ধূসর কাবিন রঙিন প্রণয়
পর্ব ১৫
“চন্দ্র, মামনী তুমি সারা রাত ঘুমাও না। শুধু ছটফট করো। এভাবে তোমার শরীর খারাপ করবে মা।”
“ডাক্তারের এপয়ন্টমেন্ট কখন মাম্মি? বাপিও যাবে?”
“যাবে। এইতো বারোটার দিকে বের হবো আমরা।”
“ডাক্তার দেখানো শেষে আমি খান বাড়িতে চলে যাব মাম্মি।”
জেরিন সুলতানা মেয়ের পাশে গিয়ে বসেন।দু’হাতের আঁজলায় মেয়ের মুখ তুলে নিয়ে বলেন,
“চন্দ্র, মামনী খুব কষ্ট হচ্ছে? আমি তোমাকে মানা করেছিলাম মা। বুঝিয়েছিলাম যে পৃথিবীর অসংখ্য অসংখ্য দম্পতি আছে যাদের সন্তান হয় না। তারা একে অপরকে নিয়ে সুখী। মাহিম তোমাকে ভালোবাসে, তোমাকে সামান্য অবহেলা করে না। তুমি সুস্থ হলে এতিম বেবি দত্তক নিতে পারবে। সেই বাচ্চাটাও মা বাবার আদর পাবে। কিন্তু তুমি নিজেই মাহিমের দ্বিতীয় বিয়েতে মত দিলে। তোমার শাশুড়ি তোমার ব্রেইন ওয়াশ করে দিলেন কী বলে জানি না। তুমি নিজ হাতে মাহিমকে চৈতালীর হাতে তুলে দিয়েছ। এখন এভাবে মুষড়ে পড়ে নিজেকে দুর্বল প্রমাণ করতে, অসহায় প্রমাণ করতে উঠেপড়ে কেন লেগেছ?”
“আমি নিজেকে অসহায়, দুর্বল দেখিয়ে সিমপ্যাথি চাইছি না। চৈতালীকে মাহিমের জীবনে আনার আমার অন্য উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু ওকে মাহিমের পাশে সহ্য করা আমার পক্ষে কখনোই সম্ভব না। আমাদের কাজ হয়ে গেল চৈতালী মুক্ত হয়ে যাবে। তাই মাহিমের এত কাছাকাছি ওর না গেলেও চলবে। সবাই এমন করে মাহিমকে ভাগ করতে আমাকে জোর করছে কেন?”
“অন্য কী উদ্দেশ্য?”
চন্দ্রিমা চুপ করে যায়। লিভার ট্রান্সপ্লান্টের বিষয়টা সে মাকে কিছু বলতে চায় না। তার মা বাবাকে চেনে চন্দ্রিমা। তারা নানা ধরনের সোশ্যাল ওয়ার্কে জড়িত। এভাবে ডোনারের অজান্তে অর্গান ডোনেশন নেওয়ার বিষয়টা হয়তো কখনোই সহজ ভাবে গ্রহণ করবে না। সারোগেসির বিষয়টাও না।
“বলো চন্দ্র। কী উদ্দেশ্য?”
“কী বলবো। জানিই তো লিভার ট্রান্সপ্লান্টের পর গর্ভধারণ করা আমার জন্য সহজ হবে না। সারোগেসির মাধ্যমেও বেবি এদেশে বৈধ না। কিন্তু আম্মি বেবি দত্তক নেওয়া মেনে নিবেন না। তাই চৈতালী এসেছে আমাদের জীবনে।”
“চন্দ্র, আম্মু তোমাকে আমরা প্রচন্ড ভালোবাসি। তুমি যা চেয়েছ দিতে চেষ্টা করেছি। তুমি মাহিমকে বিয়ে করতে চেয়েছ আমরা পাশে থেকেছি। যদিও তোমার বাপি আগেই সতর্ক করেছিলেন। মাহিমের পরিবার অর্থডক্স মাইন্ডের, আমরা সাবধান করেছিলাম। আগাতে ভয় পাচ্ছিলাম আমরা। কিন্তু তোমার আত্মবিশ্বাস ছিল যে তুমি মানিয়ে নিতে পারবে। অথচ দেখ জোবাইদা বেগমের ইচ্ছের সামনে তুমি বা মাহিম কেউ দাঁড়াতেই পারলে না। দত্তক বাচ্চাকে নিজের বাচ্চা ভাবার মতো মানসিকতা সেই পরিবারের নেই বলে তুমি একটা বাচ্চা মেয়েকে নিজের সতীন বানিয়েছ, যেন সে তোমাদের বেবি দেয়! এরপর মেয়েটাকে বের করে দিবে? এত সহজ? ভুলে যেও না এই মেয়ে নিচুতলার মানুষ। তার কোন মান সম্মানের পরোয়া নেই। তুমি তাকে কোন সিনক্রিয়েট ছাড়া বের করতে পারবে? ড্রামা করে লোক জানাজানি করবে।”
“তো মাম্মি? করলো লোক জানাজানি। হলো একটু হাসাহাসি সমাজে। এর বেশি কিছু করার ক্ষমতা চৈতালীর নেই বলেই ওকে মাহিমের জীবনে আনা।এমনি বের হতে না চাইলে তার বাবার হাতে আর কিছু টাকা দিয়ে দিলেই মেয়েকে নিয়ে চলে যাবে। সৌন্দর্য, অর্থ, শিক্ষা কোন দিক থেকে সে চন্দ্রিমা আবেদিনের কাছাকাছি আসার মতো না।”
“আর বয়সে? সুস্থতায়? তোমাকে স্পষ্ট করেই বলি গত একবছরে তুমি মাহিমকে তার শারীরিক চাহিদার কতটুকু দিতে পেরেছ? রক্ত মাংসের স্বাদ একবার পেয়ে গেলে নাকি পশুও আর তা থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করতে পারে না। তেমনি বিবাহিত যে পুরুষ একবার শারীরিক সুখের সান্নিধ্য পেয়েছে তারজন্য তা থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা সহজ নয়। এটা কি সিনেমা পেয়েছ? বলিউডের মুভি যে নায়ক দেবতাসম। একজন পতি*তাকে নিয়ে আসলো বাচ্চা হওয়ার জন্য। শুধু একদিন কাছাকাছি গেল। বাচ্চা হলো। এরপর সেই প*তিতা ভালো মানুষি করে বাচ্চা তাদের দিয়ে চলে গেল। এটা বাস্তব জীবন। এখানে কেউ কারও অধিকার ছাড়বে না।মাহিম যত চৈতালীর কাছাকাছি যাবে তত তার প্রতি অনুরক্ত হবে। আর সবকিছু ছাপিয়ে তার কাছে চৈতালীর কাছে পাওয়া দেহ সুখই প্রধান হয়ে থাকবে। আমি আগেও বলেছি এসব। কিন্তু তুমি বলেছ সব জেনেশুনে আগাচ্ছ।”
“আম্মি আমি পাগল হয়ে যাব। প্লিজ এভাবে বলো না।”
মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন জেরিন সুলতানা।
“তোমার কাছে দুটো পথ আছে। হয় তুমি চৈতলীকে মেনে নাও। না হয় একবারে তোমাদের জীবন থেকে সরিয়ে দাও। বাচ্চা হলে চৈতালী তোমাদের জীবনে মধ্যবর্তিনী হয়ে থাকবে। শোন আম্মু, আমরা ঠিক করেছি তোমাকে নিয়ে সিঙ্গাপুর যাব। তোমার বাপি খোঁজ নিয়েছে। খরচ হবে অনেক, কিন্তু অর্গান ডোনেশন হয়তো পাওয়া যাবে। বাইরে মরণোত্তর দেহ দান করে অনেকেই। তেমন কারো লিভার তোমার সাথে ম্যাচ হলে তুমি লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করতে পারবে।”
“কেমন খরচ হবে?”
“ওখানে বেশকিছু দিন থাকতে হবে। এক কোটি ধরে রাখতে হবে।”
“হিউজ মানি আম্মি। আর যদি ডোনার নিজেদের থাকে তাহলে?”
“নিজেদের ডোনার কই আম্মু? আমি বা তোমার বাবা দিতে পারবো না। শারীরিক নানা কন্ডিশনের জন্য তো আমরা আগেই বাতিল হয়ে গিয়েছি। মাহিমের সাথে সবকিছু ম্যাচ হয় না তোমার। ও ভালো ডোনার হবে না। আর হলেও তোমার মনে হয় মাহিম ওর লিভার তোমাকে দিত বা জোবাইদা বেগম তা মেনে নিতেন?”
“আম্মি, চৈতালী ডোনার হতে পারে না?”
“চৈতালী? ও তোমাকে লিভার কেন দেবে?”
“জেনেশুনে দেবে না। কিন্তু না জানিয়ে আমরা যদি নেই।”
জেরিন সুলতানা মেয়ের কথা শুনে অবাক হয়ে যান। চন্দ্রিমা মায়ের হাত ধরে আকুতি জানায়।
“চৈতালী তো মারা যাবে না মা। কিন্তু ওর লিভারের কিছু অংশ পেলে আমি নতুন করে বাঁচবো। ও সুস্থ, কমবয়সী একটা মেয়ে। আমাকে লিভারের কিছু অংশ দিলে ওর কোন ক্ষতি হবে না। আমাদের ব্লাড গ্রুপ সহ অনেককিছুই ম্যাচ করে। আমার বাচ্চার দরকার নেই। জোবাইদা বেগম কী চান সেটা আর আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমি শুধু আমার মাহিমের সাথে বাঁচতে চাই। বাপিকে রাজি করিয়ে তুমি আমাকে বাঁচানোর ব্যবস্থা করো আম্মি। চোখের সামনে মাহিমকে অন্য কারও হতে দেখলে মৃত্যুর আগেই আমি মারা যাব। যতদ্রুত সম্ভব আমি সুস্থ হতে চাই।”
জেরিন সুলতানা হতবিহ্বল হয়ে যান। একদিকে ক্রন্দনরত কন্যার চেহারা অন্যদিকে চৈতালীর নিষ্পাপ মুখ। দুটোই তার অন্তর কাঁপিয়ে দেয়।
“একটু অপেক্ষা করো চন্দ্র। আমি তোমার বাবার সাথে কথা বলি। দেখি কী করা যায়। আমরা তোমার কিছু হতে দেব না।”
*****
চৈতালী কলেজে এসেছে। মাহিম নিজে ওকে কলেজে নিয়ে এসেছে। কাজ শেষে আবার নিয়ে যাবে। হাওয়াই মিঠাই রঙের সালোয়ার কামিজ পরেছে চৈতালী। রাতারাতি বেশভূষা পাল্টে যেন এ এক অন্য মেয়ে। দামী ব্যাগ, জুতো, ঘড়ি। কিন্তু ক্লাসের মেয়েরা চৈতালীকে দেখতে গেটে ভীড় করেনি। তারা এসেছে চৈতালীর বরকে দেখতে। ব্লু জিন্স, সাদা শার্ট, চোখে কালো সানগ্লাসে মাহিমকে ভীষণ স্মার্ট লাগছে। দামি গাড়িতে করে চৈতালীর আগমন আর সাথে মাহিমকে দেখে অবাক হোন জলিল স্যারও। তিনি চেষ্টা করেছিলেন চৈতালীর পরীক্ষা দেওয়া আটকাতে। তিনি ভেবেছিলেন চৈতালীর দোজবর স্বামী মধ্যবয়স্ক কোন লোক হবে। যে হয়তো এমনিতেই চৈতালীকে পড়ালেখা করাতে আগ্রহী হবে না। আর চৈতালী তারপরও চেষ্টা চরিত করে কলেজ পর্যন্ত এলেও চৈতালী আর তার ভাই শফিককে একটা শিক্ষা দিয়ে ছাড়বেন তিনি। পরীক্ষাই দিতে দিবেন না। কিন্তু এখন আর ভেজালে না জড়ানোই ভালো মনে করেন।
“এই চৈতালী, এই হিরো কিভাবে জোটালি? তলে তলে এত কাহিনি ”
“চৈতালী, তুই নাকি ছোট বৌ? না মানে দ্বিতীয় বৌ। ছোট বলা যায় না। দেখতে শুনতো তো তোর বর নায়ক মানুষ। আরও দুইটা তো নিশ্চয়ই করবে।”
“সুন্দর চেহারা আর টাকা দেখে আরেকজনের ঘর ভাঙলি চৈতালী। কারও ঘর ভেঙে কেউ সুখী হয় না। একদিন তোর ঘরও কেউ ভাঙবে।”
চৈতালী ভালমন্দ সব কথাই শোনে। কিন্তু কাউকে কোন ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না।
(চলবে)
ধূসর কাবিন রঙিন প্রণয়
পর্ব ১৬
চৈতালী কাজ শেষে কলেজ থেকে বের হতে পা বাড়ায়। মাহিম বাইরেই অপেক্ষা করছে।
‘এই চৈতালী, প্রথমবার দুলাভাইকে নিয়ে এসেছিস, আমাদের ট্রিট দিবি না? বিয়েতেও দাওয়াত পাই নাই।’
‘চৈতালী, তোর গাড়িতে উঠাবি না আমাদের?’
‘যাহ্ এত মানুষের জায়গা কী করে হবে গাড়িতে। তারচেয়ে আমাদের ট্রিট দিবে ভাইয়া। সেই ভালো। এই চৈতালী ভালো কিছু খাওয়াবি।’
চৈতালী নিজের মতো ব্যাগ গুছিয়ে কাগজপত্র নিয়ে পা বাড়াতে বাড়াতো বলে,
‘তোদের ট্রিট তো দিতাম, বিয়েতে দাওয়াতও দিতাম। কিন্তু জানিসই তো ভয় লাগে। আমি যেমন একজনের ঘর ভেঙে টাকার জন্য বিয়ে করছি। তেমনি আবার অন্য কার মনে কী আছে। নতুন বিয়ে হলো, এখনই তিন চার নাম্বার সতীন চাই না। তাই অন্য বেগানা মেয়েদের আপাততঃ স্বামীর কাছে আসতে দেব না। কিছুদিন স্বামীর টাকা ভোগ করে নেই। ভবিষ্যতে সে আরও বিয়ে করলে করবে। চারটা তো করার অনুমতি তো আছেই। যাইরে দোয়া করিস।’
*****
“সব কাজ শেষ?”
“মোটামুটি। আরও কয়েকবার আসা লাগবে।”
“তোমার বান্ধবীরা সব উৎসুক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে যে এভাবে দেখার কিছু আছে সেটাই তো জানতাম না।”
“আপনি না হয়ে অন্য কেউ হলেও দাঁড়াতো। কারও নতুন বিয়ে হলে বর যদি নিয়ে আসে, তখন সবাই এভাবে ভীড় করে। শ্যালিকা হওয়ার ঢং করে। দুলাভাই বলে আহ্লাদ করে। তারপর সবাই মিলে কোথাও খায়।”
“তো, আমাকে ধরলো না কেন? পছন্দ হয়নি?”
“একটু বেশিই পছন্দ হয়েছে। কিন্তু ওরা এলে আপনারই ভালো লাগতো না। আপনি হয়তো এই ধরণের হাসিঠাট্টায় অভ্যস্ত নন। চন্দ্রিমা আপার বান্ধবী আর আমার বান্ধবীরা এক নয়।”
“এক না হওয়ারই কথা। চন্দ্রিমর বান্ধবীরা বয়সে বড়। বেশ ম্যাচুয়র। এখানে সব কলেজের বাচ্চা মেয়ে।”
“ম্যাচুরিটি কি বয়স দিয়ে হয়? এদের কারও কারও বাচ্চা হয়ে গিয়েছে। এসএসসির পরই বিয়ে হয়ে গিয়েছে এমন মেয়েও আছে।”
“কী বলো?”
“হুম। আচ্ছা বাদ দিন কিছু খাব।”
“কী ফুচকা খাবে? না ঝালমুড়ি?”
রাস্তার পাশে টুলে ফুচকা নিয়ে বসে থাকা লোকগুলোর দিকে ইশারা করে মাহিম। ওদের চারদিকে ভীড়।
“নাহ্। যখন অবিবাহিত ছিলাম, তখন ভাবতাম যখন টাকা হবে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে খেয়ে দেখবো কেমন লাগে। ক্যাফেতে দামি ফাস্টফুড খাব। কফি খেয়ে দেখবো। জানতে চাই পঁচিশ টাকার কফি আর তিনশো পঁচিশ টাকার কফি কোনটার স্বাদে কতটা পার্থক্য। ফুচকা, চটপটি, ঝালমুড়ি তো সারাজীবনই খেলাম। বিশ টাকার সামর্থ্যে এর বেশি কী খাব। এখন তো আপনি আছেন। নিজে আয় না করলেও, আপনার সাথে খেতেই পারি এখন বড় রেস্টুরেন্টে।”
“অবশ্যই পারো। চলো নিয়ে যাই। খাওয়ার পর তোমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আমি চন্দ্রিমার কাছে যাব। ওর ডাক্তারের সিরিয়াল আছে।”
“আচ্ছা। আমাকেও নিয়ে যান।”
“তোমাকে না নেওয়াই ভালো। ওর শরীরটা ভালো না। তাই মনটাও কিছুটা বিক্ষিপ্ত।”
“বুঝতে পেরেছি। ঠিক আছে।”
*****
মাহিম চৈতালীকে গার্ডেন ভিউ ক্যাফেতে নিয়ে আসে। ক্যাফেটা শহরের খুব নামী ক্যাফে। চৈতালী মেনু দেখে। এক কাপ কফির দামই শুরু তিনশো পচাত্তর থেকে।
“দাম দেখা লাগবে না। কী খাবে বলো।”
“দাম দেখবো কেন। দাম তো দিবেন আপনি। কিন্তু কোনটা ভালো হবে বুঝতে পারছি না। তিতা লাগবে না কোনটা?”
“ক্যাপাচিনো নাও। সাথে ব্রাউনি দিতে বলছি। ব্রাউনি আইসক্রিম খাবে? ভালো লাগবে।”
“আপনি কি খাবেন?”
“আমি এক্সপ্রেসো খাব।”
“ওটা তিতে লাগে?”
“আমার তো লাগে না। তাহলে ওটাই দিন দুটো। আগে ব্রাউনি আইসক্রিম খাব তারপর কফি।”
চৈতালী খুব আগ্রহ নিয়ে আইসক্রিম খাচ্ছে দেখে মাহিমের মজা লাগে।
“কেমন?”
“আইসক্রিম টা মজা। কেকটা একটু পুড়ে যাওয়া ধরনের। অত নরম না, তিতে ভাব আছে।”
“রাখ তাহলে। তোমার মিষ্টি পছন্দ বুঝেছি। রেড ভেলভেট খাও। ভালো লাগবে।”
ওয়েটারকে ডেকে রেড ভেলভেট দিতে হবে মাহিম। নিজে কফিতে ছোট ছোট চুমুক দেয়। ব্রাউনি আইসক্রিম তার আর চন্দ্রিমার প্রিয় আইটেম। এই ক্যাফেতে আসলে তারা এটা খেতই। অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর অনেক খাবারে চন্দ্রিমার নিষেধাজ্ঞা আছে। তবু আজ ডাক্তার দেখানো শেষে চন্দ্রিমাকে নিয়ে বের হবে ঠিক করে। একসাথে সময় কাটালে চন্দ্রিমার মনও ভালো লাগবে।
“তুমি অন্য রকম চৈতালী। মানে যেমন হয় না, একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা। তারা একটু উচ্চবিত্ত পরিবারে বিয়ে হলেও নিজের আগের জীবনটা মিস করে। তাদের রাস্তার পাশে ফুচকা খেতে ইচ্ছে করে, হকার্স মার্কেটে শপিং করতে ইচ্ছে করে।
“থাকলেন কেন? আরও আছে তো। গাড়ি বাদ দিয়ে হ্যাসবেন্ডের সাথে সাইকেলে চড়তে তাদের ভালো লাগে। লোকাল বাসে লাফ দিয়ে উঠতে ভালো লাগে। বৃষ্টিতে টং দোকানে দাঁড়িয়ে চা খেতে ভালো লাগে। আর কী বাকি আছে বলেন তো? কই দেখেছেন এসব? সিরিয়ালে না নাটক নভেলে পড়েছেন।”
বলেই ফিক করে হেসে দেয় চৈতালী। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
“আমি বুঝি না সিরিয়ালগুলোয় যার এত মধ্যবিত্ত জীবন পছন্দ সে ভালবেসে ধনী ঘরে বিয়েই বা কেন করে? আর বিয়ে করে এসব ন্যাকামিও বা কেন করে? আরে জীবনের বিশ বাইশ বসন্ত বাসে ধাক্কা খেয়ে, বৃষ্টিতে ভিজে রিকশা খুঁজে কী তার ফ্যান্টাসি শেষ হয়নি যে বিয়ের পরও এই মিস করার ঢং করতে হবে? মানুষ রাতদিন পরিশ্রম করে ভালো আয় করতে। তারপর যখন আয় করে, ভালো চলতে শুরু করে তখন আগের জীবনটা মিস করে বলে কান্নাকাটি করে। ডিপ্রেশনে পড়ে। তাহলে এত কষ্ট করারই দরকার। ছেড়া কাঁথা গায়ে দিয়ে টিনের চালের ফুটো দিয়ে আকাশের চাঁদ দেখেই তো খুশি থাকতে পারে।”
“তাহলে তোমার নতুন জীবন ভালো লাগছে?”
“অবশ্যই লাগছে। আমি ছোটোবেলা থেকে অনেক পরিশ্রম করেছি। রিকশা ভাড়া বাঁচাতে লোকাল বাসে উঠেছি। হেঁটে স্টুডেন্ট পড়াতে গিয়েছে। রোদে হেঁটে গলা শুকিয়ে গেলে একটা পানির বোতল কেনার বিলাসিতা করতে পারিনি, ডাব বা জ্যুস খাওয়া দূর। আজ আমি এসি গাড়ি করে কলেজে আসলাম। কলেজে আমার অবস্থানই বদলে গেল। যে মেয়েগুলো একটু ভালো অবস্থার পরিবার থেকে কলেজে এসেছে তারা কী দেমাগ দেখিয়ে চলতো। আজ তারা আমার জামা, ব্যাগ সব খুটিয়ে দেখলো। আমার নায়কের মতো হ্যান্ডসাম হ্যাসবেন্ড দেখে সুন্দরী মেয়েগুলো জ্বলেপুড়ে গেল। আমার তো এই বেশ লেগেছে। আমার তাই পুরানো জীবনের দুঃখবিলাস করতে একদমই শখ নেই। ঘর পালাতে গিয়ে আমি ভুল করছিলাম। ভালোই হয়েছে জলিল স্যার দুই নাম্বারি করেছেন। আপনাকে আমার ভালো লেগেছে। আপনি মানুষ ভালো। বয়সে একটু বড় কিন্তু বোঝাই যায় না। স্মার্ট মানুষ। আমি ঠিক করেছি তাই কোন দুঃখবিলাস করবো না। আপনি চন্দ্রিমা আপাকে ভালোবাসেন আমার কোন আপত্তি নেই। আমি আমার জীবনে নিজের জন্য সুখ খুঁজে নেব। আচ্ছা এখন আমাকে আপনার ভালো ফোনটায় কয়েকটা ছবি তুলে দেন। ফেসবুকে দেব। সবগুলোকে আরও জ্বালাবো।”
চৈতালীর সোজাসাপটা কথায় বিরক্ত হওয়ার বদলে মাহিমের মজা লাগে। মেয়েটা গোল্ড ডিগারের মতো চিন্তা ভাবনা রাখলেও মাহিমের কাছে তা স্বাভাবিকই মনে হচ্ছে। ফোনে ভাইব্রেশন হচ্ছে। চন্দ্রিমা কল করছে। মাহিম কল কেটে চৈতালীর ছবি তোলায় মন দেয়। একটা সেলফিও তোলে।
(চলবে)