ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ২৭
ফারহান মনোযোগ দিয়ে মিতুলের প্রোফাইল দেখতে থাকে। তুলতুলের বিয়ের সময় থেকে এ পর্যন্ত পোস্ট করা ছবি, স্ট্যাটাস নানা অনুভূতির শেয়ার সব খেয়াল করে মনোযোগ দিয়ে। এর আগের বেশিরভাগ পোস্টই কলেজ লাইফ নিয়ে, সদথে নানা মিম শেয়ার। তুলতুলের বিয়ে পরবর্তী সময়ের পোস্টগুলো আলাদা। বেশকিছু সুন্দর সুন্দর ছবি আপলোড করা। সুন্দর ক্যাপশন দেওয়া ছবিগুলোতে। ছবিগুলো নিঃসন্দেহে আরমানের তোলা। একক ছবি আছে অনেক।।বন্ধুদের সাথে ফুচকা পার্টির ছবি আছে, লেকের ধারে এত চমৎকার কিছু এস্থেটিক ছবি তোলা। যা বোঝাই যাচ্ছে প্রফেশনাল কারও তোলা। ছবিগুলোতে আরমানের রিঅ্যাকশনও আছে। মিতুলের ইদানীংকার পোস্টগুলো কেমন বিষণ্ন। ফারহান হঠাৎ কেমন অস্থিরতায় ভোগে। এতদিন তার প্রতি মিতুলের অনাগ্রহ বা দূরত্বের কারণটা ফারহাকেই ভেবেছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ফারহাই সত্যি কথা বলেছে। ফারহা এই ইঙ্গিত অনেক আগেই দিয়েছিল। বলেছিল মিতুলের পছন্দ ফারহান নয়। মিতুল শুধুমাত্র পারিবারিক চাপে এই বিয়েতে মত দিয়েছে। যদিও ফারহানের নার্সাসিস্ট মন তখন এই কথাটাকে গুরুত্বই দেয়নি। ধরেই নিয়েছিল ফারহা জেলাস হয়ে এইসব বলছে। এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত ছিল যো মিতুল ফারহানকে পছন্দ না করার প্রশ্নই আসে না। তাই তো মিতুলের ঠান্ডা আচরণ, নিষ্প্রভ মুখ সবকিছু তার নজর এড়িয়ে গিয়েছে। আজ আরমান সামনে না আসলে তা নজরে আসতোও না। ফারহানের পাশে মিতুল ছিল, আর আরমানের পাশে মীরা। অথচ পুরোটা সময় যেন মিতুল আর আরমানের চোখই কথা বলে গেল। আরমানকে ফারহানের ইচ্ছে করে করা অপমানগুলো মিতুলকে বিচলিত করছিল তা স্পষ্ট বুঝতে পারছিল। বোঝাই যাচ্ছে আরমান আর মীরার মাঝেও সেই টানের অনুপস্থিত যা বিয়ে ঠিক হওয়া জুটির মাঝে থাকা উচিত। এমন নয় তো মিতুলের সাথে ফারহানের বিয়ে হচ্ছে বলে, শুধু তাকে দেখাতেই আরমান আর মীরার বিয়ে? যেন মিতুল জেলাসের বশে হলেও এই শৃঙ্খল ভেঙে বের হয়?
ফারহানের রোখ চেপে যায়। না, এটা সে হতে দিবে না। নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে সে মিতুলকে বিয়ে করতে এগিয়েছে। শর্মিলা আহমেদ তো শুরু থেকেই এই বিয়েতে নিজের অমতে রাজি তা ফারহান জানে। মিতুলের সাথে তার বিয়েটা এখন আর আবেগে সীমাবদ্ধ নেই। এমনিতেই মিতুলের নিষ্প্রাণ আচরণ তাকে ক্ষুদ্ধ করে দিয়েছে। সবসময় সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা ফারহানের জন্য এ অভিজ্ঞতা নতুন। মিতুলকে সময় দেওয়া যাবে না। ফারহা বা অন্য কারও কাছে নিজেকে ছোটো করা যাবে না। রোখ চেপে যায় ফারহানের। মিতুলকে ফোন দিতে গিয়েও দেয় না। নাহ,এখন কিছুই বলবে না। মিতুল এই ধারণা নিয়েই তার জীবনে প্রবেশ করুক যে ফারহান কিছুই জানে না, কিছুই বুঝেনি। কিন্তু ফারহানের বদলে অন্য কাউকে পছন্দ করার ক্ষোভও সে ভুলবে না। মিতুলের ইচ্ছে থাক না থাক বিয়ে হবেই। কাউকে হাসাহাসি করার সুযোগ সে দিবে না। বিয়ের পর সে মিতুলকে বোঝাবে অবহেলা, তাচ্ছিল্য আর অনাগ্রহ কাকে বলে। হেলা ফেলায় পড়ে থেকে হলেও তারই সংসার করতে হবে। এর থেকে মিতুলের মুক্তি নেই, যতদিন না ফারহান নিজে তাকে মুক্তি দিচ্ছে।
***
তুলতুল আর সায়েম বাড়ি ফিরে দেখে শেলী এসেছে। তুলতুল একটু ভয়ই পায় মনে মনে। মীরা অভিযোগ করেনি তো। যতই হোক, ফারহান তার বোনের হবু বর। তুলতুলের পক্ষের আত্মীয়। সামান্য বিষয়টাও তখন বড়ো হয়ে যাবে।
“আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া। আসসালামু আলাইকুম আপু।”
“ওয়ালাইকুম সালাম। এত দেরি যে তোমাদের? মীরা তো কখন বাসায় পৌঁছে গেল। তোমাদের সাথে নাকি দেখা হয়েছে যমুনায়। একসাথে খেলে তোমরা।”
“জি। ঐ মিতুলকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসতে দেরি হলো।”
“সায়েম, কেমন দেখলি ছেলেকে?”
“ভালোই। দেখতে শুনতে ভালো। ভালো পজিশনে আছে। পারিবারিক অবস্থানও ভালো।”
“বাহ্ সব ভালো। যতই ভালো হোক, আমার ভাইয়ের চেয়ে ভালো পাওয়া সম্ভব না।”
যুবায়ের শেলীর দিকে বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকায়। সবকিছুতে অযথা খোঁচাখুঁচি ভালো লাগে না।
“আরে আমাকে এমন করে দেখছ কেন? দুষ্টুমি করলাম। আমার ভাই ভালো না? এই যে সারাদিন শ্বশুর বাড়ির ডিউটি করলো। শ্যালিকার জন্য খরচ করছে। কয়জন পাবে এমন?”
যুবায়ের কিছু বলার আগেই সায়েম বলে,
“আমার কোনো খরচ হয়নি আপু। খাবারের বিল ফারহানই দিয়েছে। আর করে না কে বললো। আমার দুলাভাই কম করে নাকি।”
শেলী কথা এড়াতে তুলতুলের দিকে মন দেয়।
“তুলতুল, বসো। হাতে শাড়ির ব্যাগ নাকি? কে দিলো?”
“ফ্রেশ হয়ে আসি আপু। একবারে ফ্রেশ হয়ে এসে বসছি।”
“শাড়ি কে দিয়েছে বললে না তো?”
“শাড়ি আপনার ভাই পছন্দ করে কিনে দিয়েছেন।”
“সায়েম? বাহ্ সায়েম শাড়িও কিনতে পারে? দেখেছ আম্মু আজ পর্যন্ত তোমার আমার জন্য কখনো কিনেছে?”
“তোমরা ওর পছন্দে শাড়ি কিনেছ কোনোদিন? বলো টাকা দিয়ে দিতে।”
“আচ্ছা তোমার সমস্যা কী? তুমি আমাকে খোঁচাচ্ছ কেন? তুলতুল দেখি সায়েমের শাড়ির পছন্দ কেমন?”
জলপাই রঙের শাড়িতে গোল্ডেন স্ট্রাইপ। খুব সিম্পল, কিন্তু খুবই অভিজাত।
“সত্যি এই শাড়ি সায়েম পছন্দ করেছে!মাশাল্লাহ মাশাল্লাহ। এমনি এমনি বলি আমার ভাইয়ের কথা। দেখ জীবনে এত সুন্দর শাড়ি বৌয়ের জন্য এনেছ?”
যুবায়ের হাত উঠিয়ে নেয়। জান্নাত আরাও স্বীকার করেন আসলেই শাড়িটা দারুণ হয়েছে।
***
“ধন্যবাদ মীরা, আপনি বাসায় কিছু বলেননি।”
“আপনি না করায় যে বলিনি তা শুধু নয়। এমনিতেই বিষয়টা নিয়ে কথা বলার ইচ্ছে ছিল না। একজনের নীচু মানসিকতার উত্তর দিতে যদি আরেকজনের বাসায় সমস্যা সৃষ্টি করি। সেটা তো একই আচরণ হলো। তবে… ”
“তবে কী?”
“আমার মনে হলো আপনি তুলতুল ভাবি, মিতুলের জন্য অনেক বেশি কনসার্ন।”
আরমান চুপ করে থাকে।
“কী হলো চুপ করে আছেন যে? আচ্ছা বাদ দিন।বলুন আমরা কবে শপিং এ যাব? আঙটি কিনে ফেলি। এনগেজমেন্টের বাকি আর এক সপ্তাহ। নাকি আঙটি নিজেদের মতো কিনে ফেলতে বলবো আম্মাকে?”
“মীরা আমি আঙটি কিনে নেব।”
“আমি সাথে যাব না?”
“দেখি।”
“আরমান, আপনি কি চিন্তিত?”
“মীরা আমি পরে ফোন দিচ্ছি। রাখি হ্যাঁ।”
***
“কী বলেন আপনি? তিনদিন পরই আকদ মানে? এত তাড়াতাড়ি?”
“আরে আমরাই তো বলছি আলাদা করে এনগেজমেন্ট করার দরকার নাই। ছোটো করে অনুষ্ঠান হোক। এখন নাকি ফারহান বলতেছে তাহলে এনগেজমেন্ট না করে আকদ করে ফেলতে। আমাদের উপর চাপ পড়লো না। পরে ছেলে পক্ষের রিসেপশন বড়ো করে হবে। আমি রাজি হয়ে গেলাম।”
“রাজি হয়ে গেলেন?”
“হ্যাঁ না করার কী আছে। এই বাসার ছাদেই আয়োজন করে ফেলব। ক্যাটারিং এর লোক ডেকে ছোটো স্টেজ করে ফেলব। শোনো জেসমিন আর শফিকরে দাওয়াত দিতে হবে। আপন চাচা চাচী বিয়েতে না থাকলে খারাপ দেখায়। আম্মাকে সাথে নিয়ে যাব ওদের বাসায়। মিতুলকেও বিষয়টা জানিয়ে দিও। তুলতুলের শাশুড়ির সাথে কথা বলে তুলতুলকে আনাও। এই কয়দিন এখানে থাকুক বোনের সাথে।”
“তুলতুলের বাড়িতেও তো আয়োজন।”
“আরে সেটা তো তুলতুলের ননাসের বাড়িতে। তুমি বেয়াইনের সাথে কথা বল।”
***
“মা ডেকেছিলেন?”
“হ্যাঁ বসো তুলতুল।”
জান্নাত আরা এসময় ডেকে নেওয়ার কারণ তুলতুল আন্দাজ করতে পারছে। সায়েমের শাড়ি কিনে দেওয়ার বিষয়টা হয়তো হজম হয়নি। এতদিনে এইটুকু বোঝার ক্ষমতা ওর হয়েছে।
“সায়েম তোমাকে শাড়ি কিনে দিয়েছে খুবই ভালো। আমি ঐ সব শাশুড়ির মতো না যে ছেলে, ছেলের বৌকে কিছু দিলো আর তাতে কলিজা কালো করব। আমার ছেলেও দিল খোলা হাত খোলা।”
তুলতুলের হাসি পায়। এতদিনে এই প্রথম সায়েম কিছু নিজ থেকে কিনে দিয়েছে। তবু মাথা নেড়ে সায় দেয়।
“কিন্তু তুলতুল। সায়েমের মনে না থাকলেও তোমার তো মনে রাখা উচিত ছিল এই ছেলেটা কোথা থেকে এসেছে। তার মা আছে, বোন আছে। আমি বুড়ো হয়ে গিয়েছি, আজ আছি কাল নাই। এতকিছুর চাহিদা রাখি না আর। মনেও রাখি না। ছেলের টাকা শুধু শুধু নষ্ট করতেও চাই না। কিন্তু শেলীও তো সায়েমের কিছু হয় তাই না? তারও তো হক আছে। আমি না হয় মা হক ছেড়ে দিলাম। বোনকে কিভাবে ছাড়তে বলি? কিছু যখন কিনবা, তখন স্বামীকে মনে করিয়ে দিতে হয় এসব। ঘরের সবার মনের কথা ঘরের বৌকে মনে রাখতে হয়।”
“মা, সবার মনের খবর রাখতে গেলে তো সায়েমেরই সমস্যা হয়ে যেত। আপনি না হয় নিবেন না। কিন্তু যুবায়ের ভাই, দাদী, বাবা, বাবু সবার জন্য তো কিছু না কিছু নিতে হতো। আমি তাই কিছু বলিনি। আমিও নিতে চাইনি। উনি বললেন মিতুলের বিয়েতে পরতে পারব। বিয়ের পর তো কেনাকাটা করা হয়নি।”
“বোনের বিয়েতে এত হালকা কেন পরবা? তোমার বিয়ে হলো কয়দিন। কাতান পরবা। তুমি নতুন বৌ, এখন জমকালো শাড়ি পরবা, সাজবা। এসব হালকা শাড়ি হলো তোমার চেয়ে যাদের বয়স সামান্য বেশি, তাদের জন্য। দেখ আমি এই শাড়ি বের করছি।”
জান্নাত আরা একটা লাল কাতান শাড়ি বের করে দেন।
“এটা পইরো। নতুন বৌ। তুমি বরং ঐ শাড়িটা নিজের হাতে শেলীকে দিয়ে দাও। তুমি দিচ্ছ বলে। দেখবা কত খুশি হবে।”
তুলতুল শাড়ি হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। জান্নাত আরা সন্তুষ্টির হাসি হাসেন। তুলতুল এত সহজে মেনে নিবে ভাবেননি।
(চলবে)