ধূসর অনুভূতি পর্ব-১৩+১৪

0
916

#ধূসর অনুভূতি
পর্ব:১৩+১৪
লেখক: শাপলা

বড় চাচা রাগী চোখে বাবার দিকে তাকালো। বললো,এই ছেলে কে? এইভাবে ভদ্রলোকের ঘরের মধ্যে ঢুকে সিনক্রিয়েট করছে।
মেহেদী ভাইয়া কারো কথা পাত্তা না দিয়ে ভিতরের দিকে চলে গেল। মেহেদী ভাইয়ার চেঁচামেচির কারণেই শাহীন ভাইয়া দরজা খুললো। ঝিনুক আপুর চেহারা টা একদম ফ্যাকাশে রক্তশূন্য হয়ে আছে।ভয়ে রীতিমতো কাঁপছে সে।
মেহেদী ভাইয়া বললো, তুমি এতো ভয় পাচ্ছো কেন ঝিনুক? আমি আছি না?
ঝিনুক আপু হঠাৎ মেহেদী ভাইয়ার বুকে মাথা রেখে কাঁদতে লাগলো।
সেখানে তখন বাকিরাও সবাই চলে এসেছে।
চাচি চিৎকার করে উঠল মায়ের দিকে তাকিয়ে,ছিঃ ছিঃ তোমার মেয়ের স্বভাব-চরিত্রের এই দিকটা তো আমার জানা ছিল না।
মা পাথরের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
শাহীন ভাইয়া হুট করে মেহেদী ভাইয়ার গায়ে হাত তুলে ফেললো।আর,মুখে বিশ্রি একটা গালি দিলো।
মুহূর্তেই দুইজনের মধ্যে মারামারি শুরু হয়ে গেল।
শাহীন ভাইয়া ফ্লোরে পরার কারণে তার ঠোঁট খানিকটা কেটে গেল।
মা আর বাবা এসে দুইজন কে থামালো।
বড়চাচা চিৎকার করে বাড়ি মাথায় উঠিয়ে ফেললো।”কত বড় সাহস, আমার বাড়িতে থেকে আমার ছেলের গায়ে হাত তোলে।একে এখুনি বিদায় কর তুই মিজান।নয়তো আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না…”
শাহীন ভাইয়া দাঁত চেপে বললো, বিদায় পরে কইরেন আগে আমি ওর হাত-পা ভেঙে নিই।ও আমার গাঁয়ে হাত তোলে চিনে নাই এখনো আমি কে….
বাবা শাহীন ভাইয়া-কে শান্ত করার অনেক চেষ্টা করতে লাগলো।
মা বললো, মেহেদী তুমি এই মুহূর্তে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবা। দুধ দিয়ে যে আমি যে কালসাপ পুষছিলাম আগে তো বুঝি নাই।
মেহেদী ভাইয়া ঝিনুক আপুর দিকে তাকিয়ে বললো, ঝিনুক তুমিও আমার সাথে চলো। এখানে থাকার দরকার নেই।
শাহীন ভাইয়া বাঘের মতো গর্জন করে উঠলো,এই ছোটলোকের বাচ্চা কি বললি তুই? আমার বউ তোর সাথে যাবে কিসের জন্যে?এই ঝিনুক তুমি এই শয়তানকে বলো এখান থেকে যেতে।
মেহেদী ভাইয়া ঝিনুক আপুর দিকে তাকিয়ে রইলো।
ঝিনুক আপু বললো, আপনি কেন চলে যাচ্ছেন না? আপনি আল্লাহর ওয়াস্তে চলে যান। আপনার পায়ে ধরছি দয়া করে যান।
– তুমি আমার সাথে চলো,ভয় পেয়ো না।এই জাহান্নামে তোমার থাকার দরকার নেই।
ঝিনুক আপু বললো,আমি যাবো না।আমি যেতে চাই না। আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে এটা জানার পরেও আপনি কেন এখানে এসেছেন ঝামেলা বাঁধাতে?
মেহেদী ভাইয়া বললো,আমি জানি ঝিনুক তুমি এগুলো মন থেকে বলছো না। তোমার চোখের পানি ই বলে দিচ্ছে তুমি মিথ্যা বলছো।
– আমার চোখে পানি আসছে আপনার আচরণ দেখে। অভদ্রের মতো এসে আপনি মারামারি শুরু করে দিয়েছেন আমার হবু স্বামীর সাথে।
তর্কাতর্কি চলতেই থাকলো।
এক পর্যায়ে সত্যি সত্যিই মেহেদী ভাইয়াকে বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়।
মা মেহেদী ভাইয়ার বাবার কাছে ফোন করে বিচার দেয় যে, আপনার ছেলেকে আমি নিজের ছেলের মতো মনে করছিলাম।আর, আপনার ছেলে এখন আমাদের সর্বনাশ করতে চাচ্ছে।
সব শুনে মেহেদী ভাইয়ার বাবাও খুব রাগ করে। তিনি মেহেদী ভাইয়াকে বলেন এখুনি যেন চলে আসে।
এতোসব কিছুর পরও হয়তো মেহেদী ভাইয়া থাকতো। কিন্তু, ঝিনুক আপুর ব্যবহারেই সে যেতে বাধ্য হলো।
বড় চাচা বড় গলায় বলতে লাগলেন, আমার ছেলের চরিত্র নিয়ে তো অনেক কথা শুনাইছিস এখন তোর মেয়ে যে কেমন সেটাও তো স্বচক্ষেই দেখলাম।
বাবা কিছুই বললেন না। চুপ করে বসে রইলেন।মা দুঃখ প্রকাশ করে বললেন,সব দোষ ঐ ছোটলোকের বাচ্চার। আমার মেয়ের মাথাটা খাইছে ও…
বড়চাচা বললেন, আমি আর সময় দিতে পারবো না। ঝিনুক একটা ভুল করেছে,আমি মাফ করলাম।কারণ, আমি তার বাবার মতো। কালকেই কাজী ডাকিয়ে বিয়ে পড়ানো হবে।কোনো অনুষ্ঠানের দরকার নাই।ঐ ছেলে আবারো ঝামেলা করতে পারে। অবশ্য এ সব উটকো ঝামেলা উপড়াইতে আমার এক সেকেন্ডও লাগবে না তাও এখন ঝামেলা চাচ্ছি না..
