ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ২৬
ওয়াশরুম থেকে বের হতে না হতেই আরমানের মুখোমুখি হয় মিতুল। মিতুলের চোখের কাজল লেপটে গিয়েছে। আলগোছে কান্নার জল মোছা হয়েছে বুঝতে পারছে আরমান।
“মিতুল কিছু হয়েছে? তুমি কাঁদছিলে?”
“কই না তো। আপনি এখানে কী করেন?”
“সায়েমের সাথে দেখা করতে এসেছি। মিতুল, তোমার সাথে কি ঐ লোক কোনো অসভ্যতা করেছে? করলে নির্দ্বিধায় বল।”
আরমানের চোয়াল শক্ত হতে দেখে অবাক হয় মিতুল। আরমান হঠাৎ রেগে যাচ্ছে বুঝতে পারছে। মিতুলের দেরি হচ্ছে কেন দেখতে তুলতুলও এগিয়ে আসে। তুলতুলকে আসতে দেখে মিতুল তাড়াতাড়ি বলে, “কিছু হয়নি। চোখে কী যেন পড়েছে। আমি বরং মুখ ধুয়ে আসি।”
“কী হলো আরমান ভাই? হাত ধোয়া হয়েছে? মিতুল কই? আবার ওয়াশরুমে গেল?”
“হ্যাঁ, চোখে কী নাকি পড়েছে। মুখ ধুতে গেল। আপনি নক দিয়ে একটু দেখুন।”
***
খাবারের টেবিলে সব স্বাভাবিকই হয়েও হলো না। মীরা বুঝতে পারছে না হঠাৎ আরমান এত থমথমে হয়ে আছে কেন। এখানে আরমানেরই মীরার খেয়াল রাখার কথা। অথচ মীরা যেন এখানে আরমানের পাশে থেকেও নেই। তুলতুল সবার সাথে মীরার পরিচয় করিয়ে দেয়। মীরা ও আরমান অবশ্য একসাথে খেতে চায়নি। কিন্তু ফারহান আর সায়েম কিছুতেই তাদের আলাদা বসতে দিবে না।
“তো আরমান ভাই, কী করছেন?”
“খাচ্ছি।”
ফারহান থতমত খায়।
“না মানে, জব না ব্যবসা। কোন প্রফেশনে আছেন?”
“ছবি তুলি।”
“ছবি তোলেন? আচ্ছা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের বিজনেস।”
“না ভাই। ছবিই তুলি। ওয়েডিং ফটোগ্রাফার না। তবে সায়েমের বিয়ের ছবি আমারই তোলা।”
“ওহ, তাই নাকি। বিয়ের ছবিগুলো আমি দেখেছি মিতুলের ফেসবুকে। দারুণ তুলেছেন। মিতুলের সিঙ্গেল ছবিগুলোও তাহলে আপনার তোলা। ইসস প্রফেশনালি নিতেই পারতেন। আয় খারাপ না। আমিও আপনাকেই বুক করতাম। আমার বাজেটও বড়ো। তবে আপনার হবু ওয়াইফ মানে মীরা আপু ভাগ্যবান। পার্সোনাল ফটোগ্রাফার পেয়ে যাচ্ছেন। আপু করেই বললাম। মাইন্ড করেননি তো। সময়বয়ী বা বয়সে আমার বড়ো হবেন মনে হলো।”
সায়েম আর তুলতুল বিব্রত বোধ করে। যদিও ফারহান হেসে হেসেই কথা বলছে। তবু কথাগুলো অপমানজনকই লাগছে। মীরা অস্বস্তিতে ভুগছে বোঝাই যাচ্ছে।
“আরমান। আম্মু ফোন দিচ্ছেন। সন্ধ্যা হচ্ছে তো। বাসায় যাব। কেনাকাটা আরেকদিন করব। বাসায় কী জানি ইমার্জেন্সি আছে।”
তুলতুলের দিকে তাকায় সায়েম। তুলতুল বিষয়টা বুঝতে পেরে বলে।
“আরে এখনই তো গয়নার দোকানে যাচ্ছি আমরা। আঙটি পছন্দ করে যান আপু। চলেন যাই।”
“না তুলতুল ভাবি। আমার আলাদা পছন্দ এমনিও নাই। আরমানের কাছে মাপ দেওয়া আছে। ও পছন্দ করে তার বাজেটে যা নিবে তাই চলবে।”
“বাহ আপু, আরমান ভাই তো ভাগ্যবান। এত বুঝদার স্ত্রী পাচ্ছেন। আপনিও ভাগ্যবান।”
“আমি কেন ভাগ্যবান? এই বয়সে বর পাচ্ছি বলে? আপনি আমার বয়স যত ভাবছেন তত না ভাইয়া। আমি আপনার চেয়ে ছোটো না হলেও সমবয়সীই হব। কিন্তু এখনো মেয়েদের সবাই কুড়িতে বুড়িই ধরে নেয়।”
“আরে না না। আপনি কী বলেন এসব।”
“দুষ্টুমি করলাম। দুষ্টুমি কী আপনি একাই করতে পারেন নাকি।”
মীরা বের হতে উদ্যোত হলে আরমানও উঠে যায়।
“ঠিক আছে। আপনারা কেনাকাটা করেন। আমি মীরাকে নামিয়ে দিয়ে আসি।”
মীরার মন খারাপটা কিছুটা হলেও ভালো হয়ে যায়। আরমান তার সাথে উঠে না আসলে মীরার খুব অপমানবোধ হতো।
***
“তুলতুল কেমন লাগছে ছেলে? সায়েম বাবা কী বলে?”
“আমি বললে বিশ্বাস করবেন না। সায়েম বাবার কথা বিশ্বাস করলে বলি, ছেলে কিঞ্চিৎ অভদ্র। আর আপনাদের যা ধারণা, মিতুলকে খুবই পছন্দ করে বিয়ে করতে চাইছে। মাথায় করে রাখবে। তাও মনে হলো না। তিনি তো নিজের প্রেমেই মগ্ন। বাপরে নিজে নিজে এত বিশেষ ভাবতে কাউকে দেখিনি। নিজেকে বড়ো দেখাতে সামনের মানুষটাকেও অপমান করে ফেলে। আমার ননাসের ননদের সাথে দেখা হয়েছে সেখানে। সায়েমের কাজিনের সাথেই বিয়ে ঠিক হয়েছে। ওনাদের কেমন ছোটো করলেন খাওয়ার টেবিলে। তাছাড়া আমার মনে হলো মিতুলও এই বিয়েতে খুশি না। মিতুলকে আমি একটুও হাসতে দেখিনি। বরং মনে হলো ওয়াশরুমে গিয়ে কান্নাকাটি করেছে। আমি ভাবতাম আমার কপালেই ঠোকর খাওয়া লেখা আছে। এখন মনে হচ্ছে মিতুলের কপালও খুব একটা সুবিধার হবে না।”
ফরিদা বেগমের খুবই বিরক্ত লাগে। মেয়েগুলো এমন হয়েছে কোথা থেকে।
“খারাপ কী দেখলি? মিতুলকে কত সুন্দর শাড়ি কিনে দিলো। খাবারের বিলও নাকি সে দিয়েছে।”
“কী রঙের শাড়ি? মিতুলকে জিজ্ঞেসও করেনি তার পছন্দের রঙ কি। নিজের পছন্দে কিনে হাতে ধরিয়ে দিলো।”
“এটাও দোষ? মন বড়ো না হলে বিয়ে হওয়ার আগেই কেউ এভাবে কেনাকাটা করে দেয়? তোর জামাই দিয়েছিল। মন থাকতে হয়।”
“আচ্ছা। তাহলে এখন আপনাদের সাধের বড়ো জামাইয়ের মন ছোটো হয়ে গেল। এই সেই, যার সাথে রাগ দেখিয়েছি বলে বাবার বাড়ি, শ্বশুর বাড়ি দুটোই আমার জন্য…। ”
“তোর জন্য কী? তোর সমস্যা নিজের কারণে হয়েছে। এই চটাং চটাং কথা। এগুলো বাবার বাড়িতে মানে, শ্বশুর বাড়িতে না। আড কথা ঘুরাস না। কাল পর্যন্ত সায়েমের এই ঐ কত দোষ ছিল।।আজ আমি একটু বলতেই তুইও কি ফোঁস করিস নাই? এটাই স্বামী স্ত্রীর টান। আর বুঝলাম না তোদেরও কী দরকার ছিল তোর শ্বশুর বাড়ির মানুষদের একসাথে নিয়ে বসার। সায়েম যে হিসাবি এটা তুইও জানিস। আরমান তো মনে হয় না কিছু করে। এতজনের বিল ঐ ছেলে হাসিমুখে দিলো। তাও খারাপ বলার মানেই হলো হিংসা।”
“কে হিংসা করে আম্মু? আমি মিতুলকে? না সায়েম ফারহানকে? বোনের বড়োলোক ঘরে বিয়ে হলে আমি হিংসা করব? না করি না। বোনের ভাগ্য যদি আমার চেয়ে ভালো হতে দেখতাম। তাহলে হয়তো মনের ভেতর একটা দীর্ঘশ্বাস জাগলেও জাগতে পারতো। কিন্তু হিংসা না।”
***
“মিতুল, যাচ্ছি রে।”
“আজ থেকে যাও না আপু। বিয়ের পর তুমি একদিনও থাকলে না।”
“আজ সারাদিন বাইরে ছিলাম। তাও আবার সায়েম কে নিয়ে। জানি না বাসায় সবাই কেমন গাল ফুলিয়ে আছে। এর মাঝে যদি মীরা আপু বাসায় গিয়ে কোনো কথা লাগায় তাহলে তার ঝাঁঝও আমাকেই নিতে হবে।”
“তুমি তো তাহলে ঝামেলায়ই পড়ে গেলে।”
“আরে ঝামেলার কিছু নাই। এসব স্বাভাবিক। মিতুল, শোন আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি কিছু একটা হয়েছে। আমাকে বলতো ফারহান কি তোর সাথে অসভ্যতা করেছে? করলে বল আমি সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করব বিয়ে ভাঙতে। দেখি কে বিয়ে করায়।”
“না তো আপু। সত্যি এমন কিছু করলে আমিই থাপ্পড় মেরে দিতাম। হাত উঠে যেত আমারই। এমনিতেই ওনাকে আমার ভালো লাগে না। আচ্ছা, তুমি এটা কেন জিজ্ঞাসা করছ?”
“জানি না আরমান ভাই আমাকে ম্যাসেজ দিলেন। ওনার মনে হলো কিছু একটা ঠিক নেই। আমারও মনে হয়েছে তুই খুব চুপচুপ ছিলি।”
“আরমান ভাই বেশি বুঝে। এমন কিছু না। আমাকে না দেখে ওনার হবু বৌকে দেখুক। আর ওনার হবু বউটাকে দেখেছ। তিনিও তো আমাদের সাথে ফ্রি হতে পারছিলেন না। শুধু অন্য লোকের দোষ ধরে লাভ আছে?”
“বাব্বাহ, তুই দেখি ফারহান সাহেবের সাইড নিচ্ছিস। শোন, মীরা আপু অস্বস্তি বোধ করা স্বাভাবিক। তিনি আমাদের কাউকে ভালো করে চেনেন না। হবু বরকে নিয়ে আমাদের সাথে বসে আছেন স্বস্তি বোধ না করতেই পারেন। কিন্তু আপনার হবু বর সত্যি বলতে ভদ্র ভাষায় সামনের মানুষটাকে ছোটো ফিল করান। আমরা কি ওনাকে বলেছি বিল দিতে? নিজে জোর করে বিল দিলেন, সেটা আবার জানিয়েও দিলেন।”
“লোকটা শো অফ করতে পছন্দ করে আপা।”
“আচ্ছা মিতুল, তোর কি অন্য কাউকে পছন্দ?”
“নাহ। আর পছন্দ হলেও কী। আমার পছন্দের মানুষও যদি আমাকে পছন্দ করতো তাহলে তো এই নার্সাসিস্টকে বিয়ে করতাম না। বিয়ে যেহেতু এখানে করছি তখন অন্য সব প্রশ্ন অবান্তর।”
“তুই যাকে পছন্দ করেছি তাকে কি শুধুই পছন্দ করেছিস না ভালবেসেছি?”
“জানিনা আপু। মোহও হতে পারে।”
“তা সেই লোকটা কি জানে তুই তার মোহে মোহাবিষ্ট?”
“সেটাও জানি না। তাছাড়া ওনার সাথে আমার কোনো কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই।”
“কেন নেই? বিবাহিত?”
” বলা যায়।”
” বলা যায় মানে? একটা উত্তর হবে। হয় বিবাহিত না হলে অবিবাহিত। বলা যায় মানে কী? মিতুল আমাদের এ জীবনটা কত অনিশ্চিত জানিস না? এখানে বলা যায়, ভাবা যায়, হতে পারে নাও পারে এসব সম্ভাবনা অসম্ভাবনার জায়গাযই থাকা উচিত না। তাকে ভালবাসলে মুখ ফুটে বলে দে। উনি করে বলছিস। তোর চেয়ে অনেক বড়ো? কলেজের স্যার?”
“আরে নাহ। একটু বড়ো। তবে স্যার না।”
“শোন, বড়জোর কী করবে? না করে দিবে তোকে। তাও ভালো। তুই তো তুই জেনে মরবি যে যাকে তুই ভালোবেসেছিস সে তোকে ভালোবাসিনি। কিন্তু যাকে তুই ভালোবেসেছিস সে হয়তো তোকে ভালোবেসেছিল অথবা হয়তো বাসেনি। এমন হয়তোর ভাবনা তোকে সারা জীবন খুঁচিয়ে যাবে। ভালবাসলে বলতে হয়। কে আগে বললো কে পড়ে এসব হিসাব করলে চলবে না। এই ফারহান নামক নার্সাসিস্ট কে জীবনে আসতে দেওয়ার আগে একবার যার জন্য ভালোবাসা মনে এসেছে তাকে বলেই দেখ।”
“পারবো না আপু। এ এখন আর হয় না।”
(চলবে)