#ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে
পর্ব ৬
তুলতুলের ঘুম ভেঙেছে খুব ভোরে। আসলে ঘুম আসেনি বলতে গেলে, ভাঙবে কী। সময় নিয়ে গোসল করে। যতটা নিঃশব্দে সম্ভব শাড়ি পরে। ভেজা চুল মুছে আঁচড়ে নেয়। সোনার গয়নাগুলো জুয়েলারি বক্সে গুছিয়ে নেয়। মা বলেছিল শাশুড়ির কাছে গয়না দিতে। নতুন বৌ শাশুড়িকে নিজ থেকে সেধে গয়না দিতে চাওয়া ভালো। না হলে শাশুড়ি ভাববে বৌ টাকা পয়সা চিনে বেশি। গিফটের আঙটি, চেইন, টাকাও গুণে গুছিয়ে নেয়। গিফট থেকে বেছে কানে এক জোড়া ছোটো ঝুমকা, আর চেইন পরেছে। মাথায় ঘোমটা দিয়ে আস্তে দরজা খুলে বের হয়। সায়েমের ঘুম ভাঙুক চায় না। বাড়িতে এখন ঘরের লোকজন ছাড়া বাইরের কেউ নেই। সবাই বৌ ভাতের জন্য একবারে কমিউনিটি সেন্টারে যাবে। তুলতুল শাশুড়ি মায়ের দরজার কাছে এসে থমকে দাঁড়ায়। দরজা খোলাই আছে।
“আসব মা?”
“আসো। উঠেছ এত সকালে।”
তুলতুল এগিয়ে গিয়ে গিয়ে বক্সগুলো বিছানায় রাখে।
“এগুলো?”
“আম্মু বলেছিলেন সব আপনার কাছে জমা রাখতে। আমি হারিয়ে ফেলব। রাতে আপনার শরীর খারাপ ছিল তাই দিতে পারিনি।”
জান্নাত আরা অবাকও হোন, মনে মনে খুশিও হোন। নাহ্ মনটা ভালোই মনে হচ্ছে তুলতুলের।
“বিয়ের গয়না তোমার আলমারিতে রাখ। এসব আমাকে দিতে হবে না। তোমার জিনিস তোমার কাছে রাখ। গিফটেরগুলো দেখি। কে কী দিলো। তাদের কারও বিয়েতে আবার তেমন কিছু দিতে হবে।”
“এই চেইন আর কানের দুলগুলো গিফটের। আমি পরেছি। বালা সেটের।”
“ঠিক আছে। নতুন বৌ খালি কানে, খালি গলায় থাকা ভালো না।”
জান্নাত আরা বেছে ভালো একজোড়া কানের দুল শেলীর জন্য রাখলেন।
“এগুলো শেলীকে দেব। তুমি গিয়ে সায়েমকে উঠে রেডি হতে বলো।”
তুলতুল মাথা নেড়ে সায় দেয়। তুলতুল সব গুছিয়ে আলমারিতে রাখতে বের হয়ে গেলে জলিল সাহেব বলেন,
“মেয়েটা লক্ষী আছে। নম্র ভদ্র। গড়ে পিঠে নিলে ভালোই হবে। অযথা রাতে যা ভয় দেখালে।”
“গড়েপিঠে নিতেই একটু ভয়, একটু চাপ দিতে হয়। প্রথম রাতে বিড়াল মারার কথা এমনি এমনি আসেনি। ভয় পেয়েছে বলে একরাতেই লাইনে এসেছে। বুঝেছে যে সায়েমের জীবনে মায়ের অবস্থান কী। মা, বাবা, বোন এদের আগে স্ত্রী না। এই ডায়লগ বহু বছর আগে তুমিই আমাকে দিয়েছিলে। এখন বয়সের সাথে সব ভুলতে বসেছ তাহলে?”
জলিল সাহেব চুপ করে থাকেন। জান্নাত আরা ওঠেন। রান্নাঘরে যেতে হবে।
***
ঘুমন্ত সায়েমের মুখটা দেখতে ভালো লাগে তুলতুলের। সায়েম সুপুরুষ একজন। ফর্সা ছেলে তুলতুলের ভালো লাগে না। সায়েমের তামাটে বর্ণের মাঝে একটা আকর্ষণ আছে। যথেষ্ট লম্বা, মেদহীন শরীর। বিয়ের প্রথম রাতে শারীরিক বিষয়টা যেমন হওয়ার কথা তেমনই হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে সুন্দর একটা দিন শুরু হওয়ার কথা ছিল। অথচ তুলতুলের মনে একটা বিষকাঁটা খচখচ করে খোঁচাচ্ছে। তা হলো সায়েমের কথা। রাতে স্বাভাবিক কাছে আসার পর তুলতুলকে সায়েম বলেছিল, সকালে উঠে মা আর বোনের সাথে যেন একদম মন থেকো আন্তরিকতা দিয়ে মিশে যায়। রাতের কোনো মান অভিমান সকাল পর্যন্ত টেনে নিতে না।
“শোনো, আম্মু, আপু আমার তোমার দু’জনেরই বড়ো। তাদের কথা শোনার চেষ্টা করবা। ভালোই বলবেন। খারাপ না।”
“জি চলব। তবে একটা কথা বলি। আপু হয়তো দুষ্টুমি করেই বলছেন। কিন্তু সত্যি আমাকে বলছেন যে মায়ের শরীরটা ভালো না, তাই আপনি ভাইয়ার সাথে ঘুমাবেন। ফুল ঝেড়ে তাই বিছানা পরিষ্কার করে ফেলতে।”
“বললে বলছে। আমি খেয়াল করছি সেই কখন থেকে তুমি আপুর দোষ খোঁজা শুরু করেছ তুলতুল। এই জন্য টেনশনে আম্মুর শরীর খারাপ হয়েছে। আপু যে বলতো ভাইয়ের বৌ আসলে ঘরে বোনের জায়গা শেষ হয়ে যায়। কথাটা তো মিথ্যা না দেখি। নতুন বৌ কেমন হবে, কতটা ছেলের সাথে মানিয়ে সংসার করবে সে চিন্তায় তোমার সামনে আম্মুর অসুস্থতা দেখলে। তাও তুমি একই ত্যানা পেচাচ্ছ।”
তুলতুলকে বাহুডোর থেকে মুক্ত করে পাশ ফেরে সায়েম। তুলতুল সত্যি বলছে না মিথ্যা, তা সায়েমের ভাবার বিষয় না। এসব ফ্যামিলি ক্যাচাল বিয়ের প্রথম রাতেই তার বিরক্ত লাগছে। বন্ধুরা যে বলে বিয়ের শুরু থেকেই বৌকে টাইট দিতে হয়। কথাটা ভুল না। একটু নরম হতেই তুলতুলের অভিযোগ, নালিশ শুরু।
***
“পছন্দ হয়েছে?”
“না হলেই বা কী আম্মু। তুমি তোমার ছেলের বৌকে দিয়ে আমার জন্য যা রাখলে, তাতেই আমি খুশি। ছোটো হোক যা হোক, আমি কোনোদিন কিছু বলছি? আমার শাশুড়ি কিছু বললেও তো তোমাদের শুনাই না।”
“গিফটের জিনিস সব ছোটো ছোটো। এটাই ভালো ছিল।”
“তুলতুলের কানের গুলো কে দিলো?”
“ওর খালা।”
“ওটার ডিজাইন ভালো। এটা একটু আদিকালের। থাক সমস্যা নাই। শায়ানের দাদি কী বলবে জানো। বলবে একমাত্র মামার বিয়েতে ভাগ্নেকে কী দিয়েছে?”
জান্নাত আরা চুপচাপ ভাবেন কিছুক্ষণ।
“দে এগুলো। পাল্টে দেই।”
“না থাক। আমার এগুলো পছন্দ না জানো তো। আমি তো অন্য ননদ ননাসের মতো না। যেই শাড়িটা বৌ ভাতের জন্য উপহার দিলাম, সেটার দাম দিয়ে এমন দুই জোড়া কানের দুল কেনা যাবে। জুবায়ের তো তাও শুনবে না। আঙটি কিনবেই।”
“জুবায়েরের কথা তো আমরা জানি। মন কত ভালো। তুই দে তো। দে এদিকে।”
***
শেলী কানে ঝুমকা জোড়া পরে ফেলে। মা এনে দেওয়ার পর খুশি মনে নিলেও এখন মন খচখচ করছে। এখন তুলতুলের কানের দিকে তাকালে মনে হচ্ছে আগের কানের দুলটাই ভালো ছিল। তুলতুলকে কত মানিয়েছে। ধ্যুত, এখন আবার পাল্টাতে বলা যাবে না। খেতে বসে কিছুই ভালো লাগে না শেলীর। বারবার মনে মনে দুই জোড়া দুলের তুলনা করে চলে।
“কী নাত বৌ, দুল জোড়া ননাসের কানে চইলা গেল? ভালোই হইছে। এইটা আরও সুন্দর লাগতিছে তোরে। এই হয়, মাইনষে বোঝে না। হিংসায় চক্ষে অন্যের বাড়ির ঘাস বেশি সবুজ লাগে। সেই দিকে তাকায়া থাকতি থাকতি নিজের গোলা লুট যায়। একসময় তোর শাউড়িও এই আছিল। খালি ভাবতো আমার মাইয়গো সব দিয়া দিতাছি। অন্তর কালা কইরা সুখের দেখা না জেয়ানকালে পাইছে, না এখন বয়স কালে পাইব। নাত বৌ কঠিন পরীক্ষা তোর সামনে। আমগো সায়েম হইলো মায়ের পোলা। নিজের স্বামী কইরা পাওন সহজ হইব না। শক্ত থাকতি হইব।”
(চলবে)