ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-১০

0
78

#ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে
পর্ব ১০

মাকে কী বলে বের হবে, ভাবতে ভাবতে মিতুলের ভয়ে জ্বর আসার অবস্থা। এই সময় বাবা, চাচা কাজে থাকেন। রাতুল স্কুলে। অন্য সময় হলে নোটস নেওয়ার কথা বলে বের হতে পারতো। এখন তো এই বাহানাও নেই। আর কিছুদিন পর ক্লাস শুরু হবে। এখন পড়ালেখার বাহানা নেই। ফারহার ক্লাস চলছে। সে বের হয়ে গিয়েছে। আফসোস হচ্ছে মিতুলের, কেন ক্লাশটা এখনো শুরু হলো না। অনেক ভেবেচিন্তে বান্ধবীকে ম্যাসেজ পাঠিয়ে দেয়।

“মিতুল, কী করিস?”

“কিছু লাগবে আম্মু?”

“পেঁয়াজগুলো কেটে দিবি? খালার সময় হয়নি।”

“আসছি।”

মিতুল পেঁয়াজের সাথে তরকারিও কেটে দেয়। সহকারী খালা প্রতিদিন তিন কাজ করেন। ঘর মোছা, থালাবাসন মাজা, আর ভারী কাপড় ধোয়া। যার যার পরার কাপড় সে সে গোসলের সময় ধুয়ে ফেলো। ভারী কাপড় কয়েকদিন জমিয়ে খালা একদিন ধুয়ে দেন। যেদিন কাপড় থাকে না, কুটা বাছা করে দেন। আজ কাপড় ছিল। কুটা বাছা করা হয়নি। একয়দিন এমনিতেও মেহমানের চাপ গিয়েছে, বেশি সময় থাকতে হয়েছে। খালা আজ তাই তাড়াহুড়ো করে চলে গেলেন।

মিতুল চাল ধুয়ে বসিয়ে দিতে গেলে ফোন আসে।।হাত মুছে ফোন ধরে।

“হ্যাঁ ঝুমুর। নাহ, টাকা কই? উমম… আম্মুকে জিজ্ঞেস করে জানাচ্ছি। তবে মনে হয় না।”

মিতুল ফোন রাখলে ফরিদা জিজ্ঞেস করেন,

“ঝুমুর কেন ফোন দিয়েছে? কী না বললি?”

“ঝুমুর আমাদের চটপটি খাওয়াবে। ডাকছে।”

“এই সকাল এগারোটা বাজে কিসের চটপটি?”

“বিকালে ওর কী কাজ আছে। বলতেছে ক্লাস শুরু হয়ে গেলে একজন এক ডিপার্টমেন্টে চলে যাব। দেখা হবে না। ও বোধহয় কাল আবার দেশের বাড়িতে বেড়াতে যাবে। ক্লাস খোলার সময় হলে আসবে। তাই আজ ডাকলো আমাদের কয়েকজনকে। আমি, ঝুমুর, সোনিয়া, লাবণ্য। লাবণ্যের আব্বু ওকে নতুন ফোন কিনে দিয়েছে। লাখ টাকা দাম। আইফোন। যা সুন্দর ছবি আসে। লাবণ্য নাকি বলেছে ফোন নিয়ে আসবে। আমরা একসাথে ছবি তুলব।”

“এত কী ছবি তোলা বুঝিনি। দুইদিন আগে বোনের বিয়েতে আশ মিটিয়ে ছবি তুলে হয়নি? আর এইটুকু মেয়ের ফোন লাখ টাকা! বাপমায়ের রক্ত পানি করা টাকা নষ্ট করা।”

“আমি কিছু বলছি? আমার কাছে তো টাকাও নাই। আসতে যেতে রিকশাভাড়াও তো লাগে। আমি তো না ই করে দিয়েছি। তুমি জিজ্ঞেস করায় বললাম। আর আরেকজনের মেয়ে লাখ টাকার ফোন নিলেও বা আমার কী। আমার ফোন তো পনেরো হাজার টাকার। ছবি ওঠে ঝাপসা। অন্যের ফোনে ছবি না তুলে আর করব কী। আমি লাখ টাকা দূর, ত্রিশ হাজার টাকার ফোনও কোনোদিন কিনতে পারব না। তাও যে ওরা আমার সাথে এখনো বন্ধুত্ব রাখছে এই বেশি।”

“কেন রাখবে না? বন্ধুত্ব টাকা দিয়ে হয়?”

