ধূসর কাবিন রঙিন প্রণয় পর্ব-০৮

0
655

ধূসর কাবিন রঙিন প্রণয়
পর্ব ৮

এইবাড়ির অন্য একটা রুমে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখছে অন্য আরেকজনও। চৈতালী শাড়ি, গয়না কিছুই খোলেনি। দু’বার শিউলি, একবার জোবাইদা বেগম এসে দেখে গিয়েছেন চৈতালীকে। জোবাইদা বেগম ভারী কাপড় বদলে সুতি শাড়ি পরে নিতে বলেছেন চৈতালীকে। চন্দ্রিমার শরীরটা নাকি হঠাৎ খারাপ করেছি। মাহিম তাই চন্দ্রিমার রুমেই আছে জানিয়ে গিয়েছেন। শিউলি মেয়েকে মন খারাপ করতে নিষেধ করেছেন। কিছুক্ষণ পর ঘুরে আবার আসেন শিউলি। উসখুস করতে করতে বলেন,

“মন খারাপ করিস না। এই মাইয়া আর কয়দিন। থাক আইজ মাহিম জামাই বাবাজি ঐ রুমে। না হইলে মানুষই মন্দ কইবো। বলবো নতুন বৌ পাইয়া পুরানা বৌরে ভুলে গেলো। আইচ্ছা টাকার ব্যাগ কই রাখছস? আবার বড় ভাবিসাবরে দিয়া দেছ নাই তো? আসছিল নাকি তোরে দেখতে? শোন শাশুড়িরে ব্যাগ দিস না। তোর কাবিনের পাঁচ লাখ টাকার ব্যাগ কই? নিয়া গিয়া নিজের কাছে রাখতে চাইছে নাকি বড় ভাবি?

“না আম্মা। ব্যাগ আলমারিতে। এই রুম নাকি আমার। আলমারির চাবি দিয়েছেন আমাকে। বলছেন নিজের মতো গুছিয়ে রাখতে নিজের জিনিস।”

“থাক তোর এখানে রাখনের দরকার নাই। তোর আব্বা বলছে ব্যাগ আমার কাছে দিয়ে দিতে। তুই ছোট মানুষ কেমনে রাখবি না রাখবি। বাড়ির কামের লোক চুরি করবো। টাকাটা মাইর যাইবো। এমনও হইতে পারে তারাই টাকা সরাইয়া নিলো আস্তে এক ফাঁকে। নাম দিব কামের বেটির।”

হেসে দেয় চৈতালী। মায়ের বারবার এসে ঘুরে যাওয়ার কারণ বুঝতে পেরেছে এবার।

“আম্মা, তাদের এত সহায় সম্পদ। এই ভিক্ষার পাঁচ লাখ তাদের চুরি করার দরকার নাই। আর চুরি গেলে আমার যাবে।”

“তোর যাইব মানে? পাঁচ লাখ কী তোর কম মনে হয় যে ভিক্ষার লগে মিলাস?”

“আমারে তো তাই দিছে। তাই না আম্মা?”

“মোটেও না। এইটা তোর হক। তোর কাবিনের টাকা।”

“তাইলে আমার কাবিনের টাকা আমার কাছে থাক। হারালেও আমিই বুঝবোনে আম্মা। তুমি আর আব্বা অনেক করছো আমার জন্য। আর কত চিন্তা নিবা। যাও ঘুমাও।”

“বাহ্ টাকা পয়সা হাতে আসতে না আসতে আমার তোমার চিনছস! তোরে এই পর্যন্ত বড় করছে কে? এইখানে বিয়া দিলো কে?”

“এই টাকাটা থাকুক। আমি বুঝতে পারতেছি এই বাড়িতে আমার ভবিষ্যত কী হবে। তখন টাকাগুলো কাজে আসবে।”

“সেজন্যই বললাম যে তোর কাছে থাকলে হারাইতে পারে। ছোট মানুষ তুই। ভবিষ্যতে আপদে বিপদে তোর কামে আসবো। আর তাছাড়া তোর ভবিষ্যত ভালাই হইবো। ঐ মাইয়া বাঁচবো না বলে বেশিদিন। চাচী আম্মা আর বড় ভাবি চায় তুই তাড়াতাড়ি বাচ্চা জন্ম দিবি। একবার বাচ্চা হইলে তোরে এই বাড়ি থেইক্কা সরাবো কে? তখন তোরই সব।”

“আমারে বড় করতে যা কষ্ট হইছে, তার বিনিময়ে পুরাটাই তো বুঝে পাইছো। পাইছো না? ঘর, জমি সবই তো পাইছো। টাকা আমিই রাখতে পারবো। এতটাও ছোট না। এত ছোট হইলে বিয়ে দিলা ক্যান? আবার বলতেছ বাচ্চাও দিতে। বিয়ের দিনই বাচ্চা দেব? বাচ্চার বাবা কই? বাবা হইলো বড় বৌয়ের রুমে। আম্মা যাও তো, ঘুমাও। টাকার চিন্তায় ঘুম হারাম করা লাগবে না।”

শিউলি গজগজ করতে করতে চলে গিয়েছেন। একবার ভেবেছিলেন মেয়েকে দুটো কড়া কথা বলবেন। কিন্তু সামলে নিয়েছেন। এখন আর মেয়ে অবিবাহিত কেউ না। আর তিনিও দাঁড়িয়ে আছেন মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে। টাকা নিয়ে মা মেয়ে বচসা করছেন এই কথা কেউ শুনলে ভালো দেখাবে না। তাছাড়া মেয়ে রেগে আছে। বিয়ের আগে যতই অনিচ্ছা আর রাগ দেখাক। একবার বিয়ে হয়ে গেলে যেকোন বয়সের মেয়ের মন পাল্টে যায়। বাসর রাতে মনের অজান্তেই স্বামীর অপেক্ষা করে। আদর সোহাগের স্বপ্ন দেখে। চৈতালীও তার ব্যতিক্রম নয়। সেখানে নতুন বৌ রেখে স্বামী রাত কাটাচ্ছে বড় বৌয়ের ঘরে। এতে যে কারও মন মেজাজ খিঁচড়ে যাবে। তাই চৈতালীকে আর ঘাটালেন না।

*****

চন্দ্রিমার ঠোঁটে গভীর একটা চুম্বন এঁকে দিতে দিতে অদম্য একটা চাহিদা, একটা তৃষ্ণা জেগে উঠছে মাহিমের মাঝে। চন্দ্রিমার অসুস্থতার পর হতে শারীরিক বিষয়টা একদমই অনিয়মিত। চন্দ্রিমা নিজেই মাঝেমাঝে এগিয়ে আসে। মিলন হলেও তখন একটা অস্বস্তি জেগে ওঠে। কিছু বিষয়ে মাহিমের ধীরস্থির ভাব না বরং বন্যতা ভালো লাগে। বিশেষ মুহুর্তে এত হিসেব করে ভেবেচিন্তে কাছে আসাটা তার সেই বন্যতা নষ্ট করে। কিন্তু চন্দ্রিমাকে ফিরিয়েও দিতে পারে না। ফেরালে চন্দ্রিমা মনে কষ্ট পায়, ভাবে তার অসুস্থতার জন্য মাহিমের হয়তো তাকে আর ভালো লাগে না। আজও এমনই একটা অস্বস্তিতে পড়েছে মাহিম। চন্দ্রিমাকে ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে।

“চন্দ্র সারাদিন আজ অনেক ধকল গিয়েছে তোমার উপর। রাত একটা বেজে আসলো। শুয়ে পড়। তুমি ঘুমালে আমি চলে যাব।”

মাহিমের অস্বস্তি বুঝতে পারে চন্দ্রিমা। এই মুহুর্তগুলো মনের ভেতরটা তেতো হয়ে যায়। বিয়ের পরের দিনগুলো মনে পড়ে। যখন মাহিমকে এমন সময়ে কোন বাহানায় নিবৃত্ত করা যেত না। এখনও মাহিমকে তেমন মুহূর্ত উপহার দিতে চায় চন্দ্রিমা। সে আর স্বামীকে তৃপ্তি দিতে সক্ষম নয়, এই ভাবনাটা তাকে প্রচন্ড ভাবে আঘাত করে। মাহিম সরে যেতে গেলেও তাই টেনে রাখতো চন্দ্রিমা। শরীর খারাপ লাগলেও চাইতো মাহিম পাশেই থাকুক। কিন্তু আজ আটকায় না। না চাইলেও তার জীবনে প্রতিদ্বন্দ্বী এসেছে। জোর করে নয়, তাকে আগের সেই চন্দ্রিমা হয়েই মাহিমকে শুধু নিজের করে নিতে হবে। এরজন্য তার সুস্থ হওয়া প্রয়োজন।

“আমি ঘুমাবো। তুমি যাও। আসলেই রেস্ট প্রয়োজন আমার।”

মাহিম উঠে দাঁড়িয়ে আবার বলে,

“চন্দ্র পোড়া পোড়া একটা গন্ধ পাচ্ছি অনেকক্ষণ। এতক্ষণ নানা ভাবনায় বলা হয়নি। শর্টসার্কিট হলো না তো।”

“না না, মশার কয়েলের গন্ধ। বন্ধ করে দেব। তুমি যাও।”

মাহিম বের হয়ে গেলে বারান্দার দিকে তাকায় চন্দ্রিমা। সেখানে একটা লোহার বাস্কেটে এখনও ছাই চাপা আগুন হয়তো ধিকিধিকি জ্বলছে। তারই গন্ধ পেয়েছে মাহিম। দুপুরে মাহিমের আনা হলুদ লাল শাড়ি পরে হলুদে গিয়েছিল চন্দ্রিমা। চৈতালী আর সবাইকে এটাই দেখাতে চেয়েছিল যে সে চেয়েছে বলেই বিয়েটা হয়েছে। কিন্তু সেই এখনও মাহিমের একমাত্র পছন্দ। কিন্তু গিয়ে যখন দেখলো মাহিম চৈতালীর জন্যও একই শাড়ি কিনেছে। তখনই শাড়িটা খুলে পুড়ে ফেলতে মন চেয়েছে। সেখানে স্বাভাবিক থাকলেও রুমে ফিরেই শাড়িটা খুলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। সে আর চৈতালী কখনই এক নয়, হবেও না। সারোগেসি এইদেশে বৈধ আর সহজ হলে সে কখনোই চৈতালীকে মাহিমের আশেপাশে আসতে দিত না। নিজের শারীরিক সুস্থতার জন্যও তার ডোনার প্রয়োজন। অনেকদিন ধরেই ডোনার খুঁজছে কিন্তু পায়নি। বলতে গেলে মাহিমের জন্য নয়, নিজের জন্যই চৈতালীকে এই বাড়িতে এনেছে। প্রয়োজন শেষে ছুঁড়েও ফেলবে।

****

মাহিম রুমে এসে অবাক হয়ে যায়। চৈতালী জেগেই আছে। বিছানায় আধশোয়া হয়ে একটা বই পড়ছে। মনে হচ্ছে উপন্যাস পড়ছে। এবং এই রাত একটা পর্যন্ত শাড়ি গয়না পরেই বসে আছে।

“তুমি পোশাক পাল্টাওনি কেন? এসবে অস্বস্তি লাগছে না?”

“নাহ। এসি চলছে তো। তাই খারাপ লাগছে না।”

“ওহ্।”

“তাছাড়া আপনার জন্য সাজলাম আপনি ই তো দেখলেন না। তাই খুললাম না।”

“আমি যদি রাতে না আসতাম?”

“তাহলে কাল সকালে দেখতেন। দেখা তো হতোই তাই না?”

“তুমি সকাল পর্যন্ত এভাবে থাকতে?”

“থাকতাম। আমার সমস্যা হতো না। যদিও এত গয়নাগাটি পরার অভ্যাস নাই। অভ্যস্ত না। তাও থাকতাম।”

“কেন?”

“আমার স্বামী আমাকে বৌ সাজে দেখবে না?”

চৈতালীর এত সহজ স্বাভাবিক কথাবার্তায় অবাক হয় মাহিম। ও ভেবেছিল চৈতালী অনেক আড়ষ্ট থাকবে। তাই রুমে ঢুকতে তার নিজেরই অস্বস্তি লাগছিল।

“দরজা লাগিয়ে দেন। আপনি আসবেন বলে রুমের দরজা খোলা রাখছিলাম। আর তো কেউ আসবে না এখন তাই না? আর আপা ডাকতে আসলে দরজা খুলে যেতে পারবেন।”

“কোন আপা?”

“চন্দ্রিমা আপা। আপাই তো ডাকা উচিত না? না দিদি ডাকবো? সিরিয়ালে দেখি ছোট বৌ, বড় বৌকে দিদি ডাকে।”

মাহিমের বিরক্ত হওয়ার কথা। কিন্তু কেমন হাসি পাচ্ছে।

“ডাকো। সিরিয়াল দেখ বুঝি খুব?”

“নাহ্ আম্মা দেখে। তখন দেখা হয় টুকটাক।”

“তুমি তো ভালই শুদ্ধ কথা বলো। তো মাঝেমধ্যে আঞ্চলিক টান আসে যে?”

“আব্বা, আম্মা ভাইদের সাথে তো আঞ্চলিক টানেই বলি। আপনার সাথে শুদ্ধ বলছি।”

“ঘুমাবে না?”

“ঘুমাতে চান? ঘুমান। কাপড় পাল্টাবেন না? আম্মা, মানে আপনার আম্মা কাপড় রেখে গিয়েছে আপনার। কাল কিছু কাপড় এই রুমে নিয়ে আসবেন। তিনদিন আমার সাথে থাকবেন, তিনদিন আপার রুমে। মাসের চার শুক্রবারের দুটো আপা পাবে, দুটো আমি। যদি শুক্রবার পাঁচটা হয়, তাহলে তিনটা আমি পাব। আপাতো আপনাকে বেশি পেয়েছে এতদিন। আমি তাই একটু বেশি পেতেই পারি এখন।”

মাহিম এবার রেগে যায়। এইটুকু মেয়ে এত চটাং চটাং কথা বলে!

“তুমি বেশি বেশি বলছো না? বুঝতে পারছি সারাদিনের নানা ঘটনায় তোমার মাথা এলোমেলো হয়ে আছে। যাও ফ্রেশ হয়ে ঘুমাও।”

“আমার মাথা একদম ঠিকই আছে। আমি বয়সে আপনার থেকে বেশ ছোট হতে পারি। কিন্তু অশিক্ষিত নাবালিকা নই। বিয়ের কবুল বলার সময়ই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি কবুল যেহেতু বলেছি, স্ত্রী হিসেবে নিজের প্রাপ্যটুকু ঠিকই বুঝো নেব। আমাকে ভালোবাসার জন্য জোর করতে পারবো না ঠিক। এটা মন থেকে আসে। কিন্তু স্ত্রী হিসেবে আমার বাকি যা হক তার কিছুই আমি ছাড়বো না।”

হতভম্ব মাহিমকে পাশ কাটিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায় চৈতালী।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে