#ধোঁয়াশার_মেঘ
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ১০
তুরাব রুমের সামনে এসে দেখলো রহিমা খালা আর মিহিকা কথা বলছে। তুরাব বিড়বিড়িয়ে বলল,
“এহ খালার সাথে কত হেসে হেসে কথা বলছে। আর আমার সাথে কথা বলার সময় খালি খ্যাক খ্যাক করে।”
তুরাব পকেট হাতরে ফোন বের করে রহিমা খালার ফোনে কল দিলো। রহিমা খালা ফোন ধরতেই তুরাব গমগমে গলায় বলল,
“খালা একটু আমার রুমে আসেন তো।”
রহিমা খালা তুরাবের কথা মতো মিহিকার রুম ছেড়ে তুরাবের রুমে গেলেন। তুরাব দাঁড়িয়ে ছিলো নিজের রুমের জানালার পাশে। রহিমা খালা আসতেই একটা শপিং ব্যাগ রহিমা খালার হাতে ধরিয়ে দিয়ে তুরাব তাড়া নিয়ে বলল,
“এটা মিহিকাকে পড়িয়ে ছাদে নিয়ে আসবেন রাতের ডিনার শেষে।”
রহিমা খালা মাথা নাড়িয়ে চলে গেলেন। তুরাব ব্যস্ত হয়ে পড়লো নিজের কাজে।
——————-
রাতের খাবারের সাথে রহিমা খালা একটা শপিং ব্যাগ নিয়ে প্রবেশ করলেন মিহিকার রুমে। মিহিকা চুপ করে বসে ছিলো। রহিমা খালা আসতেই আলতো করে হাসি দিলো সে। রহিমা খালা টেবিলের উপর রাতের খাবার রেখে বললেন,
“তোমাকে এই জামা পড়ে তুরাব বাবা ছাদে যেতে বলল।”
মিহিকার কপালে ভাঁজ পড়লো। এই ঠান্ডার মাঝে রাতের বেলা সে ছাদে গিয়ে কি করবে এটাই বুঝতে পারলো না সে। রহিমা খালার এগিয়ে দেওয়া ব্যাগের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কেন যেতে বলছেন?”
রহিমা খালা মিটমিটিয়ে হেসে বললেন,
“তা তোমার স্বামীই ভালো জানে। আমি কেমনে বলবো বলো।”
মিহিকা নিজ মনে বিড়বিড়ালো,
“ছাদে নিয়ে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে আবার ফেলে দিবে নাকি!”
পরমুহূর্তেই বলে উঠলো,
“না না যাবো না আমি।”
রহিমা খালা ভ্রুকুচকে বললেন,
“আরে যাবা না কেন! যাও দেখবা ভালো কিছুই হবে।”
মিহিকা সরু চোখে রহিমা খালার দিকে তাকিয়ে বলল,
“সত্যিই তো ভালো কিছু হবে তো।”
রহিমা খালা শপিং ব্যাগটা মিহিকার হাত ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
“আরে বাবা সত্যিই ভালো কিছু হবে। এখন এতো কথা বাড়াইয়ো নাতো।”
বলেই রহিমা খালা চলে গেলেন। মিহিকা ভাবতে ভাবতেই খেতে লাগলো। খাওয়া শেষে শপিং ব্যাগটা খুলে দেখলো লাল রঙের একটা বড় গাউন। সাথে মানানসই হালকা গহনা। জামাটা বেশ সুন্দর। মিহিকা ভেবে চিনতে সিদ্ধান্ত নিলো সে ছাদে যাবে। দেখাই যাকনা কি হয়। মিহিকা লাল গাউনটা পড়ে নিলো। সাথে গহনা গুলোও পড়ে নিলো। কাজলও ছিলো ব্যাগে। কাজল দিলো চোখে। চুলগুলো ছাড়াই রাখলো। সাদা রঙের একটা জ্যাকেটও ছিলো। সেটাও পড়ে নিয়ে রওনা হলো ছাদের দিকে।
ছাদের দিকে যত আগাচ্ছে তত মিহিকার বুকটা অজানা কারণেই ধুকপুক ধুকপুক করছে। ছাদের দরজার সামনে পৌঁছে চোখ কুচকে এলো মিহিকার ছাদ অন্ধকার হয়ে আছে পুরোটা। মিহিকা কাঁপা গলায় বলল,
“শুনছেন আপনি কোথায়?”
ঠান্ডায় হাত,পাসহ পুরো শরীরটা কাঁপছে। হাত লাল হয়ে এসেছে। প্রতিধ্বনিত হচ্ছে কথা। মিহিকা আবারো বলে উঠলো,
“আপনি কি এখানে আছেন?”
লাইট জ্বলে উঠলো। চারপাশে লাল, সাদা বেলুনের ছড়াছড়ি। ছাদের কাণিশে একটা ছেলে উল্টো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিহিকা কপাল কুচকে তাকালো। না এটা তো তুরাব না। মিহিকা সরু চোখে তাকালো সামনের দিকে। নীল স্যুট পরিহিত লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল,
“কে আপনি? উনি কোথায়?”
ছেলেটা হাসি মুখে ঘুরে দাঁড়ালো। মিহিকা হা হয়ে গেল। অবাক হয়ে বলল,
“আরহাম আপনি এখানে?”
আরহাম হাসি মুখেই বলল,
“কেন গো কচু গাছের সাতচুন্নি কাকে আশা করছিলে তুমি?”
মিহিকা আশেপাশে তাকিয়ে তুরাবকে খুঁজতে লাগলো। তুরাবকে কোথাও না দেখে বলল,
“আপনি এখানে কি করছেন?”
আরহাম মিহিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“যদি বলি নেই!”
মিহিকা কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
“হেয়ালি করছেন আমার সাথে!”
আরহাম আবারো হেসে বলল,
“কেন ভালো লাগছেনা?”
মিহিকা পরপর কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“দেখুন ঠান্ডা মধ্যে এখানে আমি আপনার ফালতু বকবক শুনতে আছিনি।”
বলেই মিহিকা উল্টো ঘুরে চলে যেতে নিবে তার আগেই একটা শক্ত হাত এসে মিহিকার হাত চেপে ধরলো। মিহিকা দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,
“অন্য মানুষের বউয়ের হাত ধরতে শরম করেনা আপনার। হাত ছাড়ুন বলছি।”
তুরাব হেসে বলে উঠলো,
“ওমা মেঘনন্দিনী তুমি নাকি এই বিয়ে মানোনা।”
মিহিকা ভ্রুকুচকে পিছনে ঘুরেই দেখলো তুরাব হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। পড়নে তার কালো স্যুট, সাদা শার্ট। মিহিকা আমতা আমতা করে বলল,
“বিয়ে মানুষের একবারই হয়।”
তুরাব হাসলো। দেখেই বোঝা যাচ্ছে প্রশান্তির হাসি। মিহিকার হাত ছেড়ে তুরাব হাঁটু গেড়ে বসতেই আরহাম সেখান থেকে সরে ছাদের অন্যপাশে গিয়ে দাঁড়ালো যেখানে সোহা দাঁড়িয়ে ছিলো নীল রঙের শাড়ি পড়ে। আরহাম ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই সোহা হেসে বলল,
“কাজ হয়েছে?”
আরহাম আস্তে করে বলল,
“হুম”
সোহা আরহামের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মিহিকা তুরাবকে ভালোবাসে কি?”
আরহাম হেসে বলল,
“হুম ভালো তো বাসেই। তাছাড়া কেউ কাউকে চোখে হারায়।”
সোহা কপাল কুচকে বলল,
“কিভাবে বুঝলে?”
আরহাম সোহার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আরে তোমাদের মেয়েদের বুক ফাটে তবুও মুখ ফোঁটে না। ওর চোখেই আমি তুরাবের জন্য সফটনেস দেখেছি।”
সোহা আরহামের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
“তোমাদের মনে হয় খুব মুখ ফোঁটে। আঙ্কেলের কাছে এখনো তো বিয়ের কথাটাই বলতে পারলে না।”
আরহাম চোখ ছোট ছোট করে সোহার দিকে তাকিয়ে বলল,
“চ্যালেঞ্জ করছো?”
সোহা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“এখানে আবার চ্যালেঞ্জের কি আছে?”
আরহামও মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“নতুন বছরেই তোমাকে বিয়ে করবো ইনশাআল্লাহ।”
সোহা সামনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“দেখো কি করতে পারো?”
————
তুরাব হাঁটু গেড়ে বসে আংটি উঁচু করে ধরে বলতে লাগলো,
“মেঘনন্দিনী আমি ছোট থেকেই ভালোবাসার মানুষ পাইনি। আমার জন্মের দুইবছরের মাথায় আমার বাবা মা এক্সিডেন্টে মারা যায়। এরপর দাদুর কাছে মানুষ হই আরো একবছর তারপর উনিও মারা যায়। মামা আমাকে দুইবছর লালন পালন করে আবাসিকে দিয়ে দেয়। সেখানেই থাকা। দুনিয়ায় আমার কারো প্রতি মায়া জন্মানোর ছিলোনা। কোনো মতে জীবন পার করছিলাম। পরে আমার পরিচয় হয় আরহামের সাথে। ওকে আমি নিজের ভাই মনে করে এসেছি সারাজীবন। ও ছাড়া কিছুই বুঝতাম না। ভার্সিটি লেভেলে এসে ওর থেকেও আলাদা হয়ে যাই। যদিও যোগাযোগ ছিলো। কিন্তু যেদিন ইরাদের বাসায় তোমাকে দেখি। আমি থমকে যাই। থমকে যায় আমার পৃথিবী। মনে হচ্ছিলো তোমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে পার করে দেই যুগের পর যুগ। তোমার সেই কাজল কালো চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি আজীবন। সেখানেই মনে হয়েছিলো এই মেঘনন্দিনীকে আমার লাগবে। জানোতো প্রথমে বেশ ধোঁয়াশার মাঝে ছিলাম যে তোমার পরিবার মেনে নিবে কি না এই নিয়ে। পরে তোমার বাবার কাছে গিয়ে আমি একদম সোজাসুজিই বলি যে, আমার তোমাকে লাগবে। কিন্তু উনি আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সেদিন। অবশ্য আমি তখন ছিলাম বেকার। নিজের দিনই চালাতাম কোনোমতে। বাবা যত টাকা ছিলো সব কিন্তু আমার পড়াশোনার পিছনেই গেছে। সে যাইহোক, আমার শেষ ভরসা তুমি। তোমাকে ছাড়া এই তুরাব কিছুই না। আমার বেঁচে থাকার আশা তুমি। তুমি কি হবে আমার ছেলের বউয়ের একমাত্র শাশুড়ি। দেখ মেঘনন্দিনী এখানে না বলার কোনো রাস্তা নেই কারণ তুমি যে লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে দেখতে তা কিন্তু আমি জানি। আর তুমি রাজি না থাকলে জীবনেও তুমি আমাকে বিয়ে করতে না। এখন কি তুমি হবে মেঘরাজের মেঘনন্দিনী।”
মিহিকা পলকহীন তাকিয়ে আছে তুরাবের দিকে। তুরাবও মিহিকার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন দুইজন মন দিয়ে একে অপরের। মিহিকা কি বলবে কিছু বুঝতে পারছেনা।
আরহাম আর সোহা অপেক্ষা করতে করতে ছাদের অপর পাশ থেকে তুরাবদের দিকে আসলো। দুইজনকে এভাবে দেখে সোহা চলে যেতে চাইলেও আরহাম ওর হাত ধরে আটকে রেখে বলে উঠলো,
“আরে ভাবি নিয়ে নেন। আমার ভাইটা বসে থাকতে থাকতে বুড়ো হয়ে গেল।”
আরহামের কথায় দুইজনের ভাবনার ছেদ ঘটলো। মিহিকা লজ্জা পেল খানিকটা। হাত বাড়িয়ে দিলো। তুরাব হাসি মুখে আংটিটা মিহিকার অনামিকা আঙুলে পড়িয়ে দিয়ে মিহিকার ঠান্ডা হাতে ঠোঁটের উষ্ণ স্পর্শ এঁকে দিলো। মিহিকা লজ্জায় লাল নীল হতে লাগলো। এতোটা লজ্জা লাগছে কেন তার? নিজের কাছেই অজানা। শরীর কাঁপছে বেচারির।
আরহাম আর সোহা হাত তালি দিতে লাগলো। তুরাব উঠে দাঁড়িয়ে হুট করেই মিহিকাকে জড়িয়ে ধরলো নিজের বুকের মাঝে। মিহিকা তুরাবে উষ্ণ বুকে মুখ গুজে দিলো। তুরাব আরহামের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এখানে কি করছিস তোর উনিকে তো এনে দিলাম। তার সাথে থাক। আমার ইয়াতে কাঠি করছিস কেন?”
আরহাম মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“ওহ কাজ শেষ এখন তুই কে আর আমি কে। তাই না।”
তুরাব নাক টেনে বলল,
“সোহা এই পাগলরে বোঝাও তো।”
সোহা আরহামের হাতে একটা চিমটি কেটে বলল,
“এই কি করছো?”
আরহাম সোহার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি আবার কি করলাম?”
#চলবে