ধূসর অনুভূতি পর্ব-১৫+১৬

0
905

#ধূসর অনুভূতি
পর্ব:১৫+১৬
লেখক- শাপলা

মালিহা রেস্টুরেন্টে বসে আছে।তার সামনে বসে আছে ঝিনুক আর যুথি… অনেক ক্ষন ধরেই নিশ্চুপ তিনজন।মালিহা তিনদিন ধরে তার বাবার বাসায় এসেছে। আজ সকালে সাহস করে যুথিকে ফোন করেই ফেলেছে।বলেছে তিতলির সাথে দেখা করতে চাই।
যদিও দেখা করতে ঝিনুক আর যুথি এসেছে শুধু।তিতলি আসেনি।
তিনজনের মধ্যে প্রথম কথা বললো ঝিনুক। খুব সুন্দর করে হেসে বললো,
– তো মিসেস ফারহান কেমন আছেন আপনি? আপনার স্বামী কেমন আছে?
মালিহা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।বললো, ঝিনুক আমার ক্ষমা চাওয়ার কোনো যোগ্যতা নেই তাই ক্ষমা চাইবোও না।আমি শুধু তিতলিকে একবার দেখতে চাই। এরপর আমি চলে যাবো।
ঝিনুক বললো,তিতলিকে কেন দেখতে চান ?আমরা তো তিতলিকে যার তার সাথে দেখা করাই না। বোঝেনই তো কত খারাপ মানুষ চারপাশে। এদের সাথে মিশে যদি তিতলির মনটা বিষিয়ে যায়…
মালিহা বললো, ঝিনুক আমি তিতলির মা হই।
ঝিনুক তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো।
বললো, ও আচ্ছা আপনি যে মা ভুলে গেছিলাম।তিনবছরের মেয়েকে ফেলে পালিয়ে যাওয়ার সময় কোথায় ছিল আপনার মাতৃত্ব?
মালিহা চোখের পানি মুছলো।”প্লিজ ঝিনুক একবার দেখা করে আমি চলে যাবো। দূর থেকে দেখবো একবার দয়া করো।”
– আমি বেঁচে থাকতে আপনার মতো অসৎ মহিলার ছায়াও আমার তিতলির গায়ে পরতে দিবো না।
মালিহা অসহায়ের মতো যুথির দিকে তাকালো।যুথিও মাথা নিচু করে ফেললো।
ঝিনুক আবার বললো,কোন সাহসে আপনি তিতলির সাথে দেখা করার কথা চিন্তা করলেন? আপনি এখনো আমাকে চিনেন নাই।আমি ভালোর সময় যেমন ভালো,তেমন খারাপের সময় আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ নাই।
যুথি ঝিনুক কে শান্ত হতে বললো। এরপর মালিহার দিকে তাকিয়ে বললো,ভাবী তিতলি এখন তোমাকে অনেকটাই ভুলে গেছে। তোমার জন্য আর কাঁদে না। এখন তুমি যদি আবার ওর সামনে যাও ওর পুরানো ক্ষতটা আরো বাড়বে। তুমি তো আর সবসময় ওর সাথে থাকতে পারবে না।মায়া বাড়িয়ে তো লাভ নেই।
মালিহা কেঁদে উঠলো।সে তিতলির জন্য তিতলির প্রিয় চকলেট এনেছে দুই বক্স,খেলনা এনেছে।
চোখের পানি মুছে যুথির হাতে বক্সগুলো ধরিয়ে দিয়ে বললো, দেখা যখন করতে দিবাই না তাহলে আর কি করার… এইগুলো তিতলিকে দিও।
যুথি বক্স গুলো হাতে নেওয়ার আগেই ঝিনুক সেগুলো ক্ষিপ্রভাবে নিজের হাতে নিয়ে ছুড়ে বাইরে ফেলে দিলো।
বললো, আপনাকে কিছু দিতে হবে না।তিতলির কিছু লাগলে আমরাই দিতে পারবো বুঝেছেন?
মালিহা বললো,আমি দোষ করছি আমি মানছি। কিন্তু তিতলি তো আমার মেয়ে।ওকে আমি কিছু দিতেও পারবো না?