“এখন হয় আম্মু। এখন টাকা থাকলে সব হয়। সুন্দর শাড়ি হয়, কারও কাছ থেকে নিয়ে পরতে হয় না। দাগ লাগার ভয় পেতে হয় না। মনের মতো জুতো হয়, চকচকে সাজ হয়, গয়না হয়, দামী ফোন হয়। সবই হয়।”

মিতুল ভাত বসিয়ে দিয়ে রুমে চলে যায়। নাহ প্ল্যান কাজ করলো না। ম্যাসেজ দিয়ে ঝুমুরকে বলেছিল একটু পর ফোন দিতে। ঝুমুর ডাকছে দেখলে মা মানা করবে না হুট করে এসময়ে বের হতে। ইচ্ছে করেই এই সময়টা নিয়েছে। এসময় লেকের পাড়ে লোক কম থাকে। ফাঁকা পাবে। বাবা, চাচা থাকবে কাজে। রাতুল স্কুলে। না হলে মা আবার বলতো, রাতুলকে সাথে নিয়ে যা। সবমিলিয়ে এই সময়টা বের করলো। বাকি চার নাচুনে বুড়িদের তো বলতেই তারা রাজি। এমনিতেই মিতুলের ছবি দেখে তাদের মাথা খারাপ। সেই ফটোগ্রাফারের কাছে ফ্রি ছবি তোলার সুযোগ পেলে না করে কী করে!

আসলে সেদিন যখন মিতুলকে তার বান্ধবীর বাসায় নামিয়ে দেয়। আরমানের পরিচয় পেয়ে সেদিনই তো মিতুলের বান্ধবী অস্থির। রীতিমতো ‘ভাইয়া, আমাদের একদিন ছবি তুলে দিবেন? আমাদের বান্ধবীদের খুব শখ ফ্রেন্ডস থিমে ছবি তুলব। রিলসের জন্য সুন্দর সুন্দর শর্ট নেব। আমাদের টাকা নাই তাই ফটোগ্রাফার ভাড়া করতে পারি না।’

মিতুলের এত বিব্রত লাগছিল। একদম ডাহা মিথ্যা কথা। সুযোগ পেলেই এর তার ডিএসএলআর ক্যামেরায় ছবি তোলে। যদিও এটা সত্যি, টাকা পয়সা দেয় না। কারণ ক্যামেরার মালিকও তাদের মতো স্টুডেন্ট মানুষ। শখের ফটোগ্রাফার। মেয়েদের সঙ্গ পেলেই খুশি। কিন্তু আরমান তো বড়ো মানুষ। এসব বাচ্চামি আব্দার করা কি যায়?
অথচ লোকটা রাজি হয়ে গেল। কাজকর্ম নেই দেখে বোধহয়। কিন্তু যদি টাকা চায়!
মিতুল আরমানকে আলাদা করে একপাশে ডেকে জিজ্ঞেস করতেই আরমান হেসেই উড়িয়ে দেয়। বলে লাগবে না কিছু। দুই প্লেট চটপটি খাওয়ালেই হবে। আজকের তারিখ আর সময়টা মিতুলেরই ঠিক করা। এখন মিতুলই যদি না যেতে পারে? শয়তানগুলো ঠিকই লেকেরপাড়ে চলে যাবে। ছবি তুলবে। মিতুলই মিস করবে। মিতুল কি আরমানকে ম্যাসেজ করে জানিয়ে দিবে যে আসতে পারবে না? মিতুলই তো আরমানের সাথে পরিচয়ের সূত্র। সে না থাকলে আরমান কেন আসবে? আরমান তো ওদের চেনেই না।

“নে ধর।”

“কী?”

“একশোর বেশি দিতে পারব না। তোদের বাবা আমাকে কয়টাকা দেয় জানিস? তাড়াতাড়ি চলে আসবি। একটার ভেতর।”

“সত্যি যাব?”

মিতুলের মুখটা একশো ওয়াটের বাল্বের মতো জ্বলে ওঠে।

“যাহ।”

“কিন্তু এখনই তো বাজে এগারোটা একটায় কিভাবে আসব? দুইটা বাজবে।”

যদিও বলেই আর অপেক্ষা করে না। দ্রুত রেডি হতে হবে। বৌভাতে পরবে বলে ঠিক করা জামাটাই পরে নেয়। সাজা যাবে না বেশি। মা সন্দেহ করবে।।কানের দুল আর চুড়ি পথেই পরে নিবে। গাঢ় করে চোখে কাজল দেয়। টিপ দিতে গিয়েও দেয় না। কেমন লজ্জা লাগছে। তারপরও টিপের পাতাটা ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয়।

***

“মিতুল, চুল খুলে দাও”

“আমার চুল স্ট্রেইট করা না। এলোমেলো লাগবে।”

“ট্রাস্ট মি। ভার্জিন সবকিছুর একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে।”

মিতুল ভার্জিন মানো জানে। একমুহূর্ত একটু আড়ষ্ট হয়ে যায়। পরমুহূর্তে বোঝে যে আরমান ন্যাচারাল চুলের কথা বলছে।

মিতুল বেনী খুলে দেয়। গাঢ় কালো কাজল চোখ, কপালে কালো টিপ। মিতুলকে লাগছে চমৎকার। আরমান ক্যামেরায় চোখ রাখে। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে রোদ আসছে। আলোছায়া পড়ছে সদ্য যৌবনে পা রাখা তরুণীর মুখে। এই ফ্রেমটা ক্যামেরাবন্দী করতে হবে।

আরমানকে মেয়েরা ঘিরে ধরেছে। সবাই স্ক্রিনে ছবি দেখছে। কোনো কোনোটা ডিলিট করার আব্দারও করছে।

“মিতুল, তুই যে কী ফটোজেনিক। তোকে ছবিতে অন্য রকম সুন্দর লাগে।”

লাবণ্যের কথায় আরমানও সায় দেয়। মিতুলের চেহারার গঠনটা যেন ছবি তোলার জন্যই। বিভিন্ন এঙ্গেলে তোলা সোলো ছবিগুলোর ফ্রেম অসাধারণ এসেছে। সবাই এখন চটপটির অর্ডার দিয়ে বসেছে।

“এ কী এত কেন?”

“দুই প্লেট চটপটি পারিশ্রমিক ছিল। মনে নেই?”

“আমার চটপটির দাম তাহলে তুমি দিলে?”

“জি।”

“তাহলে আবার দেখা পাওনা রইলো। ফুচকাটা আমার তরফ থেকে হবে।”

***
মিতুলদের বাসাটা পুরানো দিনের তিনতলা বাসা। পৈতৃক জায়গায় বাড়ি। নিচতলায় বড়ো একটা বসার ঘর। একপাশে লাইব্রেরির মতো অনেক বই রাখা। মিতুলের দাদা মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের উপ- পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ছিলেন। শিক্ষিত মানুষ হওয়ার পাশাপাশি সৌখিনও ছিলেন। পড়তে পছন্দ করতেন। ব্যক্তিগত সংগ্রহকে লাইব্রেরির রূপ দিয়েছিলেন। নিচতলায় দুটো অতিথি কামরাও আছে। মিতুলরা দোতলায় থাকে। একসময় ফারহারাও একসাথেই থাকতো। কিন্তু পরিবার বড়ো হওয়ায়, আর চাচার আয় ভালো হওয়ায় তিনতলা নতুন করে তুলে কয়েকবছর আগে চাচা চাচী উপরের তলায় সিফট হয়েছেন। মিতুলদের দোতলা পর্যন্ত তাই বাসা পুরানো দিনের। আর তিনতলা আধুনিক। মিতুলের চাচা চাচী প্রায় বিভিন্ন উপলক্ষে এই কথা মনে করিয়ে দেন যে ওনারা পৈতৃক বাড়ি বড়ো ভাইকে ছেড়ে দিয়েছেন। নিজেদের থাকার জায়গা নিজেরাই করে নিয়েছেন। বাবার সম্পদ থেকে কিছুই নেননি।

যদিও তিনতলা করেছেন বাবার জমিতেই। তাছাড়া লম্বা সময় একসাথে ছিলেনও। কিন্তু আসলে তারা ঝগড়া ঝামেলা করে বলে না। হেসে হেসে কথাচ্ছলে বলে। তাই কথাটা হঠাৎ হঠাৎ শুনতে খারাপ লাগলেও কেউ ফিরতি জবাব দেওয়ার কথা ভাবে না। বিশেষ করে রফিক সাহেব কিছু না বললে, ফরিদার বলার প্রশ্নই আসে না।

মিতুল বাড়ির গেট খুলে ঢোকার আগে খেয়াল করেনি গলির সামনে গাড়ি ঘোরাতো থাকা মানুষটা হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে ওকে দেখছে। এলো চুলের মিষ্টি মেয়েটার কপাল ঘামে ভিজে উঠেছে। টিস্যু নেই। ওড়নায় মুখ মুছে নিচ্ছে। গড়পড়তার সাধারণ বাঙালি তরুণী। একটু আগেই ফারহার সাথে ছোটোখাটো একটা ডেট করে আসা ফারহান সিদ্ধান্তটা নিয়েই নেয়। বাসায় গিয়েই মায়ের সাথে কথা বলবে।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে