ধূসর কাবিন রঙিন প্রণয় পর্ব-০৫

0
737

ধূসর কাবিন রঙিন প্রণয়
পর্ব ৫

“কী আজেবাজে কথা বলছো মাহিম। তুমি গাড়ি নিয়ে একাই বের হয়েছ। আমি নিজে দেখেছি।”

“হ্যাঁ, একাই বের হয়েছিলাম আম্মু। চৈতালীকে আমি পেছনের রাস্তা থেকে গাড়িতে উঠিয়েছি। বলে নিতে গেলে মানা করতেন কেউ না কেউ। তাই শফিককে বলে চৈতালীকে আলাদা ভাবে পেছনের গেট দিয়ে বের করিয়ে নিয়েছি। আমি জানতাম সামনের গেট দিয়ে বের হতে গেলে অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। কিন্তু হুট করে বিয়ে করে ফেলছি, আগে কখনও কথা বলার সুযোগ হয়নি ভালোভাবে। তাই ভাবলাম বিয়ের কিছু কেনাকাটা করিয়ে দেই। সাথে চৈতালীর সাথে কিছু কথা বলার, জানাশোনারও সুযোগ হলো।”

দারোয়ান হাসেমকে কতগুলো শপিং ব্যাগ হাতে প্রবেশ করতে দেখে ফজলে আলী খান আর কথা না বাড়িয়ে লাঠিতে ভর করে উঠে দাঁড়ান। স্বামীর সাথে উঠে দাঁড়ান জোহরা বেগমও। খান সাহেবের বয়স হচ্ছে, আগের মতো সেই দোর্দণ্ড প্রতাপ এবং বজ্রকণ্ঠ নেই। সময়ের ফেরে অনেকটাই ঠান্ডা হয়ে গিয়েছেন। এখন তার জায়গা নিয়েছে বড় বৌমা, জোবাইদা। জোবাইদাই এখন সব কিছু শোনে, বলে, নিয়ন্ত্রণ করে। ফজলে আলী খান উপস্থিত থাকেন, কোন মতামত দিতে হলে দেন। জোহরা বেগম তো শুরু থেকেই জোবাইদার উপর কথা বলে না। আর হাসান আলী খান বরাবরই নরম সরম মানুষ। পারিবারিক আলোচনায় ওনার উপস্থিতিটাই শুধু নিশ্চিত হয়, মতামতের পরোয়া কখনই করা হয় না। তিনিও বাবা মায়ের সাথে কামরার দিকে চলে যান। দাদা দাদী, বাবা সবাইকে স্বাভাবিক ভাবে উঠে যেতে দেখে মাহিম বোঝে পরিস্থিতি অনুকূলে চলে এসেছে। জোবাইদার মেজাজ খারাপ হয়ে যায় ছেলের আচরণে। তার সন্তানকে তিনি কঠিন ব্যক্তিত্ব, পারিবারিক ঐতিহ্য ও গর্বের শিক্ষা দিয়ে বড় করেছিলেন। স্বামীর মতো নরম চরিত্রের যেন না হয় তাই ছিল তার চাওয়া। হয়েছিলও তাই, মাহিম তার মনের মতো ছেলে ছিল। অথচ এখন এই ছেলের সমস্ত দুর্বলতা যেন স্ত্রীর আঁচলে। প্রথমে চন্দ্রিমা এখন এই চৈতালী। যখন যাকে সঙ্গী বানাচ্ছে, তারজন্যই নরম হয়ে যাচ্ছে। মাকে একপাশে ঠেলে দিচ্ছে।

“তাহলে চৈতালীর ভাই শফিক এই কথাটা বললো না কেন যে চৈতালী তোমার সাথে গিয়েছে। এত ঝামেলা, ভুল বোঝাবুঝি হতো না তবে।

“শফিক ভয় পেয়ে গিয়েছে। আমি মানা করছিলাম তো, তাই বলেনি। তাই না শফিক?”

মাথা নাড়ে শফিক। কী হচ্ছে বুঝতে পারছে না। তবে এখন হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলানোই সঠিক মনে হচ্ছে।

“এত কেনাকাটার কী প্রয়োজন ছিল মাহিম? আমি তো শাড়ি আনিয়েছি। আর পারিবারিক গয়না যা আছে তা দিয়ে সোনায় মুড়িয়ে কয়েকটি বিয়ে দেওয়া সম্ভব।”

“জোবাইদা।”

“জ্বি আব্বা।”

“বাদ দাও। মাহিম, দাদাভাই তুমি তোমার হবু স্ত্রীকে নিয়ে কোথাও যেতে চাইলে জানিয়েই যেতে পারতে। লুকানোর প্রয়োজন ছিল না। মায়ের মনে কষ্ট দেওয়া ভালো কথা নয়।”

জোহরা বেগম স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তিনিও তো একজন মা, তারমনে কতশত বার আঘাত পেয়েছেন। আর স্ত্রীর অধিকার তো বাদই দিলেন। তখন কী খান সাহেব এসব বুঝতেন না! না তার মন নেই বলে ভাবতেন?

****

“আপা, তোকে তুলে নিয়ে আসছে নাকি মাহিম ভাই? স্যারের সাথে দেখা হয়নি?”

“মাহিম ভাই… মানে মাহিম সাহেবকে আমি যে পুরাতন বাজারের বাসস্ট্যান্ডের দিকে গিয়েছি এটা কি তুই বলছিস?”

“নাহ। আমি তো বারবার বলছি তুই কই গিয়েছিস আমি জানি না। মাহিম ভাইয়ার সাথে তো আমার কথাই হয়নি।”

চৈতালী অবাক হয়। মাহিম তবে তাকে কী করে খুঁজে পেল? এমনও না যে রাস্তায় দেখে চিনেছে। চৈতালী মুক ঢেকে বোরখা পরে ছিল। খুব কাছের কেউ না হলে চট করে এভাবে চিনে ফেলা সহজ নয়।

“কী রে আপু, কী ভাবিস? স্যারের সাথে কথা হয়নি?”

“স্যারের কথা আর জিজ্ঞেস করবি না। শয়তানের বাচ্চা একটা। আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছে বদমাশটা। চিন্তা কর আমি চৌত্রিশ বছরের মাহিম সাহেবকে বিয়ে করা নিয়ে দ্বিধায় ছিলাম। মনে হচ্ছিল আমার চেয়ে পনেরো বছরের বড়, একজন স্ত্রী আছেন। যতই সুন্দর মানুষ হোক, আর টাকাপয়সা থাকুক। এভাবে দুই নাম্বার বৌ হতে কার মন চায়। সবচেয়ে বড় কথা লেখাপড়া করতে চাইছি বলে পালিয়েছি। আর ঐ বুড়া হাবড়া, দুই বাচ্চার বাপ আমাকে বিয়ে করে হোটেলে তুলতে চাইছিল। কোন রকমে খাওয়ার হোটেল থেকে বাহির হয়ে রাস্তায় আসছি। হাঁটতে ছিলাম এলোমেলো। কই যাব বুঝতেছিলাম না। জানতাম এইখানে এতক্ষণে সবাই জেনে গিয়েছে। সাহস করে আসলেও আম্মা আব্বার মাইর একটাও মাটিতে পড়বে না। খান দাদা বাড়ি ছাড়া করবেন আমাদের। ভয়ে একবার ভাবছি আত্মহত্যা করে ফেলি। কিন্তু আল্লাহর শাস্তির ভয়ে সেই সাহসও হচ্ছিল না। হঠাৎ গাড়ি নিয়ে সেখানে হাজির মাহিম ভাই মানে মাহিম সাহেব। আমাকে বললো গাড়িতে বসতে। চিনলো কিভাবে কে জানে। বললেন এভাবে পালানোর দরকার নাই, বিয়ে তিনিই ভাঙবেন। বাড়ির কাছে আসতে আসতে মনে হলো ওনাকেই বিয়ে করি। এছাড়া ভালো কিছু আমার কপালে নাই। আজ এখানে বিয়ে না হইলে আব্বা আম্মা বাড়ি, জমি কিছু পাবে না। আর সেসব না পাওয়ার রাগ উঠবে আমার উপর। আমার পড়ালেখা বন্ধ করে দোজবর, বয়স্ক অন্য কারও সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে। আমার বিয়ের জন্য কোন খরচ তারা এমনেও করবে না, তো ভালো বর পাবো কই। পছন্দের মানুষ নাই, রঙ রূপ নাই। আমিই ওনাকে অনুরোধ করলাম বিয়েটা না ভাঙতে।”

“আপা, মাহিম ভাই লোক হয়তো খারাপ না। দেখলি না তোর দোষ কিভাবে ঢাকলেন। বিয়া হইলে হয়তো ভালাই হইবো। মন খারাপ করিস না। তার বড় বৌ আর কয়দিন। অসুখ বিসুখে থাকে।”

“যাহ্ কারও জীবনের বিনিময়ে সুখ চাই না। আমি তো দোয়া করি তিনি সুস্থ হয়ে যান। ওনার অনুরোধেই মাহিম সাহেব বিয়েটা করছেন।”

“সতীন সতীনই আপা। তুই ভালো তাই জগত ভালো ভাবিস। জামিল বদমাশরে দেখ। হারামজাদারে যদি উচিত শিক্ষা না দিয়েছি। তার আলুর দোষ আমি ছাড়াচ্ছি।”

“কিছু করতে যাস না শফিক। স্যার এমনেও ক্ষেপে গিয়েছেন। তার মুখের উপর পানি ছুঁড়ে মারছি। সেই রাগ হয়তো তোর উপর ঝাড়বে। ফেল করালে তোর একটা বছর নষ্ট হবে।”

“হোক, একটা শিক্ষা তো তারে আমি দেবই।”

*****

বাদ আসর খান বাড়ির ছাদে ছোট্ট করে হলুদ সন্ধ্যা হয়ে যায় চৈতালীর। মাহিম হলুদের অনুষ্ঠান করতে রাজি হয় না। এতে জোবাইদা বেগম খুশিই হোন মনেমনে। ছেলের বৌ এর সাথে ছেলের অতিরিক্ত মাখামাখি ওনার ঠিক পছন্দও নয়। চন্দ্রিমাকে ঠিক এই কারণেই বেশি অপছন্দ করতে শুরু করেছিলেন। কারণ মাহিম চন্দ্রিমার প্রতি বেশি অনুরক্ত হয়ে পড়েছিলেন। যদিও চন্দ্রিমাকে তিনিই পছন্দ করে ছেলের বৌ করেছিলেন। কিন্তু বিয়ের পর চন্দ্রিমা যেন ধীরে ধীরে বশ করে নিয়েছিল তার মা ভক্ত ছেলেটাকে। খান সাহেবেরও আদরের নাত বৌয়ের জায়গা করে নিচ্ছিল। সাথে ছিল নিজের রূপ গুণের চাপা অহংকারের ছটা। নিজের বিয়ের পঁয়ত্রিশ বছরের স্বামীর এতটা ভালোবাসা আহ্লাদ কখনও পাননি জোবাইদা। মনের শান্তি ছিল এই পরিবারে তার একচ্ছত্র আধিপত্য। সেটাও হাতছাড়া হচ্ছে বুঝতে পারছিলেন। তাই সেই হিংসা থেকেই হোক বা নিজের অপূর্ণতা থেকেই হোক, চন্দ্রিমা তার চোখের বালি হতে সময় নেয় না। শুধুমাত্র চন্দ্রিমাকে কষ্ট দিতেই তিনি এই হলুদ আয়োজন করেছেন। যেন চন্দ্রিমা বোঝে এই বাড়িতে তার দিন শেষ হয়ে এসেছে। রাজকন্যা চন্দ্রিমার জায়গা নিচ্ছে সামান্য ভূমি দাসের মেয়ে চৈতালী। যে রূপে, বংশ গৌরবে চন্দ্রিমার সমান না হয়েও আজ তার বরাবরে দাঁড়িয়ে আছে।

মায়ের অনুরোধে আর আদেশে চৈতালীর পাশেই হলুদ লাগাতে বসে মাহিম। শর্ত দেয় শুধু দাদা, দাদী আর মা বাবাই সামান্য হলুদ ছোঁয়াবে তার গালে। তারপর সে উঠে যাবে।

জোবাইদা বেগমের হলুদ লাগানো শেষ। এমন সময়ই কাজের মেয়েটার সহায়তা নিয়ে ছাদে চলে আসে চন্দ্রিমা। লাল পেড়ে হলুদ শাড়ি পরেছে সে। মাথায় খোঁপা করে গাঁদা ফুলের মালা জড়িয়েছে। হাত ভর্তি লাল চুড়ি। উজ্জ্বল বর্ণের চন্দ্রিমাকে লাগছে সদ্য ফোটা রক্তজবার মতোই সুন্দর। শুধু চোখগুলো বিষণ্ণ। রাজ্যের অসুস্থতা আর ক্লান্তি ভর করেছে দু-চোখ জুড়ে। মাহিম উঠে দাঁড়াতে গেলে ইশারায় বসতে বলে চন্দ্রিমা। চট করে দেখে সে অসুস্থ বোঝার উপায় নেই। অসুস্থতা তার সৌন্দর্য ম্লান করলেও ছিনিয়ে নিতে পারেনি। মাহিম আর চৈতালীর মাঝে গিয়ে বসে চন্দ্রিমা। হলুদ তুলে নেয় হাতের আঙুল ছুঁয়ে। কিছুটা চৈতালীর মুখে লাগায়, কিছুটা মাহিমের। সহকারী মেয়েটাকে বলে ছবি তুলতে।

“মালেকা, সুন্দর করে ছবিটা তোল। এটা বাঁধাই করে শোবার ঘরে রাখবো।”

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে