ধূসর কাবিন রঙিন প্রণয়
পর্ব ৪
রোবটের মতো হেঁটে গিয়ে গাড়িতে বসে চৈতালী। এত দামি গাড়িতে আগে কখনও বসার সুযোগ হয়নি তার। প্রথম গাড়িতে ওঠার অভিজ্ঞতায়, নাকি মাহিমের পাশে বসার জড়তায় জানা নেই তবে জড়োসড়ো হয়েই বসে থাকে চৈতালী। মনে হচ্ছে মূর্তির টানটান হয়ে আছে। মাহিম আড়চোখে তাকিয়ে দেখে। বিরক্ত মুখে বলে,
“এভাবে বসেছ কেন? সিট বেল্ট লাগাও। হঠাৎ গাড়ি ব্রেক করলে হুমড়ি খেয়ে পড়বে আর মাথা ফাটবে।”
মাহিমের কথা মাথায় ঢোকে না চৈতালীর। গাড়ির দরজা তো বন্ধ। হুমড়ি খেয়ে পড়বে কই? এটা তো খোলা রিকসা না। তার ভাবনার জগত থেকে বের হয় যখন হঠাৎ ব্রেক কষে মাহিম। অসতর্ক চৈতালী গাড়ির ড্যাশবোর্ডে গিয়ে পড়ে । মাথা ঠুকে যাওয়ার আগেই হাত বাড়িয়ে দেয় মাহিম। চৈতালীর আঘাতটা তাই বড় হয় না। তার মাথা গিয়ে মাহিমের হাতেই পড়ে।
“এভাবেই মাথা ফাটে। কথা বললে শোন না কেন? বললাম না সিট বেল্ট বাঁধো। না পারো না।”
মাথা নেড়ে না জানায় চৈতালী। মাহিম বেল্ট টেনে বেঁধে দিতে গেলে অস্বস্তিতে সিটের সাথে মিশে যায় চৈতালী।
“এমন করার কিছু নেই। এভাবে সুযোগের বাহানায় গায়ে হাত দেওয়ার লোক আমি নই। মাহিম আলী খানের ব্যক্তিত্ব এমন নয় যে কৌশলে কারও গা ছুঁয়ে মজা নিতে হবে।”
“আমি আগে কখনও গাড়িতে উঠি নাই। তাই ভয় লাগছিল। অন্য কিছু ভাবি নাই।”
অবশেষে মুখ খোলে চৈতালী।
“অন্য কিছু ভাবার কোন কারণও নেই। আমার মেয়ের অভাব হয়নি যে তোমাকে জোর করে বিয়ে করতে হবে। বাসায় নিয়ে যাচ্ছি। তুমি কোন প্রিন্সেস নও বা রূপসী কোন মেয়েও নও যে তোমাকে বন্দী বানিয়ে বিয়ে করতে হবে। আর সেই বিয়ে থেকে বাঁচার জন্য তুমি বাড়ি থেকে পালাবে। বিয়ে ক্যান্সেল করছি। স্বাভাবিক ভাবে নিজের বাবা মা ভাইবোনের সাথে বাড়িতে চলে যাবে। কেউ তোমাকে আটকানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা করবে না। যেই ডাস্টবিন থেকে এসেছ, সেই ডাস্টবিনে ফিরে যাবে। আমার বিষয়টা আগেই মনে রাখা দরকার ছিল। কাককে যতই পাখি ভেবে পরিষ্কার স্থানে নিয়ে আসা হোক, খাবার খাবে সে ময়লা ঘেঁটেই।”
অষ্টাদশী বয়সটা চরম আবেগের। সামান্য কথার বাতাসে মনের ভেতর উথাল পাথাল ঝড় বয়ে যায়। চোখের নদীতে প্লাবন নামে। না চাইলেও তা উপচে পড়ে চোখের কোল ঘেঁষে। কিছুক্ষণ আগে জামিল স্যার তাকে এত ছোট করে কথা বললেন, আর এখন মাহিম। এই পুরুষগুলো কী ভাবে, শুধু তারাই শ্রেয়? আর নারী শুধু শরীর আর রূপ সর্বস্ব। জামিল স্যারের কাছে তো তার শরীর ছাড়া আর কোন মূল্য ছিল না। আর মাহিম তো তাকে সেটাও দিলো না। রীতিমতো আস্তাকুঁড়ের ফেলনা জিনিসই বানিয়ে দিলো। সে এমন একজন যার কাছে না রূপ আছে না অর্থ। অথচ গুণের কদর না কেউ করে, না কেউ দেখে।
“কান্নাকাটি করার কিছু নাই। আছে এক ফ্যাচফ্যাচে কান্না। শোন, এসব আমাকে স্পর্শ করে না। মায়ের আদেশে বা দাদীর অনুরোধেও দ্বিতীয় বিয়ে করতে আমি এই জন্য রাজি ছিলাম না। জানতাম চন্দ্রিমার মতো মেয়ে আর পাবে না। চন্দ্রিমা একজনই। অসুস্থ হোক আর যাই হোক, ওর জায়গা আগেপরে কেউ নিতে পারবে না। ওর বরাবর তো দূর, কাছাকাছিও না তুমি। তবু যখন খোদ চন্দ্রিমা অনুরোধ করলো তোমাকে বিয়ে করতে, অনেকটা দয়ার বশে তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। মনে হয়েছিল গরীব ঘরের মেয়ে হলেও তোমার লেখাপড়া ভালো। রক্ত সম্পর্কে আমাদের আত্মীয়ও হও যেহেতু বংশ খারাপ হবে না। দেখেশুনেও নম্র ভদ্র মনে হয়েছিল। কিন্তু কাক আসলে ময়ূরের পাখা লাগালেই ময়ূর হয়ে যায় না।”
মাহিমের কঠিন কঠিন কথায় কান্না বন্ধ হয়ে গিয়েছে চৈতালীর। হাঁ করে কথা গিলছে। চৈতালীর অনুরোধে তাকে বিয়ে করতে চেয়েছে মাহিম! কিন্তু চন্দ্রিমা তার জন্য কেন অনুরোধ করবে? চন্দ্রিমা তো এর আগে কোনদিন তার সাথে কথাও বলেনি ঠিক মতো। হ্যাঁ অসুস্থ হওয়ার পর গত কয়েক মাসে চন্দ্রিমার মাঝে অনেক পরিবর্তন এসেছে। বারবার বাবা মা নিতে এলেও শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে যেতে চাইতেন না। ডাক্তার দেখানোর জন্য গেলেও কিছুদিন পর ফিরে আসতেন। ইদানীং বেশিরভাগ সময় নিজের ঘরেই থাকে চন্দ্রিমা। চৈতালী এই বাড়িতে এলে নিজের রুমে ডেকে নিতেন। মায়া করে টুকটাক কথা বলতেন। যা আগে কখনও করেনি। মাহিমের আম্মা যে এখন চন্দ্রিমাকে পুত্রবধূ হিসেবে আর ভালোবাসেন না তা সবাই স্পষ্ট বুঝতে পারতো। অসুস্থ ছেলের বৌকে কোন শাশুড়িই পছন্দ করেন না। চৈতালীকেও যে তিনি খুব সাদরে বৌ বানাতে চান তা নয়। বিয়ের পুরো আলোচনায় মুখ পাথরের মতোই করে ছিলেন। শুধু তিনিই নন, কাউকেই খুব একটা সন্তুষ্ট চিত্তের মনে হয়নি এই বিয়ে নিয়ে। যদিও প্রস্তাবটা তাদের দিক হতেই আসা। কেউই খুব বেশি আগ্রহী নয়, তাহলে এই বিয়েটা ঠিক হলো কিভাবে তাই বিস্ময়। চন্দ্রিমার আগ্রহের কথা শুনে আরও বেশি অবাক হয় চৈতালী। মনে তাই হাজারও প্রশ্ন জাগে তার। কিন্তু মুখ দিয়ে তার ছিটেফোঁটাও বের হয় না।
বাড়ির গেটের সামনে এসে দাড়ায় মাহিমের নেভী ব্লু রঙের হোন্ডা এয়ারওয়েভ কার। হর্ণ দিলে দারোয়ান গেট খুলে দেয়। একপলকে মাথায় অনেককিছু খেলে যায় চৈতালীর।
“শোনেন মাহিম ভাইয়া। আমি না বুঝে বোকার মতো ঘর পালিয়েছি। কিন্তু কারও হাত ধরে না। আমার কোন প্রেমিক নাই সত্যি। আপনার আপত্তি না থাকলে আমি বিয়েটা করতে চাই।”
শীতল চোখে চৈতালীর দিকে তাকায় মাহিম। মাহিমের ঠান্ডা চাহুনি দেখে চোখ নামিয়ে নেয় চৈতালী।
****
বসার ঘরে জমায়েত হয়েছে সবাই। একপাশে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে শফিক আর শাহীন। শাহীন ভাইয়ের কাছ থেকে একশত টাকা আর ক্রিকেট ব্যাট বাগিয়ে নিলেও কথা পেটে চেপে রাখতে পারেনি। চৈতালী বের হয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণের ভেতর মাকে গিয়ে সব বলে দেয় শাহীন। শিউলি প্রথমে দুই ছেলেকেই ধুপধাপ এলোমেলো থাপ্পর লাগিয়ে দিয়েছেন। প্রথমে ভেবেছিলেন নিজেই গিয়ে খুঁজবেন। কতদূর বা যাবে মেয়ে। কিন্তু শাহীন জানে না বোন কোথায় কার কাছে গিয়েছে, আর শফিক তো গোঁ ধরে আছে। মায়ের মার, গালি খেয়েও বলতে রাজি না বোন কোথায় গিয়েছে। স্বামী বলার সাহস হয় না শিউলির। প্রথম রাগের ঝাপটা তার উপরেই যাবে।
কিন্তু কথা চাপা থাকে না। কিছুক্ষণের ভেতর পুরো বাড়ি জেনে যায় যে চৈতালী বাড়িতে নেই। জোবাইদা বেগমের কানে গেলে তিনি বিষয়টি তার শ্বশুর, খান সাহেবকে জানান। শিউলি আর রহিম তরফদারকে দুই ছেলে সহ বসার ঘরে আসতে নির্দেশ দিয়েছেন খান সাহেব। চন্দ্রিমা ছাড়া সেখানে সবাই উপস্থিত আছে। তখনই মাহিমের সাথে সেখানে এসে উপস্থিত হয় চৈতালী। খান সাহেব জিজ্ঞেস করেন,
“এই মেয়ে তোর সাথে কী করে মাহিম? কোথায় পেয়েছিস? বাস স্ট্যান্ডে না রেল স্টেশনে? এই আবর্জনাকে আবার সাথে করে আনলি কেন? এখনি এর বাপ মাকে লাথি মেরে বের করতাম আমি। বেইমান অকৃতজ্ঞের দল।”
“কী বলছেন বুঝতে পারছি না দাদাজান। চৈতালীকে আমি সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম।”
বিষম খায় জোবাইদা বেগম। তার ছেলের সাথে চৈতালী বাহিরে গিয়েছিল কখন! এ ঘরে একটা মশা ঢুকলে যেমন তিনি টের পান, তেমনি একটা মাছি বের হলেও তিনি জানতে পারেন। অথচ এমন জলজ্যান্ত মেয়েকে নিয়ে ছেলে বের হয়েছে তা তিনি জানবেন না? তার জানামতে ছেলে একাই গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিল।
(চলবে)