ধোঁয়াশার মেঘ পর্ব-০৭

0
3

#ধোঁয়াশার_মেঘ
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ০৭

মিহিকার কথায় তুরাবের চোখ কপালে উঠার মতো অবস্থা। তুরাব ধমকে উঠে বলল,
“চুপ থাক, বেশি কথা বলতে না করেছিনা।”

তুরাব ফোনে দেখলো সকাল ছয়টা বাজে। মিহিকার সাথে কাহিনী করতে করতে অনেকটা সময়ই কেটে গেছে। তুরাব নিজ মনেই হাসলো। ফোনটা নিয়ে কল করলো আরিফুল খানের নাম্বারে। প্রথমবার কল রিসিভ না হলেও দ্বিতীয়বার রিসিভ হতেই তুরাব গলা পরিষ্কার করে বলল,
“আসসালামু আলাইকুম শশুড়মশাই।”

আরিফুল সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন,
“তুরাব আমার মেয়ে কোথায়?”

তুরাব হেসে বলল,
“আপনার মেয়ে তার বরের বাসায় আছে শশুরমশাই।”

আরিফুল সাহেব রেগে বললেন,
“ফাজলামো করছো তুমি আমার সাথে বেয়াদব ছেলে কোথাকার। আমি জানতাম তুমিই আমার মেয়েকে কিছু করেছো।”

তুরাব জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
“আরে আরে রাগ করেন কেন, আমার একমাত্র শশুড়মশাই। কোথায় জামাই বাবাজীবন বলে কথা বলবেন তা না কিসব বলছেন।”

আরিফুল সাহেব সোফায় কয়েক ঘা বসিয়ে দিয়ে বললেন,
“আমার মেয়ে কোথায়?”

তুরাব মিহিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার বউকে আমি বিয়ে করার জন্য কাজী ডেকেছি। তাই ভাবলাম আপনার সাথে একটু কথা বলে নেই। হাজার হলেও আপনি আমার একটা মাত্র রাগী ভিলেন মার্কা শশুড়মশাই।”

আরিফুল সাহেব কিছু বলতে নিবেন তার আগেই তুরাব বলে উঠলো,
“খুব না বলেছিলেন আপনার মেয়েকে দিবেনা। এখন আমি বড় পজিশনে আছি। ওকে ভালো রাখার সামর্থ্য আমার আছে এখন।”

তুরাব দমে গিয়ে আবারো বলতে লাগলো,
“আমি যদি এখন আপনার সামনে যেতাম, আপনি খুশি মনে আমার হাতে আপনার মেয়েকে তুলে দিতেন। কিন্তু না আমি তা করবো না। টাটা শশুড়মশাই। তাছাড়া আমার বাসর দিন করতে দেড়ি হয়ে যাবে।”

মিহিকা এতোক্ষণ চোখ বড় বড় করে তুরাবের দিকে তাকিয়ে ছিলো। কিন্তু শেষের কথা শুনে মিহিকার বিষম উঠে গেল। তুরাব ফোন কেটে পকেটে ঢুকিয়ে পানি এগিয়ে দিলো মিহিকাকে। মিহিকা কোনো মতে পানি গিলে বলল,
“এই মিয়া আপনি কিসব বললেন আমার বাবার কাছে। এই ব্যাটা তারমানে কাজী। আমি বিয়ে করবোনা।”

তুরাব ডান হাতের বুড়া আঙুল দিয়ে নিচের ঠোঁটের কোণা মুছে মুচকি হেসে বলল,
“বিয়ে তো তোকে করতেই হবে।”

মিহিকা পিছিয়ে যেতে নিলে তুরাব মিহিকার হাত শক্ত করে ধরে সামনে বসে থাকা কাজীকে বলল,
“বিয়ে পড়ানো শুরু করুন কাজী সাহেব।”

মিহিকা ছটফট করতে লাগলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আমি বিয়ে করবোনা।”

তুরাব রক্তলাল চোখে মিহিকার দিকে তাকিয়ে গমগমে গলায় বলল,
“বেশি কথা বলিস না। যা বলছি চুপচাপ কর।”

মিহিকা এবার তেজ নিয়েই বলল,
“করবোনা আমি। আমি কি আপনার কিনে নেওয়া কোনো বস্তু নাকি যে আপনার সব কথা শুনে চলবো।”

তুরাব দাঁত কিটমিট করে বলল,
“তোকে কি আমি বলেছি নিজেকে বস্তুর সাথে তুলনা করতে। দেখ মাথা এমনিতেই যথেষ্ট গরম আছে। আর গরম করিস না। এবার মাথায় পানি গরমে বসালে ফুটতে থাকবে।”

মিহিকা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“আমার মাথা তো হিমালয়ের বরফ। যে বরফ কোনোদিনও পানি হয়ে ফুটতে পারবেনা। ছাড়ুন আমাকে। আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবোনা।”

তুরাব নাকমুখ খিচিয়ে বলল,
“কেনরে আমি কি তোরে চিমটি দিছি যে আমারে বিয়ে করবিনা।”

কাজী সাহেব এবার অধৈর্য্য হয়েই বলে উঠলেন,
“আপনারা দয়া করে একটু চুপ করে বিয়েটা করবেন কি? এমনিতেই ভোর ভোর আমাকে তুলে এনেছেন। তারউপরে আমাকে সামনে বসিয়ে ঝগড়া করছেন।”

তুরাব নড়েচড়ে বসে গম্ভীর গলায় বলল,
“আপনি আপনার কাজ শুরু করছেন না কেন?”

কাজী সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন তুরাবের দিকে। মনে মনে ভাবলেন,
“লে ঠেলা নিজেরাই ঝগড়া করছিলো এতোক্ষণ আর এখন নাকি সে নিজের কাজ করছেনা।”

কাজী সাহেব মনে মনে কয়েকখানা গালি দিলো তুরাবকে। তারপর নিজের কাজ শুরু করলো। গম্ভীর গলায় বললেন,
“দেনমোহর কত ধরবেন?”

তুরাব একটু হেসে মিহিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার কাছে তোকে পাওয়ার থেকে বড় দেনমোহর আর কিছু নেই, কিন্তু কাজী সাহেব, একটা ভালো অঙ্ক লিখে দিন, যাতে শশুড়মশাই খুশি হন।”

মিহিকা রাগে গজগজ করতে করতে বলল,
“কাজী সাহেব, কোনো দেনমোহর লাগবে না, কারণ এই বিয়ে আমি মানি না। আমি করবোনা এই বিয়ে।”

তুরাব চোখ কুঁচকে মিহিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুই চুপ করবি? তোরে চুপ থাকতে বললাম না। বেশি কথা বললে কিন্তু..!”

বলেই পকেট থেকে একটা বন্দুক মিহিকার কপালে ধরে বলল,
“মেঘনন্দিনী হয় তুই মেঘরাজের হবি না হয় আর কারো না।”

মিহিকা মুখ বাঁকিয়ে অন্য দিকে ফিরে বসে পড়লো। তুরাব অবাক হলো। এখানে যেকোনো মেয়ে থাকলে ভয় পেতো। আর এই মেয়ে তো তাকে ভয়ই পাচ্ছে না। তুরাব খানিকটা ভরকে গেলেও নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
“দেখ আমি কিন্তু মজা করছিনা।”

মিহিকা আবারো মুখ বাঁকিয়ে বসে রইলো। কাজী এবার ধমকে বললেন,
“চুপ যান আপনারা। তাড়াতাড়ি করুন তো।”

তুরাব মিহিকার কাছে ঘেঁষে বসে বলল,
“৩০ লক্ষ টাকা ধরুন দেনমোহর।”

মিহিকা কপাল কুচকে তাকালো তুরাবের দিকে। তুরাব কাকে যেন ফোন দিলো। সাথে সাথেই দুইটা ছেলে এসে দাঁড়ালো রুমের সামনে। তুরাব গম্ভীর গলায় বলল,
“দুইজন সাক্ষী রেডি এখন তুই কবুল বললেই কাহিনীর টুইস্ট।”

মিহিকা মুখ বাঁকিয়ে কিছু বলতে নিবে তার আগেই তুরাব ওই দুইটা ছেলের মাঝ বরাবর সুট করলো। মিহিকা সহ সবাই কানে হাত দিয়ে চোখ মুখ খিচে বন্ধ করলো।

তু্রাব হাসলো। কাজ মনে হয় হয়ে গিয়েছে। তুরাব ইশারা করে কাজী সাহেবকে। কাজী সাহেব কবুল বলতে বললে, তুরাব দ্রুত কবুল বলে দেয়। মিহিকা না করতে নিবে তার আগেই আবারো আগের জায়গায় সুট করলো। মিহিকা এবার কাঁপা গলায় কবুল বলেই দিলো। বলা তো যায় না যদি তাকে সত্যিই উড়িয়ে দেয়। মিহিকা কবুল বলায় তুরাব ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো। কাবিননামায় সাইন করে দিলো তুরাব। মিহিকা কলম ধরতেই পারছেনা। হাত পা থরথর করে কাঁপছে তার। বুক ফেটে কান্না আসছে। এমন ভাবে যে তার বিয়ে হবে সে কল্পনাও করেনি। না জানি তার মা বাবার কি অবস্থা হবে বিয়ের কথা শুনে। অবশ্য এই ছেলে তো তার বাবাকে বলেই দিয়েছে।

মিহিকার হাতে কাবিননামার কলম ধরে রেখেও সাইন করতে পারছে না। তার ভেতরে এক প্রবল ঝড় বইছিল। কীভাবে একজন মানুষ এতটা জেদি হতে পারে? তার বাবার মুখ মনে পড়ছিল, সেই স্নেহমাখা চেহারা।

মিহিকা কাঁপা গলায় বলল,
“আপনি কি জানেন, আপনি যা করছেন, সেটা অপরাধ? এটা কোনো প্রেম বা বিয়ে নয়। আপনি আমাকে ভয় দেখিয়ে, বন্দুকের মুখে এই কাজ করাচ্ছেন। আমি কোনোদিনও আপনাকে মেনে নেব না।”

তুরাব হেসে বলল,
“তুই কি জানিস, আমি অপরাধী কিনা সেটা আইন প্রমাণ করবে। কিন্তু তুই যে আমার বউ, এটা আজকে আমি প্রমাণ করে দেব।”

মিহিকা এবার সাহস জোগাড় করে বলল,
“আপনি আমাকে ভয় দেখিয়ে জিততে পারবেন না। আমি কোনোদিনও এই বিয়ে মেনে নেব না। আপনি যতই চেষ্টা করুন না কেন।”

তুরাব আলতো হেসে বলল,
“তা না হয় পরেই বোঝা যাবে। এখন সাইনটা কর তো।”

মিহিকা বেচারি এবার কেঁদেই দিলো। তুরাব বিরক্ত হলো বেশ। নাকমুখ কুচকে বলল,
“ছিচকাদুনির মতো এতো কাঁন্না করো কেন বলো তো। ঝগড়া করার সময় তো গলাটাও নিচু করে কথা বলো না।”

মিহিকা নাক টেনে বলল,
“জোর করে তো কবুল বলিয়ে নিলেনই। এখন আবার পকপক করছেন কেন!”

তুরাব মুখ বাঁকালো। মিহিকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাইনটা করে দিলো। তুরাবের খুশি আর ধরে কে।তুরাব যেন জিতে গিয়ে এক ধরনের বিজয়মুখর হাসি দিলো। তার চোখে ফুটে উঠলো গভীর আত্মবিশ্বাস, আর মিহিকার চোখে অসহায়ত্বের ছাপ। তুরাব কাবিননামা নিয়ে কাজী সাহেবকে বিদায় দিলো। বাকি দুইজনকেও কি যেন বলে বের করে দিলো। মিহিকা তখনো বসে বসে চোখের কোণে জমা অশ্রু সামলানোর চেষ্টা করছে।

তুরাব মিহিকার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“দেখো, আমার কাজ শেষ। এখন তুই আমার বউ, আর এই বিয়েটা ভাঙার কোনো রাস্তা নেই। এবার মজা করে সংসার শুরু করি।”

মিহিকা দাঁত চেপে বলল,
“আপনার মতো জেদি, নির্লজ্জ আর স্বার্থপর মানুষ আমি জীবনে দেখিনি। আপনি যা করেছেন, তা ক্ষমার অযোগ্য।”

তুরাব বাঁকা হাসি দিয়ে বলল,
“ক্ষমা আর ভালোবাসা একই মুদ্রার দুই পিঠ, মেঘনন্দিনী। সময়ের সাথে দেখবি, তোকে রাজরানির মতো রাখবো। তুই শুধু আমার কথা শোন, তাহলেই হবে।”

মিহিকা রাগী মুখে তাকালো তুরাবের দিকে। তুরাব এগিয়ে এলো মিহিকার দিকে। মিহিকা হুট করে সামনে তাকাতেই তুরাবকে তার এতো কাছে দেখে চমকে গেল। মিহিকা কিছু বোঝার আগেই তুরাব মিহিকার কোমর ধরে নিজের কাছে টেনে এনে মিহিকার নাকে নাক ঠেকিয়ে বলল,
“বউ মোবারক মেঘনন্দিনী। এখন তোমার উপর শুধুমাত্র আমার অধিকার। একদিন তুমি আমাকে ভালোবাসবেই।”

মিহিকা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
“জোর করে কি ভালোবাসা হয়!”

তুরাব মিহিকার কোমর ছেড়ে দিয়ে দুইহাত মিহিকার দুই গালে আলতো করে ধরে বলল,
“জোর করে না জান। এমনিতেই তুমি আমার মায়ায় পড়বে। যে মায়া কেউ কখনো কাটতে পারবেনা।”

মিহিকা গম্ভীর গলায় বলল,
“ছাড়ুন আমাকে। এভাবে থাকতে আমার অসহ্য লাগছে।”

তুরাব মিহিকার কথায় পাত্তা না দিয়ে মিহিকাকে শক্ত করে বুকে টেনে বিছানায় শুয়ে পরলো। চোখ বুজে বলল,
“সারারাত ঘুমাইনি এখন একটু ঘুমাতে দেও তো। তুমিও ঘুমাও চুপচাপ।”

মিহিকা ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল,
“আপনি আপনার ঘুমকে ধরে ঘুমান আমাকে ছাড়ুন তো।”

তুরাব বিরক্তিতে চোখমুখ কুচকে বলল,
“এতো ছাড়ুন ছাড়ুন করো কেন বলো তো। কোথায় বলবে ধরুন ধরুন তা না।”

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে