ধূসর কাবিন রঙিন প্রণয়
পর্ব ২১
দিনগুলো কেটে যাচ্ছে ঝড়ের গতিতে। হসপিটাল থেকে রিলিজ নিয়ে চন্দ্রিমা বাবার বাড়িতেই আছে। খান বাড়িতে চৈতালীর দিন কাটছে একা একা। মাহিম বেশিরভাগ সময় বাইরে বাইরে থাকে। চন্দ্রিমাকে নিয়ে সিঙ্গাপুর যাওয়ার সমস্ত কাজ গুছিয়ে নিয়েছে। কিছু একটা হয়েছে বুঝতে পারছে চৈতালী। মাহিমকে কেমন উদভ্রান্ত লাগে ইদানীং। ঠিক মতো খায় না, ঘুমায় না। জোবাইদা বেগম একদিন খুব বকাঝকা করেছেন। কিন্তু মাহিমের আচরণে কোন পরিবর্তন আসেনি। মাহিম গ্রামের বড় একটা এক দাগের জমি বিক্রি করে দিতে চাইছে। পারিবারিক সম্পত্তি বলে বিক্রি করতে বাবা হাসান আলী খান এবং দাদা ফজলে আলী খানের অনুমতি প্রয়োজন। সেখান থেকেই চৈতালী জানতে পেরেছে সিঙ্গাপুরে চন্দ্রিমার চিকিৎসার জন্য কোটি টাকার প্রয়োজন। এতটাকা মাহিমের ব্যক্তিগত একাউন্টে নেই। মেয়ের চিকিৎসার অর্ধেক খরচ আবেদিন সাহেব দিবেন, অর্ধেক মাহিম। আর এটাই জোবাইদা বেগমের পছন্দ নয়। তবে তিনি নন এবার প্রশ্ন রেখেছেন ফজলে আলী খান।
“মাহিম আমাদের যথেষ্ট অন্ধকারে রেখেছ তোমরা। এবার খোলাখুলি বলো তো কী হয়েছে চন্দ্রিমার। টাকা বিষয় না, কিন্তু আমাদেরও জানা উচিত কী হচ্ছে।”
ফজলে আলী খান গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করেন।
“দাদাজান, চন্দ্রিমার লিভার ক্যানসার সন্দেহ করছে ডাক্তার। ভেতরে কতটুকু ছড়িয়েছে তা নিশ্চিত না। আমরা তাই ওকে সিঙ্গাপুর নিতে চাই। যদি সম্ভব হয় লিভার ট্রান্সপ্লান্টও করতে হতে পারে। তাই এত অর্থ প্রয়োজন।”
“তোমরা তাহলে এসব আগে থেকে জানতে না?”
“এতটুকু ছড়িয়েছে বুঝতে পারিনি। প্রাথমিক পর্যায়ে ধরে চিকিৎসা চলছিল। হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের সংক্রমণে সিরোসিস হয়েছে প্রাথমিক ডায়াগনোসিস এতটুকুই ছিল। এটা ক্যান্সারে রূপ নেওয়ার বিষয়ে জানলাম কিছুদিন হলো।”
“কিছু বিক্রি করা লাগবে না। আমি তোমাকে টাকা ট্রান্সফার করে দেব।”
জোবাইদা বেগম নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকেন না।
“আব্বা, পুরো টাকা আমরা দিতেই পারি। কিন্তু কেন দেব? তারা আমাদের সাথে প্রতারণা করেছে। একদিনে কারও এমন অসুখ হয়? হেপাটাইটিস সি কিভাবে হলো? মদ খেত নাকি আল্লাহ মালুম।”
“আম্মু, কী যা তা বলছো! শুধু মদ খেলে, ড্রাগস নিলে সিরোসিস হয়? হেপাটাইটিস সি ভাইরাস রক্তের মাধ্যমেও ছড়াতে পারে।”
“এখন ব্লাড ট্রান্সফিশনে স্ক্রিনিং হয়। কোন ভাইরাসের উপস্থিতি থাকলে সে রক্ত দেওয়া হয় না। তাছাড়া চন্দ্রিমা রক্ত কবে নিলো?”
“আরও অনেক পথ আছে। একই সিরিঞ্জ ব্যবহার, বা ডেন্টাল ক্লিনিকে হেপাটাইটিস আছে এমন রোগীর ব্যবহৃত ইনস্ট্রুমেন্ট থেকেও হেপাটাইটিস ছড়ায়। মায়ের থাকলে জন্মের সময় সন্তানের হতে পারে।”
“চন্দ্রিমা অবস্থাপন্ন পরিবারের মেয়ে। ও নিশ্চয়ই নিম্নমানের কোন ডেন্টাল ক্লিনিকে যায়নি কখনো।”
“যেকোনো ক্লিনিকে স্টেরিলাইজেশন মেইনটেইন না হলে এমনটা হতে পারে। কিভাবে হলো তা কী খুব গুরুত্বপূর্ণ?”
“তোমার কাছে না হলেও, আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কোন একটা কিন্তু তো অবশ্যই আছে।”
“আপাততঃ এসব নিয়ে ভাবতে পারছি না আম্মু। চন্দ্রিমার প্লাটিলেট কাউন্ট কমছে। ব্লাড লাগতে পারে। ডোনার রেডি করতে হবে।”
“ওর বাবা মা দিতে পারবে না?”
“ওনাদের বয়স হয়েছে।”
“আচ্ছা চন্দ্রিমার ব্লাড গ্রুপ কি?”
“ও পজেটিভ”
চৈতালী এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলেও এবার বলে,
“আমার রক্তের গ্রুপও ও পজেটিভ। আমি দিতে পারবো।”
“আগে বাইরে ডোনার পাই কিনা দেখি। না পেলে তোমাকে বলবো। কিন্তু ধন্যবাদ চৈতালী, তুমি ব্লাড দিতে চেয়েছ।”
জোবাইদা বেগম কিছু না বলে চিন্তায় পড়ে যান।
*****
“আম্মু, বাপিকে চৈতালীর কথা বলোনি?”
“বলেছি চন্দ্র। তোমার বাপি বলেছেন আমরা তোমাকে নিয়ে সিঙ্গাপুর যাব। তোমার বাপি টাকা ম্যানেজ করে ফেলেছেন। আমাদের সবকিছু তো তোমারই জন্য। আমারা ডোনারও পেয়ে যাব।”
“দেশেই তো ট্রান্সপ্লান্ট সম্ভব।”
জেরিন সুলতানা চুপ করে থাকেন। দেশে ট্রান্সপ্লান্ট হয়তো সম্ভব। কিন্তু চন্দ্রিমার সুস্থতার পথ সহজ না। লাস্ট রিপোর্ট অনুযায়ী সিরোসিস, ক্যানসারের রূপ নিয়েছে। মেয়ের মাথায় আলতো চুমু একে দেন।
*****
রাতে মাহিম চন্দ্রিমার ফাঁকা রুমটায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল। চৈতলাী এসে পাশে বসে। মাহিম একপলক তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়।
“কিছু বলবে চৈতালী?”
“আপনার মনটা খারাপ?”
“হ্যাঁ। চন্দ্রিমা আজ খুব অদ্ভুত আচরণ করলো। ও ভাবছে আমি হয়তো ওকে জীবন থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইছি। আমাকে ওর রুম থেকে চলে যেতে বললো। আমি বের হওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পরমুহূর্তে আবার আমার হাত টেনে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো। ও মানসিক ভাবে একদম ভেঙে পড়েছে। আর আমি ওর জন্য কিছুই করতে পারছি না।”
“আপনার আপনার দ্বারা সম্ভব সবকিছুই করছেন। আপাও তা জানেন।”
“চন্দ্রিমার অভিযোগও তো মিথ্যা না। আমি তো আসলেই কিছুটা ওর প্রতি অমনোযোগী হয়েছিলাম।”
“আপনি সেই রাতের পর আমাকে এড়িয়ে চলছেন। আমি হয়তো আপনার মনে কষ্ট দিয়েছি। না হয় আপনি নিজেকে দোষী ভাবছেন।”
“নাহ। তুমি তো ঠিকই করেছ। আসলে আমি নিজেই নিজেকে নিয়ে কুণ্ঠিত। চন্দ্রিমার এমন অবস্থায় আমার তোমার দিকে ঝুঁকতে থাকা, তাও শারীরিক আকর্ষণে। এই জিনিসটা যদি চন্দ্রিমা করতো তবে? ভাবলেও নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হয়।”
“আপনি আপাকে নিয়ে বিদেশে যাওয়া লাগবে না।”
“কেন? তুমি কি চাও আমি ওকে চোখের সামনে মারা যেতে দেখবো? নাকি ভাবছো তোমার জন্য টাকা কম পড়বে?”
“আমি এমন কিছু ভেবে বলিনি। আমার যা দাম ছিল তা দিয়েই দিয়েছেন। আমি আপনার কাছে চন্দ্রিমা আপার মতো অমূল্য নই জানি। আমি তাই দেওয়ার কথা বলছি, যা দেওয়ার জন্য মূল্য চুকিয়েছেন আপনারা।”
“মানে?”
“আমি তখন সবার সামনে ব্লাড দেওয়ার কথা বলেছি। আড়ালে বলছি আমার লিভার দিতে চাই আপাকে।”
মাহিম চমকে উঠে বসে।
“কী বলছো? তোমাকে কো বললো আমরা এর জন্য মূল্য চুকিয়েছি?”
“আপা বলেছেন। আমাকে আজ ফোন দিয়েছিলেন। আপনার ফোনে আমার ছবি আর আমাদের সেলফি দেখেছেন। সম্ভবত অসুস্থতার কারণে এমনিতেই অস্থির হয়ে ছিলেন। ছবিগুলো দেখে আরও অস্থির হয়ে গিয়েছেন। আমাকে ফোন দিয়ে অনেককিছুই বলেছেন। যা আপনার কাছ থেকে শোনার অপেক্ষায় ছিলাম।”
“কী বলেছে চন্দ্রিমা?”
“আপনাদের জীবনে আমার আসার কারণ বলেছে। এবং বলেছে যদি আমার লিভার না ই নেওয়া হয়। তাহলে আপনার জীবনে, এই সংসারে আমার কেন প্রয়োজন নেই। আমাকে কাবিনের টাকা সহ সবই দেওয়া হয়েছে। আমি যেন এখান থেকে চলে যাই।”
“চন্দ্রিমা অসুস্থ, কী বলছে নিজেও জানে না। ও যা বলছে সব কথা মনে নিও না।”
“আপা অসুস্থ কিন্তু পাগল নন। তিনি যা বলেছেন সুস্থ মস্তিষ্কে আমাকে বুঝিয়ে বলেছেন। কিন্তু খুশি হতাম যদি কথাগুলো আপনি আমাকে বলতেন।”
“আমরা অন্য ডোনার খুঁজছি। তোমার কিছুই দিতে হবে না। আই এম স্যরি চৈতালী। আমরা তোমার সাথে অন্যায় করেছি।”
(চলবে)