যুথি বললো,আপু একবার দেখা করতে চাইছে দাও না…
ঝিনুক কোনো কথাই বললো না। অনেক ক্ষন আবার নীরবতা।
মালিহা আশা করে বসে আছে ঝিনুক এর হয়তো মন গলবে।
অনেক ক্ষন পর বাদশার প্রসঙ্গ উঠলো।
ঝিনুকের দু’চোখে পানি জমলো। বললো,ভাবী তুমি ভাইয়াকে ছেড়ে গেছিলা কিসের জন্য বলবা? আমার তো মনে হয় আজকালকার যুগে আমার ভাইয়ের মতো ছেলে পাওয়া মুশকিল। তুমি চলে যাওয়ার আগে যে চিঠি লিখে গেছিলা আমাদের সবার নামে একগাদা দোষ সেই চিঠিতে লিখে গেছিলা….
মালিহা বললো, পুরানো কথা কেন তুলছো?
– না ভাবী পুরানো কথা তুলতে হবে। তুমি আমাদের অনেক দোষ,ত্রুটি লিখছিলা সেটা পড়ার পর আমাদের নিজেদের কাছে নিজেদের খুব নিচু মনে হতো। আশেপাশের মানুষজন বলতো,বউটার উপর মনে হয় বাদশাহ অনেক টর্চার করছে এর জন্য না পেরে বউটা পালাইছে। আমার ভাই এইসব কথা শুনে শুনে মানসিক ভাবে চরম বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। তোমার চিঠিতে তার এতো দোষ পড়ে সে অবাক হয়ে গেছে যে তোমার তার প্রতি এতো বিতৃষ্ণা ছিল ,এতো ঘৃনা ছিল…সে সহ্য করতে পারে নাই।তো,ভাবী আমি জানতে চাই এখন কি তোমার মনের মতো স্বামী পাইছো?সেই স্বামী কি সর্ব গুণে গুণান্বিত?
ঝিনুকের চোখের পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পরছে।
মালিহা মাথা নিচু করে বসে রইলো। অনেক কষ্টে চোখের পানি আটকাচ্ছে সে।বললো,আমি ভুল করছি ঝিনুক কতবার বলবো…
ঝিনুক তার ব্যাগ থেকে মালিহার লিখে যাওয়া চিঠিটা বের করলো।সেটা মালিহার সামনে ধরলো।
হেসে বললো, ভুল না তুমি অন্যায় করছো অন্যায়,পাপ।ভাবী তুমি চিঠিতে লিখছো আমি আর যুথি নাকি তোমার জীবন অতিষ্ঠ করে দিচ্ছি। তোমার সব কিছুতে আমরা হাত দিই। তোমার শখের জিনিস নষ্ট করি। তোমার কোনো প্রাইভেসি নাই। আচ্ছা ভাবী প্রাইভেসি যদি নাই ছিল তুমি ফারহান ভাইয়ের সাথে প্রেম করছো কিভাবে? তোমার তো যথেষ্ট প্রাইভেসি এবং স্বাধীনতা ছিলো যার কারণে তুমি উনার সাথে পরকীয়া চালাতে পারছো বছরভর।রইলো বাকি আমরা তোমার সবকিছু তে ভাগ বসাতাম।আহারে ভাবী কসম করে বলতেছি বুঝতে পারি নাই তুমি আমাদের এইসব ব্যবহার অপছন্দ করো।তোমাকে বড় বোনের মতো মনে করছিলাম।তাই, তোমার কানের দুল, চুলের ফিতা নির্দ্বিধায় নিজের ভাবছি। কিন্তু,বুঝি নাই ভাবী তো বড় আপু হয় না।যদি ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারতাম তাহলে তোমার রুমেও যাইতাম না। শেষের দিকে এমনিতেও যেতাম না তোমার কাছে। বুঝতাম পছন্দ করো না। কিন্তু, শুরুতে বুঝতাম না। বুদ্ধি-শুদ্ধি কম ছিল তো তাই। তুমি তো মনে করো সব দোষ আমাদের। তুমি পরিস্থিতির চাপে পড়ে বাধ্য হইছো, কিন্তু তোমার ধারণা ভুল ভাবী। আমাদের দোষ আছে মানছি কিন্তু তোমার দোষ সবচেয়ে বেশি। আমার ভাইকে তুমি দোষী করছো ভাবী,আমি আমার ভাইয়ের চেয়ে ভালো ছেলে আর কোথাও কোনোদিন দেখি নাই। ছোট বেলার থেকে সে ছায়ার মতো আমাদের আগলে রাখছে।তার বিরুদ্ধে যখন তুমি এত্তোগুলো অভিযোগ করলা আমি মানতে পারি নাই ভাবী। আমার মায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুলো আমি মানছি, মায়ের দোষ আছে আমি জানি। কিন্তু, আমার ফেরেস্তার মতো ভাইরে তুমি অমানুষ বলছো, জানোয়ার বলছো।
ঝিনুক জোরে শ্বাস নিলো। এরপর আবার বলতে শুরু করল, ভাইয়ার অনেক দোষ তোমার চিঠি পড়ে জানছি এইবার আমি একটু তার গুণগুলো বলি কেমন…. তুমি ভাইয়ার বউ হয়ে যখন আসছো তখন ভাইয়ার কোনো চাকরি ছিল না, বেকার ছিলো। ভাইয়া বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে তবু তোমাকে বিয়ে করছে।কয়টা ছেলের এমন বুকের পাটা থাকে বলো তো…প্রেম করে, সর্বনাশ করে পরিবারের দোহাই দিয়ে চলে যায় ছেড়ে। আমার ভাই তো তা করেনি। আমার ভাই তো মদ-গাঁজা খায়না।এমনকি তোমার জন্য সিগারেট খাওয়াও বাদ দিয়ে দিছিলো।কোনো বাজে নেশা ছিল না।কোনো মেয়ের দিকে তাকাতোও না।কয়টা পুরুষ দেখাইতে পারবা এমন চরিত্রবান?তার কি দোষ ছিল বলবা?সে তার বোনদের ভালোবাসতো,মা-বাবাকে ভালোবাসতো এটা দোষ?তোমাকে কি ভালোবাসতো না?তোমাকে ফারহান ভাইয়ের সাথে নোংরামি করতে দেখে যুথি যখন ভাইয়াকে বিচার দিছিলো তখন ভাইয়া উল্টা যুথিকেই ধমকাইছিলো। বলেছিলো,ভাবলি কি করে মালিহার নামে এতো খারাপ একটা কথা বিশ্বাস করবো আমি?পরের বার এমন কথা বললে চড়িয়ে দাঁত ফেলে দিবো।’আহ খোদা কত বিশ্বাস ছিল তোমার উপর। তুমি পালিয়ে যাওয়ার পরেও বিশ্বাস করে নাই ভাবছিল বিপদে পরছো।সেই বিশ্বাস তুমি ভেঙে দিলা?মন ভাঙা তো মসজিদ ভাঙার সমান ভাবী। তোমার শাড়ি আমরা পছন্দ করলে ভাইয়া আমাদের দিয়ে দিতো? আচ্ছা, এরপর কি ভাইয়া তোমাকে কিনে দিতো না?আরে, আমাদের জন্য কিনে আনা কিছুও তুমি পছন্দ করে দেখতা ভাইয়া সাথে সাথে বলতো, তোদের ভাবীকে দিয়ে দে এটা তোদের জন্য আরেকটা কিনবো।ভাবী এইসব ছোট ছোট কারণে মানুষ সংসার ভাঙে? আমার মা তো আমাদের গায়েই হাত তুলতো কথায় কথায়। তুমি তো কোন ছাড়… শ্বাশুড়ির উপর জেদ করে সংসার ভাঙলা? সংসার কি শ্বাশুড়ির সাথে করতা নাকি স্বামীর সাথে?আমরা সবাই বুঝতাম ভাইয়া তোমাকে ভালোবাসে অনেক শুধু তুমি ই বুঝতা না।বুঝবা কেমনে তুমি তো ভালোবাসায় মগ্ন ছিলে পরপুরুষের সাথে। ফারহান ভাই কি আমার ভাইয়ের চেয়েও ভালো? অনেক সুখী এখন তুমি?
ঝিনুক কেঁদে উঠলো।মালিহা আর যুথিও কাঁদতে লাগলো।
ঝিনুক চোখের পানি মুছে বললো,ভাবী তুমি না হিংসা করছো ভাইয়া কেন আমাদের পিছনে টাকা খরচ করে…আজ দেখো ভাইয়ার বিপদে তুমি পাশে নেই, পালিয়ে গিয়ে সুখে আছো। কিন্তু,আমি তো পালায় যেতে পারছি না আমার ভাইকে ফেলে। আমার ভাই যে পাগল হয়ে গেলো। হাসপাতালে ভর্তি, তুমি কই এখন?আমার তো জান বেরিয়ে যাচ্ছে একা একা সংসার টা টানতে। এখন আসো হিংসা করতে…
মালিহা চোখের পানি ফেলে অবাক হয়ে বললো, বাদশার কি হইছে?
ঝিনুক বললো, তোমাকে বলতে চাচ্ছি না। তুমি তো কেউ না। তোমাকে বলে লাভ কি….চল যুথি।
ঝিনুক উঠে চলে গেল।
যুথি কি বলবে ভেবে পেলো না। তার ঝিনুক আপু ইদানীং এতো রাগী হয়ে গেছে।
যুথি বললো,ভাবী তিতলি ভালোই আছে। তুমি চিন্তা করো না।আমরা ওর খেয়াল রাখি।
মালিহা বললো, বাদশার কি হইছে?
যুথি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সব খুলে বললো।
মালিহা সব শুনে পাথরের মতো হয়ে গেল।
যুথি বললো,ভাবী আমাদেরও দোষ ছিল, শুধু তোমার একার না।আমরাও বুঝাতে পারিনি যে আমরা তোমাকে ভালোবাসি। ।
যুথি কাঁদতে লাগলো।
মালিহা যুথিকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বললো,আমি ভালো নাই যুথি আমি ভালো নাই।
যুথি কাঁদতে কাঁদতে বললো,আমরাও ভালো নাই।
মালিহা বললো,তিতলির এখনকার তোলা একটা ছবি দেখাবা?
যুথির ওয়ালপেপারেই তিতলির ছবি সেইভ করা ছিল।
যুথি দেখালো।মালিহা ফোনের মধ্যেই চুমু খেয়ে ফেললো।
পরদিন তিতলির সাথে দেখা না করেই সে ফিরে এলো একরাশ কষ্ট নিয়ে।

ঝিনুক-কে এখন কেমন যেন অদ্ভুত লাগে।যুথি চিনতে পারে না নিজের বোনকে।মাকেও চিনতে পারে না।সবাই বদলে গেছে।আর, বাদশাহর অবস্থা তো আরো খারাপ।সে তো তাদের কাউকেই চিনে না।এমনকি তিতলিকেও না…..
একটার পর একটা কষ্ট এসে সবাই কে বদলে দিয়েছে।
এখনো যে আরো একটা বড় কষ্ট পাওয়া বাকি তারা তো জানেও না।

আমি বারান্দায় বসে ছিলাম। ঝিনুক আপু হঠাৎ আমার পাশে এসে বসলো।আমি অবাক হলাম।আপু তো এতো তাড়াতাড়ি ফিরে না কখনো।কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আপু বললো,ডক্টরের রিপোর্ট। নে দেখ…
আমি বললাম,দেখে কি হবে,আমি তো বুঝবো না।ড.রবিউলের ওখানে গিয়েছিলে?
ঝিনুক আপু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। বাদশাহ ভাইয়াকে ইদানীং একজন নিউরোসার্জনও দেখছেন।কারণ,ডাক্তারদের ধারণা মানসিক সমস্যা ছাড়াও বাদশাহ ভাইয়ার আরো কোনো রোগ আছে। বাদশাহ ভাইয়া দৃষ্টিশক্তি কমে যাচ্ছে, ইদানীং অনেক বেশি দূর্বল হয়ে পরেছেন,জ্বর-মাথাব্যথা-বমি তো লেগেই আছে।আর কাউকে না চিনার বিষয়টা তো আগে থেকেই ছিল। মানসিক সমস্যা থেকে ভুলে যাওয়ার ব্যাপারটা হওয়া স্বাভাবিক কিন্তু সব মিলিয়ে দেখলে মনে হয় ব্যাপারটা শুধুমাত্র মানসিক আঘাতের কারণে হচ্ছে না। আগের থেকেই হয়তো কোনো সমস্যা ছিল আর মানসিক আঘাতের পর সেটা আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে। সাইকোলজিস্টের পরামর্শেই বাদশাহ ভাইয়াকে একজন নিউরোলজিস্ট দেখানো হয়েছে।
ঝিনুক আপুর হাতে তারই রিপোর্ট।
আপু নির্লিপ্ত ভাবে বললো,ডাক্তার বলেছে ভাইয়ার মাথায় টিউমার হয়েছে।ম্যালিগনেন্ট টিউমার।এটা ভীষণ ভয়ানক ব্যাধি বুঝেছিস। ভাইয়া মনে হয় বাঁচবে না।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।এতো বড় কষ্টদায়ক একটা খবর আমাকে শুনতে হলো।
ঝিনুক আপু বললো,আসলে ভাইয়ার বেঁচে থাকার মতো মানসিক জোরও নেই।মালিহা ভাবী যাওয়ার পর সে ভেবেছে এর জন্য সে-ই দায়ী।কোনো রোগ থেকে বেঁচে ফিরতে হলে সর্ব প্রথম যেই জিনিসটা লাগে তা হলো বেঁচে থাকার ইচ্ছাশক্তি।ভিতর থেকে মরে যাওয়া মানুষকে বাঁচিয়ে তোলা যায় না।যা আমার জন্য এক কাপ চা বানিয়ে আন।মাথা ব্যাথায় মরে যাচ্ছি।
আমি কাঁদতে কাঁদতে চা বানালাম।
বললাম,আপু ভাইয়াকে দেখতে যাবো।
আপু বললো,লাভ নাই রে। ভাইয়া কাউকে চিনে না।সেন্সও থাকে না ম্যাক্সিমাম টাইম।
– আমি তবুও ভাইয়াকে দেখতে চাই….
– কান্নাকাটি বন্ধ কর। ভাইয়া কি মরে গেছে? অপারেশন করতে হবে।
– অপারেশন করালে কি ভাইয়া ঠিক হয়ে যাবে?
– ভাগ্য ভালো থাকলে হবে।
– কয়টাকা লাগবে আপু?
– তিন লাখ।
টাকার পরিমাণ শুনে আমি আপুর দিকে তাকালাম।
– এতো টাকা কিভাবে যোগাড় করবে আপু?
– সেটা নিয়ে তোকে চিন্তা করতে হবে না। দরকার হলে আমার দুইটা কিডনি বিক্রি করে দিবো।
ঝিনুক আপু হাসলো।
আমি তাকিয়ে রইলাম।কি বলা উচিৎ জানি না।
এরপর আস্তে আস্তে ঝিনুক আপু কিছু টাকা যোগাড় করেও ফেললো,যদিও সেটার পরিমাণ বেশি না। শুরুতেই পুরো টাকা দিতে হবে না, সুতরাং কিছু সময় হাতে আছে।
ঝিনুক আপু হন্যে হয়ে টাকা জোগাড়ের চেষ্টা করছে। আমাকে নিয়ে এক দুঃসম্পর্কের মামার বাসায়ও গেলো একদিন, মোটকথা কোনো আত্মীয় বাদ নেই।মামা বাসায় ছিলেন না।তার স্ত্রী আর ছেলে ছিল।সব শুনে তারা বললো,অবশ্যই মামাকে জানানো হবে।
কিন্তু,আদৌ জানাবে কি না কে জানে।আর,জানালেই বা উনি আমাদের সাহায্য করবে এটা হওয়ার কোনো শিউরিটি নেই। আমার মনে হলো আমাদের ভাগ্য টা সবদিক দিয়েই খারাপ।অন্য মানুষেরা বিপদে পড়লে তাদের আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ঢাল হয়ে দাঁড়ায়।আর, আমাদের এক সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কেউই নেই।
হঠাৎ রাস্তায় মেহেদী ভাইয়াকে দেখলাম।
আমি ঝিনুক আপুকে বললাম, আপু দেখো মেহেদী ভাইয়া।
আপু বললো,তো?দেখতে হবে কিসের জন্য? এলিয়েন সে?
ঝিনুক আপু পা চালিয়ে হাঁটতে লাগলো। সাথে আমিও… কিন্তু মেহেদী ভাইয়া ততক্ষণে আমাদের দেখে ফেলেছে। তিনি দৌড়ে এলেন।
জিজ্ঞেস করলেন,কেমন আছো তোমরা?
আমি বললাম,জ্বি ভালো আছি।
মেহেদী ভাইয়া জিজ্ঞেস করলো, ঝিনুক তুমি তো এখন দেশে থাকার কথা না….
ঝিনুক আপু বললো,না আমার তো এখন মঙ্গল গ্রহে থাকার কথা।
মেহেদী ভাইয়া হাসলো।বললো, তুমি আগের মতোই আছো। তোমার স্বামী কেমন আছে?
আমি বললাম, ভাইয়া আপুর বিয়েটা হয়নি। বাদশাহ ভাইয়া ভেঙে দিয়েছিল।
মেহেদী ভাইয়ার চোখে হঠাৎ জল টলমল করে উঠলো।বললো, ঝিনুক তুমি আমাকে এতো বড় খবরটা দাও নি কেন?
ঝিনুক আপু বললো,আপনাকে খবর দিতে হবে কেন? আপনার জানার ইচ্ছা থাকলে আপনি নিজেই খবর নিতেন।
মেহেদী ভাইয়া বললো, আমি তো ভাবছি তোমার……….
এরপর থেমে বললো, আচ্ছা বাদ দেও সব দোষ আমার মেনে নিলাম।এর জন্য আমাকে যা শাস্তি দিবা মেনে নিবো। এখন প্লিজ আসো কোথাও বসি, কতদিন তোমার সাথে কথা হয়না।
ঝিনুক আপু বললো,সময় নেই বসতে পারবো না।তা, আপনার তো স্টাডি শেষ… এখন কি চাকরি খুঁজছেন?
মেহেদী ভাইয়া বললো,আসলে চাকরি খুঁজছি না।ওসব চাকরি বাকরি আমার দ্বারা হবে বলেও মনে হয় না।
– তাহলে এখানে যে?আমি তো খবর পাইছিলাম আপনি নিজের শহরে চলে গেছেন।
মেহেদী ভাইয়া বললো,হ্যাঁ বাড়িতেই থাকতাম। একটা আর্ট এক্সিবিশনের জন্য কিছু দিন হলো এসেছি।আমার কিছু ছবি আছে তো তাই।
আমি অবাক হয়ে গেলাম।-সত্যি?
মেহেদী ভাইয়া হেসে বললো, হুম সত্যি।দেখবা তোমরা?আসো।কয়েকটা সেল হয়ে গেছে ইতোমধ্যে।
আমি বললাম,তাহলে আর দেখবো কিভাবে?
– আরে বোকা এক্সিবিশন যতদিন চলবে ততদিন তো সব ছবিই থাকবে মানুষজন দেখার জন্য।যারা কিনেছে তারা এক্সিবিশন শেষ হওয়ার পর ছবি নিয়ে যাবে।
ঝিনুক আপু যেতে চাইলো না। আমার জোরাজুরিতে গেলো।যদিও আপুর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল আপু আসলে যেতে চায়। মেহেদী ভাইয়ার আঁকা ছবি দেখলে আপুর মনটা এমনিতেও একটু ভালো হবে। বাদশাহ ভাইয়ার অসুস্থতার পর থেকে তো আমাদের জীবন থেকে তো সব খুশি হারিয়ে গেছে।
আমরা মেহেদী ভাইয়ার সাথে আর্ট গ্যালারিতে গেলাম।কত সুন্দর সুন্দর ছবি চারপাশে।
এর মধ্যে মেহেদী ভাইয়া তার নিজের আঁকা ছবি গুলো দেখাতে লাগলো।তার একটা ছবি সবচেয়ে পছন্দ হলো আমার.. ছবিটার নাম”ঝিনুক”।উপরে নীল আকাশ আর নিচে সমুদ্রের নীল ঢেউ মিলেমিশে একাকার।সেই ঢেউয়ের মধ্যে একটা মেয়ে বসে আছে।মেয়েটার মাথার চুল উড়ছে। কিছু অবাধ্য চুল তার মুখের উপর পরে আছে।তাই, অর্ধেক টা চেহারা দেখা যাচ্ছে।সেই অর্ধেক টা চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটা আসলে ঝিনুক আপুকে ভেবেই আঁকা হয়েছে।ছবিতে মেয়েটার হাতে একটা ঝিনুক আছে…সবাই হয়তো ভাববে এর জন্যই ছবিটার নাম ঝিনুক কিন্তু…..কি জীবন্ত একটা ছবি। ছবিটার দিকে তাকালেই মনে হচ্ছে যেন আমিও ছবিতে থাকা মেয়েটার সাথে সমুদ্রের বেলাভূমিতে আছি। নীল ঢেউয়েরা এসে আমাকেও ছুঁয়ে দিচ্ছে। সমুদ্রের ঠান্ডা বাতাস যেন আমার গায়েও লাগছে…আর,ছবিতে থাকা মেয়েটা তো আরো জীবন্ত।মনে হচ্ছে সত্যিই সে মাত্র পাড়ে এই ঝিনুক টা কুড়িয়ে পেয়ে হাতে নিয়েছে।
আমি অবাক হলাম এতো সুন্দরও মানুষ আঁকতে পারে।কত পরিশ্রম না জানি হয়েছে।
তবে,আরো অবাক হলাম যখন শুনলাম এই ছবিটা দশ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে।
আমি চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে রইলাম। ঝিনুক আপু বললো,আপনি তো বড়লোক হয়ে গেছেন…
মেহেদী ভাইয়া হেসে বললো,আরে নাহ…কি যে বলো।আমি যদি আরেকটু বিখ্যাত হতাম তাহলে পঞ্চাশ হাজার টাকা হতো কমপক্ষে এটার দাম।
ঝিনুক আপু বললো,এতো টাকা দিয়ে ছবি কিনার মানুষ আমাদের দেশে আছে এটাই তো জানতাম না।
মেহেদী ভাইয়া হেসে বললো,আছে…আছে অনেক আছে।তবে এটা যিনি কিনেছেন তিনি অ্যামেরিকান।
ঝিনুক আপু দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুঃখ প্রকাশ করে বললো,এতো দাম দিয়ে এসব না কিনে কিছু টাকা আমাদের মতো অসহায়দের দিতে পারে না।
মেহেদী ভাইয়া হঠাৎ খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো।
বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলো, আমাদের কোনো সমস্যা কিনা……
ঝিনুক আপু কিছুতেই বললো না।আমাকে নিয়ে চলে এলো।পরে, মেহেদী ভাইয়া আমার ফোনে ম্যাসেজ পাঠালো।আমিই তাকে সবটা বলে দিলাম।
পরদিন হাসপাতালে গিয়ে দেখি মেহেদী ভাইয়া বসে আছে।
ঝিনুক আপু আমার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকালো।বললো, কেন ওকে জানাইছিস?
ঝিনুক আপু অনেক চেষ্টা করেও বেশি টাকা জোগাড় করতে পারলো না।আসলে, একবারে এতো গুলো টাকা জোগাড় করা কঠিন।তাই ভাইয়ার অপারেশনেও দেরী হচ্ছিল। এদিকে দ্রুত না করালে তো বিপদের আশংকা বাড়ছে।ডাক্তারকে অনেক রিকোয়েস্ট করার পর তিনি আপুকে বললো,আগে পঞ্চাশ হাজার টাকা জমা দেন।সেই সময়টা যে কি ভয়ানক কষ্টদায়ক ছিল। ঝিনুক আপু কেঁদে কেঁদে ডাক্তারকে রিকোয়েস্ট করছিল। আমার বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছিল।
কিন্তু, পঞ্চাশ হাজার টাকাও আমাদের কাছে অনেক টাকা। ঝিনুক আপু শুধু দশ হাজার টাকা যোগাড় করেছে।বাকি চল্লিশ হাজার টাকাই মেহেদী ভাইয়া দিলো। ঝিনুক আপু নিস্তেজ ভাবে জিজ্ঞেস করল, আপনি এতো টাকা কই পেলেন? আপনার সব গুলো ছবিই কি এতো দাম দিয়ে মানুষ কিনেছে?
মেহেদী ভাইয়া বললো,উহু।আমার জমানো টাকা ছিল কিছু,ছবিরও ছিল।তবে,সব ছবি তো বিক্রিও হয়নি।
ঝিনুক আপু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, আপনার টাকা ফেরত দিয়ে দিবো আমি।চিন্তা করবেন না।

ঝিনুক আপু আমাকে ডেকে নিয়ে বললো, আমাদের বাড়ি বিক্রি করে দিবো। এছাড়া তো আর বাকি টাকার কোনো পথ দেখছি না।
আমি তাকিয়ে রইলাম। বললাম,এই অল্প সময়ে তো বাড়ি বিক্রি করা সম্ভব না।
ঝিনুক আপু বললো,সবই সম্ভব।
সত্যি সত্যিই একটা ফ্ল্যাট বিক্রির চেষ্টা করছিল আপু।যদিও শেষমেশ আর তা করতে হয়নি।
কারণ,এক সন্ধ্যায় মালিহা ভাবীর বাবা আমাদের বাসায় আসলেন।
ঝিনুক আপুর হাতে একটা ব্যাগ ধরিয়ে দিলেন তিনি। বললেন,এর মধ্যে কিছু টাকা আছে। বাদশার জন্য দিলাম।সে তো আমার সন্তানের মতোই।
আমি,মা আর ঝিনুক আপু অবাক হয়ে গিয়েছিলাম প্রচুর।
ঝিনুক আপু বললো, আপনার টাকা আমি ফেরত দিয়ে দিবো পরে ….
তিনি বললেন,দ্বিধা করো না।তোমাকে দিইও নি যে তুমি ফেরত দিবা ; আমি আমার নাতনির জন্যই দিলাম।তার তো মা নেই,বাবা অন্তত থাকুক।আর, আমি যে টাকা দিয়েছি সেটা তোমরা আর আমি ছাড়া কেউই জানে না।কেউ জানুক আমি চাইও না। এরপর তিনি উঠে চলে গেলেন। দরজার কাছে গিয়ে একটু থেমে বললেন,একটা কথা মালিহাকে তিতলির সাথে দেখা করতে দিও।সে তার ভুল বুঝতে পারছে যদিও শোধরানোর সুযোগ নেই তাও তিতলি তো তার সন্তান।
উনি চলে গেলেন। থামলেন না আর।
আমাদের তখনো বিশ্বাস হচ্ছিল না যে সত্যিই ঘটছে বিষয়টা।মা বাচ্চা মানুষের মতো খুশিতে চিৎকার করে উঠলেন। আমাদের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলেন, আমার ছেলে ঠিক হয়ে যাবে?
আমি আর ঝিনুক আপু তাকিয়ে রইলাম মায়ের দিকে।
মা ছুটে গিয়ে তিতলিকে ঘুম থেকে জাগিয়ে ফেললেন।তিতলিকে কোলে নিয়ে ঘরময় ছোটাছুটি করতে লাগলেন।
…..
ভাইয়ার অপারেশন সাকসেসফুলি শেষ হলো।
ভাইয়ার জ্ঞানও ফিরলো।আমরা ভাইয়ার সাথে দেখা করতে গেলাম। ভাইয়া ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো শুধু। মায়ের চোখ বেয়ে পানি পড়ছে দেখে চোখে না সূচক ইশারা করলো।যেন চোখের পানি না ফেলে।
এরপর আবার কি একটা ইঞ্জেকশন দেওয়া হলো। ভাইয়া ঘুমিয়ে পরলো।
পরদিন আবার একটু সমস্যা দেখা দিলো।ডাক্তারদের চিন্তিত দেখা গেলো।
আমরা কিছুই বুঝতে পারলাম না।
ডাক্তার বললো, হঠাৎ কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছে আবার…
ঝিনুক আপু ঝাঁঝালো কন্ঠে বললো, আমার ভাই বাঁচবে কিনা সেটা বলেন।
ডাক্তার বললো,আসলে এই টিউমার একবার অপারেশন করলে পুরোপুরি নির্মূল হয়না।এতে ক্যানসারের সেল আছে।ম্যাক্সিমাম ক্ষেত্রেই সমস্যা টা আবার ফিরে আসে।তবে,এতো দ্রুত যদিও না। কিন্তু, আপনার ভাইয়ের ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ্য করছি হঠাৎ করেই কমপ্লেক্স হয়ে যাচ্ছে বিষয়টা।আসলে…..
ঝিনুক আপু ডাক্তারের কথার মাঝখানে চেঁচিয়ে উঠলো,এতো কথা জানতে চাইছি? আমার ভাই বাঁচবে কিনা শুধু সেটা বলেন।
ঝিনুক আপু কান্না করে দিলো।
ডাক্তার বললো,আল্লাহকে ডাকুন।
মা বলতে লাগলেন,আমি তোদের বলছিলাম না আগেই? বাদশাহ বাঁচবে না… মায়ের মন সব জানে।আমার কপাল তো এতো ভালো না রে….
আমি আর ঝিনুক আপু মাকে জড়িয়ে ধরে ফেললাম।মা আর আমি কাঁদতে লাগলাম। ঝিনুক আপু কেমন পাথরের মত হয়ে গেলো। অনুভূতিহীন।
হঠাৎ, তাকিয়ে দেখি মালিহা ভাবী দাঁড়িয়ে আছে আমাদের থেকে খানিকটা দূরে।
এই গরমেও গায়ে একটা চাদর পেঁচিয়ে রেখেছে সে।

চলবে,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে