ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-০৫

0
86

#ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে
পর্ব ৫

তুলতুল বিছানা ঝেড়ে ফুল গুলো কুড়িয়ে এক করে দরজার বাইরে নিয়ে রাখতে গিয়ে দেখে সায়েম এগিয়ে আসছে।

“এগুলো কই নাও?”

“দরজার বাইরে রাখব।”

“ডেকোরেশন সব খুলে ফেললে? পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে সাজিয়াছিলাম। খোলার এত কী তাড়া ছিল?”

শেলী বের হয়ে আসে।

“হুম। আমিও তো তাই বললাম। একটাদিন অন্তত ঝালরগুলো থাকতে পারতো। খোলা পাপড়িগুলো সরিয়ে ফেললেও। কী জানি, তুলতুল মনে হয় পোকার ভয় পায়। আম্মু ঘুমিয়েছে?

” হ্যাঁ আপু।”

শেলী তুলতুলের দিকে ফিরে বলে, “দেখলে সায়েম তো চলেই এলো। আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেই পারতে। বিয়ের রাত কত স্পেশাল হয়। তুমি সমস্ত সাজগোজ তুলে ফেললে। আমার ভাইটা চোখ ভরে বৌকে দেখতেও পারলো না।”

জুবায়েরের গলার আওয়াজ ভেসে আসে। শেলীকে ডাকছে।

“আপু শায়ানের ঘুম ভেঙে গিয়েছে মনে হয়। কাঁদছে তোমার জন্য।”

শেলী হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে যায়। শায়ানের কাঁচা ঘুম ভাঙলে সহজে ঘুমায় না। জুবায়ের এমনি ভালো, শেলীকে শাসন করে না। কিন্তু ঘুম কাতুরে। রাতে ঘুমের সমস্যা হলে মুখ কালো করে রাখবে। শেলী চলে গেলে সায়েম দরজা লাগিয়ে দেয়। তুলতুল অবাক হয়েছে ভাইবোনের কথোপকথনে।

“আপা বাবুকে ঘুম পাড়িয়ে আসবে না আবার?”

“কেন আসবে? তুমি কি বিয়ের রাতটা আপার সাথে কাটাতে চাও নাকি? চাইলে বলো। ডেকে আনি।”

তুলতুল কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে,

“আন্টি, মানে আম্মুর শরীর কেমন এখন?”

“ভালো। ঘুমের ঔষধ দিয়েছি। ঘুমাচ্ছে।”

সায়েম তুলতুলের হাতটা ধরে খাটে নিয়ে বসায়।পকেট থেকে একটা বক্স বের করে।

“হাতটা দাও।”

তুলতুল হাত বাড়িয়ে দিলে ব্রেসলেট পরিয়ে দেয়।

“পছন্দ হয়েছে?”

তুলতুল মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে।

“তুলতুল, আমার জীবনে আজ তোমার প্রথম দিন। আজই তোমাকে কিছু কথা বলে রাখি। আমার আব্বুকে তো দেখেছ। নরম সরম মানুষ। কিন্তু আব্বুর এই নরম সরম হওয়ার ধকল আম্মুর উপর দিয়ে গিয়েছে। আমার দাদী বাড়িতে অনেক কষ্ট করেছেন। আব্বুর আয় রোজগারও বেশি ছিল না।সংসারে দিয়ে হাতে তেমন কিছুই থাকতো না। তাই সে সময় দাদীর ইচ্ছে ছিল আম্মু সন্তান কিছুদিন পর যেন নেন। কেননা ফুপুদের বিয়ে বাকি ছিল। কিন্তু এর ভেতর আপুর জন্ম হয়। দাদী খুবই বিরক্ত হোন। আপুর সাথেও যে খুব ভালো আচরণ হয়েছে তা নয়। আস্তে আস্তে ফুপুদের বিয়ে হয়। দাদার মৃত্যুর পর দাদী এমনিতেই একটু নরম হয়ে গিয়েছিলেন। আমার ছোটো ফুপুর অকাল মৃত্যুর শোক আর বয়সের কারণে ধীরে ধীরে সবকিছু থেকে গুটিয়ে নেন। কিন্তু আম্মুকে কখনোই ভালোবাসেননি। আমার বিয়েতেও কমিউনিটি সেন্টারে যাননি। দেখলে না বাড়িতে একপলক সামনে এসে শুধু আমাদের দোয়া করে দিয়ে রুমে চলে গেলেন। এই যে আম্মু এত অসুস্থ। দাদী একবারও দেখতে গেলেন না। যাই হোক সংসার আম্মুর হাতে চলে আসে একসময়। আপু আমার চেয়ে সাত বছরের বড়ো। আমার জন্মের পর তাই আম্মু আমাকে আপুর মতো কষ্ট পেতে দেননি। বিয়ের অনেক বছর পর জন্ম বলেই হোক, বা ছোটো সন্তান বলেই হোক। আম্মু আমাকে কোল ছাড়া করতে চাইতেন না। হয়তো যে আদরটা আপুকে ছোটোবেলায় সামর্থ্য আর কাজের চাপে দিতে পারেননি। সেটাই আমাকে অনেকবেশি করে দিয়েছেন। আপুর কাছেও আমি ছোটো ভাই কম, আর প্রথম সন্তান বেশি। তাই আমি ওনাদের কথার উপর গিয়ে তোমার সাইড কখনও নিতে পারব না। আর তোমার কারণে যেন ওনারাও কষ্ট না পান। তুমি আজ প্রথম দিনই যে জেদ দেখালে তা আমার ভালো লাগেনি।”

“আমি কী করেছি?”

“ছবি তুললে না। তোমার পায়ে এমন কী ব্যথা ছিল?”

তুলতুল মুখ নামিয়ে রাখে। কী উত্তর দিবে। সায়েম যে শুধু মা, বোন ভক্ত তা নয়। খুব আত্মকেন্দ্রিক মানুষও। এইটুকু বুঝতে তুলতুলের ভুল হয় না। সায়েম নিজের দিকটা ছাড়িয়ে তুলতুলের কোনো বিষয়ই হয়তো খেয়াল করেনি। এখন তুলতুল যদি বলে আপার ব্যবহারে কষ্ট পেয়ে সে ছাদে যায়নি। সায়েম কি সেটার অর্থ বুঝবে?

“তুমি তখন আম্মু আর আপুর উপর জেদ করে যাওনি তাই না? অথচ বিয়েতে এগুলো স্বাভাবিক বিষয়। তুমি তোমার বাবার মন জুগিয়ে চলো নাই? আমি যতটুকু জানি তোমাদের পরিবার রক্ষণশীল মনোভাবের। তুমি যেমন আমাকে বিয়ের আগে দেখনি। বাবা চাচার পছন্দে বিয়ে করেছ। আমিও তাই। তুমি ভালো মেয়ে হলে, আমিও ভালো ছেলে। তোমাকে দেখে নম্র ভদ্র বাধ্যগত মনে হয়েছে, সেজন্য আম্মু তোমাকে বৌ হিসেবে পছন্দ করেছেন। যেন আমাদের সাথে মিলেমিশে থাকো।
অঘচ তিনি তো জানলেন না জেদ কতটা আছে তোমার। তোমাকে আম্মু বা আপু খারাপ কিছু বলেছে? মুরুব্বিরা একটু পুরানো ধ্যানধারণার হয়। আগের আমলে সব আরও জটিল ছিল। মহিলারা মানিয়ে চলে নাই? আমার আব্বু কোনোদিন আম্মুর পক্ষ নিয়ে দাদা দাদীকে কিছু বলেন নাই। তাই বলে ওনাদের সংসার হয় নাই? মুরুব্বিদের না রাগিয়ে, জেদ না করে, অনুগত আর নমনীয় থাকলে নিজেরটা ঠিকই বুঝে পাবা। ঠিকই তো কাপল ছবি তোলার অনুমতি দিলো। তোমার জন্যই তোলা হলো না। এই যে তুমি একা ভয় পাবা, তাই আপা বাচ্চা রেখে তোমার পাশে এসে থাকলেন। এই আদরটা দেখবা না? শাসনটাই দেখলে? আম্মুর শরীর খারাপ। একটু সুস্থির হতেই বললেন ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমাবেন। আমার বাসর রাতের কথা এত অসুস্থতার মাঝেও মাথায় ছিল। অথচ তুমি মুখটা এমন করে রেখেছ। আপু বলার পরও আমার জন্য অপেক্ষা করলে না। সাজগোজ সব তুলে ফেলে, পুরো বিছানা ক্লিন করে ফেললে। আমার ইচ্ছে ছিল নতুন বৌয়ের মুখ দেখে উপহারটা পরিয়ে দিব।”

তুলতুল পুরোই ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকে। বলে কী সায়েম!

“আমি ভাবলাম আপা আমার সাথে ঘুমাবে। আপনি দুলাভাইয়ের সাথে বা…”

“বা কী? আম্মুর সাথে ঘুমাব? এত বড়ো ছেলে আমি বিয়ের রাতে আম্মুর সাথে কেন ঘুমাব? আর আপুও বা তোমার সাথে ঘুমাবে কোন দুঃখে? আপু নিজের ঘুম নষ্ট করে আসলেন তুমি যেন ভয় না পাও। আম্মুর ঘরে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলে। বাবা বলছিল নতুন বাড়িতে ভয় পাচ্ছ। তাই আপু আসলেন। আপু তো বলেছে তোমাকে।”

তুলতুল কী বলবে? বলেনি বলবে? বলবে যে শেলী আপা বলেছে তিনি তুলতুলের সাথে ঘুমাবেন আর সায়েম দুলাভাইয়ের সাথে! বিশ্বাস করবে সায়েম? উল্টো এটাই ভাববে না যে তুলতুল মিথ্যা বলছে। এদিকে তুলতুলের চুপ থাকা সায়েম তুলতুলের ভুল স্বীকার করাই বুঝে নেয়।

“শোনো তুলতুল। আপু আর আম্মুকে তোমার প্রতিপক্ষ ভেব না প্লিজ। আমি আমার দাদা বাড়ির মতো অবস্থা চাই না। আমার আম্মু একটু সেকেলে মানুষ। তুমি ম্যানেজ করে চলবা। দেখবা সব পাবা। তুমি তার একমাত্র ছেলের বৌ। ওকে?”

তুলতুল মাথা নেড়ে সায় দিলে সায়েমের মুখে হাসি ফোটে। তুলতুলের হাতটায় একটা চুমু খায়। যদিও
তুলতুল কিছুই বুঝতেই পারছে না । রোমান্টিক তার নিজের বাবাও নন। দাদীও কোনো রসোগোল্লা শাশুড়ি না। তবু মায়ের সাংসারিক জীবনও কি এমন জটিল ধাঁধা কিনা তুলতুলের জানা নেই। বিয়ের প্রথমদিনই সাংসারিক এসব মারপ্যাঁচ তুলতুলের মাথার উপর দিয়ে যায়। সায়েমকে আজ রাতে নিজের করে পেয়ে সুখী হবে না নিজের করে পেতে হলে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে বলে ভীত হবে। কিছুই বুঝতে পারছে না।

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে