড়ি ফিরে আসবি ইনশাদ। যাক এসেছিস যখন ভালোই হয়েছে। বাড়িতে নিশ্চয়ই করিম চাচার থেকে সবটা শুনে এখানে এসেছিস?”
–“হ্যাঁরে বাড়িতে গিয়ে দেখলাম তোরা কেউই ছিলিস না তখন করিম চাচা সব বললো তারপরই হাসপাতালে এসেছি। বড়ো বাবা কেমন আছে এখন?”
–“বাবা কে ভিতরে রাখা হয়েছে ডাক্তার বেরোয়নি এখনো। আমি এসেছিলাম মায়ের জন্য কিছু ওষুধ কিনতে এসে দেখি তুই এখানে ইনসিয়ার সাথে দাঁড়িয়ে রয়েছিস। তুই ভিতরে যা আমি ভিতরে গিয়ে সবার সাথে কথা বল। এই দুর্দশার সময়ে তোকে দেখলে মা খুশি হবে অনেকটা। আর ইনসিয়া তুমিও ভিতরে যাও এভাবে রাস্তাঘাটে একলা একলা দাঁড়িয়ে থাকা শোভা পায় না।”
ইনশাদ সন্দেহের চোখে ইনসিয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করলো। ইনসিয়া আগের ন্যায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে এখনো। বুঝতে বাকি রইলো না ইনসিয়ার তখন বলা কথাগুলো আর রিহানের ইনসিয়ার এভাবে বলার মানে কি দাঁড়াতে পারে। মনের কৌতুহল মিটাতে রিহানকে একপ্রকার প্রশ্ন করলো ইনশাদ।
–“রিহান মেয়েটি কে হয় তোর?”
ইনসিয়া প্রস্তুত ছিলো না ইনশাদের প্রশ্নে। বিস্ময় নিয়ে রিহানের দিকে করুন দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করলো। বোধগম্য হচ্ছে না রিহান কি বলবে ইনশাদকে এখন? তাদের বিয়েটাতো আর চিরস্থায়ী নয়। ক্ষনস্থায়ী সময়ের জন্য। ইনসিয়ার ভাবার মাঝেই রিহান উওর দিলো,
–“ইনসিয়া আমার বউ হয়। তুই ভিতরে যা আমি মায়ের জন্য ওষুধ আনতে যাচ্ছি।”
চার অক্ষরের বলা শব্দ গুলো ইনশাদের কর্নকুহরে বজ্রপাতের ন্যায় আঘাত আনলো মস্তিষ্কে ! কথাটি শোনা মাত্র ভূমন্ডল কম্পিত হলো যেনো! ইনসিয়ার বিয়ে হয়ে গেছে এটাই মানতে কষ্ট হচ্ছে যেখানে সেখানে কিনা রিহান মানে তার ভাইয়েরই বউ ইনসিয়া! আর কিছু ভাবতে পারলো না তার আগেই রিহান বলে ওঠলো,
–“তুই আমার ব্যাপারে জানিস না এমন কোনো কথাই নেই। এই বিয়েটা আর ক’দিনের মাত্র। সবটা তোকে বলবো বাড়িতে গেলে।”
রিহানের কথার আগামাথা কিছুই বুঝলো না ইনশাদ! ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো ইনসিয়ার দিকে। রিহানের কথায় ইনসিয়ার কোনো ভ্রুক্ষেপ হলো না! সে জানতো রিহান এটাই বলবে। কারন এটাই যে চরম সত্যি। আরো কোনো কিছু না ভেবে চিন্তে ভেতরে চলে গেলো ইনশাদ। ইনশাদ হাসপাতালের ভিতরে প্রবেশ করলো। সবাই সিটে বসে আছে শুধুমাত্র তার বড়ো মা কেবিনের দরজায় হেলান দিয়ে কাঁদছে! ইনশাদ মিতালী রহমানকে বড়ো মা বলে ডাক দিলো!
উপস্থিত সবাই রিহানের মতন অবাক হয়ে আছে ইনশাদকে দেখে। ইনশাদের যে পরিস্থিতি ছিলো তাতে কেউই আশা করে নি যে ইনশাদ আবারো ফিরে আসবে তাদের মাঝে। বড়ো মা পিছন ফিরে ইনশাদকে দেখে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো যেনো ইনশাদকে দেখার আনন্দ আর স্বামীর অসুস্থতা দু’টো মিলিয়েই এই কান্না! ইনশাদ তার হাত দিয়ে আলতো পরশে মিতালী রহমান এর গাল বেয়ে পড়া অশ্রু কনা মুছে দিলো। অতি আবেশ মাখা মধুর কন্ঠে বললো,
–“বড়ো’মা তুমি এভাবে কেঁদো না দয়া করে তুমি যদি এভাবে কাঁদো তাহলে আমার কি রকম লাগে বলতো? এতোবছর পর ফিরে এসেছি কি এভাবে কান্না দেখার জন্য? বড়ো আব্বুর কিছু হবে না। এটা আমি নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি বুঝলে? দেখো একটু পরেই ডাক্তার এসে বলবে আব্বু একদম ঠিক হয়ে গেছে।”
মিতালী রহমান কাঁদতে কাঁদতে বললো “তোর মুখের কথাখানিই যেনো সত্যি হয় রে।”
তাদের বাক্য বিনিময়ের মাঝখানেই ডাক্তার দরজা ঠেলে বাইরে আসলেন। ডাক্তার আসতেই সবাই হুমড়ি খেয়ে ডাক্তারকে ধরলো মিজানুর রহমানের কথা জিগেস করতে।
–“রোগী কোনো কিছু নিয়ে গভীর চিন্তা ভাবনায় ছিলেন যার ফলে তার মানসিক প্রেশার বেড়ে যায় এবং তার ফলেই ওনার হার্ট অ্যাটাক হয়। তবে এখন আর ভয়ের কারন নেই ওনি এখন বিপদমুক্ত আছে। আজকের দিনটা হাসপাতালে থাকুক কাল বিকেলে ওনাকে ডিসচার্জ করে দেওয়া হবে। আপাততো কিছু ওষুধ লিখে দিচ্ছি ওগুলোই ক’দিন খাওয়াবেন। খেয়াল রাখবেন ওনি যাতে কোনোকিছু নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা না করেন।”
ডাক্তারের বলা কথাগুলো শুনে উপস্থিত সকল ব্যাক্তিদের মুখে হাসির রেখা ফুটে ওঠে। সকলের মন থেকে ভয়ের রেশ কেটে যায়। ডাক্তারের কথার পৃষ্ঠে মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ নামক সম্মতি জানায় সবাই। মিতালী রহমান প্রশান্তির শ্বাস ফেলেন। ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিলেন সিটে। চোখ বুজে রইলো কিছু সময়। একে একে রিহানের কাকা, কাকী, দাদী সবাই মিলে প্রশ্নের ঝুড়ি মেলে ধরলো ইনশাদের দিকে! কিন্তু ইনশাদের চোখ আটকে আছে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ইনসিয়ার দিকে!
#চলবে?
#বিঃদ্রঃ ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।