ধূসর কাবিন রঙিন প্রণয় পর্ব-২২ এবং শেষ পর্ব

0
906

ধূসর কাবিন রঙিন প্রণয়
শেষ পর্ব

“চৈতালী, তুমি জিদ করে এসব বলছো বুঝতে পারছি। আসলে চন্দ্রিমার সুস্থতার জন্য একজন ডোনার প্রয়োজন ছিল। আর আম্মু, দাদা, দাদী সবাই এ পরিবারের পরবর্তী প্রজন্ম দেখতে চাইছিল। সবার চাপে এই ভুলটা আমার মতো সুস্থ মানুষ করে ফেলেছে। শুধু ভুল না রীতিমতো অপরাধ। তোমাকে অন্ধকারে রেখে বিয়ে করা। আশা করা যে সবকিছু তুমি ঠিক করে দেবে। এই সবে আমি কী করে সায় দিয়েছি জানি না।”

“আপনারা সব লুকিয়েছেন তা নয়। হয়তো আমার কাছে লুকিয়েছেন। কিন্তু আমার যে অভিভাবক, তারা তো জেনেশুনেই আমাকে বিয়ে দিয়েছে। আপনার নিজেকে এত অপরাধী ভাবারও কিছু নেই। আপনি তো আমার সাথে এখনও কোন অন্যায় করেননি।”

“তোমার বাবাকেও লিভার ট্রান্সপ্লান্টের বিষয়ে জানাইনি। জানালে বিয়ে দিতেন না।”

“অবশ্যই দিতেন। হয়তো লাখ পাঁচেক বেশি লাগতো। কিন্তু ঠিকই দিতেন। কাল আব্বা, আম্মা আসবেন। তখনই প্রমাণ পাবেন। আচ্ছা লিভার দিলে কী হয়? মানে কিডনি দুটো আছে একটা দিলেও নাকি মানুষ বাঁচে। লিভার তো এতটা। লিভার দিলে আমি মারা যাব?”

“না না। লিভারের কিছু অংশ নেওয়া হয়। পুরো লিভার কেন নিবে? লিভারের সেলগুলোর কিছু স্পেশাল ক্ষমতা আছে। আমি ডাক্তার না তাই ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারছি না। কিন্তু লিভারের সেল গুলো সংখ্যায় বাড়তে পারে। ফলে যাকে লিভারের ছোট অংশ দেওয়া হলো তার লিভারের ঐ ছোট অংশ সংখ্যায় বেড়ে কাজ করার মতো কর্মক্ষম হয়। ডোনারেরও জীবন সংশয় থাকে না সুস্থ হয়ে যায়। এমনকি লিভার ডোনেশনের এক বছর পর সে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনও কাটাতে পারবে। সন্তান জন্ম দিতে পারবে।”

“তাহলে কেউ আপাকে দিতে চায় না কেন?”

“দিতে চাইলেই তো হবে না। ম্যাচ হতে হবে। নিজের পরিবার হলে তাই সবচেয়ে ভালো ম্যাচ হয়। চন্দ্রিমার বাবা মায়ের ডায়াবেটিস, প্রেশার থাকায় অসুস্থ, বয়স হয়েছে। আমার সাথে ভালো ম্যাচ হয় না।”

“আমার সাথে হয় ভালো তাই না? এই জন্য আমি যেদিন পড়ে গিয়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলেছিলাম আপা আমাকে বড় হাসপাতালে নিয়ে এতগুলো টেস্ট করালেন। ম্যাচ হয় কিনা দেখতে। তারপরই তো হঠাৎ আমাদের বিয়ের আয়োজন।”

“আমি তখন বিষয়টা জানতাম না। কিন্তু যতদিন গিয়েছে আমি বুঝতে পেরেছি যা করেছি অন্যায় করেছি। চৈতালী এভাবে তোমার লিভারের অংশ নিতে পারবো না বলেই এতদিনেও তোমাকে এই কথা জানানোর সাহস হয়নি।”

“আমি নিজেই দিতে চাই। আপনাকে এভাবে কষ্টে দেখতে পারছি না। আপাকে আপনি সত্যি ভালোবাসেন। আপা ভাগ্যবান। সবাই এই ভাগ্য নিয়ে আসে না। আবার আপা দুর্ভাগাও। এত চমৎকার সাজানো জীবন অসুস্থতার কাছে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।”

“তুমি আমাদের জীবন ঠিক করতে চাইছো?”