বাবা কিছু বললেন না।তার নিরবতাকেই সম্মতি হিসেবে ধরা হলো।চাচি বারবার বলতে চেষ্টা করলেন, তিনি এই বিয়েতে রাজি না। কিন্তু, তার কথা শাহীন ভাইয়া পাত্তা দিলো না। তিনি ঝিনুক আপুকে বিয়ে করবেনই।কি থেকে কি হয়ে গেল আমরা কেউই কিছু বুঝতে পারছিলাম না।
সেদিন রাতে অনেক ঝামেলার পর রাত দুইটার সময় আমি নিজের ঘরে এলাম।
তিতলি বাদশাহ ভাইয়ার কাছে। খুব অদ্ভুত লাগছিল যে বাদশাহ ভাইয়া এতো বড় ঝামেলা দেখেও ঘর থেকে বের হলো না।
আপুকে বললাম, আপু তুমি কেন মেহেদী ভাইয়ার সাথে এমন করলা?উনি মনে কত কষ্ট পাইছে তুমি জানো?
ঝিনুক আপু বললো,আমিও যদি শাহীনের বিপক্ষে গিয়ে ওর পক্ষে কথা বলতাম। শাহীন ওকে খুনই করে ফেলতো।তুই তো জানিস ই শাহীন কত বড় শয়তান।এমন কাজ নাই যেটা ও করতে পারে না।আর,বড়চাচা তো অসৎ পথে অনেক টাকা ইনকাম করছে, যেকোনো কিছু ধামাচাপা দেয়া উনার বা হাতের ব্যাপার…
ঝিনুক আপু দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
আমি বললাম, আপু এখন অন্তত তুমি মেহেদী ভাইয়াকে একটা ম্যাসেজ পাঠিয়ে বলো সব সত্যিকথাগুলো।
ঝিনুক আপু বললো,ম্যাসেজ আমি পাঠাইছি।লিখছি, আমার কালকে বিয়ে।আর যেন আমার সাথে যোগাযোগ এর চেষ্টা না করে।
আমি ব্যথিত চোখে তাকিয়ে রইলাম।-‘তুমি এমন ব্যবহার কিভাবে করছো? তোমার কি মায়া লাগছে না? তুমি ই উনার সাথে যেচে মিশেছো শুরুতে।উনি তো তোমার সাথে নিজে থেকে মিশেনি। ‘
– শোন যুথি বিয়ের পর কি আমি ওর সাথে যোগাযোগ করতে পারবো?পারবো না। খামোখা ওর কষ্ট বাড়িয়ে লাভ কি? এখন আমার এমন ব্যবহার দেখে ও দ্রুতই আমাকে ভুলে যাবে।সেটাই ভালো।
– তুমি বিয়ে করতে চাও?
– চাওয়া ছাড়া কি কোনো উপায় আছে?
– ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়।
– দেখি উপায় বল।আমি তো কোনো উপায় দেখছি না।
– তুমি পালিয়ে যাও।
– পালাবো কিভাবে বোকা মেয়ে?আর আমি পালালে মা-বাবার কি হবে ভেবে দেখ…বড়চাচা তাদের কি পরিমান অপমান করবে ভাবতে পারিস…আর, ভাইয়ার চিকিৎসার টাকাও উনারা দিবে না।বাড়ির অর্ধেক যদি বেচে দেয়?আর, আমি পালালে যদি জেদ করে তোর সাথে বিয়ে দিয়ে দেয় শাহীন জানোয়ার টার তাহলে।আমি কষ্ট পেলে পাবো। কিন্তু,তুই আমার ছোট বোন।তোর কোনো কষ্ট তো আমি সহ্য করতে পারবো না।
ঝিনুক আপু কান্না করে দিলো।
আমিও আপুকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলাম।
ঝিনুক আপু বললো,তার চেয়ে ভালো আমার এখানেই বিয়ে হোক। তাহলে বাবা-মায়ের অনেক আর্থিক হেল্প হবে।ভাইয়াও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবে।আর,আমি তো এতো ভালো মেয়ে না।মেহেদী কয়দিন পর ভালো একটা মেয়ে কে বিয়ে করে নিবে শেষ।
ঝিনুক আপু হাসলো।
আমি বললাম, আপু আর কি কোনো উপায় নেই?
– জানি না বোন।কোনো উপায় তো দেখছি না।
রাতে আমার একটুও ঘুম হলো না। ঘুমের ভাণ ধরে শুয়ে রইলাম।
ঝিনুক আপুও ঘুমালো না।সারারাত ই নিঃশব্দে কাঁদলো।কান্নার দমকে তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছিল।একসময় এই দীর্ঘ বিষাদের রাত পেরিয়ে ভোরের আলো ফুটলো।
মা আমাদের ডাকতে এলেন।যদিও আমরা ঘুমাই ই নি।
কাঁদার কারণে ঝিনুক আপুর চোখ-মুখ ফুলে আছে। চোখদুটো হয়ে আছে রক্তাভ।
মা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন,তোর আজকে বিয়ে আর তোরে লাগতাছে পেত্নীর মতো।এতো কানছিস কেন ?মনে হচ্ছে তোর বাপ মা মারা গেছে…
ঝিনুক আপু কিছুই বললো না।
মা বললেন,শোন ঝিনুক তুই আমারে ভুল বুঝিস না। আমার কিছুই করার নাই।
মায়ের দু’চোখে পানি জমলো।
তিনি ঝিনুক আপুর মাথায় হাত রাখলেন। বললেন, একবার চিন্তা কর তোর চাচাদের কত টাকা পয়সা,ক্ষমতা। তাদের সাথে সম্পর্ক খারাপ করে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরে লাভ আছে? তোর ভাইয়ের নাই চাকরি..আমরা চলবো কিভাবে?উনারা যদি টাকা পয়সা দিয়ে আমাদের হেল্প করে তাহলে তোর ভাইয়ের চিকিৎসা হবে।তিতলিটার তো বাবা ছাড়া কেউই নাই।তুই কি চাস তোর ভাই পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াক?একটা মাত্র ভাই তোর।সারা জীবন বটগাছের মতো ছায়া দিয়ে রাখছে… এখন শুধু নিজের কথাই ভাববি?আর, মেহেদী কি এতোই ভালো ছেলে? প্রেমের সময় সব ছেলেরাই ভালো বিয়ের পর যেই লাউ সেই কদু।ওর কোনো চাকরি নাই,এখনো পড়ালেখা ই শেষ হয়নি।আর্থিক অবস্থাও ততো ভালো না। মানে তুই কিভাবে এত নিশ্চিত যে ওর সাথে বিয়ে হইলে তুই সুখী হবি? শাহীন আগে খারাপ ছিল আমি মানলাম। কিন্তু,তাই বলে কি সারাজীবন ই খারাপ থাকবে বল… বিয়ের পর বাচ্চা কাচ্চা হইলে আরো ভালো হইয়া যাবে।কি সুন্দর তোকে তুমি করে বলছে।রাগও তো আগের মত নেই।কালকে মেহেদীর আচরণ দেখে আমার ই মন চাইছে ধরে পিটাইতে। কিন্তু, শাহীন তো সহ্য করলো।
আমি বললাম,প্লীজ মা শাহীন ভাইয়ের গুনগান কইরো না তো খামোখা।যাও….
মা বললো,কই যাবো আমি? এখন তোর বোনের সাজগোজ করা লাগবে না?
সকাল হতে না হতেই ফুপু তার পরিবারের সবাইকে নিয়ে চলে এলো।
আপুকে শাড়ি পরানো হলো।
ফুপা আসেন নি এখনো তিনি কাজী নিয়ে ফিরবেন।
সবাই বসে আছে বসার ঘরে।মা সবাইকে নাস্তা দিলো।
তখন হঠাৎ বাদশাহ ভাইয়া বসার ঘরে আসলো।
ভাইয়ার চোখ লাল হয়ে আছে। চুল গুলো এলোমেলো। মুখের মধ্যে খোঁচা খোঁচা দাড়ি।লাল চোখের জন্যই কেমন পাগল এর মতো লাগছে।
মা বললেন, বাদশাহ তোর শরীর ভালো না। তুই গিয়ে ঘুমিয়ে থাক।তোকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তুই ঘুমাস নি।
বাদশাহ ভাইয়া বললো,ঘুমাবো কিভাবে আমার বোনের এতো বড় সর্বনাশ এর দিন আজ।
মা অসহায় ভাবে আত্মীয় দের দিকে তাকালেন। এরপর ফ্যাকাশে ভাবে হেসে বললেন, ছেলেটার মাথার ঠিক নেই। চিকিৎসা চলছে সেটা তো জানেনই সবাই।ওর কথায় কিছু মনে করার দরকার নাই।
বাদশাহ ভাইয়া বললো, ঝিনুকের বিয়ে আমি বেঁচে থাকতে শাহীনের সাথে হবে না। তুমি যদি তবুও শাহীনকেই জামাই বানাতে চাও তাহলে আমাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলো।
মা চোখ বড়বড় করে বললেন, বাদশাহ তুই রুমে যা…হুট করে একটা কথা বলে ফেলিস কোন আক্কেলে?
বাদশাহ ভাইয়া বললো, রুমেই তো থাকি সারাক্ষন মা।বের তো হইনা।আর,হুট করে কিছু বলছি না তো,কাল সারারাত ধরে ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
বড় চাচা রাগত স্বরে বললো, সমস্যা কি তোদের?এ খানে আসার পর থেকেই অপমান আর অপমান করে যাচ্ছিস।আজকে বিয়ের দিন আবার নতুন নাটক শুরু…
এমন সময় ফুপা এলেন।বড়চাচা বিরক্ত হয়ে বললেন,কাজী কই? তুমি একলা কেন?
ফুপা বললেন, বাদশাহ তো ফোন করে আমাকে মানা করলো কাজী আনতে।
বড়চাচা চিৎকার করে উঠলেন।
মা বাদশাহ ভাইয়াকে বললেন,তুই কেন ঝামেলা করছিস বাবা?
বাদশাহ ভাইয়া শাহীন ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,তোরা খাওয়া দাওয়া করে যাস। ইচ্ছা করলে নিচতলায় থাকতে পারিস।অথবা তোদের যে আরেক টা বাড়ি আছে সেখানেও গিয়ে থাকতে পারিস, তোদের ইচ্ছা।তবে, খালি মুখে যাওয়া যাবে না।
শাহীন ভাইয়া হেসে বললো, খালি মুখেও যাবোনা,খালি হাতেও যাবো না।বউ নিয়ে তবেই যাবো।
– স্যরি শাহীন। তোর মতো নিকৃষ্ট কুত্তার কাছে আমার বোনকে বিয়ে দিবো না আমি।
শাহীন ভাইয়া আর বাদশাহ ভাইয়ার মধ্যে তর্কাতর্কি চলতে থাকলো।
বাদশাহ ভাইয়া বললো, আমি পুলিশ কে ফোন করবো।একটা প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে জোর করে বিয়ে দেয়া হবে , এতোই সোজা।
শাহীন ভাইয়ার মা চিৎকার করে বলতে লাগলেন, তোর বোনের যে কীর্তি দেখলাম রাতে,ঐ অসভ্য মেয়েরে ঘরে নেওয়ার ইচ্ছাও আমার বিন্দুমাত্র নাই। তবুও, তোদের দয়া করতেছি।
– ধন্যবাদ চাচি আপনারা কষ্ট করে দয়া না করলেই আমরা খুশি।
বড়চাচা বললেন, বিয়ে দিবি না?তোর বোন ছাড়া কি আর দুনিয়ায় মেয়ে নাই? তোর বোনকে তো এমনেও পছন্দ হয়নি আমার।
কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে বাদশাহ ভাইয়া টেবিলের উপর সাজানো সবগুলো প্লেট,গ্লাস ভেঙ্গে ফেললো। চিৎকার করে বলতে লাগল,এই বিয়ে হবে না…হবে না..হবে না।দয়া করে বিদায় হন আপনারা।নাহয় আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না…
বড়চাচা বাবার দিকে তাকালো।
বাবা বললো,যেহেতু আমার ছেলে চাইছে না।মেয়েও রাজি না। আবার, আপনাদেরও ঝিনুক কে বেশি পছন্দ হয়নি।এর থেকে ভালো মেয়ে পাবেন বলছেন তাহলে বিয়েটা মনে হয় না হওয়াই ভালো।
মা অসহায় ভাবে আপুর দিকে তাকালো।বললো, ঝিনুক তুই কিছু বল। তুই তো রাজি আছিস তাই না?
ঝিনুক আপু বললো,হ্যাঁ ভাইয়া আমি রাজি আছি। তুমি প্লিজ নিজের ঘরে যাও।
বাদশাহ ভাইয়া বললো,কি ব্যাপার বললাম না বিয়ে হবে না আপনারা শোনেন নাই?
বড় চাচা বললো,এতো বড় অপমান করলি আমাদের?এর পরিণতি কি হয় শুধু দেখ।
তারা সবাই চলে গেলো চিৎকার চেঁচামেচি করে।
আমি খুশি তো হলাম বিয়ে ভাঙায় আবার ভয়ও পেলাম।
মা কাঁদতে লাগলেন খুব। ঝিনুক আপু কে বকতে লাগলেন,এতো খারাপ তুই? নিজের পরিবারের ভালো চাস না?
বাদশাহ ভাইয়া বললো,মা তুমি ঝিনুক কে একটা গালিও দিবা না ‌যদি দাও…
– গালি দিলে কি করবি তুই?আরে তোর ভালোর জন্যই তো এরেই কয়,যার জন্য চুরি করি সেই কয় চোর।
বাদশাহ ভাইয়া বললো,মা তুমি আমার ভালোর জন্য ঝিনুক এর জীবন ধ্বংস করে দিচ্ছিলা?
মা কেঁদে উঠলেন, চুপ থাক তুই…কারোর ক্ষতি করছিলাম না আমি।বিয়ে হলে সবার ভালোই হতো। তোদের ভালোই চাই আমি…
বাদশাহ ভাইয়া বললো, তুমি হয়তো আমাদের ভালোই চাও মা। কিন্তু এই ভালো চাইতে গিয়ে অজান্তেই আমাদের খারাপ করে ফেলো।আমরা অনেক বড় হইছি মা এখন নিজের ভালো নিজেকে বুঝতে দাও।
মা আরো জোরে জোরে কাঁদতে লাগলেন। বললেন,
– ভালো চাইতে গিয়ে কি খারাপ করছি আমি তোর?
বাদশাহ ভাইয়া হাসলো।
– মা আমার সংসার ভেঙে গেছে মা। তুমি দেখছো না?দুঃখে কষ্টে, অপরাধবোধ এ আমি ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যাচ্ছি মা।
– ওহ আচ্ছা এইসব আমার দোষ?
– না মা… শুধু ঢালাও ভাবে সবটাই তোমার দোষ না।তবে, তোমারও দোষ আছে।মা বিয়েতো হয়েই গেছিলো আমাদের, মানলাম মালিহাকে তোমার পছন্দ হয়নি কিন্তু সারাক্ষন এটা তাকে বলার, কাজেকর্মে বুঝিয়ে দেওয়ার কি দরকার ছিল? শুরুতে তো সে পালিয়ে যাওয়ার মনোভাব নিয়ে এই বাড়িতে আসে নাই মা, সংসার করার ইচ্ছা নিয়েই আসছিল।তাহলে আমাকে ছেড়ে চলে গেলো কেন?ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলে তো বিয়ে করতো না কোনো দিন।
বাদশাহ ভাইয়ার চোখ বেয়ে পানি পড়লো।
মা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলো। চেঁচিয়ে বললো,
– জানোয়ারের বাচ্চা তুই এখনো ঐ বেশ্যার জন্য কাঁদিস?তুই নিজের মা’কে দোষারোপ করিস?
বাদশাহ ভাইয়া বললো,না মা সবচেয়ে বেশি দোষ আমার আর মালিহারই। কিন্তু, অভিভাবক হিসেবে তুমি কোনোদিন আমাদের দোষ গুলো শোধরাতে সাহায্য করোনি উল্টা দোষ ধরেই গেছো।আমি আগে মনে করতাম মালিহাই দোষী।ওকে অভিশাপ দিতাম। কিন্তু,যখন দেখলাম ঝিনুকও তোমার জন্য চোখের পানি ফেলছে তখন বুঝলাম…
– কি বুঝলি তখন?আমি ডাইনী?আমি জাঁদরেল?
ভাইয়া কিছু বললো না। ঝিনুক আপুর কাছে গিয়ে তার চোখের পানি মুছে দিলো।
বললো, আমার বোনের চোখের পানির বিনিময়ে আমি সুখী হতে চাই না…
ভাইয়া ঘর থেকে বের হয়ে চলে গেলেন।
মা আমার দিকে তাকালেন।
বললেন,বল তুই বল আমার দোষ সম্পর্কে…আমি শুনি। তোদের মালিহা ভাবী তো নির্দোষ।
আমি বললাম,মা একটা কথা বলি।ভাবী নিঃসন্দেহে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করছে। কিন্তু,আমরাও নিরপরাধ না। ভাইয়া তোমার বিচার শুনে ভাবীর সাথে ঝগড়া করতো। তুমি কোনোদিন থামাতে না।আমি তোমাকে কতদিন বলেছি, ভাইয়া কে তুমি থামাও। তুমি উল্টা ভাইয়া কে বলতা,মালিহারে ধইরা দুইটা চড় লাগা…. এরপর, তুমি তিশির সাথে ভাইয়ার বিয়ে দিতে চাইলা।তিশি হলো একটা অকালপক্ক,ফালতু মেয়ে।ওর সাথে যদি ভাইয়ার বিয়ে হতো তাহলে ভাইয়ার জীবন টা পুরোপুরি ধ্বংস হতো। এখন আবার তুমি ঝিনুক আপুর সাথে..…..
মা হাত উঁচিয়ে আমাকে থামালেন। বললেন, এখন সংসার টা কিভাবে চলবে আমি শুধু ঐটাই দেখবো।আজ থেকে আমি এই ঘরে নিশ্চুপ হয়ে থাকবো।তাহলে কেমন সুখের বন্যা বয় সেটাই আমি দেখতে চাই।

দেখতে দেখতে একমাস হয়ে গেলো। আমাদের বাসায় যে কি চলছে নিজেও বুঝতে পারছি না।কখনো কখনো মন চায় সব ছেড়ে ছুড়ে চলে যাই।
বড়চাচা বাবার উপর ক্ষোভ থেকে বাড়ির অর্ধেক টা বিক্রি করে দিয়েছে এক অসৎ লোকের কাছে।যে প্রতিদিন মদ খেয়ে বাড়ি আসে। সারাক্ষন ই ছাদে বসে থাকে, আজেবাজে লোকের আড্ডা লেগেই থাকে। তার কারণে আমরা কেউই ছাদে উঠতে পারি না।তাকে কিছু বলাও যায়না কারণ সেও তো বাড়ির মালিক।এই লোকের আচরণে সবাই ত্যাক্ত-বিরক্ত;বড় চাচা ইচ্ছা করেই এমন একটা লোকের কাছে বাড়ি বিক্রি করেছে যেন আমাদের কষ্ট পেতে হয়।ইশিতা ভাবীরা বাসা ছেড়ে চলে গেছে।কারণ,এমন মাতাল যেই বাড়িতে থাকে সেখানে কি কোনো ভদ্রলোক থাকতে পারে?
বাবা তো এমনিতেও সংসারের কোনো বিষয়ে কথা বলেন না। আত্মভোলা মানুষ।ঠিক ভুল সব সিদ্ধান্ত মা-ই নিতো আগে। এখন তো সে-ও আমাদের উপর রাগ করে একদম চুপচাপ হয়ে গেছে।নিজে থেকে কিছু বলে না ,আমরা কিছু জিজ্ঞেস করলেও হ্যাঁ,না করে উত্তর দেয়।এই বাড়িতে বর্তমানে তিতলি ছাড়া কারো সাথেই মা কথা বলে না।
বাদশাহ ভাইয়া কিছু দিন ভালোই ছিল।জবের জন্য চেষ্টা করছিলো পাশাপাশি তার বন্ধুর দোকানে বসতো।
কিন্তু, সাতদিন ধরে বাদশাহ ভাইয়ার অবস্থা খুবই খারাপ।কাউকে চিনতে পারে না।ঘরের মধ্যে ভাঙচুর করে।তাই,তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।কলেজে পড়ার সময় মা আমাকে আর ঝিনুক আপু কে কিছু গয়না গড়িয়ে দিয়েছিল।নানিও কিছু দিয়েছিলেন। ঝিনুক আপু এখন সব বিক্রি করে দিয়েছে ভাইয়ার চিকিৎসার জন্য।
ঝিনুক আপু একদম অন্যরকম হয়ে গেছে। আগের মতো চঞ্চল, হাসিখুশি আর নেই। সারাক্ষন কপালে চিন্তার রেখা,সংসারের পুরো ভারটাই তার উপর। এখন আর ইউনিভার্সিটি তে ক্লাস করতে যায়ও না। সারাদিন বাইরে থাকে। বাসায় ফিরে রাত আটটায়।বাসা থেকে খানিকটা দূরে একটা কম্পিউটার টিচিং সেন্টারে ইন্সট্রাক্টর হিসেবে কাজ করছে দুপুর পর্যন্ত। এরপর টানা ৫ টা টিউশনি করছে। বাসায় ফিরেও ফুরসৎ নেই। আমাদের পাশের বিল্ডিং এ একজন ড্রেস ডিজাইনার থাকে।তার থেকে বিভিন্ন ড্রেস এনে সেলাই করা,স্টোন বসানো এইসব কাজ করে রাত ১২টা পর্যন্ত কমপক্ষে। অনেক সময়সাপেক্ষ কঠিন কাজ কিন্তু পারিশ্রমিক খুবই কম।তবুও,এই কম টাকাই বা কে কাকে দেয়।আমিও আপুকে রাত্রে বেলা সাহায্য করি।দু-একটা ছাত্রও পড়াই দিনে। ঝিনুক আপু বলে, প্রতিদিন ইউনিভার্সিটি যাবি।ক্লাস কামাই দেওয়া চলবে না।
ঝিনুক আপু-ই এখন বাজার সদাই করছে। বাবার ওষুধ কিনছে। আমার পরিক্ষার ফি দিচ্ছে।তিতলির জন্য দিনশেষে খেলনা নিয়ে ফিরছে। ভাইয়ার চিকিৎসার টাকা দিচ্ছে।
আপুর অনেক কষ্ট হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু,আপু সব সহ্য করে নিচ্ছে।কারণ,আজ যদি তার শাহীন ভাইয়ার সাথে বিয়ে হতো তাহলে হয়তো বড়চাচা আমাদের উপর রাগ করে মুখ ফিরিয়ে নিতেন না।
কোথাও না কোথাও আপু সব কিছুর জন্য নিজেকেই দোষী মনে করে।যদিও তার আসলে দোষ নেই,সব দোষ আমাদের কপালের।
আগে কি সুন্দর ছিল সবকিছু। এখন সেসব শুধু ই স্বপ্ন।
একটা জিনিস বুঝতে পারলাম, মানুষ যখন সুখে শান্তিতে থাকে তখন তার সঙ্গী-সাথির অভাব হয় না। কিন্তু,দুঃখের সময়টুকু বড়ই একাকী পার করতে হয়।
জীবনের সমস্ত গ্লানি,কষ্ট-দুঃখ,যন্ত্রনা,ব্যর্থতা অর্থাৎ সবচেয়ে কঠিন মূহুর্তগুলো কাটাতে হয় একা একাই।কেউ সাহায্য করবে,পাশে এসে দাঁড়াবে এই চিন্তা করা বোকামি।কত আত্মীয় স্বজন কিন্তু কেউই বলছে না ওদের পাশে দাঁড়াই।সবারই নিজ নিজ সংসার আছে,সবাই নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত।
মেহেদী ভাইয়া আর ঝিনুক আপুর বিয়েটা হয়নি। পরিবারের সবাইকে এমন অনিশ্চয়তার সাগরে ফেলে নিজে বিয়ে নামক ভেলায় চড়ে তীরে চলে যাবে এমন কাজ আর যে-ই করতে পারুক ঝিনুক আপু তো পারবে না। মেহেদী ভাইয়ার সাথে আর কথাও হয়নি ঝিনুক আপুর…আমি বলেছি যোগাযোগ করো, তোমার যে বিয়ে হয়নি সেটা জানাও।
ঝিনুক আপু বলে,পারবো না রে।ওর যদি গরজ থাকে ও নিজেই খোঁজ নিবে। আমাদের বিয়ে হওয়ার কোনো দরকার নেই।বিয়ে করে আমি স্বার্থপরের মত স্বামী নিয়ে সুখে সংসার করতে পারবো না তোদের কষ্টে রেখে।আর, মেহেদীর বাবারও আমাকে পছন্দ না।উনি বলেছেন আমরা নাকি পাগলের বংশ। আমার ভাই পাগল,তাই আমিও পাগল হবো একদিন।এমন জায়গায় উনি ছেলেকে বিয়ে করাতে চানও না।
আমি অবাক হয়ে বললাম,আপু তোমাকে এইসব কে বলেছে?
ঝিনুক আপু বললো,শুনেছি একজনের কাছে।কি ব্যাপার মুখ গোমড়া করছিস কেন?তুই কি ফিউচারে তোর ছেলের বিয়ে কোনো মাথা খারাপ মেয়ের সাথে দিবি?দিবি না।সবাই নিজের টা ষোলো আনা বোঝে।তাই বলে,কেউ খারাপ না।
আমি বললাম, আপু তুমি মেহেদী ভাইয়ার সাথে একবার কথা বলো…
– কথা বলতে ইচ্ছা করে না।এই যে এতো সমস্যায় আছি এখন আর কাউকে বলতেও ইচ্ছা করে না। সেদিন এক ফ্রেন্ডকে বলছিলাম যে অনেক আর্থিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।ওমা.. আমার কথা শুনে দেখছি ওর চোখ মুখ কেমন হয়ে গেছে।হয়তো ভাবছে,আমি ওর থেকে ৫-৬ হাজার টাকা ধার চেয়ে বসবো।হাহা…
আমি বললাম, আপু মেহেদী ভাইয়া অন্যদের মতো না তুমি তো জানো।
– না রে বোন আমি এতো কিছু জানি না।ওর সাথে আমার তেমন কোনো সম্পর্কই ছিল না। শুধু একজনের আরেকজনকে ভালো লেগেছিল সেই কথা জানাতেও পারিনি মুখে।আমাকে ও এতো দিনে ভুলেও গেছে হয়তো… যাক ভুলে যাক…
ঝিনুক আপু দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
এইরকম রঙহীন-ধূসর জীবন কাটছিল আমাদের। ঝিনুক আপু প্রায় রাতেই কাঁদে ঘুমের মধ্যেও মেহেদী ভাইয়ার নাম নেয়। কিন্তু, সকাল হলে সব অন্যরকম। একজন কঠোর নারী আত্মপ্রকাশ করে সে।
একদিন ঝিনুক আপু হাসিমুখে এসে বললো,যুথি আমি একটা নতুন চাকরি পেয়েছি।
ঝিনুক আপুর নতুন চাকরি হলো একটা ছোট্ট বাচ্চা কে রাতের বেলায় রাখা। বাচ্চার মা ডাক্তার,সিঙ্গেল মাদার।সপ্তাহে তিনদিন নাইট ডিউটি করেন।ঐ তিনরাত বাচ্চাটাকে আপু রাখবে।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।”আপু তুমি এখন আয়ার কাজ করবা?”
ঝিনুক আপু বললো,শোন কোন কাজ ছোট করবি না।এটা তো কোনো পাপ কাজ না।কত বড় বড় অফিসার রা যে ঘুষ খায়, অবৈধ টাকা কামাই করে তাদের দেখলে তো স্যার..স্যার করিস।আর,আমি সৎপথে একটা কাজ করবো সেটা তোর ছোট মনে হয়।ঐ লেডি ডাক্তার বাচ্চা কে আমার কাছে রেখে রাতভর কত রোগীর সেরে ওঠার ওসিলা হবে, এখানে আমারও কৃতিত্ব আছে পরোক্ষভাবে বুঝলি?
আমি আর কিছুই বললাম না।
অনেক দিন পর মা আমাদের ঘরে এলেন, আমাদের সাথে কথা বললেন।
বললেন, ঝিনুক যদি বিয়েটা করতো তাহলে আর দিন রাত এতো কষ্ট করতে হতো না।
ঝিনুক আপু বললো, বিয়ের পর আরো কষ্ট করতে হতো মা। তুমিই বা কেমনে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে টাকা পয়সা পাওয়ার স্বপ্ন দেখো।উল্টা জামাই যৌতুকের আশা করে বসে থাকতো।হাহা।ঐ দেশে ওরা আমাকে শত কষ্ট দিলেও আমি চুপ করে সহ্য করতাম।এখন তো সারাদিন পরিশ্রম, কষ্ট করে এসেও নিজের কাছের মানুষদের মুখ দেখি। মায়ের মুখ দেখি।ঐ যে একটা কবিতা আছে না,দেখিলে মায়ের মুখ, দূরে যায় সব দুখ।
মা আর কিছু বললেন না।চলে গেলেন রুম থেকে।
মায়ের চোখে পানি টলটল করছিলো আমি দেখেছি।
…….
…….
মালিহা আজ ভোররাতে খুব অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখেছে।তার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠেছে স্বপ্নটা দেখে। আচ্ছা, ভোরের স্বপ্ন কি সত্যি হয়? কোথায় জানি শুনেছিল।স্বপ্নে দেখলো কি সুন্দর একটা সবুজ মাঠ, চারপাশে মৃদু বাতাস বইছে,পাখিরা গান গাইছে।আর, সবুজ ঘাসের উপর তারা তিনজন হাঁটছে।তিতলি মাঝখানে আর তিতলির দুই হাত ধরে সে আর বাদশাহ হাঁটছে‌।তিতলি কি মিষ্টি করে হাসছে। হঠাৎ,সে তিতলির হাত ছেড়ে দৌড়ে কোথায় একটা চলে গেল।তিতলি এদিক ওদিক তাকিয়ে তাকে খুঁজতে লাগলো।মামণি…মামণি বলে ডাকতে লাগলো। কিন্তু, কোথাও আর মালিহার চিহ্নটুকুও নেই। বাদশাহ একাই তিতলির হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ, বাদশাহও তিতলির হাত ছেড়ে চলে গেলো …তিতলি দিগন্ত বিস্তৃত পুরো মাঠটায় একা দাঁড়িয়ে রইলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে বাবা-মা বলে খানিক ক্ষন ডাকলো। এরপর, ঘাসের উপর বসে কাঁদতে লাগলো।
এই পর্যায়ে এসে স্বপ্নটা ভেঙে গেলো।মালিহা শুনতে পেলো ফজরের আজান হচ্ছে।মালিহার বুক কাঁপতে লাগলো।এ কেমন অলক্ষুনে স্বপ্ন! সাধারণত মালিহা ফজরের নামাজ পড়ে না। কিন্তু,আজ খুব সময় নিয়ে নামাজ পড়লো। দীর্ঘ সময় মোনাজাতে কাঁদলো।
কিন্তু, কিছুতেই তার মনের অস্থিরতা কমছে না।
তিতলিকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে তার….
সকাল বেলা ফারহান কে নাস্তা দিয়ে মালিহা সাহস করে বললো,তিতলিকে কিছু দিন এখানে এনে রাখতে পারলে…..
ফারহান একরাশ বিরক্তি নিয়ে মালিহার দিকে তাকালো।
মালিহা সবটুকু কথা শেষ করতে পারলো না আর।
ফারহান অফিসে যাওয়ার পর সে ঘরে একা একা বসে কাঁদলো কিছুক্ষণ।
আচ্ছা, বাদশাহ কি আবার বিয়ে করেছে?১৬ বছরের মেয়েটার সাথে তো বিয়ে টা হয়নি। এখন কি অন্য কাউকে করেছে? বিয়ের পর কি তিতলিকে ভুলে গেছে?এটাই কি স্বপ্নের মানে?
মালিহা ডুকরে কেঁদে উঠলো।”তিতলি মা আমার আমি তোমাকে ফেলে এসে অনেক বড় অপরাধ করেছি। তুমি আমাকে কোনোদিনও ক্ষমা করো না, কোনোদিনও না।”
মালিহা সিদ্ধান্ত নিলো সে তিতলিকে দেখতে যাবে।
কিন্তু, ফারহানকে তো বলতে হবে অন্যকথা। দুইদিন পর মালিহা ফারহানকে বললো,আমি মায়ের কাছে গিয়ে কয়েক দিন থাকতে চাই।
ফারহান প্রথমে রাজি হলো না।
কিন্তু,মালিহা তাকে বুঝালো সন্তানসম্ভবা অবস্থায় প্রতিটা মেয়েরই নিজের মায়ের কাছে থাকতে মন চায়।
কয়েকটা দিনের-ই তো ব্যাপার।সে গেলে কি তার মা তাকে তাড়িয়ে দিতে পারবে?
ফারহানকে অনেক অনুরোধ করে রাজি করালো মালিহা। ফারহান কে রাজি করাতেই লেগে গেল সাতদিন। ফারহান কাঁটা কাঁটা ভাবে বলে দিয়েছে ভুলেও যেন বাদশাহর ধারেকাছে না যায়।তার বউ এখন মালিহা,এটা যেন মনে রাখে।
ফারহানের অফিস খোলা তাই ফারহান এখানেই থাকবে।মালিহা মনে মনে খুশি হলো।সেটাই ভালো।
একাই রওয়ানা হলো সে।যদিও একা না, তার মধ্যে এখন আরো একটি সত্ত্বাও বেড়ে উঠছে।
মালিহা সারা শরীরে কাঁপুনি অনুভব করতে লাগলো।
কতদিন হয়ে গেছে তিতলির গোলগাল মুখটা সে দেখে না। কতগুলো মাস পেরিয়ে গেছে তিতলিকে সে জড়িয়ে ধরতে পারে না।
বাবার সামনে গিয়ে সে কিভাবে দাঁড়াবে? তিতলি কি তাকে দেখে ছুটে চলে আসবে কোলে উঠতে,মনে হয়না আসবে।তার শ্বশুর-শ্বাশুড়ির সাথেও কি দেখা হবে?না সে কিছুতেই পারবে না। ঝিনুক,যুথি ওরা তাকে দেখে কি বলবে?
আর, বাদশাহ??
বাদশার কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মালিহা।
তার চোখ বেয়ে পানি পড়ে।ইশ!এতো বড় ভুলটা না করলে কি হতো…..তার সংসারে যেতেই তার আজ এতো সংকীর্ণতায় ভুগতে হচ্ছে….
চলবে,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে