#ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে
পর্ব ৭
মিতুল নতুন সালোয়ার কামিজটা পরে খুশি হতে পারছে না। কেমন সাদামাটা লাগছে। চাচীর কাছে আরেকটা শাড়ি চাইতে যাওয়ার সাহসও নেই। বিয়ের দিন দুটো ঘটনা ঘটেছে। ফারহার জুতো তো ভেঙেছেই, চাচীর শাড়িতেও বেমক্কা দাগ লেগেছে। রফিক সাহেব শাড়ি ড্রাই ওয়াশে দিয়েছেন। দাগ যেন উঠে যায় সেই দোয়া করছে মিতুল। চাচীকে দাগ লাগার কথা বলেনি। এমনি আয়রন করতে দিয়েছে বলেছে। বাবা কিছু না বললেও, মা আচ্ছা মতো শাসিয়েছেন।
ফারহা জুতো নিয়ে ভালো মতো দেখেছে। না হিল ভাঙেনি। মিতুলের ভাগ্য নিয়ে হিংসাই হয় ফারহার। ইসস ভেঙে গেলে মিতুলকে দুটো কথা শোনানো যেত। তা হলো না। সমস্যা নেই, শাড়ি আসলে ঠিকই সুযোগ হবে। মিতুল যখন অতিথিদের টেবিলে ব্যস্ত ছিল। সুযোগ পেয়ে একফাঁকে একটু ঝোলের দাগ শাড়ির আঁচলে লাগিয়ে দিয়েছে ফারহা। নেটের শাড়ি থেকে এই দাগ সহজে উঠবে না। দেখা যাক এবার কিভাবে বাঁচে মিতুল।
মিতুল লম্বা চুলগুলো আঁচড়ে ছেড়ে দিবে না বেনী করবে ভাবছে। স্বাভাবিক ঢেউ খেলানো চুল মিতুলের। ফারহার চুলের মতো চকচকে নিখুঁত স্ট্রেইট করা না। ফারহার চুল লম্বা না। কাঁধ পর্যন্ত চুলকে ভলিউম স্ট্রেট করে ঝরঝরে করে রাখে ফারহা। চুল সবসময় বাধ্য ছাত্রের মতো সটান থাকে। মিতুলের চুল অবাধ্য। অগত্যা বেনী করবে ঠিক করে। বিয়ের দিন তো বোনের ব্রাইডাল মেকআপের সাথে নিজের সাজ ফ্রি পেয়েছে। আজ আর পার্লারে যাওয়া যাবে না। ফারহা অবশ্য সাজতে চলে গিয়েছে। চাচী বলেছিল মিতুলকেও নিয়ে যেতে, হালকা সাজিয়ে দিলেই হবে। কিন্তু ফারহা বললো কোনো মেকআপ আর্টিস্ট হালকা কমদামের সাজ সাজায় না। সব প্রি বুকিং এর ক্লায়েন্ট, তাও ফুল পেমেন্ট করতে হবে। পাঁচ দশ হাজার দিয়ে একদিনের পার্টি সাজ মিতুলের সাধ্য কী স্বপ্নেরও বাইরে। বাবা শুনলে মিতুলকে পাগল ঠাওরাবেন। মা তো কিছু বলারই অবকাশ রাখবেন না।
“নে এটা পর। মুখ এত ভোঁতা করে রাখতে হবে না।”
“কী আম্মু?”
“শাড়ি। কমদামের জামদানি হলে কী হইছে। সুন্দর আছে। তোর খালার সাথে কত দোকান ঘুরে কিনলাম। তোর খালা বলছে একই শাড়ি অন্যরা আট দশ হাজারেও কিনে। আমরা অনেক দামাদামি করে কিনছি।”
মিতুল প্যাকেটটা বের করে অবাক হয়। এটা তো সেই জামদানিটা যা মা বিয়ে উপলক্ষে কিনেছে।
“তুমি বিয়ের দিন কাতান পরলা। বললা এটা বৌভাতে পরবা। এখন আমাকে দিচ্ছ কেন?”
“তুই পর। তোদেরই তো বয়স এখন। আমি বেনারসি পরব। তোর মামা দিলো না।”
“ঐটা তো আগেও পরেছ।”
“তো কী হইছে? তোদের কথা শুনলে মনে হয় এক শাড়ি একবার পরলে, ছবি তুললে শেষ? আমরা যখন ছোটো ছিলাম, আম্মাকে সারাজীবন দুইটাই তোলা ভালো শাড়ি পরতে দেখছি। কী যত্নে রাখতেন। ভাঁজে ভাঁজে নেপথেলিন দিতেন। রোদে দিতেন। আমার তো কত শাড়ি। আর একবার পরলেই শাড়ি পুরান হয় না।”
শেষ মুহূর্তে মিতুল ব্লাউজ নিয়ে বসে। মায়ের মাপে বানানো ব্লাউজ তার গায়ে হবে না। টাক দিয়ে সেলাই করে কোনোমতে মাপ মতো আনে। মাই শাড়ি পরিয়ে দেন। সাহায্য করেন কুঁচি ধরতে। মিতুল অবাক হয়। বিয়ের দিন পার্লারে শাড়ি পরানোর সময় মনে হয়েছিল, কত ঝামেলা। এখন মা চট করে কোনো পিনআপ ছাড়া আটপৌরে ধরনের শাড়ি পরালেন। অথচ খুলে যাচ্ছে, পড়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে না। লম্বা চুলে বেনী করে কানের পাশে ফুল গুঁজে দিয়েছে মিতুল। চোখে কাজল দেয় গাঢ় করে। ঠোঁটে লিপস্টিক। সাজের বাকি অনুষঙ্গ খুব একটা নেই। যা আছে তাই দিয়ে সাজে।
***
আরমানের আজ বৌভাতে আসার কথা ছিল না। কিন্তু কী এক অমোঘ টানে মায়ের সঙ্গী হয়ে বৌভাতেও চলে আসে। আজও ক্যামেরাটা সাথে নিয়ে এসেছে। আজ অবশ্য সায়েম অনুরোধ করেনি। নিজেই আগ্রহ নিয়ে ছবি তুলছে। আজ আর তুলতুল মানা করে না। সায়েমের সাথে কাপল ছবি তোলে। শেলী আর জুবায়েরেরও কাপল ছবি তোলা হয়। কিন্তু জুবায়ের আগ্রহী কম থাকায় শেলী আরমানকে বেশিক্ষণ আটকে রাখতে পারে না।
মিতুলদের বাড়ির সবাই এসে পৌঁছালে আরমান সবাইকে স্টেজে ডেকে ফ্যামিলি ছবি তুলে দেয়। আজ জান্নাত আরাও কিছুটা ফুরফুরে মেজাজে আছেন।
“আপনাকে সিঙ্গেল কয়টা ছবি তুলে দেই?”
“আমাকে? পাব কিভাবে?”
“ভাবির কাছ থেকেই তো নিতে পারবেন। বা হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার থাকলে দিন। ছবি পাঠিয়ে দেব।”
ফারহা আর বাকিদের ছবিও তুলে দেয় আরমান। ক্যামেরায় ছবিগুলো দেখতে গিয়ে আরমানের চোখ আটকে যায় জাম রঙের জামদানি পরিহিতা রমনী মিতুলের দিকেই। সিধে সাধা সাজে কী মিষ্টি লাগছে। যদিও বিয়ের অনুষ্ঠানের দিন মিতুলের গায়ের রঙ আরও উজ্জ্বল লেগেছিল। হয়তো সাজের জন্য। আজ ঘরোয়া সাজে শ্যাম বর্ণের লাগছে। আর সত্যি বলতে এই শ্যাম বর্ণে মেয়েটাকে আরও বেশি মায়াবী লাগছে। বয়সটার পার্থক্য একটু কম হলে মাকে মিতুলের কথা বলতে পারতো। প্রায় দশ বছরের পার্থক্য হবে বয়সের। বলতে গেলে বাচ্চা মেয়ে। আগ বাড়িয়ে বেশি কথা বলতে গেলে হয়তো ছ্যাচড়া হাবড়া ভাববে। হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারটাও দেয়নি এখনো।
***
“আম্মু আজকের অনুষ্ঠানে ওনারা আসবে না?”
“কে?”
“ঐ যে ফারহান না কী যেন নাম।”
মেয়ের কথায় মুচকি হাসেন মা,
“হুম, এই জন্য এত আগ্রহ নিয়ে সেজেছ তুমি? আরে ওনারা এখানে কেন আসবেন। ওনারা তো সায়েমদের আত্মীয় না। আমাদের কমন আত্মীয়।”
“আমাদের আত্মীয় হলে চাচার দাওয়াত দেওয়ার কথা না?”
“মনে হয় না। দূরের আত্মীয় তো।”
ফারহার বিরক্ত লাগে। শুধু শুধু এত কষ্ট করলো। আগেই জিজ্ঞেস করা দরকার ছিল। অবশ্য আসা লসও হয়নি। এই যেমন একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার খেয়াল করেছে। দাঁড়িওয়ালা ফটোগ্রাফার মোটামুটি নিষ্ঠার সাথে মিতুলকে ফলো করে যাচ্ছে। পাভার্ড কিনা কে জানে। ঠিকই আছে। মিতুলের প্রেমিক হওয়ার যোগ্য। কিন্তু লোকটা কে জানা দরকার। ফটোগ্রাফার না বাড়ির কেউ? বাঁধা দেওয়ার কোনো ইচ্ছে ফারহার নেই। তামাশা দেখতেই বরং মজা।
***
“মিতুল, তোমাকে তো চেনাই যাচ্ছে না। ঐদিন তো রঙ ফর্সা লাগছিল।”
শেলীর কথা বিব্রত হয় মিতুল। কিন্তু আপুর ননাস ঝামেলা করার মানুষ জানে। তাই বিরক্ত বা রাগ দেখানো যাবে না। মিতুল হাসিমুখেই উত্তর দেয়।
“জি আপু। ঐদিন পার্লারে সেজেছিলাম তো। ওরা না চাইলেও ফর্সা বানিয়ে দেয়।”
“ইসস, না চাইলে বানায় নাকি। আজও সাজতা। ঐদিন যারা দেখেছে, তারা তো আজ কনফিউশানে পড়ে যাবে। ঐদিন দেখলো সাদা, আজ কালো। এ তো লোক ঠকানো।”
মিতুল অবাক হয়। সে কাকে ঠকালো! মিতুলের অবাক মুখ দেখে শেলী বলে,
“আর দুষ্টুমি করলাম। মানে আমার মতো অন্য কেউ তো অবাক হতে পারে। যাক আমার ভাইয়ের বৌ ঠিক আছে। আমরা না হয় ছাড়তাম না। একরঙ দেখিয়ে, আরেক রঙের মেয়ে গছিয়ে দেওয়া তো ঠকানোই তাই না।”
“আপু অনেক ফর্সা। আম্মুর রঙ পেয়েছে।”
“হুম, তুমি আঙ্কেলের মতো কালো হয়েছ।”
ফারহা এগিয়ে আসতে শেলী ফারহার গাল ধরে আদর করে দেয়।
“এই মেয়েটা অনেক কিউট। পুতুল পুতুল। আমার এমন সুন্দর একটা সাদা জাপানি পুতুল ছিল। আরেকটা ভাই থাকলে একে বৌ করতাম।”
ফারহা খুশি হয়ে যায়। নাহ শেলীকে যত খারাপ ভেবেছে, ততটাও না। রূপ গুণের কদর করে।
“আপু আপনাদের ফটোগ্রাফারকে বলে আমাদের সিঙ্গেল ছবিগুলো দিয়েন প্লিজ।”
“আমাদের ফটোগ্রাফার? ওহ আচ্ছা আরমান? ও আমাদের কাজিন হয়। শখ করে ছবি তোলে তো। তাই সায়েমের বিয়ের ছবি তুলে দিচ্ছে।”
ফারহা কিছু বলার আগেই মিতুল বলে,
“ঐ ভাইয়া আপনাদের আত্মীয়?”
“হ্যাঁ।”
“আপু, ভাইয়া কি প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার?”
ফারহার প্রশ্নে হেসে দেয় শেলী।
“আরে নাহ। ভবঘুরে। কিছু করে না। হেঁটে হুটে খায়।”
শেলীর শ্বশুর বাড়ির অনেক আত্মীয় স্বজনেরা এসেছে। শেলী আজ তাই নিয়ে ব্যস্ত। বেশিক্ষণ দাঁড়ায় না।
***
বিকেল ঘনিয়ে এসেছে। মিতুল কমিউনিটি সেন্টারের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে একটু মন কষাকষি চলছে। সায়েমের পরিবার আজ তুলতুল আর সায়েমকে দিতে চাইছে না। ওনারা বলছেন দু’দিন পর দিবেন। মিতুল আর রাতুলের এত মন খারাপ হয়। যদিও দু’দিন এমন কোনো সময় না। তাও মিতুলের মনে হচ্ছে কতদিন বোনের সাথে দেখা নাই কথা নাই।
“আপুর জন্য মন খারাপ?”
আরমানকে দেখে মিতুলের রাগ হয়। লোকটা শুধু শুধু ফটোগ্রাফার হওয়ার নাটক কেন করলো? মিতুলের উত্তর না পেয়ে আরমান নিজ থেকেই বলে।
“দুটো দিন। দেখতে দেখতে চলে যাবে। ভাবিকে ছবিগুলো দিয়ে দেব। সুন্দর এসেছে।”
“কালো এসেছে জানি। দিতে হবে না থাক। বিয়ের দিনেরগুলো আপুর কাছ থেকে নিয়ে নেব।”
“বিয়ের দিন তো সিঙ্গেল ছবি তোলাই হয়নি। আর সেদিনের চেয়ে আজ অনেক বেশি সুন্দর হয়েছে। সুন্দর কিন্তু কালো ফর্সার উপর নির্ভরশীল না।”
মিতুল ভরাট চোখে তাকিয়ে থাকে।
“সত্যি সুন্দর এসেছে?”
“হ্যাঁ। খুব বেশি সুন্দর।”
“কই দেখি।”
ছবিগুলো ক্যামেরার স্ক্রিনে দেখে মিতুলের মনটা ভালো হয়ে যায়। এই মায়া মায়া মেয়েটা মিতুল?
“আমাকেই দিন। আপনার ছবি তোলার হাত কিন্তু খুব সুন্দর।”
“কিভাবে দেব?”
নাম্বার বলে মিতুল।
“আজ রাতেই পাঠাব।”
মিতুলের একটু রাগ ছিল। কালো বলায় মনে কষ্ট ছিল। এখন সব জল হয়ে গেল।
(চলবে)