ধোঁয়াশার মেঘ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব

0
6

#ধোঁয়াশার_মেঘ
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ১১(অন্তিম পর্ব)

সোহা আরহামকে টেনে নিয়ে গিলো। তুরাব মিহিকাকে ছেড়ে ওর হাত ধরে এগিয়ে গেল। ছাদের কাণিশে দাঁড়াতেই হাজারো রঙের লাইট জ্বলতে থাকা বেলুন আকাশে উড়তে শুরু করলো। মিহিকা অবাক নয়নে দেখতে লাগলো। তুরাব হেসে মিহিকার দিকে ঝুকে ওর কানে ফিসফিসিয়ে বলল,
“আই লাভ ইউ মাই লাভ”

মিহিকা চোখ বুজে নিলো। সুখ সুখ অনুভব হচ্ছে তার খুব। মিহিকা মিষ্টি করে হেসে রেলিং এ রাখা তুরাবের হাতে হাত রেখে বলল,
“আমি আমার বিবাহিত একমাত্র স্বামীকে আজীবনের জন্য পাশে চাই। থাকবেন তো আমার পাশে!”

তুরাব মুচকি হেসে বলল,
“পাশে থাকার জন্যেই তো এতকিছু করা।”

দুইজনই হাসলো। তুরাব ধোঁয়াশায় ছিলো মিহিকা কেমন প্রতিক্রিয়া করবে তা নিয়ে। কিন্তু হুট করেই সব যে মিহিকা মেনে নিবে ভাবেনি তুরাব।

দুইজনকে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হাসতে দেখে দূরে দাঁড়িয়ে হাসলো আরহাম, সোহা আর রহিমা খালা। আরহাম রহিমা খালার দিকে তাকিয়ে বলল,
“খালা সকালে ওনারা আসবেন তো।”

রহিমা খালা হেসে বললেন,
“আরে আরহাম বাবা তুমি একদম চিন্তা করোনা। তুরাব বাবাকে নিজের ছেলের মতো আগলে রেখেছি সবসময়। আর ছেলের সমস্যা মানেই আমার সমস্যা। দেখবে সকালে নতুন বছর আরো বেশি সুন্দর হবে।”

আরহাম হেসে বলল,
“ধন্যবাদ খালা মিহিকাকে বোঝানোর জন্য।”

রহিমা খালা হাসিমুখেই বললেন,
“বোঝানোর কিছু নেই। মেয়েটা আসলে নিজেই বুঝতে পারছিলো না। আর জানো তো মতের বিরুদ্ধে কিছুই করা যায় না।”

—————

তুরাব মিহিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তা বলছি কি মেঘনন্দিনী তোমাকে আজকে অনেক সুন্দর লাগছে।”

মিহিকা আতশবাজি দেখতে ব্যস্ত ছিলো। মিহিকা সে ধ্যানে থেকেই বলল,
“আপনাকেও।”

তুরাব চোখ বড় বড় করে বলল,
“কিহ বললে মেঘনন্দিনী?”

তুরাবের জোরে বলা কথায় হুশ হতো মিহিকার। মিহিকা দাঁত দিয়ে জিভ কাটলো। তুরাব চোখ ছোট ছোট করে মিহিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার দিকে নজর দিচ্ছো?”

মিহিকা ভ্রুকুচকে বলল,
“নজর দেওয়ার কি আছে হ্যাঁ। আপনিই তো হা হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। তখন তো আমি কিছু বলিনা। ওইদিন সকালে যে আমার পাশে শুয়ে আমার দিকে হা হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। আমি কি এই নিয়ে আপনাকে কিছু বলেছি।”

তুরাব কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
“ওই ওই ওয়েট, তুমি তার মানে জেগে ছিলে তখন!”

মিহিকা আমতা আমতা করতে বলল,
“একটা মানুষ কতক্ষন ঘুমাতে পারে। এখানে আনার পর থেকে আমাকে খালি ঘুমাতে বলছেন।”

তুরাব অবাক হয়ে বলল,
“এই আমি কখন বললাম ঘুমাতে। আমি তো তোমার সাথে বাসর দিনই করতে চেয়েছিলাম।”

মিহিকা কান গরম হয়ে গেল। তুরাবের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনি এতো ঠোঁট কাটা কেন?”

তুরাব মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“খালি বলছি তাই এমন করছো, কিছু তো করিই নি।”

মিহিকা আমতা আমতা করে বলল,
“আমার ঠান্ডা লাগছে আমি নিচে যাবো।”

তুরাব হুট করেই মিহিকাকে কোলে তুলে নিলো। মিহিকা হতবাক হয়ে বলল,
“একি কি করছেন আপনি?”

তুরাব মিহিকার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমিই তো বললে রুমে যাবে!”

মিহিকা ছটফট করতে করতে বলল,
“তো এভাবে কোলে নিলেন কেন?”

তুরাব হাঁটতে হাঁটতে বলল,
“তোমাকে রুমে নিয়ে যাবো তাই।”

মিহিকা তুরাবের বুকের কাছের শার্ট খামচে ধরে বলল,
“আমাকে নামিয়ে দিন। আমি নিজে পায়ে হেঁটে যেতে পারবো।”

তুরাব ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,
“না তো আজ কোনো ছাড়াছাড়ি নেই। আজ তুমি কিছুতেই আমার বাসর করা থেকে আটকাতে পারবেনা।”

মিহিকা চোখ গোল গোল করে বলল,
“মানে!”

তুরাব টুক করে মিহিকার গালে একখানা চুমু বসিয়ে বলল,
“মানেটাতো রুমে গিয়েই বুঝতে পারবে।”

তুরাব নিজের রুমে এসে পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে দরজাটা আটকে দিলো। ডিম লাইটের আলোতে মিহিকার মুখটা বেশ মায়াবী লাগছে। তুরাব মিহিকাকে বিছানায় শুয়ে দিয়ে মিহিকার চোখে চোখ রাখলো। মিহিকা কিছু বলতে নিবে তার আগেই তুরাব ডানহাতের তর্জনী মিহিকার ঠোঁটে রেখে বলল,
“হুস আর কোনো কথা হবে না। নতুন বছরের প্রথম প্রহরে তুমি শুধু অনুভব করবে ধোঁয়াশার মেঘের মাঝে এক ঝলক ভালোবাসার সূক্ষ রোদের ঝিলিক।”

———————

সকালের তুরাবের ঘুম ভাঙতেই চোখ খুলল সে। সামনেই মিহিকার ঘুমন্ত মুখ ভেসে উঠতেই হাসলো সে। মিহিকার কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো আলতো স্পর্শে সরিয়ে দিয়ে কম্বল ঠিক করে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আবারো চোখ বুজলো তুরাব। ঠোঁটে তার প্রশান্তির হাসি।

মিহিকা চোখ পিটপিট করে তাকাতেই তুরাব বলে উঠলো,
“গুডমর্নিং মেঘনন্দিনী।”

মিহিকা আলতো হাসলো। তুরাব দুষ্টামি হাসি দিয়ে বলল,
“ভাবছি শশুর মশাইয়ের সামনে কিছু আন্ডাবাচ্চা নিয়ে হাজির হবো। উনি ওদের মুখের দিকে তাকিয়েই আমাদের ঠিক মেনে নিবে। কি বলো বউ?”

মিহিকা কিছুক্ষন কপাল কুচকে তুরাবের দিকে তাকিয়ে থাকলেও পরমুহূর্তেই বিষয়টা বুঝতে পেরে তুরাবের বুকে কয়েকটা কিল বসিয়ে দিলো। তুরাব হাসতে লাগলো হো হো করে। তখনি দরজায় টোকা পরলো। তুরাব ভ্রুকুচকে বলল,
“কে?”

রহিমা খালা ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে উঠলেন,
“তুরাব বাবা উঠো তোমার শশুরবাড়ি থেকে লোকজন এসেছে।”

তুরাবের কুচকে যাওয়া কপাল আরো বেশি কুচকে গেল। মিহিকা শুনেও অবাক। তুরাব বলে উঠলো,
“সকাল সকাল মজা করেন না তো খালা।”

রহিমা খালা আলতো হেসে বললেন,
“আমি মজা করছিনা। খানসাহেব সোফার রুমে বসে আছে তার স্ত্রী আর ছেলেকে নিয়ে।”

তুরাব ঝট করে উঠে পরলো। ওয়াশরুমে গেল ফ্রেশ হতে। ঘড়িতে সকাল নয়টা। যদিও ফজরের সময় দুইজন মিলে উঠে নামাজ আদায় করে প্রার্থনা করেছে নিজেদের নতুন জীবন যেন ভালোমতো কাটে। তুরাব ফ্রেশ হয়ে এসে বলল,
“আমি বললে তুমি বের হবে।”

মিহিকা মাথা নাড়ালো। তুরাব বের হয়ে সোফার রুমে এলো। সত্যিই আরিফুল সাহেব, হেনা খান আর মিহির এসেছে। তুরাব মিহিরের দিকে ইশারা করতেই সে হাসলো। তুরাব কিছুই বুঝতে পারলো না।

আরিফুল সাহেব মুচকি হেসে বললেন,
“আরে জামাইবাবা জীবন আসো বসো।”

তুরাব হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আরিফুল সাহেবের দিকে। হা হয়ে বলল,
“একি আপনি আমার সাথে এমন করে কথা বলছেন!”

আরিফুল সাহেব এগিয়ে এসে তুরাবের পিঠে হাত রেখে বললেন,
“আমাকে ক্ষমা করে দিও বাবা। আমি বুঝতে পারিনি যে আমার মেয়েও তোমাকে চায়।”

তুরাব কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
“মানে!”

তখনি রুমে আরহাম প্রবেশ করতে করতে বলল,
“মানে আর কি বিয়ে যখন হয়েই গেছে। আর মিহিকাও তোকে চায়। সেখানে ওনাদের আর কি বলার থাকে। তাই ওনারা তোদের মেনে নিচ্ছেন।”

আরিফুল সাহেবও আরহামের কথায় সম্মতি দিয়ে বললেন,
“হুম বাবা আমি তখন বুঝতে পারিনি তুমিই আমার মেয়ের জন্য ঠিক। আর তুমি যদি আমার মেয়েকে ভালোই না বাসতা তাহলে এতো কষ্ট করে এতটা অপেক্ষা করে এতো ভালো চাকরি করতে না।”

তুরাব হাসলো। মনে মনে বলল,
“বেকার থাকলে জীবনেও এই বুইড়া খাটাশ আমারে মাইনা নিতো না।”

আরিফুল সাহেব কপাল কুচকে বললেন,
“কিছু কি বললে বাবা?”

তুরাব হেসে বলল,
“না না আসলে বলতে চাইছি কি এতো তাড়াতাড়ি সুমতি ফেরার আসল রহস্য কি?”

আরহাম হেসে বলল,
“আসল রহস্য রহিমা খালা। উনিই ওই বাসায় গিয়ে সবাইকে বুঝিয়েছেন।”

তুরাব আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
“খালা কোথায়?”

রহিমা খালা মিহিকার সাথে রুমে এলো। তুরাব ছুটে গেল ওনার কাছে। ওনার দুইহাত নিজের হাতের মাঝে ধরে বলল,
“খালা আমি কি আপনাকে এখন থেকে মা ডাকতে পারি।”

রহিমা খালা থমকে গেলেন। তার নিজের কোনো সন্তান নেই বলে তার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গেছে। এইতো ছয় বছর হলো ছেলেকে নিজের সন্তানের মতো ছেলেকে আদর যত্ন করছে। রহিমা খালা ভাঙা গলায় বললেন,
“তুমি ডাকলে আমি খুশিই হবো, কিন্তু।”

তুরাব মুচকি হেসে বলল,
“কোনো কিন্তু না মা।”

রহিমা খালার ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠলো। মিহিকা এগিয়ে আসতেই ওর বাবা মা ওকে জড়িয়ে ধরলো। মিহিকা কান্না করে দিলো। মিহিকা কান্নামাখা কন্ঠেই বলল,
“বাবা আমি ওনাকে ভালোবাসি। ওনাকে তোমরা মেনে নেও প্লীজ। উনি আমার অনেক খেয়াল রাখেন। আমি ওনার কাছেই ভালো থাকবো বাবা।”

আরিফুল সাহেব মিহিকার মাথায় হাত বুলিয়ে ইশারায় তুরাবকে কাছে ডাকলেন। তুরাব এগিয়ে গেল। তুরাবের হাতে মিহিকার হাত রেখে আরিফুল সাহেব বললেন,
“সারাজীবন আমার মেয়েটাকে দেখে রেখো বাবা। আর কোনোদিন যদি মনে হয় আমার মেয়েকে তোমার দরকার নেই বা ভালো লাগছে না। ওর সাথে খারাপ ব্যবহার না করে আমার বাড়িতে দিয়ে আসবে। আমার মেয়ের জন্য আমার বাড়ির দরজা সবসময় খোলা থাকবে।”

তুরাব মিহিকার হাত শক্ত করে ধরে ওর চোখে চোখ রেখে বলল,
“এই দেহে জান আছে যতক্ষণ আমি মিহিকার জন্য ততোক্ষণ। ওকে রেখে আসার মতো প্রয়োজন আমার কখনোই হবেনা ইনশাআল্লাহ।”

সবাই প্রশান্তির হাসি দিলো।

#সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে