#ধৈর্যের_পরীক্ষা
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি।
#পর্ব_সূচনা
পছন্দের মানুষটির সাথে পবিত্র এক বন্ধনের মাধ্যমে সারা জীবনের জন্য জুড়ে যাওয়ার মতো আনন্দ আর সুখের হয়তো কিছুই নেই।আমিও এই সুখটা অনুভব করেছিলাম যখন রাতুলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো।রাতুল রহমান আমার স্বামীর নাম,,যার সাথে আমার আজ বিয়ে হয়েছে। আমার নাম সারিকা সুলতানা।কিন্তু আমার এই সুখানুভূতি বেশিক্ষণ স্থায়ী থাকে না যখন কিনা রাতুল আমাকে বলে~~
~~দেখো আমি তোমাকে শুরুতেই বলে দিচ্ছি আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি আর এই বিয়েটা আমি আমার মা-বোনের ইচ্ছেতে করেছি।তাই কখন আমার থেকে স্ত্রীর মর্যাদা পাবে না।
তার এই কথাটা আমাকে বুকে যেয়ে কতটা বাজে ভাবে আঘাত করলো সেটা যদি তাকে দেখাতে পারতাম তাহলে সে হয়তো তার কথাটা ফেরত নিয়ে নিতো।কিন্তু আফসোস বাহ্যিক আঘাত দেখানো গেলোও অভ্যন্তরীণ আঘাত দেখানো যায় না।আমি তেজহীন গলায় বললাম~~
~~তাহলে যাকে ভালোবাসতেন তার কথা পরিবারকে জানান নি কেন..?তারা নিশ্চয়ই আপনার পছন্দের মানুষটির সাথেই আপনার বিয়েটা দিতো। মাঝখান দিয়ে আমাকে এই লোক দেখানো সম্পর্কে জড়াতে হতো না।
রাতুল বললো~~
~~আমার গার্লফ্রেন্ড এখনই বিয়ের জন্য প্রস্তুত না।সে আরো পরে বিয়ে করবে।আমি চেয়েছিলাম আরো পরে বিয়ে করতে কিন্তু আম্মু আমার বিয়ের চিন্তা করতে করতে অসুস্থ হয়ে পরেছিলো।ডাক্তার বলেছেন তাকে চিন্তা মুক্ত না রাখতে পারলে যেকোন সময় স্টোক করতে পারে।তাই মায়ের খুশির জন্য এই বিয়েটা করা।
আমি আর কোন কথা বললাম না,,এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকলাম তার মায়াবী মুখ টার দিকে।বুকের অসহ্য যন্ত্রণা গুলোর প্রকাশ হতে চাইছে অশ্রুর মাধ্যমে কিন্তু আমি তা কিছুতেই হতে দিবো না।রাতুল নিজেই বললেন ~~
~~তুমি চিন্তা করো না।তোমার পড়াশোনা ও যাবতীয় সব দায়-দায়িত্ব আমি ভালো ভাবে পালন করবো।পৃথিবীর সামনে আমি হবো বেস্ট হাসবেন্ড কিন্তু এই চার দেয়ালে জানবে আমাদের মধ্যকার সম্পর্কের আসল সমীকরণ।
আমও একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললাম~~
~~আমার মনের দায়িত্ব কে নেবে.?!যাবতীয় অন্য দায়িত্বের চেয়ে এই দায়িত্বটা কি বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়..?! আপনাকে আমায় নিয়ে ভাবতে হবে না।আমি নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে পারবো।এই বিষয়ে আশা করি আপনি আর কথা বলবেন না।
রাতুল আরো কিছু বলতে চেয়েছিলো কিন্তু সারিকার কথা শুনে আর কিছু বলতে পারে না।মূলত সে বলতে পারে না।সারিকার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে অনেক কষ্ট পেয়েছে কিন্তু সে-ও যে দুই নারীর কাছে বাধা।এক তার মা আরেক তার প্রিয় নারীটি।
সারিকা নিজের লাগেজ থেকে একটা সালওয়ার সুট বের করে ওয়াশরুমে চলে যায়।ফিরে আসে এক ঘন্টা পরে।রাতুল ততক্ষণে ঘরেই চেঞ্জ করে ফেলেছে।আড়চোখে সারিকার দিকে তাকিয়ে দেখে তার চোখ ফুলে গেছে,, ছোট্ট খাট্টো নাকটাও লাল হয়েছে আছে।সারিকা একটু পরপরই নাল টানছে।
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে সারিকা নামাজের হিজাব পরে রাতুলের সামনে এসে বলে~~
~~জায়নামাজ কোথায় একটু বলবেন..?!আমারটা আনা হয়নি তাই আপনার কাছে চাইলাম।
রাতুল বিছানায় বসে ফোন টিপছিলো সারিকার কথায় তার দিকে তাকায়। মেকআপ তোলার পর সারিকার আসল রূপটা দেখে ঘোর লেগে যায়।যতই হোক আল্লাহর কালাম পড়ে তিনবার কবুল বলে তারা একে অপরকে আপন করে নিয়েছে। এমন একটা পবিত্র সম্পর্কের সামনে একটা হারাম সম্পর্ক নিতান্তই তুচ্ছ। তার ঘোর কাটে সারিকার গলার আওয়াজে।সারিকা আবার তাকে জায়নামাজের কথা জিজ্ঞেস করলে সে বিছানা থেকে উঠে একটা জায়নামাজ এনে সারিকাকে দেয়।তারপর আবার বেডে বসে ফোন টিপতে থাকে।সে কিছুতেই ফোনে মন দিতে পারছে না,,ঘুরে ফিরে তার চোখ সেই সারিকার দিকেই চলে যাচ্ছে।
নিজের মন ঘোরানোর জন্য সে কল লাগায় তার ভালবাসার মানুষটিকে।তার নাম অনামিকা।অনামিকা একজন মডেল।তেমন নাম ডাক না থাকলেও একেবারেই যে নেই তাও না। কথা বলার জন্য সারিকার নামাজের ডিস্টার্ব হতে পারে এই ভেবে রাতুল ফোন নিয়ে বেলকনিতে চলে যায় আর বেলকনির দরজাটা লাগিয়ে দেয়।সারিকা ২ রাকাত করে ৪ রাকা’ত নফল নামাজ পরে।শেষে দোয়া করে~~~
~~~হে রাব্বুল আলামিন,, আপনি সকল বিষয়ে সর্বজ্ঞানী। আপনি বান্দার জন্য যা ভালো মনে করেন তাই করেন।হে রহমানুর রাহিম,,আমাকে ধৈর্য দিন যাতে আমি ভবিষ্যতে খারাপ পরিস্থিতি গুলোতে টিকে থাকতে পারি।আপনি তো জানেন আমি তাকে(রাতুল)কতটা ভালোবাসি,,কতটা চাই।আজ সে আমার হয়েও আমার হইলো না।সে দয়াময় প্রভু আপনি আমাকে তাকে দান করুন।তাকে সকল প্রকার হারাম থেকে বের করে সরল সঠিক পূণ্য পথে পরিচালিত করুন।আমি আমার স্বামীর ঘর করতে চাই,,যেখানে থাকবে একে অপরের প্রতি জান্নাতী ভালোবাসা,, বিশ্বাস,, মর্যাদা,,সম্মান।আমি বুঝতে পারছি আমার সামনের একটা কঠিন পরীক্ষা আসতে চলেছে যা কিনা আমার ধৈর্যের পরীক্ষা। আপনি আমাকে এই পরীক্ষায় টিকে থাকার মতো পর্যাপ্ত ধৈর্য দিন প্রভু।লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাঃ। আমিন।
সারিকা নিজের মোনাজাত শেষ করে আরো কিছুসময় জায়নামাজে বসে থাকে তারপর উঠে হিজাব ও জায়নামাজ নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে বিছানা থেকে বালিশ নিয়ে সোফায় চলে যায়।শুতেই ক্লান্তির কারণে ঘুম চলে আসে।সারিকা ঘুমিয়ে যাওয়ার আরো এক ঘন্টা পর রাতুল অনামিকার সাথে কথা বলে ঘরে আসে।এসে দেখে সারিকা সোফায় ঘুমিয়ে আছে।সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেও ঘুমাতে চলে যায়।
__________________
দেখতে দেখতে তিন মাস চলে যায়।এই তিন মাসে রাতুল-সারিকার সম্পর্কে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে।রাতুলের ক্ষেত্রে তা চোখে পরার মতো।সারিকাকে সে নিজের বেস্টফ্রেন্ড বানিয়ে নিয়েছে। তার সকল প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় কথাগুলো তার সারিকাকে বলা লাগবেই।সারিকাও নিরব শ্রোতার মতো মন দিয়ে রাতুলের কথা শুনে। রাতুল যখন তার আর অনামিকার দুষ্টু -মিষ্টি খুনসুটি গুলোর কথা বলে তখন সারিকার বুকে প্রচন্ড ব্যথা হয়।স্বামীর মুখে তার ভালোবাসার নারীর কথা শুনে কোন নারীই বা ভালো থাকতে পারে..?!
রাতুল যখন রাতে ২/৩ টায় অনামিকার সাথে কথা শেষ করে ঘুমের কোলে ঢলে পরে তখনই সারিকা উঠে নামাজে দাঁড়ায়। তার রবের কাছে মন খুলে সারাদিনের কথা উগরে দেয়।নিজের জন্য অঢেল ধৈর্য চায়।কারণ কোন খারাপ পরিস্থিতিই আসে বান্দার ধৈর্য পরীক্ষার জন্য। যে যতো বেশি ধৈর্য ধারন করতে পারবে সে তত বেশি সফল হবে ধৈর্যের পরীক্ষায়।
কিছু দিন পর~~
রাতুল তার দুলাভাইয়ের সাথে পার্টনারশীপে একটা বিজনেস শুরু করেছে।রাতুল এইসব বিষয়ে নতুন তাই বিজনেসে তার বেশি সময় দেওয়া লাগছে সব কিছু বুঝে নেওয়ার জন্য। এই কারণে অনামিকাকে সময় দিতে পারছে বলে আজ তিনদিন অনামিকা রাগ করে তার সাথে কথা বলছে না।
সারিকাকে এই বিষয়ে বললে সে বলে~~
~~তাহলে আজ তার সাথে মিট করেন।কিন্তু আপনি তাকে বলবেন না।হুট করেই দেখা করতে চলে যান।এক প্রকার সারপ্রাইজিং হবে বিষয়টা।কিছু টুকটাক গিফ্টও নিতে পারেন।
রাতুলের তার কথাটা পছন্দ হয়।সে একটা ফুলের বুকে নিয়ে তার সাথে দেখা করতে যায়।রাতুল জানে অনামিকার আজ একটা ফটো সুট আছে আর সে কোথায় থাকতে পারে।তাই সে সেই জায়গাই চলে যায়।গিয়ে দেখে সে একজন ছেলের সাথে অনেক ক্লোজ হয়ে দাড়িয়ে আছে আর হেসে হেসে কথা বলছে। বিষয়েটা রাতুলের একটুও পছন্দ হয় না।সে অনামিকাকে ডাক দিলে অনামিকা চমকে তার দিকে তাকায়।সেই সাথে তার সাথে দাড়ানো ছেলেটাও।
রাতুল তার কাছে এগিয়ে গিয়ে ফুলের বুকেটা দিয়ে বলে~~
~~কেমন আছো..?আর এটা তোমার জন্য।
~~ভালো আছি।তুমি এখানে কি করছো..?!দেখছো না ফটো সুট হচ্ছে তাও সেটে ঢুকে পরলে।
একটা রুড ভাবেই কথাগুলো বলে অনামিকা।তার পাশে দাড়ানো ছেলেটা অনামিকাকে বলে~~
~~উনি কে অনু..?
~~ফ্রেন্ড।
রাতুলকে শুধু নিজের ফ্রেন্ড হিসেবে পরিচয় দেওয়ায় রাতুল অনেক অবাক+রেগে যায়।সে বলে~~
~~জাস্ট ফ্রেন্ড..?আর কিছু নই আমি..?!
অনামিকা আমতা আমতা করে বলে~~
~~নাহ,,ভালো ফ্রেন্ড আর কি।
~~ওহহ,,আচ্ছা। ভালো,,থাকো তুমি।সরি এসে ডিস্টার্ব করার জন্য।
রাতুল কথাগুলো বলে হনহনিয়ে চলে যায়।অনামিকা তাকে একবারও আটকানোর চেষ্টা করে না।রাতুল তার বাইক চালিয়ে বাসায় এসে পরে।ময়না এসে দরজা খুলে দেয়।ময়না একটু অবাকই হয় রাতুলকে এই অসময়ে বাসায় দেখে।তাও কিছু জিজ্ঞেস করে না।রাতুল গটগটিয়ে নিজের রুমে যেয়ে দেখে সারিকা ফার্স্ট এড বক্স নিয়ে কিছু একটা করছে।পায়ে কিছু একটা লাগাচ্ছে। হাতেও ব্যান্ডেজ দেখা যাচ্ছে। সে এগিয়ে এসে দেখে তার বাম হাতের কনুইয়ের নিচ থেকে বেশ খানিকটা কেটে গিয়েছে আর বাম পা টাও এক জায়গায় রক্ত জমে কালো হয়ে আছে।সে তাড়াতাড়ি করে তার পাশে বলে বলে~~
~~এইসব কি করে হলো..?এত ব্যথা পেলে কীভাবে..?
সারিকা তাকে এই অসময়ে দেখে থতমত খেয়ে যায়।সে আমতা আমতা করে না বলার জন্য। রাতুল এমনিতেই রেগে ছিলো এখন আবার তার এই আমতা আমতা দেখে রেগে বিশাল এক ধমক লাগায়।
~~বলবে কি হয়েছে না দিবো হাত ঘুরিয়ে এক থাপ্পড়..?!
সারিকা ভয়ে ভয়ে বলে~~
~~একটা রিক্সা এসে ধাক্কা দিয়েছে পরে গিয়ে ব্যথা পেয়েছি।
~~কেমনে..?চোখ কই রেখে হাটো তুমি..?
~~চোখ জায়গা মতো রেখেই হাটি।আসলে আমি রাস্তা পার হতে পারি না তো।যেই ফ্রেন্ডটা রাস্তা পার করিয়ে দেয় সে আসে নাই আজ।তাই আজ এমনটা হলো।
রাতুল তাকে বকতে বকতে তার হাতে পায়ে ঔষধ লাগিয়ে দেয়।সারিকা এত ব্যথার মধ্যেও হাসছে।কারণ বিয়ের ওপর আজ প্রথম রাতুল তার অধিকার দেখালো।তাকে বকছে।
সন্ধ্যায় রাতুলের বড় বোন নাফিসা তার দুই বাচ্চাকে নিয়ে আসে।তার হাসবেন্ড তাকে রাতুলদের বাসার সামনে রেখে গিয়েছে। রাতে এসে আবার নিয়ে যাবে একি এলাকায় বাবার বাড়ি হওয়ায় নাফিসা মন চাইলেই মা-ভাইকে এসে দেখে যায়।সারিকা তো তাদের আসায় এত খুশি হয়েছে যে নিজের ব্যথা ভুলে গিয়ে লাফ দেয়।ফলাফল স্বরুপ পরে যায়।কিন্তু নাহ,,পরে গিয়েও পরে না।কারণ রাতুল যে তাকে ধরে ফেলেছে।
~~তুমি আদিল-আহনাফ হয়ে গেলে..?ব্যথা অবস্থায় কেউ লাফ দেয়..?!
সারিকা অপরাধী কন্ঠে বলে~~
~~সরি।আসলে আপাদের দেখে খুশির ঠেলায় এমন করে ফেলেছি।একটু আদিল-আহনাফকে কাছে নিয়ে যান।আমি ওদের আদর করবো।তার আগে কিচেনে নিয়ে যান ওদের জন স্নেক্সস বানাবো।
রাতুল তাকে দুই ধমক দিয়ে সোফায় বসিয়ে রাখে পরে রেস্টুরেন্টে থেকে স্নেক্সস অর্ডার দেয়।পুরোটা সন্ধ্যা পরিবারের সাথে বেশ ভালোই কাটে।একবারও রাতুলের অনামিকার কথা মনে পরে না।
রাতে শুতে গিয়েও রাতুলের ঝাড়ি শুনেছে সারিকা।সারিকা সোফায় শুবে কিন্তু রাতুল তাকে বেডের শোয়াবে। ব্যথা পায়ে সোফায় কি ভালো ভাবে শোয়া যায়..?সারিকা তার কথা শুনবে না,,রাতুলও তার কথায় অটল।শেষে রাতুল সারি কাকে বেডে শুইয়ে নিজের এক হাতের সাথে সোফিয়ার ভালো হাত শক্ত করে বেধে দেয়।যাতে সারিকা রাতে উঠে সোফায় গিয়ে না শুতে পারে।সারিকাও অসহায়ের মতো শুয়ে থাকে বিছানায়।
চলবে