#ধৈর্যের_পরীক্ষা
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি।
#পর্ব_শেষ
এরপর থেকে রাতুল সারিকাকে তার ভার্সিটিতে নিজের বাইকে করে দিয়ে আসে আর নিয়েও আসে।একদিন সে তাড়াতাড়ি সারিকাকে নিতে চলে গেলে দেখে সারিকার ছুটি অনেক আগেই হয়ে গিয়েছে।আসলে সারিকা টিউশন আর ক্লাসের সময় মিলিয়ে বেশি সময় বলেছে বাসায়।আর সে এখন টিউশনে গিয়েছে। তাই সে ভার্সিটিতে নেই।সে সারিকাকে ফোন করে বলে ভার্সিটির সামনে আসতে বলে।সারিকা এসে দেখে রাতুল আজ তাড়াতাড়ি এসে পরেছে। সারিকা তাড়াতাড়ি নিজের টিউশনি শেষ করে রাতুলের কাছে আসে।রাতুল তাকে কিছু জিজ্ঞেস করে না,,হেলমেট পরিয়ে এবং নিজে পরে বাইক স্টার্ট দেয়।
বাসায় এসে শান্ত কন্ঠে বলে~~
“তোমার আজ থেকে টিউশনি করানো বন্ধ। আমি তোমার যাবতীয় দায় দায়িত্ব নিয়েছি তাই আমিই তোমার সব খরচ চালাবো”।
“”এই বিষয়ে আমাদের বাসর ঘড়েই কথা হয়েছে। আমি এই বিষয়ে কোন তর্কে যেতে চাই না।শুধু একটাই কথা বলতে চাই যে আমার মনের দায়িত্ব নিতে পারে না তাকে আমার অন্য দায়িত্বও নিতে হবে না।””
এক পর্যায়ে তাদের দু’জনের কথা কাটাকাটি হয়।রাতুল সারিকাকে কিছু কটু কথা বলে রেগে অনামিকার বাসায় চলে যায়।সে চায় না সারিকাকে আর এই লোক দেখানো সম্পর্কে বেধে রাখতে।খুব শীঘ্রই তাকে মুক্ত করে দিবে এই সম্পর্ক থেকে।তার জন্য আগে অনামিকাকে বিয়ের জন্য রাজি করাতে হবে।তাই সে অনামিকার বাসায় যায়।গিয়ে দেখে তাদের বাড়ি খুব সুন্দর করে সাজানো।তাদের বাসার ভেতরে ঢুকে দেখে অনামিকা বধু বেশে বসে আছে আর তার পাশে সেইদিনের সেই ছেলেটা।অনামিকাও রাতুলকে দেখে একটু অপ্রস্তত হয়ে যায়।সে রাতুলকে আলাদা ডেকে নিয়ে গিয়ে বলে~
‘”দেখো তুমি তোমার মায়ের পছন্দে বিয়ে করে ফেলেছ আমিও আমার বাবার পছন্দে করে ফেললাম।ভেবে দেখলাম আমাদের এই সম্পর্কের কোন ভবিষ্যৎ নেই। তাই যে যার মতো পছন্দের জীবন সাথী নিয়েই থাকাটা বেটার।আশা করি বুঝতে পেরেছ আর কোন ঝামেলাও করবে না ভবিষ্যতে আমার বিয়ে নিয়ে।”
রাতুল একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে~
“করব না কোন ঝামেলা।শুধু একটা কথা বলো তো,,বিয়েটা তুমি তোমার বাবার পছন্দের করেছো নাকি নিজের?”
এই পর্যায়ে অনামিকা কিছু বলতে পারে না জোর গলায়।সে আমতা আমতা করে বলে~
“বাবার”।
“হয়েছে। আর বলা লাগবে না। আজকে জানো এইখান থেকে গিয়ে খাশ মনে দুই রাকাআত শোকরানা নামাজ পড়বো তোমার মতো একজন ফ্রড থেকে বাচিয়ে দিয়েছেন আল্লাহ আমাকে। আর সারিকার মতো একজন পূন্যবতী মেয়েকে আমার বউ হিসেবে দিয়েছেন তাই”।
অনামিকা রেগে কিছু বলতে চাইলে রাতুল তাকে বলার সুযোগ না দিয়েই চলে যায়।মনের কষ্টে একটা দূরে নদীর তীরে যেয়ে বসে থাকে।রাতে অনেক লেট করে ফিরে। বাসায় এসে দেখতে পায় সারিকা এখানে না ঘুমিয়ে তার জন্য ওয়েট করছে।
সে মনে মনে আল্লাহর কাছে অনেক ধন্যবাদ দেয় তাকে এমন একজন স্ত্রী দেওয়ার জন্য। আজ সে বুঝতে পারছে বাসর রাতে কেন সারিকাকে ওই কথাগুলো বলার ওর এতেটা বিধস্ত দেখাচ্ছিলো।
রাতুল ফ্রেস হয়ে এসে দেখে সারিকা তার খাবার নিয়ে বসে আছে। সেও চুপচাপ বসে পরে খেতে। মনে করে সারিকাকে জিজ্ঞেস করে সে খেয়েছে কিনা। সারিকা গম্ভীর মুখে বলে সে খেয়েছে। রাতুল জানে সে খায় নি। কারণ একদিন ময়না(বাসার হেল্পিং হ্যান্ড) কথায় কথায় বলে দিয়েছিলো রাতুল না আসা পর্যন্ত সারিকা খায় না।
সে এক লোকমা ভাত সারিকার মুখের সামনে ধরে।সারিকা অবাক হয়ে যায়।সে পুনরায় জানায় সে খেয়ে নিয়েছে রাতের খাবার। রাতুল শান্ত কন্ঠে বলে~
“মিথ্যাটা একটু পরে বলো। আগে ভাতটা নাও মুখে।দেখো তুমি যদি লোকমা টা না নাও আমিও খাবো না।”
সারিকা উপায় না পেয়ে তার সাথেই খেতে লাগলো।বিয়ের পর আজই প্রথম রাতুল তাকে খাইয়ে দিচ্ছে। মনে মনে খুশিতে ফেটে পরলেও মুখে তা প্রকাশ করে না সারিকা।
খাওয়ার পর সারিকাকে বেলকনিতে আসতে বলে রাতুল আগে আগে সেখানে চলে যায়।সারিকা এটো থালাবাসন রান্নাঘরে রেখে আসে,,তারপরে গিয়ে রাতুলের পাশে বসে।তারপর রাতুল আস্তে ধীরে অনামিকার সব কথা বলে।সেই সাথে এ-ও বলে সে এই সম্পর্কটাকে একটা সুযোগ দিতে চায়।এতক্ষণ সব চুপ করে শুনলেও এখন আর চুপ করে থাকতে পারে না সারিকা।সে বলে~
“আজ অনামিকা ছেড়ে গিয়েছে বলে আপনি এই সম্পর্কটাকে কন্টিনিউ করতে চান,,সে যদি না যেতো তাহলে আমাদের কিন্তু এক না এক সময় বিচ্ছেদ ঠিকই হতো। আমি কেন আপনার সেকেন্ড চয়েজ হবো? আমারও অধিকার আছে কারো ফার্স্ট চয়েজ হওয়ার। আপনি চাইলেও আমি এখন আর সম্পর্কটাকে চাই না। খুব তাড়াতাড়ি আপনাকে মুক্ত করে দেবো।
“আমি কি ভালোবাসার এতটাই অযোগ্য যে সকলে আমায় ছেড়ে চলে যায়?”
“উহু,,আপনি মানুষ হিসেবে চমৎকার আর স্বামী হিসেবেও। যদিও সেটা আপনার লোক দেখানো। কিন্তু আপনি একটা কথা বলেন আমাকে,,কাল যদি অনামিকা আবার আপনার কাছে ফিরে আসতে চায় আপনার মন কি একবারও বলবে না তাকে একটা সুযোগ দিয়ে দেখি। তখন আমি তো আবার সেই লোক দেখানো সম্পর্কে পরে যাবো। আমি কেন এমন দোদুল্যমান সম্পর্কে থাকবো? আমার কি অধিকার নেই স্বামীর সত্যিকারের ভালোবাসা পাওয়ার? তাই বলছি,,আমাকে ছেড়ে দেন। আমি চলে যাওয়ার পর না হয় যে আসবে তাকে নিজের ভালোবাসাটা দিয়েন।আমার এখন ভালোবাসতে ভয় হয় এই ভেবে,, কোন দিন জানি আপনি আমাকে ত্যাগ করেন।
রাতুল নিজের জায়গা ছেড়ে সারিকার সামনে এসে তার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নেয়।তারপর বলে~
“একবার বিশ্বাস করে দেখো ঠকবে না কথা দিচ্ছি। ঠকে যাওয়া মানুষ কখনো অন্যকে ঠকায় না।
সারিকা রাতুলের চোখের চোখ রাখে। তার চোখ জোড়া অশ্রুতে পরিপূর্ণ কিন্তু ছেলে বলে সেগুলো বের করতে পারছে না। সারিকা রাতুলের চোখ দেখে তার মনে অবস্থা বুঝতে পারে। তাই সে বলে~
“দিলাম একটা সুযোগ। কিন্তু আপনাকে নিজেই এই বিশ্বাস অর্জন করতে হবে।”
রাতুল হাসি মুখে সারিকার কথা মেনে নেয়। এরপর থেকে শুরু হয় তার বিশ্বাস অর্জনের মিশন। দিন যায়,, মাস যায় সারিকার প্রতি রাতুলের ভালোবাসা দিন দিন আরো বাড়তে থাকে। রাতুল মাঝে মধ্যে একা একা বসে ভাবে কেন সে অনামিকার আগে সারিকাকে ভালবাসলো না? তাহলে বাসর রাতে ওই সকল কথা বলে সারিকাকে কষ্ট দিতে হতো না।
আগে রাতুল শুধু জুম্মার নামাজটা পড়ত এখন সে নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে।এ কদিন রাতে সারিকা তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তে উঠলে দেখে রাতুল আগে থেকেই নামাজ পড়ছে। সে একটু অবাক হয় তাও কিছু বলে না। উঠে নিজের মতো ফ্রেশ হয়ে এসে নামাজে দাড়ায়।
________________
কয়েক বছর পর~
“এই সারা এই দিকে আসো। আজ তোমার একদিন কি আমার একদিন। নতুন বিছানাটা চাদরটা কালারস দিয়ে কি করে ফেলেছো।”
সাড়ে চার বছরের বাচ্চাটা মায়ের মার থেকে বাঁচতে দাদুর শাড়ীর আঁচলের তলায় লুকিয়ে পড়ে। মিসেস রহমানও তাকে নিজের আঁচল দিয়ে ঢেকে চুপ করে বসে থাকে। তার পুত্র বধু যে ভীষণ ক্ষেপেছে। হাতের কাছে পেলেই দুটো না লাগিয়ে দেয় নাতনিটাকে।শ্বাশুড়ির রুমে ঢোকার আগেই কলিংবেলের আওয়াজ শুনতে পায় মেয়েটি। গিয়ে দরজা খুলে দেখে তার সাহেব এসেছে। লোকটাকে দেখে তার যেনে রাগ আরে বৃদ্ধি পায়। এই লোকটার আশকারা পেয়ে মেয়েটা দিন দিন বাদরকেও অতিক্রম করে ফেলছে।
অফিস থেকে বাড়িতে ফিরে বউয়ের এমন রুদ্রাণী রূপ দেখে কিছুটা ভরকে যায় রাতুল। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বউ তার চলে যায় কিচেনে। ফ্রেশ হতে নিজেদের রুমে ঢুকলে চক্ষু তার কপালে উঠে যায়।বিছানার চাদরের এই বেহাল অবস্থা দেখে বুঝতে পারে কি কারণে তার মিসেস রেগে আছে। সে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হতে চলে যায়। এসে দেখে বউ তার রুম গুছাচ্ছে আর তাদের বাপ-বেটির পিন্ডি চটকাচ্ছে। রুম গোছানো শেষ হয়ে গেলে সারিকা রুম থেকে বের হতে গেলে রাতুল তাকে আটকে দেয়। টেনে নিয়ে আবদ্ধ করে নিজের বুক পিঞ্জরায়।সারিকা প্রথমে ছটফট করলেও কয়েক মুহূর্তে শান্তও হয়ে যায়।রাতুল তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে~~
“ওকে বকো না আর।আমি ওকে বুঝিয়ে বলবো এমন আর না করতে।”
সারিকা যেনো তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে। মেয়েকে বকার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য এতটা আদর। যা বেটা লাগবে না তোর এই আদর।সে বলেই ফেলে~~
“মেয়েকে যেনো আর না বকা দেই তাই এতো কাহিনী। ছাড়ুন লাগবে না আপনার আদর।দেন মেয়েকে আরো লায়।পরে বাদর হয়ে মাথায় উঠে নাচবে তখন বুঝবেন কত ধানে কত চাল।ছাড়ুন বদ লোক।”
রাতুল হেসে দেয় সারিকার এমন কথা শুনে। সে নিজের ডান হাত সারিকার গালে রেখে আলতো করে স্লাইড করতে করতে বলে~
“মেয়ের মাকে বুঝি এমনিতে আদর করি না। ওহ্ হো,কয়েকদিন ধরে তো করতে পারছি না। আচ্ছা ম্যামের কি এই কারণে অভিমান হয়েছে? আজকে রাতে সব অভিমান শেষ করে দেবো। ঠিক আছে মিসেস রহমান?”
সারিকা রাতুলের বুকে আলতো করে কিল দিয়ে বলে~~
“অসভ্য লোক আমি কি তা বলেছি। শুধু আজেবাজে কথা।”
“বলতে হবে কেন.? আমি বুঝি না মনে হয়।”
“কচু বুঝেন। খেতে আসুন। পাজিটা আপনার জন্য ওয়েট করে বসে আছে আজ।”
রাতুল সারিকার কপালে ভালোবাসার পরশ দিয়ে ছেড়ে দেয়।
রাতে মা-মেয়ে রাতুলের বুকে ঘুমিয়ে আছে। রাতুল এখনো ঘুমাইনি। সে তাদের দুজনের মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মনে মনে বলছে~~
~~আলহামদুলিল্লাহ।আমি আজ সুখী,,পরিপূর্ণ। আমি অর্জন করে পেরেছি সারিকার বিশ্বাস। তার বদলে পেয়েছি এক আকাশ পরিমাণ ভালোবাসা আর আমার কলিজার টুকরাকে। হে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন,, আপনাকে ধন্যবাদ আমাকে আজ এত সুখী করার জন্য আর আমাকে ধৈর্যের পরীক্ষায় জিতিয়ে দেওয়ার জন্য।
~~সমাপ্ত