ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ২৯
“সায়েমকে তুমি শাড়ি দিতে চাও না এমন কিছু বলেছ?”
“না তো মা। আমি কেন এমন বলব? আমি এমন কিছুই বলিনি।”
“না মানে হুট করে ও শাড়ির কথা তুলল। আবার গিফট দিবে বললো।”
“আমি নিজেও অবাক হয়েছি মা। আপনি তো দেখছেন ওখানে আমাকে। আমি নিজেই অবাক হয়েছি শাড়ির কথা তোলায়। আমি তো আপুকে উপহার দেওয়ার কথাই বলতাম। আর যদি শাড়ি নিয়ে ওনাকে কিছু বলতাম তাহলে তো তিনি আপনাকে এসে বলতেনই। আপনার কাছ থেকে তো কোনো কিছু লুকাবে না। আমি যদি শাড়ি দিতে না চাইতাম সেটাও আপনি জানতে পারতেন। এটা তো আপনি জানেন তিনি সবকিছুই আপনার সাথে শেয়ার করেন।”
“হ্যাঁ তা ঠিক। আমার ছেলে কাছে আগে আমি সবকিছু। তারপর অন্য কেউ। আচ্ছা আমি যে তোমাকে রাতে শাড়ি দিলাম তখন কিছু জিজ্ঞাসা করেনি?”
“জ্বি জিজ্ঞাসা করছে তো। আমি বললাম যে আপনি গিফট দিয়েছেন।”
“এটার বদলে ঐ শাড়ি দিতে বলছি, এরকম কিছু বলেছ নাকি?”
” আপনি তো বদলের কথা বলেনই নাই মা। আপনি তো আমাকে এমনিই শাড়ি দিলেন না? বললেন নতুন বউ, বোনের বিয়েতে লাল কাতান সুন্দর লাগবে। সায়েমও সেটাই বলল যে আমাকে ভালো লাগবে। লাল রং নাকি আপুর পছন্দ না। এজন্য আপু শাড়িটা নেয় নি। তবে আমাকে ভালো লাগবে। আর আপনার প্রশংসা করলো। বলল যে দেখছ আম্মু কত সুন্দর শাড়ি রেখেছে তোমার জন্য। আম্মু কত ভালো।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ তা তো করবেই। শেলীর পছন্দ অপছন্দের কিছু না। আমিই তো আমার ছেলের বৌয়ের জন্য এত সুন্দর শাড়িটা রেখে দিয়েছি। শেলীর পছন্দ না কে বলছে?লাল রং আবার পছন্দ না হয় নাকি। এটা তো অদল বদল না। এমনি বললাম শেলীকে ঐ শাড়িটা দিলে ও খুশি হত। থাক এটাই ভালো হয়েছে। দুটোই থাক তোমার কাছে। একটা বোনের বিয়েতে পরবা, আরেকটা মীরার ননদের বিয়েতে। আমাদের কী কম আছে নাকি। একমাত্র ছেলের বৌ তুমি। মানুষ দেখুক কত হাত খোলা আমাদের। ছেলের বৌ আর মেয়ে পার্থক্য করি না।”
“জি মা। ধন্যবাদ মা।”
***
“থ্যাঙ্ক ইউ।”
“কেন? থ্যাঙ্ক ইউ কেন?”
“আপনি বিষয়টা অনেক সুন্দর করে ম্যানেজ করেছেন। মা আর আপুও আমার উপর রাগ করতে পারেননি। আবার উপহারটাও আমার কাছেই থাকলো।”
“শাড়িটা তোমারই। তোমার কাছেই তো থাকবে। দেখ আমি স্বীকার করছি আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি কিভাবে ব্যালেন্স করতে হয়। এখন চেষ্টা করছি শিখতে আম্মুকে কষ্ট না দিয়ে কিভাবে তোমার পাশে থাকা যায়। আম্মুকে কষ্ট দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। আম্মু আমার উইকনেস। আপুর সাথে আর্গুমেন্টে যাওয়া মানে আম্মুর সাথে দ্বন্দ্বে জড়ানো। সেজন্য হয়তো অনেক সময় আপু কিছু বললে বা চাইলে তুমি না চাইলেও মানতে হবে। কিন্তু আমি চেষ্টা করব আমাদের দুনিয়াটা ওই দুনিয়া থেকে আলাদা রাখতে। সব সময় হয়তো পারব না। তখন তুমি না হয় একটু ম্যানেজ করে নিও। দুজন দুজনের মুখোমুখি দাঁড়ালে কেউই তো মানসিক শান্তি পাই না। যতই তুমি স্ট্রং ভাব দেখাও আমি জানি তুমিও শান্তি পাও না। বিষয়টা তাই এমন ভাবে হ্যান্ডেল করতে চেয়েছি যেন উপহারটা তোমার হাতেই থাকে। আপু বা আম্মুও রাগ করার সুযোগ না পায়। আজ আপুকে দিলে আমি যদি আবার তোমাকে কিনে দিতামও তা কখনোই হয়তো একই রকম অনুভূতি দিত না। এখন আপু জানলো যে আপুও আমার কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। তুমিও বোধহয় জানলে যে আমার ওয়াদা মিথ্যা ছিল না। আমি সত্যি আমাদের সম্পর্ক সুন্দর করতে চাই।”
“ধন্যবাদ।”
“কী শুকনা শুকনা ধন্যবাদ, থ্যাংক ইউ এসব দিচ্ছ।”
“শুকনা, শুকনা?”
“হুম। আমাকে বলো আমি কাটখোট্টা, রোমান্টিক না এই সেই। তো আমি শিখব কার কাছে এসব। গার্লফ্রেন্ড ছিল না। বৌও পেলাম এমন একজন যে আজ পর্যন্ত তুমি করে বলে না। রোমান্স করা তো দূর। নাটক সিনেমায় কত কিছু দেখি।”
“আমার মনে হয় খুব বয়ফ্রেন্ড ছিল?”
“তো ঠিক আছে। দুজনেরই ছিল না। দু’জনই শিখি। শুরু তো করি।”
“যেমন?”
“তুমি আমাকে তুমি করে বলা দিয়ে শুরু কর। আর আমি…”
বলতে বলতে সায়েম তুলতুলের হাত টেনে কাছে নিয়ে এসে কপালে একটা ছোট্ট চুমু এঁকে দেয়।
“এভাবে।”
খুব ছোট্ট একটা ঘটনা। একটু পাশে থাকা। প্রথম বার শরীরের সীমানা ছাড়িয়ে মনের কাছাকাছি আসা। এইটুকুতেই আবেগের জোয়ার আসে। আর তা তো আসবেই। মান অভিমানের পালা শেষে শুধু কথার বাঁধনই সহজ হয়ে যায় না। শরীরি আবেগও সহজ আর সুন্দর হয়ে যায়। পলি জমা বুকের মতো স্থবির নদীতেও ঢেউ ওঠে। পাহাড়ি ঝর্ণার মতো কলকল করে ওঠে জমানো কথাগুলো। সবশেষে এক অপরের গভীর স্পর্শে যা শান্ত হয়। ভালোবাসাবাসির মাঝে শুধু শায়েরী, কবিতার স্থান হয় না। তাতে অবশ্যাম্ভাবী শরীরও আসবে। তবে তখন বিষয়টা শুধু শারীরিক না হয়ে পূর্ণতার নাম হয়, সুখের নাম হয়। বিয়ের এতদিন পর যেন সায়েম আর তুলতুল অবশেষে সেই সুখের সন্ধান পেল। সায়েমকে গভীর করে আঁকড়ে ধরে তুলতুল নিজের কাছেই ওয়াদা করলো ক্ষণিক পাওয়া এই সুখ হাতের মুঠো থেকে হারাতে দিবে না। বালু হোক বা জলকণা, এই মুহুর্তগুলো ধরে রাখতে বারবার সে হাত মুঠো করবে।
***
“আসসালামু আলাইকুম আন্টি।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম মা। কেমন আছ তুমি?”
“জি আন্টি আলহামদুলিল্লাহ। আপনি ভালো আছেন?”
“হ্যাঁ, মা। আমিও আছি ভালোই। আরও ভালো হব যদি আন্টি না ডেকে আম্মু ডাক।”
“জি ডাকব।”
“তোমাদের ওখানে কি অবস্থা? বেয়াইন ফোন দিয়েছিল। খুব কেনাকাটা হচ্ছে নাকি?”
“জি, বাসায় তো উত্সব চলছে।”
মীরা লজ্জা মিশ্রিত হাসি হাসে।
“শোন মা, আরমান আঙটি কিনতে বের হয়েছে।”
“জি আমাকে দেখা করতে বলেছে। আমি কাছাকাছিই আছি।”
“আচ্ছা আচ্ছা তাই তো বলি এত শব্দ কেন। বাইরে তুমি। ঠিক আছে রাখি তাহলে এখন। তোমরা দেখে কেনাকাটা কর।”
***
“বাইরে দাঁড়িয়ে যে? চলুন ভেতরে যাই।”
“না বাইরেই বসি। দোকানে কথা বলা যাবে না।”
“আঙটি কিনব না?”
“কিনে ফেলেছি।”
“আমি আসার আগেই কিনে ফেললেন? বুঝেছি সারপ্রাইজ। সমস্যা নাই। দেখি।”
“চলুন ফুড কোর্টের একপাশে বসি।”
দুপুর হয়নি এখনো। এই সময়টা ফুড কোর্ট খালি।
“দেখি আঙটি।”
আরমান পকেট থেকে বক্সটা বের করে দেয়। খুব সিম্পল একটা আঙটি। মাঝে ফুলের মতো ডিজাইন যাতে পাথর চকমক করছে। মীরার একটু ভারী ডিজাইন পছন্দ ছিল। এটা বড়ো বেশি সিম্পল মনে হচ্ছে। আরমানের জন্য ওরা সাত আনার আঙটি বানিয়েছে। এটা মনে হচ্ছে বড়োজোর তিন আনা হবে। মীরা মন খারাপ করে না। আরমানকে অবশ্য কিছু বলে না। আঙটি তো আরমানের একার আয়ে কেনার কথা না। আন্টিতো বলেছিল তিনি ভালো বাজেট ঠিক করেছেন।
মীরা বক্স খুলে আঙটি পরতে যায়।
“কী করছেন?”
“পরে দেখছি হয় কিনা। সাইজ ছোটো মনে হচ্ছে।”
“এটা আপনার সাইজ না।”
“আমার না? কার? ওহ আচ্ছা, আন্টির জন্য নিয়েছেন নাকি? তাই তো বলি এনগেজমেন্টের আঙটি এত হালকা হওয়ার কথা তো না।”
“খুব হালকা মনে হচ্ছে?”
“না গিফটের জন্য ঠিক আছে।”
আরমান মীরার হাত থেকে আঙটিটা নিয়ে বক্সে রাখে।
“মীরা জরুরি কিছু কথা ছিল। মন দিয়ে শুনবেন প্লিজ।”
“মীরা, আমি একজনকে ভালোবেসে ফেলেছি। কখন কোথায় কিভাবে জানি না। খামখেয়ালী, উড়নচণ্ডী, বাঁধনহারা এই আমি কখন ভালোবাসার বেড়াজালে জড়িয়েছি টেরই পাইনি। যখন টের পেয়েছি তখন আর জাল ছিঁড়ে বের হওয়ার পথ নেই। কোনোদিনও কোনো সম্পর্কে না জড়ানো আমার কাছে ভালোবাসা অক্সিটোসিন হরমোনেরই একটা নাম ছিল। এড্রেনালিন রাশ যেমন আমাদের উদ্দাম করে দেয়। তেমনি অক্সিটোসিন বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণকে প্রেম অ্যাখ্যা দেয়। এসব হরমোনের ক্রিয়া আমার কাছে অপ্রয়োজনীয়ই ছিল। অথচ সেই আমি রাতের পর রাত ঘুমাতে পারি না। হঠাৎ করে নিজের একজন মানুষ পাওয়ার তীব্র চাহিদা তৈরি হলো। নিজের কেউ, যে মানুষের ভীড়ে আমার হাত জড়িয়ে গায়ে ঘেঁষে হাটবে। আমি যখন বাইকে গতির ঝড় তুলব, আমার শার্টের কোণা খামচে ধরবে। বৃষ্টি দেখলে আমার তাকে নিয়ে ভিজতে ইচ্ছে করে। রাস্তার পাশে টঙ এর দোকানে তাকে নিয়ে চা খাওয়ার বড়ো তৃষ্ণা হয়। সে একান্ত আমার নিজের মানুষ হবে। যাকে যখন তখন ভালোবাসি বলা যায়, বলা যাবে। চোখ বন্ধ করলেই আমি তার চেহারা দেখতে পাই। কিন্তু আমি ক্ষমা চাই। সেই চেহারাটা আপনার নয়।”
(চলবে)