“জ্বি।”

“কেন?”

“আপার জন্য না। আপনার জন্য। কারণ আপনি যেমন আপাকে ভালোবাসেন। আমি আপনাকে ভালোবাসি। আমার পাসপোর্ট করে দিন। ডোনার হিসেবে আমি সাথে যাব।”

মাহিম স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। সহসা কী বলবে বুঝে না। চৈতালীর মুখ দেখেই বোঝে ভালোবাসার কথাটা হেয়ালি না।

“চন্দ্রিমা ফিরে আসলে হয়তো এই বাড়িতে তোমার থাকা হবে না। নিজের সাথে এই অন্যায় মেনে নিবে? আমাকে ভালো না বাসলেই ভালো করতে চৈতালী। তোমার ভালোবাসা পাওয়ার মতো তোমার সাথে ভালো কিছুই আমি করতে পারিনি।”

“কে বলেছে পারেননি? আপনি আমাকে সম্মান দিয়েছেন। আমাকে পড়ালেখার ব্যাপারে এতটা উৎসাহ আর সাহায্য আগে কেউ কখনো করেনি। নিয়মিত ড্রয়ারে আমার জন্য হাত খরচ রেখে যেতে ভুলেননি। এত ব্যস্ততা আর চিন্তার মাঝেও আমার পরীক্ষাগুলোতে হলে আনা নেওয়া করেছেন। শারীরিক আকর্ষণের জন্য হলেও আমাকে মিথ্যা বলে ব্যবহার করেননি। আমার জন্য ভালোবাসতে এই বিষয়গুলোই যথেষ্ট। আমার জীবনে আপনিই প্রথম পুরুষ। মেয়েরা মনে মনে যেমন প্রিন্স কল্পনা করে সবদিক থেকেই আপনি তেমন। আমিই বরং আপনার জীবনে দ্বিতীয়। আপনি আমাকে ভালো না বাসাটাই বরং স্বাভাবিক। আর আপা সুস্থ হয়ে যদি আমাকে আপনার জীবন থেকে বের করে দিতে চায় তবে সেটার সিদ্ধান্ত আমি আপনার হাতে রাখলাম। আপনার জীবনে আমি থাকবো কী থাকবো না সেটা আপনিই নির্ধারণ করবেন। আমার ধূসর কাবিন কী কখনো রঙিন প্রণয় পাবে কিনা আমি জানি না।”

*****

বসার ঘরে মিটিং বসবে। মিটিং এ শিউলি আর রহিম তরফদারও এসেছেন। চৈতালীর লিভার ডোনেশনের বিষয়টা চাপা থাকে না। কেউই এই বিষয়ে মাহিম আর চৈতালীকে সমর্থন দেয় না।

“তোর কী মাথা খারাপ হইছে? লিভার দিবি মানে কী? ক্যান দিবি? মরার খায়েশ হইছে?”

শিউলি আর রহিম তরফদার চৈতালীর কাছে এসে জিজ্ঞেস করে।

“পাঁচ লাখ টাকা দিতে চায় মাহিম সাহেব।”

রহিম তরফদার বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়।

“পাঁচ ক্যান? আমি খোঁজ নিছি পনেরো লাখেও মানুষ লোক পায় না। পনেরো বল। এহ বললেই হইলো পাঁচ লাখ। শোন তোর এই বাড়িতে কী গতি হইবো আমি বুঝছি। কাজ শেষে এরা তোরে তালাক দিয়া পাঠাই দিব। টাকা বেশি করে নিবি। সারা জীবন তাহলে চিন্তা নাই। আগের পাঁচ লাখ কই? ঐ গুলা আমারে দে। আমি সামলাই রাখি। তোর নামে জমি কিনা রাখবো। জমির আয় দিয়া ভালো চলবি।”

“ঐ টাকা ব্যাংকে রেখেছি। আমার নামে একাউন্ট করে দিয়েছেন মাহিম সাহেব। আর লিভার তো আমি বিক্রি করছি না।”

“মানে?”

“মানে কোন টাকা নেব না।”

“নাটক করস? অসুস্থ হইয়া আমার বাড়ি আসার চিন্তা করিস না। টাকা নিবি না। কাবিনের টাকা নিজে রাখছিস। এরপর এরা বাইর করে দিলে আমার বাড়ি আসবি না।”

শিউলি রেগে গিয়ে বলে।

“কোনটা আপনার বাড়ি? সেই বাড়ি আর পুকুরও আমাকে এখানে বিয়ে দিয়ে পেয়েছেন। আর বাড়ি আপনার নামে না আব্বার নামে।”

এবার রহিম তরফদারও রেগে যান,

“তোরে যে এই পর্যন্ত বড় করছি, খাওয়াইছি, পড়াইছি তার টাকা কি আসমান থেকে আসছে? তার কাছে এই বাড়ি, পুকুর কয়টাকা।”

“আমার পড়ার পেছনে আপনার তেমন কিছুই খরচ হয়নি। প্রাথমিকে নামমাত্র বলতে গেলে ফ্রি পড়েছি। উপবৃত্তির টাকায় মাধ্যমিকে পড়েছি। বৃত্তির টাকায় বই খাতা কলম কিনেছি। সারা বছরে একটা ভালো জামা কিনে দেন নাই। রাতদিন সংসারে কাজের বিনিময়ে খেয়েছি। মাঝেমাঝে একজন মহিলা এসে আপনার হাতে আমার জন্য কিছু টাকাও দিয়ে যেত। হ্যাঁ আপনারা আমাকে আশ্রয়, নিরাপত্তা দিয়েছেন। যার শোধ এই বিয়ে করে আমি দিয়েছি। আমি কারও কাছে কোন ঋণ রাখতে চাই না।”

“এই চলেন চলেন। এই জন্য এই মেয়ে আমি পালতে চাই নাই। নেমকহারাম। কয় টাকা দিয়ে যাইতো ঐ মহিলা? এত দরদ হইলে তোরে সাথে নিয়া রাখে নাই কেন? আসলে তোরে কেউই সাথে রাখতে চায় না। তোর কপালে ঝাঁটার বাড়িই আছে। আমাদের কাছেও আর কোন জায়গা পাবি না।”

শিউলি আর রহিম রেগে বের হয়ে যেতে গেলে চৈতলাী আবার ডাক দেয়,

“আব্বা যা পান নাই, তার জন্য রাগ না দেখিয়ে যা আছে হাতে তা সামলান। জুয়ার টান ছাড়েন। আর কাগজপত্রে টিপসই বা সাইন করার আগে সাবধান।”

“মানে?”

শিউলি আতংকিত হয়ে যায়।

“মানে যা বোঝার বুঝে নেন। না বুঝলে আম্মাকে জিজ্ঞেস করেন।”

বলে চৈতালী মুচকি হাসে।

*****

“চৈতালী এমন সিদ্ধান্ত তুমি আর মাহিম কী করে নিতে পারো? আমাদের অনুমতি ছাড়া এমন কিছু করতে পারো? প্রথমে মাহিম কোটি টাকার জমি বিক্রি করে দিতে গেল। এখন এই ট্রান্সেপ্লান্ট। পেয়েছ টা কি তোমরা? চন্দ্রিমা অসুস্থ, ওর জন্য দোয়া থাকবে আমাদের। অর্থও দিতে সমস্যা নেই। কিন্তু অসুস্থ একজনের জন্য সুস্থ একজনকে পঙ্গু বানাতে দেব না। ভুলে যেও না চৈতালী এ বাড়িতে এসেছে খান বাড়ির ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্ম দিতে। চন্দ্রিমাকে লিভারের অংশ দিলে চৈতালী সুস্থ ভাবে মা হতে পারবে?”

“আম্মু যদিও আমি বারবার বলেছি আমি সন্তানের জন্য দ্বিতীয় বিয়ে করতে চাই না। তবুও তুমি জোর করে গিয়েছ। তোমার কি মনে মনে হয় আমি চৈতালীকে সন্তানের জন্য বিয়ে করেছি? নাহ্ আমি চন্দ্রিমার জন্যই চৈতালীকে বিয়ে করেছি। চৈতালী সব জেনেই ডোনার হতে রাজি হয়েছে।”

এই কথার পর আর কিছু বলার থাকে না। যেখানে চৈতালী নিজেই রাজি, জোবাইদা বেগম আর জোহরা বেগমের আপত্তি টেকে না। জোবাইদা বেগমের মতে জোহরা বেগমও চৈতালীর ডোনার হওয়ার বিষয়টায় ঘোর আপত্তি। আলাদা করে চৈতালীকে বোঝানোর চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু চৈতালী অনড়। চৈতালী স্বেচ্ছায় ডোনার হচ্ছে শুনে চন্দ্রিমা আর তার বাবা মাও অবাক হয়ে যায়। চন্দ্রিমার বাবা মা এসে চৈতালীর সাথে দেখা করে যান। দু’জনই চৈতালীকে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
কিন্তু চন্দ্রিমা জড়তা ভেঙে চৈতালীকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে কিছুই বলতে পারে না। সেদিন চৈতালীর সাথে মাহিমের ছবিগুলো দেখে নিজেকে সামলাতে পারেনি। অসুস্থতা, মাহিমের জীবনে অন্য কারও উপস্থিতি সবকিছু চন্দ্রিমাকে এতটাই বিপর্যস্ত করে ফেলেছিল যে চৈতালীকে ফোন দিয়ে যা মনে এসেছে বলেছে। ভেবে নিয়েছে এই করে চৈতালীকে তার অবস্থান বোঝাবে। সব জেনে চৈতালী পালিয়ে যাবে, কখনোই নিজের শরীরের কোন অংশ দিতে চাইবে না। চন্দ্রিমাকে তো কখনোই না। অথচ আজ চৈতালী স্বেচ্ছায় এর অংশ হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে চৈতালী ওকে ছোট করে দিলো।

*****

মাহিম ফাস্ট ক্লাসের সিট বুকিং করেছে। মাহিমের পাশে চন্দ্রিমার সিট। মাহিম চন্দ্রিমার হাত ধরে ওকে সুস্থতার আশ্বাস দিচ্ছে। চৈতালী বসেছে জালাল আবেদীনের পাশে। জেরিন সুলতানা ও আছেন তাদের সাথে। তিনি অন্য সিটে বসে একমনে তসবি গুনছেন। চৈতালীর এটাই প্রথম বিদেশ যাত্রা। ভয় ভয় লাগার পরিবর্তে কেমন একটা বোধহীন অনুভূতি হচ্ছে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে সাদা মেঘগুলোকে কেমন ধূসর লাগে চৈতালীর। ঠিক নিজের জীবনের মতো। এই ধূসর মেঘ সরিয়ে কখনো কি রঙিন বসন্ত আসবে তার জীবনে? জানে না চৈতালী। কি হবে ভবিষ্যতে তাও ভাবতে চায় ন। জীবনটাকে এমনই এক গন্তব্যহীন উড়ো জাহাজে ভাসিয়ে দিয়েছে যেন। কোনো গন্তব্যে গিয়ে প্লেন ল্যান্ড করবে নাকি আকাশ হতেই হারিয়ে যাবে তা জানতেও চায় না। চোখ বন্ধ করে ফেলে চৈতালী। এক অন্যের সাথে জড়িয়ে থাকা এই তিনটি জীবনের ধূসরতা কেটে গিয়ে রঙিন সময়ের অপেক্ষায় থাকে তিনজন।

(শেষ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে