#ধোঁয়াশার_মেঘ
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ০৫
ইরা অবাক হয়ে বলল,
“এহ ফারাবী!”
শাওন মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“তা নয় তো আমি। বেশি কথা বলে প্রস্তুতি নে। পার্লারের মেয়েরা আসলো বলে।”
শাওন বলতে বলতেই হেনা খানের ডাক পড়লো পার্লারের মেয়েরা নাকি চলে এসেছে। মিহিকা তপ্ত নিশ্বাস ফেলে সোফা থেকে উঠে পড়লো। রওনা হলো নিজের রুমের দিকে।
নিজের জামাটা নিয়ে ওয়াশরুমে গেল। নিজে নিজেই সাজবে সে। ভারী সাজ দিতে ইচ্ছে হচ্ছে না তার। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো এগারোটা বাজে। মিহিকা গোলাপি রঙের একটা লেহেঙ্গা পড়েছে।
ইরা, হিয়া, আরিশা, মাহি সবাই সাজতে বসে গিয়েছে। মিহিকা ওদের বলেই এসেছে যে সে একাই সাজবে। লেহেঙ্গাটা পড়ে একটু বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। বারান্দা দিয়ে নিচে তাকাতেই কপাল কুচকে এলো মিহিকার। আরহাম রাস্তার অপর পাশে দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ের সাথে। মেয়েটার আপাদমস্তক কালো কাপড়ে মোড়ানো। মিহিকা তীক্ষ্ণচোখে তাকালো সেদিকে। না মেয়েটাকে তো চেনা চেনা লাগছে না। মিহিকার কপালের ভাঁজ আরো গভীর হলো। মেয়েটা আরহামের কাছে একটা বক্স দিয়ে চলে গেল। আরহামও বাসার ভিতরে ঢুকতে লাগলো।
মিহিকা সবটাই দেখলো বারান্দা থেকে। কেমন যেন অদ্ভুত লাগলো আরহামের বিষয়টা। নানা ভাবনা চিন্তা নিয়ে রুমের ভিতরে আয়নার সামনে আসলো সে। কানে বড় বড় ঝুমকা আর কপালে টিকলি পড়ে পিঠ অব্দি হালকা কোঁকড়ানো চুলগুলো ছেড়ে দিলো। হালকা মেকআপ দিয়ে চোখে গাঢ় করে কাজল দিলো, হালকা গোলাপি রঙের লিপস্টিক দিলো ঠোঁটে। সবটা শেষ করে আয়নায় নিজেকে দেখতে লাগলো। না ভালোই লাগছে।
মিহিকা একটা তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে রুম থেকে বের হতে নিবে তখনি পিছন থেকে একটা শক্ত হাত মিহিকার মুখ চেপে ধরলো। মিহিকা কিছু বুঝে উঠার আগেই চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে এলো।
মাহি রেডি হয়ে মিহিকার রুমে এলে। বরযাত্রী চলে এসেছে। মাহি মিহিকার রুমের সামনে এসে দেখলো রুমের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করা।মাহি কপালে ভাঁজ ফেলে দরজা ধাক্কাতে লাগলো। তখনি মাহির হাতের ফোনটা বেজে উঠলো। মিহিকার নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে,
“তুই যা আমার মাথায় প্রচন্ড ব্যথা। ঘুমের ঔষুধ খেয়েছি ডাকিস না।”
মাহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেল। মাহি মুখ ছোট করে এগিয়ে গেল। মিহির মাহির সামনে এসে বলল,
“কি হয়েছে মুখটা এমন করে রেখেছিস কেন?”
মাহি মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“তোকে কেন বলবো রে!”
মিহির কপাল কুচকে বলল,
“তুই আমার সাথে ঠিক করে কথা বলতে পারিস না।”
মাহি নাকমুখ কুচকে বলল,
“নারে পারিনা।”
মিহির কিছু বলার আগেই মাহি মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল। মিহির মাহির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
মাহি এদিকসেদিক তাকিয়ে দেখলো হিয়া ফোনে কথা বলছে। মাহি হিয়ার কাছে যেতেই হিয়া মাহিকে একা দেখে ভ্রুকুচকে বলল,
“কিরে তুই একা কেন? মিহি কোথায়?”
মাহি গাল ফুলিয়ে বলল,
“মিহিপুর মাথা ব্যথা ঔষুধ খেয়েছে। আসবে না এখন।”
হিয়া কপাল কুচকে বলল,
“কি বলিস এগুলো! তাই বলে আসবেই না।”
মাহি হিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
“থাক আমি একটু পরে গিয়ে ডেকে আনবোনি।”
“তাই না হয় করিস।”
মাহি পাশে তাকিয়ে দেখলো আরহাম দাঁড়িয়ে আছে শাওনের সাথে। দুইজন একই শার্ট আর প্যান্ট পড়েছে। আরহাম সাদা শার্ট আর নেভি ব্লু রঙের জিন্স পড়েছে। বেশ সুদর্শন লাগছে আরহামকে। মাহি একপলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো।
ফারাবী আর ইরাকে পাশাপাশি বসানো হয়েছে। কাজী বিয়ের সব ব্যবস্থা করছে। কিছুক্ষন পরেই কবুল বলার মাধ্যমেই ইরা আর ফারাবীর বিয়েটা হয়ে গেল।
অন্যদিকে মাহি তখন থেকে দরজা ধাক্কিয়েই যাচ্ছে কিন্তু মিহিকার কোনো পাত্তাই নেই। অজানা ভয়ে মাহি গুটিয়ে গেল। বিয়ে বাড়ির জমজমাট পরিবেশে খুঁজতে লাগলো হেনা খানকে। কিছু দূরেই আরিফুল খান মিহিকার বাবা দাঁড়িয়ে আছে। মাহি তার কাছে যেতে নিবে তার আগেই আরিফুল খান কোথায় যেন চলে গেলেন। মাহি বুঝতে পারছেনা কি করবে সে।
——————-
মিহিকার জ্ঞান ফিরতেই সে পিটপিট করে চোখ খুললো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো সিলিং। মাথাটা তার ঝিনঝিন করছে। চোখ ঘুরে তাকাতেই দেখলো একটা রুমের বিছানায় শুয়ে আছে। মিহিকা লাফিয়ে উঠতে নিবে কিন্তু পারলো না। তার হাত পা দড়ি দিয়ে বাঁধা। মিহিকা চিল্লাতে যাবে তখন অনুভব করলো মুখেও কাপড় বাঁধা। মিহিকা কিছুই বুঝতে পারছে না। নিজেকে অসহায় লাগছে। কি হচ্ছে এসব তার সাথে? মিহিকা ছাড়া পাওয়ার জন্য ছোটাছুটি করতে লাগলো। কিন্তু কিছুতেই পেরে উঠছে না সে। তখনি হুট করে রুমের লাইট অফ হয়ে গেল।
আচমকা লাইট অফ হয়ে যাওয়ায় ভয়ে মিহিকার গলা শুকিয়ে এলো। মনে মনে যা দোয়া দুরুদ পারে সব পড়তে লাগলো। চোখমুখ খিচে বন্ধ করলো। তখনি একটা পুরুষালি হাত এসে স্পর্শ করলো মিহিকার হাতে। মিহিকা চমকে উঠলো। কেঁপে উঠলো সে। কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছে না। হাতের বাঁধন খুলে দিচ্ছে সেই লোকটা। মিহিকা কিছুই বুঝতে পারছে না। কি হচ্ছে তার সাথে এসব?
হাতের বাঁধন খোলা শেষে পুরুষালি হাতটা স্পর্শ করলো মিহিকার নরম গাল। মিহিকার চোখ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়লো। শীতল হাতটা মিহিকার চোখের জল মুছিয়ে দিলো। কানের কাছে এসে পুরুষালি কন্ঠ ভেসে এলো,
“শীতকালে মেঘনন্দিনীর চোখের পানি যে বেমানান। পানি যে বর্ষাকালে মানায়।”
মিহিকা সরে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করছে। কিন্তু পায়ের দড়ি আর মুখের বাঁধনের জন্য কিছুই করতে পারছেনা।
লোকটা আবারো বলে উঠলো,
“এতো সহজে তো ছাড়া পাবেনা মেঘনন্দিনী। তুমি যে তোমার মেঘরাজের নিজস্ব আস্তানায় বন্দি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এখানেই থাকতে হবে।”
মিহিকা ঘামতে শুরু করেছে। লোকটা মিহিকার মুখের বাঁধন খুলে দিতেই মিহিকা ভাঙা গলায় বলল,
“কে আপনি?”
লোকটা হাসলো। যা অন্ধকারে মিহিকা দেখতে পেল না। মিহিকা আবারো বলে উঠলো,
“আমি বাসায় যাবো।”
লোকটা এবার হো হো করে হাসতে লাগলো। মিহিকার ভয় আরো বেড়ে গেল লোকটার হাসিতে। মিহিকার আর বুঝতে বাকি নেই এই লোকটাই সেই হলুদের রাতের লোকটা। লোকটার মতিগতি বুঝতে পারছেনা মিহিকা। বাসায় না জানি কি অবস্থা? মিহিকার মাথা ব্যথা বেড়েছে। মিহিকা দুই হাত মাথায় চেপে ধরে চেঁচিয়ে উঠে বলল,
“কি চান আপনি?”
লোকটা মিহিকার কোমর ধরে ওকে নিজের বুকে এনে ফেলল। মিহিকার নাকে নাক ঠেকিয়ে বলল,
“যদি বলি তোমাকে চাই মেঘনন্দিনী।”
মিহিকা হাত দিয়ে লোকটার বুকে ধাক্কাতে লাগলো। কিন্তু এক চুল পরিমান ও নড়াতে পারলো না। লোকটা হেসে বলল,
“আমাকে সরানোর মতো তোমার শক্তি এখনো হয়নি মেঘনন্দিনী। কি খাও বলো তো তুমি? এক চুল পরিমান ও তো সরাতে পারলে না।”
মিহিকা ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতেই বলল,
“ছাড়ুন আমাকে, আমি বাসায় যাবো।”
“না তো এখন তো আর বাসায় যাওয়া যাবেনা। এবার যে শশুরবাড়ি যেতে হবে।”
মিহিকা এবার কান্না করে দিলো। লোকটা ধমকে বলল,
“কান্না করছো কেন আমি কি তোমাকে চিমটি দিয়েছি নাকি কামড় দিয়েছি।”
মিহিকার কিছুই ভালো লাগছে না। না জানি তার মা বাবার কি অবস্থা! মিহিকা কাঁপতে কাঁপতে বলল,
“আমার মা-বাবার কী হবে? দয়া করে আমাকে ছেড়ে দিন।”
লোকটা একটু থেমে মিহিকার মুখের দিকে তাকালো। গম্ভীর গলায় বলল,
“তোমার মা-বাবা ভালোই আছে। তাদের নিয়ে বেশি চিন্তা করো না। বরং নিজের অবস্থাটা ভাবো, মেঘনন্দিনী।”
মিহিকার এবার রাগ হলো। তেতে উঠে বলল,
“কে আপনি? এমন অন্ধকার করে চোরের মতো করছেন কেন? সাহস থাকলে সামনে আসেন।”
লোকটা আবারো হেসে বলল,
“বর দেখার জন্য এতটা অস্থির কেন তুমি মেঘনন্দিনী। এটা কিন্তু মটেও ভালো না।”
লোকটার রসিকতা একদম সহ্য হচ্ছে না মিহিকার। আরো জোরে চেঁচিয়ে উঠে বলল,
“এগুলোর মানে কি? আপনার রসিকতা এখন আমার সহ্য হচ্ছে না। বাসায় যাবো আমি।”
লোকটা হেসে বলল,
“এখন এগুলো সহ্য করতে শিখো। কারণ এখন থেকে সবসময় আমার সাথেই থাকতে হবে।”
মিহিকা দ্বিগুন কন্ঠে চেঁচিয়ে বলল,
“থাকবো না আমি।”
লোকটা হুট করেই মিহিকা গাল চেপে ধরলো। শক্ত করে ধরায় মিহিকা ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠলো। লোকটা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“ভালোই ভালোই বলছি মেনে নে। আমার খারাপটা দেখাতে বাধ্য করিস না। সইতে পারবি না বলে দিলাম।”
ব্যথায় চোখ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পরলো মিহিকার। লোকটা মিহিকার গাল ঝাড়া দিয়ে ছেড়ে দিয়ে বলল,
“যা বলছি তাই কর। তাছাড়া খবর করে দিবো বলে দিলাম।”
বলেই হনহনিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল লোকটা। সাথে সাথে রুমে লাইট জ্বলে উঠলো।
মিহিকা মুখে দুইহাত রেখে কান্না করতে লাগলো।
————————
ইরার বিদায় হতেই মাহি আরিফুল খানের কাছে গিয়ে বলল,
“চাচ্চু মিহিপু দরজা খুলছে না।”
আরিফুল সাহেব চিন্তিত মুখে মেয়ে রুমের সামনে গেলেন। মিহিকাকে ডাকতে লাগলো। কিন্তু সারা না পেয়ে তার চিন্তা আরো বাড়তে লাগলো। মুহুর্তেই সবাই এসে দাঁড়ালো মিহিকার ঘরের সামনে। আরিফুল সাহেব পিছনে ঘুরে শাওনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তাড়াতাড়ি দরজা খোলার ব্যবস্থা করো শাওন।”
শাওন আর হামিম মিলে দরজা খোলার জন্য দরজায় ধাক্কাতে লাগলো। তিন চারবার বারি দিতেই দরজা খুলে গেল। দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকলো ওরা। রুমের কোথাও মিহিকাকে দেখতে না পেয়ে হেনা খান অস্থির হয়ে পরলো।
আরিফুল সাহেব ঠাস করে সোফায় বসে পরলো। শাওন চিন্তিত মুখে চারিপাশ তাকালো। কি করবে বুঝতে পারছেনা সে? মাহি যেন কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। মিহিকা কোথায় হারিয়ে গেল। অজানা আতঙ্কে বুক কাঁপছে সবার। না জানি কোন অবস্থায় আছে মেয়েটা।
————————
মিহিকা কান্না করছিলো তখনি রুমের লাইট আবারো বন্ধ হয়ে গেল। মিহিকা হাঁটুতে মুখ গুজে আরো জোরে জোরে কান্না করতে লাগলো।
কিছুক্ষণ পরেই আবারো লাইট জ্বলে উঠলো।
#চলবে