ধোঁয়াশার মেঘ পর্ব-০৬

0
8

#ধোঁয়াশার_মেঘ
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ০৬

লাইট জ্বলে উঠতেই গভীর কন্ঠে ভেসে এলো,
“তাড়াতাড়ি খাবারটা খেয়ে নে। আমি এসে যদি দেখি খাবার আছেই তাহলে দেখিস কি হয়।”

মিহিকা প্লেটের দিকে তাকিয়ে দেখলো বিরিয়ানি। ক্ষুধা লাগলেও মিহিকা প্লেটটা আবারো ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখলো। পায়ে বাঁধন খুলে ফেলেছে আগেই। রুমের চারপাশে চোখ বুলালো সে। রুমে একটা ছোট জানালা ছাড়া আর কিছুই নেই। মিহিকা এগিয়ে গেল সেই জাননালার কাছে। কিন্তু জানালা বন্ধ। কিছুতেই খোলা যাচ্ছে না। অনেক চেষ্টার পরেও জানালা খুলতে পারলো না। ব্যর্থ হয়ে এপাশ অপাশ খুঁজতে লাগলো। কিন্তু পালানোর জন্য কোনো পথ পেল না। দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে ডাকতে লাগলো,
“কেউ আছেন, দরজা খুলুন।”

ডাকতে ডাকতে গলা ব্যথা হয়ে গেলেও কারো সাড়া শব্দ না পেয়ে অস্থির হয়ে গেল মিহিকা। দরজার সাথেই পিঠ লাগিয়ে বসে কান্না করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছে তা বুঝতেই পারেনি মিহিকা।

————————–

এদিকে আরিফুল খান আর আজিজুল খান থানায় মিহিকা মিসিং ডায়েরী লিখাতে চাইলেও তারা লেখেনি। সময় নিতে বলেছে। সবাই মিহিকার টেনশনে শেষ। হেনা খানের তো অবস্থা একদম খারাপ। উনি একদম বিছানার সাথে লেগে গেছেন। মিহির, শাওন, মাহি, হিয়া, হামিম, আরহাম সবাই বসে আছে বসার ঘরে। আজকে হিয়াদের চলে যাওয়ার কথা থাকলেও বাড়ির এই অবস্থা দেখে হিয়ার বাবা আরো একদিন থেকে যেতে বললেন। কিন্তু আরহামের আর আরহামের বাবার অফিসে কিছু কাজ থাকায় সে আজকেই রওনা দিয়েছে।

মাহি গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো ছাদে কাণিশ ঘেঁষে। মিহির মাহির পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“কিরে এখানে কি করছিস?”

মাহি একপলক মিহিরের দিকে তাকিয়ে আবারো সামনে দিকে তাকালো। মাহিকে কথা বলতে না দেখে মিহির বলল,
“তোর মিহিপু যেখানে আছে সেখানে ভালো আছে টেনশন করিস না।”

মাহি থমকালো মিহিরের কথায়। অবাক হয়ে মিহিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুই জানিস মিহিপু কোথায় আছে?”

মিহির সর্তকতার সাথে চারপাশে তাকিয়ে ইশারায় মাহিকে কান কাছে আনতে বলল। মিহিরের কথা মতো মাহি কান কাছে আনলো। মিহির ফিসফিসিয়ে বলল,
“আমি তোকে নিয়ে যাবোনি। কিন্তু কাউকে বলিস না।”

মাহি কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
“আমকে নিয়ে যাবি তো!”

মিহির আবারো চারপাশে সর্তকতার সাথে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
“হুম নিয়ে যাবো।”

——————-

ঘড়িতে রাত তিনটা লোকটা লাইট অফ করে রুমে প্রবেশ করলো। মিহিকাকে কোলে তুলে বিছানায় এনে রাখলো। মিহিকার কপালে পড়ে থাকা ছোট ছোট চুলগুলো আলতো হাতে সরিয়ে দিয়ে নেশালো দৃষ্টিতে মিহিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“মেঘনন্দিনী তোমার ঘুমন্ত মিষ্টি চেহারার মায়ায় তো আমি পড়েছি সেই প্রথম দিনেই। এতো সহজে যে এই মায়া ভুলে যাওয়ার মতো না। তোমাকে যে এই মেঘরাজের মনের কুঠিরে থাকতেই হবে। তুমি চাও বা না চাও।”

ছেলেটা মিহিকার কপাল আলতো চুমু দিয়ে মিহিকার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এই মিহিকা রানী শুধু মাত্র তুরাবের। অন্য কেউ ছোঁয়া তো দূরে থাক তাকাতেও পারবেনা তোকে। তাহলে সেখানেই তাকে পুতে ফেলবো একদম।”

তুরাব উঠে বসলো। পাশের টেবিলের খাবার প্লেটের ঢাকনা তুলতেই চোখ মুখ লাল হয়ে উঠলো। কপালে রগ ফুলে উঠলো। কটমটিয়ে তাকালো মিহিকার দিকে। ঘুমন্ত মিহিকাকে হুট করেই শক্ত দুই হাতে তার বাহু ধরে বসালো। মিহিকার ঘুম ভেঙে গেল। ঘুমের মাঝে এমন হওয়ায় সে চমকিত হয়ে তাকালো সামনের মানুষটার দিকে। ক্ষীণ আলোতে ছেলেটাকে অস্পষ্ট ঠেকলো মিহিকার চোখে। মিহিকার চোখে এখনো ঘুম। তুরাব রাগী কন্ঠে বলে উঠলো,
“তুরাবের কথা না শুনলে কি হয় জানিস তুই? কি মনে করেছিস ভালো ভালো করে কথা বলছি বলে আমি এতোই ভালো। খাসনি কেন তুই।”

মিহিকা কপাল কুচকে বলল,
“তুরাব!”

তুরাবের রাগে শিরা উপশিরা কাঁপছে। তুরাব হাতে থাকা রিমোট চাপতেই রুমের লাইট জ্বলে উঠলো। মিহিকা আলোতে চোখ ঢেকে নিলো। তুরাব রাগে পাশে থাকা ফুলদানি ছুড়ে মারলো। মিহিকা ভয়ে গুটিসুটি মেরে গেল। মিহিকা তাকালো তুরাবের রাগান্বিত মুখের দিকে। ভাঙা গলায় বলল,
“তুরাব ভাইয়া আপনি আমাকে বাসায় দিয়ে আসুন প্লিজ। আম্মু টেনশন করছে।”

তুরাবের রাগ আরো বাড়লো। রক্তলাল চোখে তাকালো মিহিকার দিকে। মিহিকা আরো ভয় পায়। তুরাবকে সে অনেক আগে থেকেই ভয় পায়। তুরাব মিহিকার কাছে এগিয়ে এসে মিহিকার গাল চেপে ধরে বলল,
“সবার কষ্ট তুই দেখিস কিন্তু আমার কষ্টই তুই দেখিস না তাই না। তোর বাপ তো বলেছিলো আমার সাথে তোকে বিয়ে দিবেনা। বিয়ে তো আমি তোকে করেই ছাড়বো। কোথায় কে আটকায় আমিও দেখবো।”

বলেই তুরাব হাত ঝাটকা দিয়ে মিহিকা ফেলে দিয়ে হনহনিয়ে চলে গেল। মিহিকা হাতে বারি খেল বেডের সাথে। মিহিকা কুকিয়ে উঠলো। হাতে বেশ জোরেই লেগেছে। মিহিকা হাত ধরে কান্না করতে লাগলো। তুরাব আবারো ফিরে এলো। গম্ভীর মুখে বেডসাইট টেবিল থেকে বিরিয়ানির প্লেটটা হাতে নিতে মাখাতে লাগলো। মিহিকা হাত ধরে কান্না করছে। তুরাব এক লোকমা বিরিয়ানি নিয়ে মিহিকার সামনে ধরলো। মিহিকা আর কিছু না বলে হা করলো। কারণ সে জানে তুরাবের রাগ সম্পর্কে। তুরাব চুপচাপ গভীর মুখে খাওয়াতে লাগলো মিহিকাকে। কয়েক লোকমা খাওয়ার পর মিহিকা বলল,
“আর খাবোনা।”

তুরাব মিহিকার কথা কানেই নিলো না। এমন মনে হলো যে তুরাব মিহিকার কথা শুনেই নি। খাওয়াতেই থাকলো সে। মিহিকা বুঝতে পারছেনা তুরাব সত্যিই শুনেনি নাকি ইচ্ছে করে না শোনার ভাব করছে। মিহিকা তাকালো তুরাবের দিকে। তুরাবে রক্তলাল চোখ, লাল নাক দেখে মিহিকা বেশ বুঝতে পারলো তুরাবের রাগ এখনো কমেই নি। মিহিকা এবার একটু সাহস করেই জোর গলায় বলল,
“আমার পেট ভরে গেছে। আমি আর খাবোনা। আপনি আমায় বাসায় রেখে আসুন।”

তবুও তুরাব ওর কোনো কথা শুনছে না। মিহিকা যেন চরম বিপদে পড়েছে। এই ব্যাটা তো কিছুই শুনছে না তার কথা। মিহিকা নিজের হাত দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরে মাথা নাড়াতে লাগলো। তুরাব এবার লোকমাটা নিজের মুখে দিলো। মিহিকা অবাক হয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলল,
“একি কি করছেন আমার খাওয়াটা আপনি খাচ্ছেন কেন?”

তুরাব চোখ রাঙালো মিহিকাকে। তুরাবের চোখ রাঙানিতে দমে গেল মিহিকা। চুপচাপ দেখতে লাগলো তুরাবকে। তুরাব দেখতে উঁচা লম্বা, সুঠাম দেহে ফর্সা গরনের, চাপ দাড়ি, ডান পাশের গালে একটা টোলের দাগ স্পষ্ট।

তুরাব বাকি অর্ধেক বিরিয়ানি শেষ করে ঢকঢক করে পানি খেতে লাগলো। পানি খাওয়া শেষ করে হাতে পানি নিয়ে মিহিকার দিকে তাকালো। মিহিকা এতক্ষন সরু চোখে তাকিয়ে ছিলো তুরাবের দিকে। তুরাব তাকাতেই চোখ নামিয়ে নিলো সে। তুরাব ভেজা হাত দিয়ে মিহিকা মুখ মুছিয়ে দিলো। মিহিকা বেশ অবাক হলো। কোনো কিডন্যাপার বুঝি এমন যত্ন করে খাওয়ায়। অবশ্য সে তো আগে কখনো কিডন্যাপ হয়নি, হতেও তো পারে এমন। রাগী রাগী ভাব নিয়ে, হাতে ব্যথা দিয়ে এখন আবার খাইয়ে দিচ্ছে ঢং যতসব।

মিহিকা নিজ মনেই এসব আজেবাজে কথা ভাবছিলো তখনি তুরাব গমগমে গলায় বলল,
“তোর বাবা মাকে কি ভালো রাখতে চাস তুই?”

মিহিকা কপাল কুচকে বলল,
“মানে!”

তুরাব গম্ভীর কন্ঠেই বলল,
“আমি যা বলবো তাই কর না হয় তোর বাবা মাও ভালো থাকবেনা বলে দিলাম।”

তুরাবের কথায় হুট করেই হো হো করে হাসতে লাগলো মিহিকা। তুরাব ভ্রুকুচকে বলল,
“পাগল হয়ে গেলি নাকি!”

মিহিকা হাসি থামিয়ে বলল,
“একটু সিনেমাটিক হয়ে গেল না!”

তুরাব হাসলো। রহস্যময় সে হাসি। মিহিকা সরু চোখে তাকালো তুরাবের সেই হাসির দিকে। তুরাব মিহিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“সিনেমাই না হয় হয়ে যাক। খারাপ তো না মেঘনন্দিনী।”

মিহিকা স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
“জীবনটা কি সিনেমা?”

তুরাব আবারো রহস্যময় হেসে বলল,
“সিনেমার থেকেও বড় কিছুরে পাগলি।”

মিহিকা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“বেশি পকপক না করে আমাকে বাসায় দিয়ে আসুন।”

তুরাব প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করে বলল,
“তুই বেশি পকপক করিস।”

ফোনে কাউকে কল করে বলল,
“ভিতরে নিয়ে আয়।”

বলেই ফোনটা রেখে দিয়ে আশেপাশে কি জানি খুঁজতে লাগলো। পাশেই পেয়ে গিয়ে ওড়নাটা মিহিকার হাতে দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
“ওড়নাটা ঠিক করেনে।”

মিহিকা এবার বেশ লজ্জায় পরলো। সে এতটা সময় ওড়না ছাড়া ছিলো। তাও আবার এই ব্যাটার সামনে। নিজ মনেই বলল,
“ছেহ, ছেহ মিহি তোর এতো হুশ হারা কবে হলো। এতটা সময় ছেহ..!”

মিহিকার ভাবনায় ছেদ ঘটলো একটা পুরুষালি কন্ঠের সালামের শব্দে। সালামের শব্দ শুনে সেদিকে তাকালো মিহিকা। একটা হুজুর দাঁড়িয়ে আছে তাদের সামনে। মিহিকার কপালে ভাঁজ পরলো। হুজুরকে ইশারায় সোফায় বসতে বলল তুরাব।

মিহিকা একবার হুজুরের দিকে তাকাচ্ছে। আর একবার তুরাবের দিকে তাকাচ্ছে। অজানা আতঙ্কে বুক কাঁপছে মিহিকার।

মিহিকা পরপর ঢোক গিলে তুরাবের দিকে তাকিয়ে বলল,
“উনি কে?”

তুরাব ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“কেন ভয় করছে নাকি?”

মিহিকা কাঁপা গলায় বলল,
“আজব তো ভয় করবে কেন!”

তুরাব আবারো রহস্যময় হাসি হাসলো। মিহিকার যেন গলা শুকিয়ে এলো তুরাবের হাসি দেখে। চোখগুলো পিটপিট করতে লাগলো সে। মাথাটা ঘনঘন করছে তার। আল্লাহ ভালো জানে এই তুরাবের মাথায় কি চলছে। কালা জাদু করবে নাকি আবার!

ভাবতেই চোখগুলো বড় বড় হয়ে গেল মিহিকার। মিহিকা চেঁচিয়ে বলল,
“এই মিয়া আপনি যে এতো খারাপ তাতো জানতাম না, শেষমেশ কালোজাদু!”

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে