ধূসর কাবিন রঙিন প্রণয়
পর্ব ১৯
মাহিম বাসায় ফিরে চৈতালীর রুমে যায়। চৈতলী এক মনে পড়ালেখা করছে দেখে খুশি হয়। ফ্রেশ হয়ে এসে নিজেও একটা বই নিয়ে বসে। টানা মানসিক টেনশনে ইদানীং বই নিয়ে বসা হয় না। অথচ স্ট্রেস কমাতে বই তাকে সাহায্য করে। মাহিম আধশোয়া হয়ে বই খুলে বসে। অরুন্ধতী রায়ের ফেমাস বই ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’। আগেও পড়েছিল। আবারও হাতে নিয়েছে। কিছু বই পুরানো মদের মতো। সময়ের সাথে স্বাদ শুধু বাড়ে, কমে না। বারবার পড়ার পরও জানা কাহিনি ভেবে একঘেয়ে লাগে না। বরং প্রতিবার নতুন করে ভাবনার খোরাক পাওয়া যায়। চৈতালী একবার তাকিয়ে দেখে জিজ্ঞেস করে,
“খাবেন না?”
“খেয়ে এসেছি। তুমি পড়। সামনে তোমার পরীক্ষা না?”
মাথা নেড়ে পড়ায় মন দেয় চৈতালী। জোবাইদা বেগম একবার এসে ঘুরে গিয়েছেন। মাহিমের কাছে চন্দ্রিমার খোঁজ খবর নিয়েছেন। চৈতালী উঠে এসে তাদের কথায় যোগ দেয়নি। কান পেতে শোনারও আগ্রহ করেনি। নিজের মতো অংক কষে গিয়েছে। মাহিমের দাদা ফজলে হাসান খান সাহেব আর জোহরা বেগম বাড়িতে নেই। জমিজমা সংক্রান্ত কাজে গ্রামে গিয়েছেন। সেখানে তাদের বাগানবাড়িতেই আজ রাতে থাকবেন। সাথে কাজের সহকারী হালিমা আর দারোয়ান ইদ্রিসও গিয়েছে। ফলে বাড়িটা কেমন খালি খালি মনে হচ্ছে। আর মাহিমের বাবা এতটাই আড়ালে নিজের মতো থাকেন যে তার উপস্থিতি টের পাওয়া যায় না।
একটানে মাহিম অনেকগুলো পেজ পড়ে ফেলেছে। মনোযোগ সরছিল না। এখন মাথাটা কেমন ধরে আছে মনে হলো। বইটার সবই ভালো, শুধু শেষটুকুতে মাহিমের অস্বস্তি হয়। মাহিম বই হাতে গিয়ে বারান্দায় বসে। চৈতালী আড়চোখে দেখে পড়া থেকে উঠে গিয়ে নিচে যায়।
“আপনার কফি।”
“কে বানালো? তুমি?”
“নাহ। আমি এমন কফি কোনদিন বানাইনি। প্যাকেট কফি হলে পারতাম। এটা সখিনার হাতে বানিয়েছি। আপনার জন্য চিনি, দুধ ছাড়া কালো কফি। আমার জন্য দুধ, চিনি দিয়ে।”
“থ্যাংকস এ লট। সত্যি ভীষণ দরকার ছিল। মাথা ধরেছে।”
“হ্যাঁ যেভাবে নড়াচড়া না করে বই পড়ছিলেন। ধরারই কথা। খুব ভালো বই? ইংরেজি পড়ে বুঝতে পারেন? লেখকের নামটা দেশি মনে হচ্ছে। মানে আমাদের বাংলাদেশ, ভারত এমন কোন জায়গার মানুষ?”
“হ্যাঁ। ইন্ডিয়ান রাইটারের বই। তুমি গল্প উপন্যাস পড়? পড়লে অরুন্ধতী রায়ের কথা শোনার কথা।”
“আমি পড়ি। তবে ইন্ডিয়ান রাইটার হিসেবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের, সমরেশ মজুমদার ওনাদের বই বইয়ের কথা জানি। পড়েছিও যে কয়টা লাইব্রেরিতে ছিল। নিজে কিনে পড়ার সুযোগ হয়নি। পড়ালেখার বইই সব সময় সব কিনতে পারতাম না। গল্প উপন্যাসে খরচ করার টাকা কই পাব।”
“এখন কিনতে ইচ্ছে করলে আমাকে বলবে। আনিয়ে দেব। তাছাড়া নিচে আমাদের পারিবারিক লাইব্রেরিতে অনেক বই আছে। সেখানে দেশি বিদেশি অনেক লেখকের বই আছে।”
“আচ্ছা এই বইটা কী নিয়ে? দ্য গড অব স্মল থিংস! নামটা কেমন অদ্ভুত। ‘ছোট বিষয়ের ঈশ্বর’।”
“এককথায় বলা যায় না। তবে সংক্ষেপে বললে বলতে হয়, আমাদের সমাজ আমাদের জন্য ভালোবাসাবাসির একটা নিয়ম যেন বেঁধে দিয়েছে। Who should be loved, and how. And how much. কাকে ভালোবাসবো, কতটুকু বাসবো।
আর এখানেই এই উপন্যাসটি প্রশ্ন করে, প্রশ্ন রেখে যায়, চিন্তার খোরাক রেখে যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের কি সমাজের এই নিয়ম মেনে তবেই কাউকে ভালোবাসা উচিত? না কি উচিত নয়?”
“বুঝলাম না। ভালোবাসার নিয়ম মানে?”
“উমম। মানে এই জন্য বললাম সহজ না সহজে বোঝানো।পারিবারিক জটিল নাটকীয়তার গল্প। জমিদার পরিবারের দুই ছেলেমেয়ের জীবন কাহিনি দিয়ে উপন্যাসের শুরু। তারা বড় হয়ে বিয়ে করে, সন্তান জন্ম দেয়। কিন্তু তাদের জীবনে ভালোবাসা থাকে না। মেয়েটার দুটি ছেলেমেয়ে থাকে, আর ছেলেটার একটি মেয়ে। কিন্তু একসময় মেয়েটা ভালোবাসার মানুষ খুঁজে পায় ঠিকই, কিন্তু ঐ যে সমাজের নিয়ম। উচ্চবর্ণ, নিম্নবর্ণের ভেদাভেদ। বয়স অনুযায়ী ভালোবাসার নিয়ম। দুই সন্তানের মায়ের এই ভালোবাসা কেউ মেনে নেয় না। মেয়েটার ভাইও না। মাঝে এই নিয়মগুলো কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয় নানা ভুল বোঝাবুঝি। বহুবছর পর সেই মেয়েটার যে দুটো ছেলেমেয়ে ছিল তারা একে অন্যের সাথে মিলিত হয়। মানে তাদের শারীরিক সম্পর্ক হয়। এভাবেই হয়তো কোন সম্পর্কে ভালোবাসা হয় আর কোন সম্পর্কে হয় না সেই বেড়াজাল ভাঙার সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছেন লেখক।”
“নিয়মের বেড়াজাল ছিঁড়তে ভাই বোনকে কেন ভালোবাসার সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনতে হলো? শারীরিক সম্পর্ক কি সব সম্পর্কের সংজ্ঞা পরিবর্তনে জরুরি?”
“ঐ যে বিষয়টি বিতর্কিত। এই বইটি যেমন পুরস্কার পেয়েছে, তেমনি সমালোচিতও হয়েছে।”
“আর ঐ বিষয়টি নিয়ে কী হয়েছে? ঐ যে উচ্চবর্ণ, নিম্নবর্ণের সম্পর্ক। শেষ পর্যন্ত কি সেই ধারণা পরিবর্তন এর কোন কথা আছে। এই নিয়ম কি ঠিক?”
“এ বিষয়ে ভালোবাসার অবশ্যই কোন নিয়ম নেই। ক্লাস অনুযায়ী ভালবাসার নিয়ম বলে কিছু নেই।”
“অবশ্যই আছে। ক্লাস অনুযায়ী শারীরিক টানের নিয়ম নেই। ভালোবাসার আছে। কাজের লোকের রুমে রাতের অন্ধকারে বাড়ির মালিক যে যায়, সেটা তো ভালোবাসা না। আমাকেই দেখুন না। আপনি রোজ একবার করে মনে করিয়ে দেন যে আমাকে দয়া করা যায়, মায়া করা যায়। ভালোবাসা যায় না। কারণ আমার আপনার শ্রেণিতে মিলে না।”
মাহিম থতমত খেয়ে যায়। দুপুরে বিড়ালের সাথে চৈতালীকে মেলানো যে চৈতালীর মনে এইদিক থেকে আঘাত করবে তা ভাবেনি।
“চৈতালী আমি অবশ্যই তোমাকে মানুষ হিসেবে সম্মান করি।”
“করেন তো। কিন্তু সেই সম্মানেরও রকমফের আছে। সময়ে সময়ে আপনি আমাকে আমার অবস্থান মনে করিয়ে সম্মান দেন। আপনার হয়তো মনে হবে তুলনা করছি। কিন্তু তুলনা না। কিন্তু বলুন তো কখনোই কি আপনি চন্দ্রিমা আপুর অবস্থান বোঝাতে কুকুর বেড়ালের তুলনা টেনে আনবেন? না আমার মান অভিমান এতটাই তুচ্ছ? শুধু গল্প উপন্যাস না। মানব জীবনের গল্পও কম নাটকীয় নয়। দ্য গড অব স্মল থিংস এর উদাহরণ আছে আমাদের সবার জীবনে। তাই না?”
“চৈতালী, আমি ভুল স্বীকার করছি। পাশাপাশি বলছি চন্দ্রিমার মতো তুমিও খুবই ব্রাইট একটা মেয়ে। শুধু পার্থক্য এই যে চন্দ্রিমা আমার জীবনে আগে এসেছে, তুমি পরে।”
“আমার খালি মনে হয় আপনাদের জীবনে আমি আসার অন্য কোন কারণ আছে। একদিন এমনই এক রাতে আমাকে সেই কারণটা খুলে বলবেন?”
“বলবো। আমি জানি তুমি বুঝতে পারবে। শুধু একটু সময় নিচ্ছি।”
(চলবে)
ধূসর কাবিন রঙিন প্রণয়
পর্ব ২০
চন্দ্রিমা বাড়িতে আসার পর মাহিম আবার আগের মতো চন্দ্রিমার রুমেই বেশি সময় কাটায়। চন্দ্রিমার শরীরটা খারাপ করছে। কিছু রিপোর্ট খারাপ এসেছে। কিন্তু অনেকটা জিদ করেই ও চলে এসেছে। মাহিম চৈতালীকে বলেছে চন্দ্রিমাকে বিরক্ত করতে না। দু’জন মুখোমুখি হলেও চৈতালী যেন এমন কিছু না বলে যাতে চন্দ্রিমা স্ট্রেস নেয়। চৈতালীও মেনে নিয়েছে। এই মুহূর্তে তার ধ্যানজ্ঞান লেখাপড়া। খুব একটা সামনাসামনি তাই হতে হয়নি।
সবকিছু ভালোই চলছিল। কিন্তু কিছুদিন পর চন্দ্রিমার শরীরটা বেশি খারাপ হয়ে যায়। ডাক্তারের পরামর্শে হসপিটালে ভর্তি হতে হয়েছে। চন্দ্রিমার বিলিরুবিন কাউন্ট বেড়ে গিয়েছে। এএলটি এএসটি রেশিও ও বেশি। খুব খারাপ কিছু না হলেও ডাক্তারের পরামর্শে কয়েকদিন হাসপাতালে থাকতে হবে। মাহিম নিয়মিত হাসপাতালে সময় দিচ্ছে। রাতে কাউকে থাকতে হয় না। হাসপাতাল থেকেই নিয়ম নেই। চৈতালীর ইচ্ছে করেছিল একদিন এসে চন্দ্রিমাকে দেখতে। কিন্তু মাহিমের অস্বস্তি দেখে আর আগ্রহ করেনি। জোবাইদা বেগম আর জোহরা বেগমও চন্দ্রিমাকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছেন। তবে ছেলের এই একবার হাসপাতাল, একবার ব্যবসার কাজে দৌঁড়ানো নিয়ে জোবাইদা বেগম বিরক্ত। চৈতালীর উপর তা ঝেড়েছেনও। চৈতালীর পরীক্ষা প্রায় শেষ। ইদানীং সারাদিন রুমে থেকেই পড়াশোনা করেছে। এমনিতেও তার খুব একটা কাজ নেই। মাহিম যখন বাড়িতে আসে তখন উঠে এসে দেখে মাহিমের কিছু প্রয়োজন কিনা। আজ জোবাইদা বেগম রুমে এসে বলেছেন,
“তোমার পরীক্ষা শেষ হয়নি এখনও?”
“প্রাকটিকাল আছে বাকি। লিখিত শেষ।”
“এখন তাহলে একটু হ্যাসবেন্ডের দিকে মন দাও। ছেলেটা সারাদিন বাইরে বাইরে থাকে। তার কোন যত্ন হয় না। এভাবে দেখা যাবে তুমিও ভালো আছ, চন্দ্রিমাও ভালো আছে। মাঝে আমার ছেলেটারই না কঠিন কোন অসুখ হয়ে যায়। সময় মতো খাওয়া নেই, রেস্ট নেই। একটা সময় পর আর মা নয়, ছেলে মানুষের স্ত্রীর যত্ন প্রয়োজন হয়। আর আমার ছেলের ভাগ্য এমন, যে কেউ তার যত্ন করবে সেটাই কপালে নেই।”
“আমি কী করতে পারি। তিনি তো সারাদিন বাসায়ই থাকেন না। থাকলে তো যত্ন করবো। রাতে এসে পোশাক পাল্টে শুয়ে পড়েন। কোনদিন খান, কোনদিন খান না।”
“পুরুষ কখন ঘরে আসে? যখন ঘরে আসার টান থাকে। তোমার হ্যাসবেন্ড যদি তোমার আকর্ষণে ঘরেই না আসে তবে সেই স্ত্রীর সৌন্দর্য, কমবয়স কোন কিছুরই কি কোন মূল্য আছে?”
চৈতালীর মনে পড়ে শ্বশুর হাসান আলী খানের কথা। সারাদিন জোবাইদা বেগমের সাথে হাসান আলী খান দশ মিনিটও কথা বলেন কিনা সন্দেহ। সারাদিন নিজের মতো বাগানে কাটান। বই পড়েন। কখনো বাইরে গেলে একাই গাড়ি নিয়ে বাইরে যান। জোবাইদা বেগমও কি তাহলে স্ত্রী হিসেবে ব্যর্থ নন?
“কী ভাবছো?”
“না কিছু না।”
“জানি কী ভাবছো। ভাবছো আমার আর মাহিমের বাবার কথা? তবে হ্যাঁ, সত্যি তো। কী মূল্য আছে আমাদের সম্পর্কের? মাহিমের জন্ম আমাদের ভালোবাসার চেয়ে এই পরিবারের প্রয়োজন বেশি ছিল। বংশধর হিসেবে মাহিমের আগমন হয়েছে। তারপর ঘরের লক্ষী হিসেবে মিন্নী এসেছে। আমার জীবনে মাহিমের বাবার ভূমিকা এখানেই শেষ। আমার জীবনে এসব প্রয়োজনও ছিল না। এই সংসারের কর্ত্রী হওয়া, মাহিমকে নিজের মতো গড়ে নেওয়াই আমার জীবন ছিল, এবং আছে। এখানে আমি অন্য কারও হস্তক্ষেপ চাই না। কিন্তু তোমার জীবন এরকম না। তুমি এখানে কর্ত্রী হয়ে আসোনি। না কারও বদলি হয়ে এসেছো। তুমি এসেছ মাহিমের জীবনে বাড়তি অংশ হয়ে। বাড়তি অংশ হতে মাহিমের জীবনের অংশ হতে চাইলে নিজেকে সেভাবে প্রস্তুত করো। মাহিমের জীবনে চন্দ্রিমাকে আর চাই না বলেই তোমাকে সে সুযোগ দিতে চাই। আমি চাই না আমার ছেলে একটা অসুস্থ মেয়ের পেছনে এভাবে নিজের জীবন ক্ষয় করুক। তোমার কাছে মাহিমের অস্থির মন শান্তি আর আশ্রয় পাবে ভেবেছিলাম। কিন্তু তুমি যদি তা না পারো, তাহলে এই পরিবারে তোমার প্রয়োজনটা কী?”
*****
আজও মাহিমের আসতে বেশ লেট হচ্ছে। চৈতলীর ঘুম এসে পড়েছে। এমনিতেও যে সে ইচ্ছে করে মাহিমের অপেক্ষায় ছিল তা নয়। তবু অবচেতন মনে অপেক্ষা করার একটা প্রবণতা তৈরি হয়েই যায়। রাত প্রায় একটা। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। গাড়ির সামান্য শব্দে চৈতলীর তন্দ্রা কেটে যায়। হালকা হালকা ঠান্ডা পড়ছে। চৈতালী পাতলা শাল জড়িয়ে নিচে নেমে এসেছে।
“তুমি জেগে আছ এখনো? পরীক্ষা নেই?”
“নাহ। লিখিত শেষ। প্রাকটিকাল হবে পরে। খাবার দিতে বলবো?”
“নাহ। মাথা ব্যথা করছে। কফি দিতে পারবে?”
“খেয়েছেন কিছু? এসময় কফি খেলে ঘুম নষ্ট হবে।”
“হাসপাতাল থেকে আসলাম তো। মাথা ধরেছে। কফি দাও পারলে। আমি উপরে গেলাম।”
“আপা কেমন আছে?”
“অনেকটা ভালো। কাল না হয় পরশু রিলিজ দিবে। আমি ওকে নিয়ে সিঙ্গাপুর যাব ভাবছি।”
চৈতালী কী বলবে জানে না। চুপচাপ কফি বানাতে যায়। এখন এই ব্ল্যাক কফি ও নিজেই বানাতে পারে। পরীক্ষার সময় বানিয়ে খেয়েছে।
রুমে এসে দেখে মাহিম লাইট অফ করে শুয়ে আছে।
“আপনার কফি। টেবিলে রাখবো?”
একটু অপেক্ষা করে চৈতালী হাত দিয়ে আলতো করে ধাক্কা দেয়। অবাক হয়ে লক্ষ করে মাহিমের গা বেশ গরম। এবার ভালো করে কপালে হাত দিতে বুঝতে পারে মাহিমের জ্বর এসেছে। ওর স্পর্শে মাহিমের তন্দ্রা ছুটে যায়।
“কফি এনেছ? ধন্যবাদ।”
“আপনার তো জ্বর এসেছে।”
“হ্যাঁ অনুভব করছি। মুখটা তাই তখন থেকে তিতে লাগছিল।”
“আম্মিকে ডাকি?”
“আরেহ না। এতরাতে আম্মুকে ডাকার প্রয়োজন নেই। আমি ঔষধ খাব। ঠিক হয়ে যাবে। ঐ ড্রয়ারের ভেতর ঔষধের বক্স আছে। পরিশ্রম বেশি হচ্ছে তো তাই একটু গা গরম হয়েছে। সিজোনাল ফ্লুও হতে পারে। প্যানিকের কিছু নেই।”
চৈতালী বক্স এনে দেয় বের হয়ে যায়। মাহিম ঔষধ খেয়ে কফির কাপ হাতে নিলে দেখে চৈতালী বাটিতে করে পানি নিয়ে এসেছে।
“কী করবে?”
“চুপচাপ শুয়ে থাকেন। একটু জল পট্টি দেব।”
“লাগবে না। ঔষধ খেয়েছি। ফ্লু হয়েছে আর কিছু না।”
চৈতালী কোন জবাব না দিয়ে জোর করে মাথায় জলপট্টি দিতে থাকে। চৈতালীর যত্নে আর ঔষধের প্রভাবে অল্প সময়েই চোখে ঘুম নেমে আসে মাহিমের।
হঠাৎ শেষ রাতে ঘুম ভেঙে কোথায় আছে মনে করতে পারে না মাহিম। একটু পর বুঝতে পারে রুমেই আছে। পাশেই জলপট্টি দিতে দিতে চৈতালীও কাত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। চৈতালীর সত্যিকারের মায়া আর যত্নে মাহিমের মনটা আদ্র হয়ে যায়। জ্বর ছেড়ে যাওয়ায় মাহিমের শরীরটাও ফ্রেশ লাগছে। আলগোছে উঠে চৈতালীকে সাবধানে বিছানায় শুইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। চৈতালী শরীরে স্পর্শ পেয়ে ধড়মড় করে ঘুম ভেঙে ওঠে।
“কী হয়েছে? কিছু লাগবে? জ্বর এসেছে আবার।”
“না না। তুমি এমন অদ্ভুত ভাবে শুয়ে ছিলে। ভাবলাম বিছানায় উঠিয়ে দেই। ঘাড় ব্যথা করবে না হলে।”
রুমটায় আবছা নীল আলো। চৈতালীর মুখটা আঁধারে ভীষণ মায়াবী লাগছে। চৈতালী উঠে এসে মাহিমের মুখোমুখি হয়।
“চৈতালী, ভালোবাসা ছাড়া কী দু’জন মানুষ কাছাকাছি আসতে পারে?”
“কোন ধরনের কাছাকাছি?”
মাহিম চৈতালীর মুখটা তুলে ধরে বলে
“এতটা কাছাকাছি। ভালোবাসি না বলেও কী তোমার এতটা কাছাকাছি আসা যায়? না তা অনুচিত?”
“ছল করে কাছে আসা অন্যায়। আপনি যদি আমাকে ভালো না বেসেও মিথ্যা ভালেবাসার দোহাই দিয়ে কাছে আসতে চান তা অনুচিত, তা অন্যায়। আর যদি স্পষ্ট বলেন শরীরের টানে কাছে আসতে চান, তা অন্যায় না আমার কাছে। আপনি সেই দাবি রাখার অধিকার রাখেন। আমার মতামত আছে কিনা জানতে চাইতেই পারেন।”
“আছে?”
চৈতালীর চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে
“তাহলে কথা দিন আমাকে ভালো না বাসেন, কখনো অসম্মান করবেন না। আমাকে কারও জায়গা দিতে হবে না। কিন্তু আমি আপনার জীবনে আগাছাও হয়ে রবো না।”
মাহিম চৈতালীর মুখ থেকে হাত নামিয়ে নেয়।
“আমাকে ক্ষমা করো। যতগুলো ওয়াদা করেছি তার চাপেই আমি পিষ্ট। আমি জানি না সেসব আমি পূরণ করতে পারবো কিনা। আর কোন ওয়াদার চাপ নিয়ে নিজেকে আর পিষ্ট করতে পারবো না। আমারও ভীষণ ক্লান্ত লাগে।”
(চলবে)