#ধোঁয়াশার_মেঘ
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ০৯
মিহিরের কথায় পাত্তা না দিয়ে মাহি চলে গেল। কোথায় তার টেনশন হচ্ছে মিহিপুকে নিয়ে। ভালো করে কথা বলবে তা না। এই মিহিরের বাচ্চা ত্যাড়ামি করছে যতসব। মাহির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মিহির দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
————————-
মিহিকা চুলে তোয়ালে পেঁচিয়ে শাড়ির কুচি ঠিক করতে করতে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই তুরাবের চোখ আটকে গেল মিহিকার উপর। নীল রঙের শাড়ির সাথে গোসল নেওয়ার পরে স্নিগ্ধা মুখখানা দেখে তুরাবের হৃদস্পন্দন যেন থেমে গেছে। চোখের পলক ফালাতে ভুলে গেছে সে। বুকের বাপাশে হাত রেখে বিড়বিড়িয়ে বলল,
“মেঘনন্দিনী তোমার এই রূপে যে আমার ধ্বংস। তোমার স্নিগ্ধা গোল মুখখানা যে আমাকে উন্মাদ করে তুলছে। তুমি এতো সুন্দর কেন মেঘনন্দিনী। আর একটু কম সুন্দর হলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেত।”
মিহিকা সামনের দিকে তাকিয়ে ভ্রুকুচকালো তুরাবকে এমন করে দাঁড়িয়ে থেকে বিড়বিড় করতে দেখে। তীক্ষ্ণচোখে তুরাবের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এইযে শুনছেন আপনি কি পাগল টাগল হয়ে গেলেন নাকি!এমন করছেন কেন?”
তুরাব মিহিকার দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
“তুমিই তো আমাকে পাগল করলে মেঘনন্দিনী। এখন আবার না জানার ভাব ধরছো। এটা কিন্তু মটেও ঠিক না। জনগন তা মেনে নিবে না।”
মিহিকা কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
“কি সব আজগুবি কথা বলেন আপনি। দেখি মেজাজ খারাপ না করে সামনে থেকে সরুন। আর আমাকে বাসায় কখন নিয়ে যাবেন?”
তুরাব হুট করেই মিহিকার হাত টেনে ওকে দেয়ালের সাথে ধরে বলল,
“বিয়ের পর মেয়েদের একমাত্র বাসা তার শশুরবাড়ি। যদিও এটা তোমার একমাত্র স্বামীর বাসা। তাতে কি? বউ আমাকে একটা চুমু দিবে।”
মিহিকা চোখ বড় বড় করে বলল,
“আপনি এমন নিলজ্জের মতো কথা বলছেন কেন? সরম করছে না একটা মেয়ের থেকে চুমু চাইতে ছিহ।”
তুরাব দুষ্টু হেসে বলল,
“আরে মেঘনন্দিনী আমি তো আর অন্য কোনো বাবার মেয়ের কাছে চুমু চাইনি। আমার একমাত্র শশুড় মশাইয়ের মেয়ের কাছেই চুমু চেয়েছি।”
মিহিকা মুখ ঘুরিয়ে বলল,
“ছাড়ুন আমাকে। আমি এই বিয়ে মানিনা।”
হুট করেই তুরাবের হাত শক্ত হয়ে গেল। কপালের রগ ফুলে উঠলো। মিহিকা হাতে ব্যথা পেয়ে আর্তনাদ করে উঠলো। তুরাব রক্তলাল চোখে বলল,
“মানবি না মানে, তিন কবুল বলে তোকে আমার করে নিয়েছি। আর তুই বললেই হলো।”
মিহিকাও তেতে উঠে বলল,
“আপনি ভুলে যাবেন না জোর করে কখনোই ভালোবাসা যায়না। গাছের ডালকে বেশি জোরে টানাটানি করলে ভেঙে যায়।”
হুট করেই তুরাব মিহিকার ঠোঁটে কামড় বসিয়ে দিলো। মিহিকার চোখ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পরলো। তুরাব কামড়ের জায়গায় আস্তে করে চুমু খেয়ে মিহিকার ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে মিহিকার ঠোঁটে হাত রেখে বলল,
“বিয়ে একটা পবিত্র বন্ধন। আর আমার দাদিমা সব সময় বলেন জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে সবটাই আল্লাহ ইচ্ছায় হয়। আল্লাহ যাদের এক করতে চায় হাজার ঝামেলার পরেও তাদের এক করে। আর মেঘনন্দিনী তার মেঘরাজেরই। তুই বিশ্বাস করলে কর না করলে না কর। তুই আমার।”
বলেই মিহিকাকে কোলে তুলে নিলো। মিহিকা বিরক্তি নিয়ে বলল,
“আমার ভালো লাগছেনা। আমার সাথে কেন এমন করছেন?”
তুরাব হাসলো। মিহিকাকে বিছানায় শুয়ে দিয়ে বলল,
“যা আর কিছু করবো না। একটু পরে খাবার আসবে খেয়ে নিস। আমি আর বিরক্ত করবোনা তোকে।”
বলেই তুরাব মিহিকার কপালে গভীর একখানা চুমু দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো। সে যতটা সহজ মনে করেছিলো ততটা হয় না সহজ হবেনা। ভালোবাসার দহনে পুড়তে হবে তাকে আরো। যার শেষ কবে জানা নেই তার। তুরাব চোখের কোণায় জমে থাকা পানিটা মুছে হেসে রুম ছেড়ে চলে গেল। মিহিকা শোয়া থেকে উঠে বসলো। বেডের একপাশে বসে হাঁটুতে মাথা রেখে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
“জীবনটা কেন এমন হলো? এমনটা না হলেও তো পারতো। এই ঝামেলা আর সহ্য হচ্ছে না।”
——————-
তুরাব মিহিকার রুম থেকে বেড়িয়ে পাশের রুমে চলে এলো। আজকেই বছরের শেষ দিন। রাতে অনেক প্লান করা ছিলো তুরাবের। প্লান মতো কাজ করবে কি না তা নিয়ে ভাবছে সে। রুমটা বেশ বড়। এটাই তুরাবের রুম। কিন্তু এই রুমে মিহিকাকে এখনোই আনবেনা সে। যেদিন মিহিকা ওকে মেনে নিবে সেইদিনই ওকে স্পেশাল ভাবে নিয়ে আসবে নিজে রুমে।
তুরাব দেখলো বিকাল হয়ে এসেছে। ফোন করলো আরহামকে। আরহাম একটু আগেই অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে কেবলি কফির মগ নিয়ে বারান্দায় এসেছিলো। তার তেমন কোনো পরিকল্পনা নেই। সামনের ছাদেই পিকনিকের বিভিন্ন আয়োজন চলছে। ছোট ছোট বাচ্চারা ছোটাছুটি করছিলো। সেগুলোই দেখছিলো আরহাম। ফোন বেজে উঠতেই টাউজারের পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখলো তুরাব কল করেছে। আরহাম মুচকি হেসে কল রিসিভ করে কানে ধরলো। তুরাব বলল,
“কি করছিস?”
তুরাবের কন্ঠ শুনে আরহাম বলল,
“কি হয়েছে তোর মন খারাপ?”
তুরাব নিজেকে স্বাভাবিক রেখেই বলল,
“না আমি ঠিক আছি।”
আরহাম হাসলো। কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল,
“মিহিকার সাথে ঝামেলা হয়েছে আবার।”
তুরাব হেসে বলল,
“ঝামেলা হওয়ার আর কি আছে রে?”
আরহাম কি বলবে বুঝতে পারলো না। কিছুটা দমে গিয়ে বলল,
“আজকে রাতে ওকে যে সারপ্রাইজ দিতে চাইলি?”
তুরাব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ভাবছি ওকে আর বিরক্ত করবোনা।”
আরহাম কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
“তুই কি ভেঙে পড়েছিস?”
তুরাব বাঁকা হেসে বলল,
“ভেঙে পড়ার জন্য তো আর বিয়ে করিনি রে পাগলা।”
আরহাম বিরক্তি নিয়ে বলল,
“তোর এই হেয়ালিই আমার ভালো লাগে না বা*ল!”
তুরাব হো হো করে হেসে বলল,
“আচ্ছা যা আমি ওকে সারপ্রাইজ দিবো। এবার খুশি তো । তুই কি করবি?”
আরহাম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“কিছুই করতাম না। আমার তো আর বিয়ে করা বউ নাই ঘরে।”
তুরাব বুঝতে পারলো আরহাম তাকে খোচাচ্ছে। তুরাব হেসে বলল,
“যাহ নতুন বছর পরবে কালকে তার আগেই তোকে দোয়া দিলাম। ওই বছরেই যেন তোর বিয়ে হয়।”
আরহাম হেসে বলল,
“ছুম্মা আমিন।”
দুইজনই হাসতে লাগলো।
কল কেটে তুরাব রুমে এলো। মাথাটা ব্যথা করছে তার প্রচন্ড। তুরাব নিজের বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো চোখ বুজে।
———————
রহিমা খালা তুরাবের কথা মতো খাবার নিয়ে মিহিকার রুমে গিয়ে দেখলো মিহিকা হাঁটুতে মুখ গুজে বসে আছে। রহিমা খালা খাবারের প্লেট নিয়ে এগিয়ে গেলেন। মিহিকার পাশের টেবিলে খাবার রেখে মিহিকার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“খাবারটা খেয়ে নেও তো।”
রহিমা খালার কথা শুনে মিহিকা চোখ তুলে তাকালো। রহিমা খালা মুচকি হেসে বললেন,
“তুরাব বাবার উপর রাগ করে খাওয়া বাদ দিও না। ও নিজেও খায়নি তোমার জন্য। এখন যদি শোনে তুমি খাও নি তাহলে রাগারাগি করবে।”
মিহিকা গম্ভীর গলায় বলল,
“নিয়ে যান আমি খাবোনা।”
রহিমা খালা মিহিকার পাশে বসে মুচকি হেসে ওর মাথা হাত বুলিয়ে বলল,
“ওর উপর রাগ করোনা মা। ছেলেটা ভালো।”
মিহিকা কিছু না বলে চুপ করে রইলো। রহিমা খালা আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেলেন। মিহিকা ওনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে খাবারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তাই তো আমি ওই ব্যাটার জন্য না খেয়ে কেন থাকবো!”
খাবার প্লেটটা হাতে তুলে নিজ মনেই বলল,
“আমার ক্ষুধা পেয়েছে, আমি খাবো। খাবারের উপর রাগ করে তো লাভ নেই। ওই ফালতু ব্যাটার জন্য আমি না খেয়ে থাকবোনা হুমও।”
মিহিকা দেখলো মুরগির মাংস দিয়ে ভাত। মিহিকা একপাশ থেকে মাখিয়ে খেতে লাগলো। ক্ষুধাও পেয়েছিলো তার অনেক। সেই কখন একটু খানি বিরিয়ানি খেয়েছিলো। মিহিকা ঝটপট খাওয়া শেষ করে প্লেটটা রাখতে গিয়েই হুট করে তার রহিমা খালার কথা মনে হলো। উনি তো বলে গেলেন তুরাবও খায় না। খানিকবাদেই নিজ মনে আবারো বলে উঠলো,
“খাইলে খাক না খাইলে না খাক। তার কি!”
মিহিকা হাত মুছে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। ভালো লাগছে না তার। বাড়ির কথা বড্ড বেশি মনে পড়ছে তার। মাহির কথা বেশি করে মনে পড়ছে। বিকেল হতেই দুইজন মিলে একসাথে কফি খেত আর আড্ডা দিতো। এই অসভ্য, নিলজ্জ ব্যাটার জন্য তো সে তার ইরাপুর বিয়েটাও খেতে পারলো না।
এইসব ভেবেই একরাশ রাগ, অভিমান, ক্ষোভ এসে জমা হলো তুরাবের উপর। মিহিকা নিজ মনেই বলল,
“আমি এর প্রতিশোধ নিয়েই ছাড়বো। বদ ছেলে কোথাকার। আস্ত বেয়াদব ছেলে।”
কিছুক্ষন পরেই তার মনে হলো আজ তো বছরের শেষ দিন। কাল নতুন বছর পড়বে। মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল মিহিকার। সবাই একসাথে কত মজা করতো। সবটা মাটি হয়ে গেল।
এসব ভাবতে ভাবতেই সন্ধ্যা হয়ে এলো। মাগরিবের নামাজ পড়ার জন্য ওযু করতে ওয়াশরুম গেল মিহিকা।
—————
তুরাব চোখ বুজ থাকতে গিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে গেছিলো টের টাও পায়নি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সন্ধ্যা সাতটা। তুরাব হুড়মুড়িয়ে উঠলো। দ্রুত পায়ে মিহিকার রুমের দিকে গেল সে। দরজার কাছে যেতেই মিহিকা হাসির শব্দ শুনতে পেল। রুমের দরজাও খোলা। তুরাবের কপাল কুচকে এলো।
#চলবে