#ধূসর অনুভূতি
পর্ব:০৫
লেখক: শাপলা
অনেক গুলো দিন পার হয়ে গেছে।মালিহা আর বাদশার ডিভোর্স হয়ে গেছে।মালিহা এখন ফারহানের বউ।এটাই তো সে চেয়েছিল। তবুও সারাক্ষন মনের মধ্যে অশান্তি।মালিহা সারাক্ষনই ভাবে,সে কি আসলেই ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে?এর মাশুল দিতে হবে না তো…
যখন বাদশাদের বাড়িতে থাকতো তখন মনে হতো বাদশাহ আর তার পরিবারের মতো টক্সিক মানুষ এই দুনিয়ায় আর নেই।মালিহা ওদের সহ্যই করতে পারতো না… পুরানো সময়ে ডুব দেয় মালিহা। ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন বাদশাহ তাকে একটা চিঠি দেয়।চিঠির সারমর্ম এই,বাদশা তাকে সেই কলেজের প্রথম দিন থেকে ভালোবাসে। কিন্তু,প্রত্যাখানের ভয়ে বলেনি। আজ,আর না বলে থাকতে পারছে না।
এমনিতেই সেদিন মালিহার মেজাজ খারাপ ছিল।তার উপর এই নেকা মার্কা ভালোবাসার চিঠি পড়ে
কেন জানি মালিহার খুব রাগ হয়।সে বাদশাকে ডেকে যা নয় তাই বলে অপমান করে।
বাদশাহ সেদিন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। তার চোখে পানি টলমল করছিল।
সেদিন বাসায় ফিরে মালিহার কোনো কিছুতেই মন বসছিল না।বাদশার অশ্রুসজল চোখ দুটোর কথা মনে পড়ে মায়া লাগছিল।মনে হচ্ছিল, ধুর এইভাবে না বলে ভদ্রভাবে রিজেক্ট করলেই হতো।
সে ঠিক করে বাদশাকে স্যরি বলবে। কিন্তু, ভার্সিটি আবার পরপর দুই দিন বন্ধ ছিল। তিন নম্বর দিন ক্লাসে গিয়ে সে জানতে পারে বাদশা গতকাল এক্সিডেন্ট করেছে।কি মনে করে সে হাসপাতালে যায় বাদশাকে দেখতে।সাথে আপেল কিনে নিয়ে যায়।
বাদশার ভয়াবহ তেমন কিছু হয় নি। শুধু একটা হাত ভেঙেছে আর মাথায় চোট পেয়েছে।মাথার চোটের জন্যই ভর্তি হয়েছে।
মালিহা যখন গিয়েছিল তখন বাদশাহ ঘুমে ছিলো।
ঝিনুক আর যুথি তার উপর হামলে পড়ে।বলতে থাকে,আপু তুমি মালিহা না?
মালিহা অবাক হয়ে যায়।তাকে ওরা কিভাবে চিনে?
ওরা বলে,ভাইয়া তোমাকে নিয়ে আমাদের কাছে অনেক গল্প করে,তাই দেখেই বুঝে গেছি। তোমাকে অনেক পছন্দ করে তো তাই।
মালিহা অবাক হয়ে বলে,আমাকে নিয়ে কি গল্প করে?আমি তো ওর সাথে কোনো দিন কথাই বলিনি।চিনিও না তত একটা।
ঝিনুক বলে,এই যে তুমি কোনদিন কি ড্রেস পরে ক্লাসে আসো।কত নম্বর বেঞ্চে বসো।কোন ক্লাসে স্যার তোমার প্রশংসা করে।কোন দিন বেশি হাসো,কোন দিন মনমরা থাকো। তোমার কয়টা বান্ধবী এইসব।
মালিহা দারুন অবাক হয়।ভাবে মেয়ে গুলো মিথ্যা বলছে। কিন্তু,যুথি বলে গত রবিবারে তুমি বেগুনি একটা জামা আর নীল ওড়না পরে আসছিলা।চুলে তেল দিয়ে বেনি করছিলা তাই না?আর সিড়ি দিয়ে উঠার সময় হোঁচট খেয়েছিলা।
বলেই হাসতে থাকে।মালিহা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। জিজ্ঞেস করে, তোমাদের ভাইয়া এইসব তোমাদের কেন বলে?
যুথি হেসে বলে, ভাইয়ার মাথার তার ছিড়া তো তাই।আমরা রোজ বলি, তোমার এই ঘোড়ার ডিমের কাহিনী শুনবো না।পারলে প্রপোজ করে এসো।দ্যান শুনবো।
ভাইয়া রোজই বলে,আজকে প্রপোজ করবোই। কিন্তু, তোমাকে দেখলেই তার সাহস হাওয়া হয়ে যায়।
মালিহার খুব হাসি পায়।বিষয়টা তার কাছে মজাই লাগে। ঝিনুক,যুথিকেও খুব পছন্দ হয়। অনেক মিশুক দুইবোন।
একদিনেই অনেক ভাব জমে যায়। অনেক ক্ষন পরেও বাদশাহ ঘুম থেকে না উঠলে মালিহা চলে যায়। ঝিনুক আর যুথি দুইজন মালিহার দুই হাত ধরে এগিয়ে দিয়ে আসে।
পরের দিন ক্লাসে একটা ছেলে বলে,বাদশাকে আজ সকালে দেখতে গেছিলাম।দেখি আপেলের প্যাকেট জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। বললাম,খাবি?তাহলে ছিলে দেই?
আমাকে এমন ধমক দিলো।বললো,ঐ শালা এই আপেল কি খাওয়ার জিনিস? মাথায় আঘাত পেয়ে মাথায় গন্ডগোল দেখা দিছে নাকি কে জানে?
মালিহার প্রচন্ড হাসি আসে,মনে মনে নিজেকে ভাগ্যবতী ও মনে হয়। তাকে কেউ এতো ভালোবাসে?
এরপর বাদশাহ ক্লাসে এলো।মালিহা বাদশার দিকে তাকালেই সে চোখ নামিয়ে নেয়।
মালিহার খুব হাসি পায়।এমনিতে তো খুব সাহসী। তাদের এক সবচেয়ে বদরাগী,ক্ষমতাধর স্যারের বিরুদ্ধে একাই প্রতিবাদ করেছিল একবার। আর, এখন মালিহা তাকালেও নার্ভাস হয়ে যায়।মালিহা একদিন বাদশাকে ডেকে তার নম্বর টা দেয়।বলে,পঞ্চাশ টাকা পাঠিও আমার নম্বরে।
বাদশাহ বিনা বাক্যে রাজি হয়।মালিহা ইচ্ছা করেই দিয়েছিল।নাহলে, বাদশাহ নিজে এসে কোনোদিন চাইবে না। ততদিনে মালিহারও বাদশাকে ভালো লাগতে শুরু করেছে।
যাইহোক,মালিহা ভেবেছিলো বাদশাহ তাকে রাতে ফোন করবে।তাই,সে হাতের কাছেই ফোন টা রাখে। কিন্তু,কোনো ফোন আসে না। অবশেষে, অনেক ক্ষন পরে একটা আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসে।মালিহা দ্রুত ফোন উঠায়।তার বুকে অন্যরকম একটা শিহরণ বয়। কিন্তু, ফোন ধরার পর ওপাশ থেকে একটা মেয়েলী কন্ঠ শোনা যায়।মেয়েটা বলে,মালিহাপু আমি ঝিনুক। বাথরুম থেকে বলছি।
মালিহা বলে,ওমা কেন?
ঝিনুক বলে,আরে লুকিয়ে ফোন করছি তোমাকে। আমার ভাই হাবাদশাহকে তুমি নম্বর দিয়েছো?
-হাবাদশাহ মানে?
– আরে হাবা যোগ বাদশাহ আরকি।
মালিহা হেসে কুটিকুটি হয়।
– দিয়েছো না আপু?
– হুম দিয়েছি তো।
– ভাইয়ার মন মানছে না তোমাকে ফোন করার জন্য। কিন্তু,ভয়ে করতে পারছে না।ভাবছে তুমি রেগে যাবা।আমরা অনেক বুঝাচ্ছি যে নম্বর দিয়েছে তো ফোন করার জন্যই। কিন্তু,সে বুঝছে না।বলছে, তুমি নাকি ফ্লেক্সিলোড করতে নম্বর দিয়েছো।কত বড় হাবদশাহ!
মালিহা হাসি থামাতে পারেনা কিছুতেই।বলে, এখন কি করা যায় বলোতো।
ঝিনুক বলে,আপু তুমি ফোন দেও।ভড়কে যাবে আর অনেক খুশিও হবে।
সত্যি সত্যিই মালিহা একটু পর ফোন করে।
আর,সে রাতে তাদের দুইঘন্টার মতো কথা হয়। বাদশাকে তার দারুন লাগতো তখন। কথাবার্তা,চালচলন,হাসি সবকিছুই ভালো লাগতো। একদিন দেখা না হলে অস্থির অস্থির লাগতো।সেই সময়গুলো খুবই সুন্দর ছিল। একেবারে স্বপ্নের মতো।
এইভাবে তিন বছর কেটে যায়।মালিহার বাবা তার অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক করে।বাদশার কি কান্নাকাটি তখন! অনেক কষ্টে বাবাকে মানাতে হয়েছে মালিহার।কারণ,বাদশারা আর্থিকভাবে তাদের চেয়ে নিচু পর্যায়ের,আর বাদশা তখনো চাকরি পায়নি। খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে, কান্নাকাটি করে, অনুরোধ করে বাবাকে রাজি করিয়ে ছিলো মালিহা।মা বলেছিলো,তুই মানিয়ে নিতে পারবি না ওদের সাথে।বিয়ে আর প্রেম আলাদা। প্রেমের সময় মনে হয় গাছতলায়ও থাকতে পারবো, কিন্তু বিয়ের পর সেটা করা যায় না।মালিহাও পাল্টা জবাব দিয়েছিল। বলেছিল, তাদের ভালোবাসা এতো ঠুনকো নয়।
এরপর, দুইজনের বিয়ে হয়। ঘরোয়া ভাবে কোনোরকম।মালিহার অনেক স্বপ্ন ছিল অনুষ্ঠান করে বিয়ে হবে,সে পরীর মতো সাজবে। ফটোশুট করবে স্বামীকে নিয়ে। খুব ধুমধাম হবে।
তবে,সেসব না হওয়াতে কষ্ট ছিল না মালিহার। ভালোবাসার মানুষটাকে তো পেয়েছে!
কিন্তু, বিয়ের পরদিনই তার শ্বাশুড়ি তাকে ডেকে বলে, তোমার কি লজ্জা নাই? বেকার একটা ছেলে কে বিয়ে করে ফেলছো।ও তো নিজেই বাপের হোটেলে খায় তোমাকে পালবে কিভাবে?
মালিহার চোখে পানি চলে এসেছিল সেদিন। বাদশার মা সারাক্ষণ ই মালিহাকে কথা শোনাতো। মালিহা তেমন রান্না-বান্না পারতো না। তিনি বলতেন,বিয়ে তো লাফ দিয়ে করে ফেলছো। তখন তো পারি না বলো নাই। রান্নার বেলায় পারি না বলো কোন মুখে?
তিনি অনেক সময় এটাও বলতেন যে তোমরা না বড়লোক। তোমার বাবা তো দশটা টাকাও দিলো না বিয়েতে। আমার বেকার ছেলের ঘাড়ের উপর বসে খাচ্ছো।মালিহা খুব খুব কষ্ট পেতো। অবশেষে, বিয়ের ২২ দিনের মাথায় বাদশার খুব ভালো একটা চাকরি হয়।মালিহা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
বাদশাহকে একদিন সব খুলে বলে যে তার মা সারাক্ষণ ই যা নয় তাই ব্যবহার করে। বাদশাহ সব শুনে বলে, মায়ের কথায় কিছু মনে করো না।মায়ের একটু রাগ বেশি।দেখো না আমাদের তিন ভাইবোনকেও সারাক্ষন বকে দেখো না।
মালিহা অবাক হয়।বলে, তুমি মাকে কিছু বলবা না?
বাদশাহ দ্বিগুণ অবাক হয়ে বলে,মাকে আমি কি বলবো?
মালিহা আর কিছু বলে না। ততদিনে সংসারের সব কাজ মোটামুটি সেই করে।আর, তার শ্বাশুড়ি সারাক্ষন ভুল ধরে।এটা হয় নাই,ওটা হয় নাই।
সারা জীবন কুটোটি না নাড়া মালিহা যেন সংসার করতে এসে অথৈ সমুদ্রে পরে।মালিহার সব বান্ধবীদের বিয়ে হয়েছে অত্যন্ত ধনী পরিবারে।তারা মালদ্বীপ যায়,বালি যায়।কত দামি দামি উপহার পায় স্বামীদের থেকে। ফেসবুকে ঢুকা যায় না তাদের পোস্ট এর জন্য।
মালিহার না চাইতেও একটু মন খারাপ হয়।মালিহা তো এতো কিছু চায়না। শুধু একটু ভালোবাসা, সম্মান আর প্রশংসা চায়।সেটাও পায় না ঠিকমতো। বাদশাহ কখনো কিছুর প্রশংসা করে না।যেচে যদি মালিহা জিজ্ঞেস করে, রান্না কেমন হইছে? তখন বলে, হুম ভালো। ব্যাস এইটুকুই।মালিহার বান্ধবীরা একদিন আসে তার বাসায়।সেটা বাদশার মা ঠিক পছন্দ করে না।বলতে থাকে,এইসব উশৃঙ্খল মেয়েদের সাথে তোমার মেলামেশার দরকার নেই।কি পোশাক আশাকের ছিরি একেকজনের।
মালিহা সেদিন পাল্টা জবাব দেয়।
এতেই দুইজনের ঝগড়া হয়ে যায়। বাদশাহ বাসায় ফিরে মালিহাকেই দোষারোপ করে।বলে, তুমি কেন মায়ের মুখে মুখে জবাব দিতে গেলা?
মালিহা অবাক হয়।যা বলবে সব সহ্য করতে হবে?
বাদশাহ বলে, নিজের মা ভেবে মেনে নাও না।এমন করো কেন?
মালিহা বলে,আমার মা কোনো দিনও এমন কথা বলতো না।আমাকে দিয়ে এভাবে কলুর বলদ খাটাতো না।কাজেই আমার মায়ের সাথে তোমার মায়ের তুলনা করবা না।
সারাক্ষন কিছু না কিছু নিয়ে ঝামেলা হতোই।চার রুমের একটা বাসা।মালিহাদের কোনো প্রাইভেসিই ছিল না।মালিহা শখ করে শাড়ি,চুড়ি, প্রসাধনী কিছু কিনলেও সেটায় এসে ঝিনুক,যুথি ভাগ বসাতো।ভাবী এটা দেও,সেটা দেও নির্দ্বিধায় আবদার।
মালিহার কাছে ওদের বিরক্ত লাগতো।আর, সারাক্ষন ভাইয়া এটা আইনো,ওটা আইনো।
কয়টাকাই বা বেতন পায়। প্রতিদিন যদি এতো কিছু আনতে হয়। তাদের ভবিষ্যৎ এর জন্যেও তো কিছু টাকা বাঁচাতে হবে।এইসব বাদশাহকে কে বুঝাবে?
এরপর, আবার বাদশাহ পীড়াপীড়ি করতে লাগলো বাচ্চা নেয়ার জন্য।মালিহা প্রচুর বিরক্ত হয়।সে চাইতো বিয়ের কয়েকটা বছর যাক। দুইজন কিছু সময় একসাথে কাটিয়ে তারপর অন্য চিন্তা।
কিন্তু,না। বাদশাহ বলে, তুমি কি আমার সাথে সংসার করতে চাও না?অন্য কোথাও চলে যাওয়ার প্ল্যান আছে?নাকি আমি ছাড়াও তোমার কেউ আরো আছে? কিসের জন্য বাচ্চা নিতে চাও না?
মালিহার বিরক্ত লাগে খুব।মা বলে, বাচ্চা হলে নাকি সব ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু,তিতলি হওয়ার পরেও কিছু ঠিক হয় না। দিনদিন মালিহার সব অসহ্য লাগতো। বাচ্চা পালা, আবার রান্না করা, তার উপর শ্বাশুড়ির কথা শোনা।
সে চাইতো আলাদা হয়ে যেতে।কিশোর বয়স থেকে স্বপ্ন দেখেছে তার আর তার বরের ছোট একটা সংসার হবে। দুইজনের ছিমছাম সংসার।সে রান্না করার সময় বর পাশে বসে থাকবে, জোছনা হলে দুইজন ছাদে উঠবে। নানান জায়গায় ঘুরতে যাবে।সে শাড়ি পরে সাজবে; তার বর মুগ্ধ চোখে তাকে দেখবে।
এসবের কিছুই বাস্তব জীবনে হয় না।
বাদশাহ কে আলাদা বাসার কথা বলায় সে বলে,আর দ্বিতীয় বার এই কথা উচ্চারণ করবে না।
বাসায় ফিরার পর সে তিতলিকে রাখতো।তার বাবার রুমে যেয়ে কিছু ক্ষন বসতো, বোনদের সাথে কথা বলতো। এরপর,ঘুমিয়ে যেতো। আবার, সকালে অফিস। সারাদিন বাইরে থাকা।ফিরে এসেও সেইম রুটিন।মালিহার সাথে আলাদা কিছু সুন্দর সময় কাটানো তার হতোই না।
কেমন যেন ধূসর মনে হতো জীবনটা।কোনো রঙ নেই।
চলবে,,