ধর যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-০১

0
114

#ধর_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে

শাড়িতে অভ্যস্ত নয় বলে বারবার শাড়ির পাড় পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। মিতুলের বিরক্ত লাগছে। বোনের বিয়েতে এমনি কত ছোটাছুটি। তার মাঝে সামলে হাঁটতে হচ্ছে যেন শাড়ির কোনো ক্ষতি না হয়। শাড়ি পরে খুবই বিরক্ত লাগছে এখন। মিতুল জানতো শাড়ি সামলাতে পারবে না। কিন্তু সুন্দর দেখানোর লোভে শাড়িই পরেছে। তাছাড়া নিজের বোনের বিয়েতে পরার মতো ভারী কোনো পোশাক মিতুলের নেই। কাতান কাপড়ের সালোয়ার কামিজ ছিল, কিন্তু বোনের বিয়েতে পরার মতো মনে হয়নি। এই শাড়িটা মিতুলের চাচীর। দুবাই নেটের শাড়িতে মিরর ওয়ার্ক করা। এত চমৎকার শাড়ি বা পোশাক মিতুল এর আগে কখনো পরেনি। চাচী এত ভালো। মিতুল কোন পোশাক পরবে এই নিয়ে যখন মায়ের সাথে ঘ্যানঘ্যান করছিল, তখন চাচীই বললেন ওনার কাছ থেকে শাড়ি নিতে। চাচীর সালোয়ার কামিজ মিতুলের গায়ে হবে না। বেশ ভারী শরীর চাচীর।

মিতুল খুশি হয়ে যায়। মায়ের কাছেও সব সাধারণ শাড়ি। কাতানই বেশি। এমন শাড়ি মায়ের নেই। মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে এবার একটা জামদানি কিনেছেন, সেটাও চার হাজার দিয়ে। চার হাজারের জামদানির বুনন ভালো নয়। কিন্তু এই চার হাজারও মিতুলের বাবা রফিক সাহেব দিতে খুব গড়িমসি করেছেন, বিরক্ত হয়েছেন। মিতুলও চার হাজার পেয়েছে কেনাকাটা করতে। কিন্তু বিয়েতে টুকিটাকি কত কিছু লাগে। একজোড়া জুতো, ভালো একটা ব্যাগ, হালকা গয়না। এতসব কিনতে পারা দূর, পোশাক আর ব্যাগেই বাজেট শেষ। জামাটা বৌভাতে পরবে। বাবার কাছে আর চাওয়ার সাহস মিতুলের হয়নি। এমন না যে রফিক সাহেব দরিদ্র মানুষ। আসলে রফিক সাহেবের স্বভাবই এমন। হিসেব করে চলাটা অনেকটা কিপ্টেমির পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন। মিতুলের মা ফরিদা বিয়ের পর স্বামীর এমন আচরণে কষ্ট পেতেন। কিন্তু সময়ের সাথে স্বাভাবিক হিসেবেই মেনে নিয়েছেন। বরং মেয়েরা কোনো কিছু নিয়ে অভিযোগ করলে স্বামীর হয়েই কথা বলে মেয়েদের শান্ত করেন।

রফিক সাহেবের সব হিসেব নিকেশ অবশ্য একজনের সাথে খাটে না। আর সে হলো মিতুল আর তুলতুলের ছোটো ভাই রাতুল। তুলতুল রফিক সাহেবের বড়ো মেয়ে, মিতুল মেজো। আর রাতুল সবার ছোটো। রাতুল সবে ক্লাস এইটে পড়ে। ফরিদা আর রফিকের আদরের সন্তান। ছেলে সন্তানের জন্য মনে একটা চাপা কষ্ট ছিল রফিক সাহেবের। স্বামীর মনোঃকষ্ট দেখে আল্লাহর কাছে অনেক দোয়া মান্নত করে রাতুলকে পেয়েছেন। তুলতুল আর মিতুল ভালোই বুঝে তারা দুইবোন একদিকে, আর ভাইয়ের আদর আরেকদিকে। অবশ্য এ নিয়ে বোনদের মনে দুঃখ নেই। ভাইকে তারা নিজেরাও খুব ভালোবাসে। বলতে গেলে রাতুলের তিন মা। মা তো মাই, বোনেরাও তাকে আদর করে মাথায় তুলে রাখে।

যাই হোক, বড়োবোন তুলতুলের বিয়েতে ভালো কেনাকাটা রাতুলের কপালেই জুটেছে। নাগরাই জুতো, কেডস, নতুন পাঞ্জাবি, জিন্সের প্যান্ট টিশার্ট সবই পেয়েছে রাতুল। এরপরও বোনদের সাথে ঘ্যানঘ্যান করেছে একটা ঘড়ির জন্য। নিজের বাজেট থেকে ভাইকে একটা ঘড়ি কিনেও দিয়েছে মিতুল।

“মিতুল, শাড়ি তো পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। হিল জুতা পর।”

“সমস্যা নেই চাচী। শাড়ি বেশি নিচু হয়েছে। আমি আরেকটু খুঁচে নিচ্ছি।”

মিতুলের ইতস্তত ভাব দেখে জেসমিন বুঝতে পারেন। নিজের মেয়ে ফারহাকে ডেকে বলেন,

“ফারহা, তোমার একজোড়া হিল বাড়তি আছে না? মিতুলকে দাও তো আম্মু।”

ফারহা মায়ের উপর বিরক্ত হয়। মায়ের অতি ভালো সাজার স্বভাব ফারিহার পছন্দ না। ফারহা আর মিতুল প্রায় সমবয়সী। ফারহা অনার্স ফাস্ট ইয়ারে পড়ে। আর মিতুল এবার এইচএসসি দিয়েছে। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে হওয়ায় ফারহা একটু বেশিই আদরের। তাই শেয়ারিং বিষয়টা তার মাঝে নেই। তাছাড়া বাবার অবস্থা ভালো হওয়ায় যেখানেই যাক আত্মীয় স্বজনের আহ্লাদটা একটু বেশিই পায়। ফারহার ইচ্ছে করে না করে দিতে। কিন্তু ঘরভর্তি মানুষ। ফারিহা না করলে সবাই ফারহাকে ছোটো মনের ভাববে। মিতুল তো এত আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে যে ফারহার না করার উপায় থাকে না।

“আনছি আম্মু।”

ফারহা রুম থেকে জুতো জোড়া এনে দেয়। মিতুল না না করে না। খুশি মনে পরে ফেলে। মিতুলের এত ছুঁতমার্গ নেই। তুলতুলের সবকিছু মিতুল শেয়ার করে। ফারহার জিনিস ব্যবহারে তাই তার কোনো লজ্জা নেই। ফারহা একটু বিরক্ত হয়েছে তাও বুঝতে পারছে না। বরং খুশিই হয়। তার হিল জুতো পুরানো হয়ে গিয়েছে। এত সুন্দর শাড়ির সাথে মানাতো না। নতুন ফ্ল্যাট জুতোই তাই পরেছিল।।কিন্তু এখন সাদা পেন্সিল হিলের সাথে পিচ কালারের নেটের শাড়িটা কেমন ফুটেছে। বোনের সাথে পার্লার থেকে সেজে এসেছে। বৌয়ের সাথে বোনের সাজ ফ্রি ছিল। এই প্রথম পার্লারে সেজেছে। আয়নায় ঘুরেফিরে শুধু নিজেকে দেখতে মন চাইছে মিতুলের। বেশকিছু ছবিও তুলেছে ফারহার ফোনে। ফেসবুকে আপলোড করবে।

***

পার্টি হাউজ কনভেনশন হলের তিনতলায় তিনটি আলাদা ফ্লোরে বিয়ে, বৌভাতসহ নানা অনুষ্ঠান হয়। অনেকসময় দেখা যায় একই দিনে দুই তিন পক্ষের অনুষ্ঠান থাকে। কারও গেস্ট বেশি থাকলে একাধিক ফ্লোর ভাড়া নেয়। না হলে আলাদা ফ্লোরে আলাদা গ্রুপের অনুষ্ঠান হয়। আজ পার্টি হাউজে দুটো বিয়ের প্রোগ্রাম হচ্ছে। কাকতালীয় ভাবে অপরপক্ষও মিতুলদের আত্মীয় হয়। মিতুলের বাবার দূরসম্পর্কের বোনের মেয়ের বিয়ে আর তুলতুলের বিয়ে একই দিনে ঠিক হয়েছে। দূরের আত্মীয় বলে জানতে পেরেছে একদম শেষ সময়ে। কোনো পক্ষ আর বিয়ের তারিখ পাল্টায়নি। বরং দুপক্ষের কমন আত্মীয়রা খুশিই হয়েছিলেন। একই সাথে দুই পরিবারের বিয়ের আয়োজন দেখা হয়ে যাবে। তুলতুলের স্টেজ সাজানো হয়েছে তিনতলায়। নিচতলা আর দোতলা অপরপক্ষ ভাড়া নিয়েছেন। তুলতুলের খুব শখ ছিল লেহেঙ্গা পরার। এখনকার ট্রেন্ড অনুযায়ী হালকা রঙের লেহেঙ্গা আর ডায়মন্ড কাট গয়না। কিন্তু তুলতুলের শাশুড়ির এসব পোশাক পছন্দ না। তিনি বেগুনি রঙের বেনারসি পাঠিয়েছেন, তাতে সিলভার কালার নকশা। সাথে গোল্ডপ্লেটের গয়না। সোনার গয়না বরপক্ষ সাথে করে নিয়ে আসবেন। গোল্ডপ্লেটও ভালো মানের মনে হচ্ছে না। কেমন ক্যাটকাটে হলদে রঙের। সাথে মেয়েপক্ষের তরফ থেকে দেওয়া সোনার চোকার আর বালা পরেছে তুলতুল। রফিক সাহেব তিনভরির ভেতর কাজ সেরেছেন। চোকারে সোনার বদলে তাই পুঁতির পরিমাণ বেশি। তুলতুল বিরস মুখে বসে আছে। বেনারসিই যখন কিনবে, লাল কিনলো না কেন বোঝে না তুলতুল। কিন্তু এসব নিয়ে অভিযোগ জানালেও কার কাছে জানাবে? হবু বরের সাথে কথা বলারই সুযোগ হয়নি। দুই পরিবারের মুরুব্বিরা বরকনে পছন্দ করেছেন। হবু শ্বশুর শাশুড়ি এসে হাতে আঙটি পরিয়ে গিয়েছেন। বরের ছুটি নেই বলে সরাসরি কনে দেখতেও আসতে পারেনি। মায়ের পছন্দই তার পছন্দ মত দিয়ে বিয়ের জন্য হ্যাঁ করেছেন। একবারে বিয়ের দিন সরাসরি বৌ দেখবে। যদিও শাড়ি গয়নার কোনো মিল নেই। তবুও তুলতুলকে দেখতে ভীষণ মিষ্টি লাগছে। মিতুল মুগ্ধ হয়ে বোনকে দেখে। মনে মনে দোয়া করে, “হে আল্লাহ, আমার বোনটা ভীষণ লক্ষী। তুমি তার বিয়ের পরবর্তী জীবনটা খুব সুখের করে দিও। যেন বিয়ের আগের জীবনের কোনো হতাশা, না পাওয়া আমার বোনটার আর মনে না থাকে। আমিন।”

***
ফারহা খুব সুন্দর একটা লেহেঙ্গা পরেছে। মাথায় একটা ঘোমটা দিলে ফারিহাকেই বৌ বলে চালিয়ে দেওয়া যেত। ফারহা লোকাল পার্লারে সাজেনি। প্রফেশনাল মেকআপ আর্টিস্টের কাছে ব্রাইডাল মেকআপ নিয়েছে। পরিবারের প্রথম বিয়ে। ফারিহা চায় তাকে এমন লাগুক, যেন বিয়েতে আগত সবার নজর তারদিকেই থাকে। লেহেঙ্গার সাথে মিলিয়ে ডায়মন্ড কাটের চমৎকার গয়না পরেছে। ফারহা লম্বা, ফর্সা, সুন্দর। তারপরও চেহারায় কী যেন একটা নেই নেই। মিতুল দেখে আর ভাবে। হঠাৎ বুঝতে পারে ফারিহার চেহেরায় মায়া নেই। কী আশ্চর্য এই মায়ার জন্য মিস ম্যাচ পেশাক আর সাজেও তুলতুলকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। অথচ পা থেকে মাথা পর্যন্ত সব ম্যাচ করে পরেও ফারহার মাঝে কী যেন নেই লাগছে।

তবে মিতুল ঠিক করে ফেলে বিয়ে ঠিক হলে তার প্রথম কাজ হবে বরের সাথে শপিং করা। বাজেটের দিকে না তাকিয়ে মনের মতো করে শপিং করবে। বাবার ভয়ে তখন ভীত থাকবে না। শাশুড়িরও না। একটাই তো জীবন, একবারই হবে বিয়ে। শখ অপূর্ণ থাকলে চলে?

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে