ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ২৮
“আম্মু ডেকেছিল কেন?”
তুলতুল ভেবেছে সায়েম শুয়ে পড়েছে। এমনিতেই আজ লম্বা সময় বাইরে ছিল। বাসায় ফিরে দেখে মেহমান। তাই তুলতুল হাত মুখ ধুয়ে নিজ থেকেই রান্নাঘরে গিয়েছে। রাতের খাবারের জন্য শাশুড়ির সাথে পোলাও, ডিমের কোর্মা করেছে। মেয়ের জামাইয়ের জন্য রোস্ট জান্নাত আরা নিজেই করেছেন। রাতের খাওয়া দাওয়ার পর টেবিল আর কিচেন গুছিয়ে রাখতে তুলতুলের অনেকটা সময় লেগেছে। খাওয়া শেষে সবাই আবার চাও খেয়েছে। টায়ার্ড লাগছে বলে সায়েম রুমে চলে এসেছিল। বাকিরাও যার যার রুমে চলে গিয়েছে। শেলীর থাকার কথা ছিল না। সায়েমের বাবা মার অনুরোধে আজ রাতটা থাকবে ঠিক করে। জান্নাত আরার সাথে কথা বলে আসতে আসতে তুলতুলের ধারণা ছিল সায়েম শুয়েই পড়েছে।
“শাড়ি দিলেন।”
“কিসের শাড়ি?”
তুলতুল প্যাকেট থেকে বের করে দেখায়। নতুন কাতান শাড়িই মনে হচ্ছে। শাড়িটা চেনা চেনা লাগছে। মনে হচ্ছে দেখেছে। মনে পড়ে সায়েমের। শাড়িটা সায়েমের ফুপির গিফট। শেলী আর যুবায়েরের বিবাহবার্ষিকীতে উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু শেলীর পছন্দ হয়নি তাই রেখে গিয়েছিল। জান্নাত আরা বলেছিলেন কারও অনুষ্ঠানে গিফট করে দিবেন। যদিও শাড়িটা বেশ সুন্দর। কিন্তু শেলীর কেন পছন্দ হয়নি জানে না সায়েম। লাল কাতানে বৌ বৌ ভাব আছে। সায়েমের ভালোই লাগে। কাউকে গিফট করার চেয়ে তুলতুলকে দেওয়াই ভালো হয়েছে। ওকে মানাবে। মায়ের প্রতি ভালোলাগা কাজ করে। কড়া ভাব দেখালেও ঠিকঔ ছেলের বৌয়ের প্রতি মায়া আছে। থাকবেই না কেন? আদরের একমাত্র ছেলের বৌ বলে কথা।
“এই শাড়িটা তোমাকে মানাবে। লাল টুকটুকে।”
“আপনার পছন্দ হয়েছে?”
“আমার পছন্দ অপছন্দের কিছু না। আম্মু দিলেন তোমাকে। আমি বললাম মানাবে। তোমারও কি আপুর মতো লাল ভালো লাগে না?”
“মানে?”
“না মানে, আপুর ধারণা আপুকে কড়া রঙে মানায় না। সেজন্য বললাম।”
“না তেমন কিছু না। লাল তো সুন্দর রঙ। আসলে আপনার পছন্দ হলে বলার কিছু নেই। আমি ঐ শাড়িটা আপুকে দিয়ে দিচ্ছি। তবে আমি না দিয়ে আপনি দিলেই ভালো হয়। আপনি আমাকে প্রথম কোনো উপহার কিনে দিয়েছেন। সেটা কত দামের তা বিষয় না। আমার খুব ভালো লেগেছিল। আমি তা অন্য কারও হাতে দিতে গেলে হয়তো নিজের অজান্তেই… ”
“কী? বুঝলাম না। তুমি কী বলছ?”
“না মানে আপুর জন্যও শাড়ি কেনা দরকার ছিল। আমার আসলে মাথায় আসেনি। তখন তো আমিই নিতে চাইছিলাম না। এর উপর অতিরিক্ত টাকা খরচের কথা কী করে মাথায় আসবে। কিন্তু উপহার পেয়ে সত্যি ভীষণ ভালো লেগেছে। আমার পরা না হোক আপনি দিয়েছেন এটাই বড়ো।”
“আম্মু কি আজকের কেনা শাড়িটা আপুকে দিতে বলেছে?”
“বললেন দিলে ভালো দেখায়। এখন তো রাত হয়ে গিয়েছে। সকালে চাইলে দিতে পারি বললেন।”
“আচ্ছা।”
সায়েম আর কিছু বলে না। বালিশ গুছিয়ে ঘুমানোর আয়োজন করে। তুলতুল হতাশ চোখে সায়েমের দিকে এক পলক তাকিয়ে শাড়ির প্যাকেটেটা আলমারিতে রেখে দেয়। কেন জানি ঐ শাড়িতে একবার হাত বুলায়। কেমন একটা অদ্ভুত আশা জেগেছিল এবার। মনে হয়েছিল সায়েম হয়তো মানা করবে। মা বোনের সামনে না হোক, আড়ালে হলেও বলবে, “তোমাকে কিনে দিয়েছি, তুমি রাখ। আপুর জন্য আবার কিনে আনব।”
অথচ শুধু ‘আচ্ছা’ বলে শুয়ে পড়লো। তুলতুল ঠোঁট কামড়ে চোখের জল আটকে দেয়। যদি সায়েম এত নির্লিপ্ত হতে পারে তবে সেও হবে। মানুষটাই নিজের না হলে, তার দেওয়া কোনো কিছুই তো নিজের হয় না। সবই মায়া। মায়ার জালে ফাঁসতে চায় না তুলতুল। মায়া বড়ো কষ্ট।
***
রাত গভীর হচ্ছে। সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও ঘুম নেই দুটি মানুষের চোখে। তুলতুলের বলা কথাগুলো ভেবে দেখে মিতুল। আজীবন শুনে এসেছে ভালোবাসার প্রকাশটা ছেলেদের তরফ থেকেই আসে। মেয়েদের শুধু সায় দিতে হয়। এখন মিতুল কী করে এর ব্যতিক্রম হবে? আরমানকে কী করে বলবে সে তাকে পছন্দ করে। পরিচিত মানুষ হিসেবে নয়, মনের মানুষ হিসেবে পছন্দ করে। পছন্দ কথাটা হয়তো ভুল। সে তাকে ভালোবাসে। এক অমোঘ আকর্ষণ অনুভব করে। যে আকর্ষণে বুকের ভেতর জোয়ার আসে। যে আকর্ষণে ঠোঁট দুটো চুপ থাকলেও চোখ অনবরত কথা বলে যায়। মনের ভেতর সুখ সুখ ব্যথা জাগে। কী এক অদ্ভুত জ্বলুনিতে শরীর মন জ্বলে পুড়ে ছাড়খার হয়। অথচ কী আশ্চর্য। যার জন্য অহর্নিশ এই জ্বালা। সে যেন কিছুই টের পায় না। চোখের ভাষা বোঝা কি এতই কঠিন? এরপরও মুখ ফুটে বলতেই হয় ‘ভালোবাসি’?
বললো না হয় মিতুল। তারপর? তারপর যদি আরমান যদি না করে দেয়? যদি পরিবারে কথাটা জানিয়ে দেয়? মিতুল কিমল পারবে কাউকে চেহারা দেখাতে? তুলতুলের শ্বশুরবাড়িতেও কত সমস্যা হবে। কেননা আরমান এবং মিরা দুজনই তুলতুলের শ্বশুরবাড়ির সাথে সম্পর্কিত। মিতুল কি করে বোনের সংসারে আরও অশান্তি নিয়ে আসবে? এমনিতেই যেখানে তুলতুলকে নানা পরীক্ষার ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে। সবচেয়ে বড় ভয় হল আরমান যদি তাকে না করে দেয় নিজেই নিজের কাছে ছোটো হয়ে যাবে না? প্রত্যাখ্যানের এই আঘাত কি করে সইবে? তুলতুল বলে সাহস করে মনের কথা বললেই নাকি হয়!
এই দূরত্ব মেটাতে শুধু কি সাহস যথেষ্ট? মিতুল না হয় সাহস করে বলেই দিলো ‘আরমান, আপনাকে আমি ভালোবাসি। সূর্য উঠলেই হারিয়ে যাবে জেনেও যেভাবে শিশির বিন্দু ভালোবাসে কিরণকে। ঝিকিমিকি আলোয় অভ্যর্থনা জানায় সে ভোরকে। যতটা ভালোবাসে পতঙ্গ আগুনকে। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধা করে না। আমিও সেই শিশির, সেই পতঙ্গ। হারিয়ে যেতে পারি জেনেও যে ঝাপ দিতে দ্বিতীয়বার দ্বিধা করবে না।”
কিন্তু এরপর যদি আরমান না করে দেয়? সেই নায়ের ভার তো মিতুল নিতে পারবে না।
মিতুল কি তবে দূরত্বের অভ্যাস করবে? সম্পর্কে যাওয়ার আগেই কি তবে শেষ হয়ে যাওয়ার চর্চা করতে হবে? কী আশ্চর্য কোন সম্পর্কের কথা ভাবছে মিতুল? কেন ভাবছে? আজ বাদে কাল অন্য আরেকজনের সাথে বিয়ে হতে চলছে মিতুল এবং আরমান দুজনেরই। তাদের জীবনে অন্য কেউ আসতে চলছে। এরপরও এসব ভাবা অন্যায়। খুব অন্যায়। এখন আর পাওয়ার নয়, বরং ভোলার অভ্যাসটা করতে হবে। মিতুল জানে না কী করে। কিন্তু করতে হবে।
***
“চোখের গভীরতা মিছে কভু হয়?
হে প্রিয় এসো ফিরে, লাগে বড় ভয়।
দিকবিদিকশুন্য আজ চঞ্চল সে চোখ,
আখি আজও নেশাতুর তোমাতেই ঝোঁক।
কেন ফেলে গেলে চলে, হলে চোখের আড়াল?
অনুভূতির ব্যবচ্ছেদ করে ধারালো করাল!
চক্ষু মুদিলে আজও ভাসে সব স্মৃতি,
যেখানেই রও প্রিয় নিও মোর প্রীতি।”
লাইনগুলো কয়েকবার আওড়ায় আরমান। কার লেখা লাইন জানে না। মুখ বইতে একটা পেজে ক্যাপশনটা খুঁজে পেয়েছে। সেই তখন থেকে লাইনগুলো পড়তে গিয়ে বারবার মিতুলের চোখদুটো মানসপটে ভেসে উঠছে। আজকের মিতুল আর আগের মিতুলে যেন আকাশ পাতাল পার্থক্য। সেই হাসিখুশি ঝর্ণার মতো চঞ্চল মেয়েটা যেন শান্ত পুকুর হয়ে গিয়েছে। কাকচক্ষু কালো চোখে ভীড় করেছে বিষাদ। আজ যতবার চোখে চোখ পড়ছিল, যেন অব্যক্ত ভাষায় কিছু বলে
যাচ্ছিল। আরমান কি কিছু মিস করে যাচ্ছে?
***
সকালে নাস্তার টেবিলে নাস্তা শেষে সবাই বিদায়ে প্রস্তুতি নেয়। ভোরে ভোরেই নাস্তা সেরেছে সবাই। যুবায়েররও অফিস আছে, তাড়াতাড়ি বের হতে হবে। সায়েমও অফিস যাবে। জান্নাত আরা তুলতুলকে চোখের ইশারা করেন। শাড়ির বিষয়টা বলতে চাইছে বুঝতে পারে মিতুল। শেলীও উসখুস করছে।
“আপু, একটা কথা বলার ছিল।”
“কী?”
শেলী আগ্রহী মুখে তাকায়। তুলতুল উত্তর দেওয়ার আগেই সায়েম বলে,
“মিতুল, মানে তুলতুলের ছোটো বোনের আকদ হবে। সবাইকে দাওয়াত দিবে। ও তোমাদের আগেই একটু জানিয়ে দিচ্ছে আর কী। তোমাদের বাড়িতেও তো বিয়ে সামনে। ডেট আগে পড়ে রেখ।”
“আহ্ হা সায়েম, তুলতুলকে বলতে দে ও কী বলতে চাইছিল।”
জান্নাত আরা অস্থির হন।
“এটাই আম্মু। ও আপু, কালকের শাড়িটা কি তোমার খুব পছন্দ হয়েছে? এমন নিতে চাও?”
“হ্যাঁ অবশ্যই। মীরার বিয়েতে পরলাম।”
“আচ্ছা আমি তাহলে ঐ দোকানে খোঁজ নেব। কালেকশনে আছে কিনা। দোকানের ব্যাগটা বরং এনে দেই। ওখানে দোকানের ঠিকানা নাম্বার দেওয়া আছে। এক কাজ করো না, বিয়ের শপিং তো তোমরাই করবা। তখন খোঁজ করে দেইখ আছে কিনা। থাকলে অন্য রঙের একটা নিয়ে নিও সেম শাড়ি। টাকা আমি দেব। গিফট।”
জান্নাত আরা ছেলের কথা শুনে থ। কিছু বলার ভাষা খুঁজে না পেয়ে তুলতুলের দিকে তাকান। তুলতুলের চোখেও বিস্ময়। যুবায়ের কথা টেনে নিয়ে বলে,
“আরে তোমার দিতে হবে কেন? আমার বোনের বিয়েতে, নিজের বৌকে একটা শাড়ি আমিই কিনে দিতে পারি। ঠিকানাটা দিও।”
(চলবে)