ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ২৫
“শর্মিলা, তুমি যা ভেবেছিলে তা তো হয়নি। বিষয়টা এখন এনগেজমেন্টে চলে এসেছে। রফিক সাহেবের ফ্যামিলি তো মনে হচ্ছে এনগেজমেন্ট না সরাসরি আকদ করিয়ে ফেলতে আগ্রহী।”
“মানে?”
“আমাকে ফোন দিয়েছিলেন রফিক সাহেব। বললেন এনগেজমেন্ট আলাদা করে না করে সেই দিনটাতেই ছোটোখাটো অনুষ্ঠান করতে চান। মানে মৌলানা ডেকে বিয়ে পড়িয়ে দেওয়ার কথা বললেন।”
“কেমন ছোটোলোক। আমি ভেবেছিলাম বিষয়টা আর আগাবেই না। ওনারাই না করে দিলে ফারহানকে বোঝানো সহজ ছিল।”
“ওনাদের দোষ কোন দিচ্ছ? এই বিয়ের জন্য তোমার ছেলের আগ্রহটাই মূল কারণ। আর বরাবরের মতো তুমি ছেলেকে সরাসরি না করতে পারবে না অথচ তুমি ছেলের ইচ্ছা মানতেও পারছ না। শর্মিলা, হয় তুমি ছেলে কে স্পষ্ট করে এখান থেকে ফিরে আসতে বলো। কারণ বুঝিয়ে বলো কেন তোমার এই সম্পর্ক পছন্দ না। আর না হয় স্বাভাবিকভাবে মেনে নাও। নতুন পরিবার শুরু হওয়ার আগেই পারিবারিক দ্বন্দ্ব ভালো লাগছে না।”
“আমি ওনাদের আকারে ইঙ্গিতে স্পষ্ট বুঝিয়েছি যে আমার ছেলের পছন্দে এই বিয়েতে আগানো।।আমার কোনো আগ্রহ নেই। ওনাদের এতটুকু আত্মসম্মান থাকবে না? পরিবারেরই এক মেয়েকে রেখে আরেক মেয়েকে কী সুন্দর তুলে দিতে রাজি। আশ্চর্য।”
“এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নাই। মানুষ যেখানে নিজের আপন মেয়ের ক্ষেত্রেও মেনে নেয়, সেখানে এ তো কাজিন। কত ঘটনা আছে এমন, বড়ো মেয়েকে দেখতো গিয়ে ছোটো মেয়েকে পছন্দ করে। বাবা মা নির্লজ্জের মতো সেই ফালতু প্রস্তাবেও রাজি হয়ে যায়। পাত্র হাতছাড়া করতে চায় না। আর এখানে তো কাজিন।মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোয় আত্মসম্মানের এক অদ্ভুত পারদ আছে। ছেলেমেয়ে নিজের পছন্দে যোগ্য সঙ্গী বিয়ে করলেও তাদের ইজ্জত চলে যায়। অথচ নিজের পছন্দে মেয়েকে চরম অযোগ্য লোকের হাতে তুলে দিলেও বিন্দুমাত্র অনুশোচনা হয় না। সব মেয়ের ভাগ্য বলে চালিয়ে দেয়।”
***
তুলতুল আর সায়েম শপিং মলের সাইডে একটু কেনাকাটা আছে বলে মিতুল আর ফারহানকে একা কিছুক্ষণ রেস্টুরেন্টে বসার সুযোগ করে দেয়। অর্ডার করার আগে আগে চলে আসবে তারা। বিশ মিনিট দুজন একটু আলাদা কথা বলুক। ইচ্ছেটা ফারহানেরই। তুলতুল আর সায়েমও মানা করে না।
“মিতুল, তোমার সমস্যা কি?”
“জি?”
“আমি আসার পর থেকে দেখছি, তুমি কেমন অন্যমনস্ক। দেখ মিতুল, আমি তোমার অস্বস্তি বুঝতে পারছি। তবে তুমি তোমার কাজিনের বিষয়টা নিয়ে ওভারথিংক করছ। এটা খুবই সিম্পল সহজ ঘটনা। তোমার কাজিনের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক ছিল না। পারিবারিক ভাবে দেখেছি। জানার বোঝার জন্য ফেসবুকে এড হয়েছি। চ্যাট করেছি। এবং ফিল করেছি ও আমার টাইপ না। ব্যস। এখানে তোমার কাজিন যেমন প্রিটেন্ড করছে যেন আমি ওকে কথা দিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করছি। বিষয়টা একদমই তা নয়।”
“আমি তো এসব বিষয়ে আপনাকে কিছু বলিইনি। ফারহা আপুর সাথে আমার কথাই হয় না এখন বলতে গেলে। আপুও আমাকে কিছু বলেনি। কিন্তু আপনি কিভাবে জানলেন আপু এমনটা ভাবে বা বলে যে একজনকে কথা দিয়ে অন্যজনকে বিয়ে করছেন? আপনাদের এখনো কথা হয়?”
“কথা হয় বলতে কী বোঝাচ্ছ? দেখ আমি আগেও বলেছি, আমি মেয়েদের এমন এটেনশন পেয়ে অভ্যস্ত। আমার একটা আলাদা চার্ম আছে। মেয়েরা আমার প্রতি এট্রাক্ট হয়, এতে আমার কোনো হাত নেই।”
মিতুলের বিরক্ত লাগে। এই লোকটা এত আত্মকেন্দ্রিক। আমি, আমি রোগে আক্রান্ত।
“আপনি কী প্রশ্নের কী জবাব দিচ্ছেন? আচ্ছা আমার সাথে তো আজ আপনার প্রথম এভাবে দেখা করা। পারিবারিক ভাবে দেখাও হয়নি। ছাদে না কোথায় যেন আমাকে দেখে আপনার পছন্দ হয়েছে। তারপর সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো। দুটো বিষয় কেমন আলাদা হয়ে গেল না? ফারহা আপুকে দেখে, কথা বলে আপনার মনে হলো আপু আপনার টাইপ না। অথচ আমাকে না জেনেই মনে হলো আমি টাইপ! এইজন্য মনে একটু প্রশ্ন আসলো। আর কিছু না। আপনার জানার আগ্রহ হয় না আমাকে?”
“তুমি কিন্তু নিজেকে একটু বেশিই প্রায়োরিটি দিচ্ছ। লেট মি ক্লিয়ার ইউ, আমার অনেক মেয়ে বন্ধু ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। এটাই স্বাভাবিক। আমি যে ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে বিলং করি সেখানে ছেলে মেয়ের বন্ধুত্ব থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু স্ত্রী হিসেবে পছন্দ করার সময় আমার কিছু আলাদা ক্রাইটেরিয়া আছে। আমি ওভার স্মার্ট মেয়ে সঙ্গী হিসেবে চাই না। তাদের সাথে আমি অলরেডি মিশেছি। আমি জানি তাদের সাথে পরবর্তী জীবন কেমন হতে পারে। হানি শুধু এই জন্য তুমি আমার টাইপ হয়েছ। তোমাকে পছন্দ করার কারণ যদি তুমি ভাবো যে তুমি খুব সুন্দর, খুবই আকর্ষণীয় কেউ। আমি তোমার প্রতি লাড্ডু হয়ে গিয়েছি তাহলে তুমি ভুল। আমার কাছে তোমাকে সিম্পলি একটা ওয়াইফ মেটেরিয়াল মনে হয়েছে। এর বেশি কিছু না। তুমি যদি এর বেশি বুঝতে চাও বা নিজেকে এর বেশি মনে কর, তাহলে তোমার কাজিনের মত তোমাকেও ছাড়তে আমার সময় লাগবে না। ফারহানকে রাগিও না। ফারহান তার বাবা-মার রাগের ধার ধরে না। তোমার নখরা যথেষ্ট দেখেছি। আর না। শুধু এটা বোঝানোর জন্যই আজ আলাদা করে ডাকা। তোমার বাবা মা আমার পরিবার থেকে প্রস্তাব পেয়ে বর্তে গিয়েছেন। তোমার কাজিন এখনো আমি ডাক দিলে হাজির হয়ে যাবে। এরপরও তুমি নিজের এটিটিউট ঠিক না করলে পস্তাতে তোমাকে হবে। আমার সাথে রাগ দেখাতে আসবে না।”
***
“নবরূপায় ঢুকি চল। এলোমেলো হেঁটে কী হবে।।কী কিনবা?”
“আমার কোনো কেনাকাটা নেই। কেনার প্ল্যান করে তো আসিনি।”
“সবসময় প্ল্যান করার কিছু নেই। বিয়ের পর তো তোমাকে শপিং এ আনা হয়নি। আজ কিনে দেই চল। মনে মনে তো আমাকে কিপটা উপাধি দিয়ে বসে আছ নির্ঘাত। নিজেও তো পছন্দ করে কেনাকাটা করতে পারো।
“কিছু লাগলে চেয়ে নিতে বলেছিলেন। চেয়ে চেয়ে জরুরি জিনিস নেওয়া যায়। শপিং তো করা যায় না। নিজে পছন্দ করে যে কিনব, আমার হাতে তো টাকা থাকে না। ভার্সিটিতে যাওয়ার হিসাবের ভাড়ার বাইরে আমার ব্যাগ ফাঁকা।”
“তুলতুল, অনেককিছুই আমি বুঝি না। আমার আসলে মা আর বড়ো বোনের বাইরে বন্ধু ধরনের কোনো মেয়েদের সাথে সম্পর্ক ছিল না। বড়ো বোনও মা সম। ছোটো বোন হলে হয়তো মেয়েদের আচরণটা ভালো বুঝতাম। তারপরও আমি স্বীকার করি, আমি যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেইনি। আমার মা, বোন, স্ত্রী সবার জায়গাটা আলাদা রাখা দরকার ছিল। কিন্তু তুমিও যদি অভিমান পেলেপুষে রাখ। সম্পর্ক সহজ হবে না। চেয়েই নাও। আমি তো দিতে না করিনি।”
***
“সায়েম কোথায় আছ ভাই? আমি আর মিরা যমুনাতে ঢুকলাম। তোমরা আছ না চলে গিয়েছ?”
“না আছি। নিচেই আছি। ইনফিনিটি সামনে। আসবা?”
“হ্যাঁ দাঁড়াও আসতেছি। মীরা, আমার কাজিন সায়েম আর ওর ওয়াইফ তুলতুল ভাবিও আছে এখানে। আপনি তো চেনেন ওনাদের।”
“হ্যাঁ। সায়েম ভাই তো আমার ভাইয়ার শ্যালক। না চেনার কী আছে।”
“চলেন যাই তাহলে। ওদের সাথে দেখা করি।”
মীরার যদিও ইচ্ছে ছিল আজকের দিনটা আরমানের সাথে একদম একা কাটানোর। তাই কাউকে সাথেও আনেনি। মনে হয়েছিল একা কিছুক্ষণ সময় কাটানো দরকার। তাহলে আরমানকে বুঝতে তার জন্য সহজ হতো। কেন জানি মিরার মনে হচ্ছে আরমানের সাথে কোথায় জানি একটা গ্যাপ রয়ে যাচ্ছে। অ্যারেঞ্জ ম্যারেজে প্রেমের বিয়ের মত অতি আবেগ থাকবে না স্বাভাবিক। কিন্তু এতটা নীরাবেগও কি স্বাভাবিক? তাই যখন আরমান এখানে আসার প্রস্তাব করে মীরার ভীষণ ভালো লেগেছিল। মনে হয়েছিল সে আসলে একটু বেশিই ভাবছে। আরমানও হয়তো তাদের বিষয়টা সহজ করতে চায়। তাই একা দেখা করতে চেয়েছে। এখানে এসে আবার কাজিন, তাদের ওয়াইফকে নিয়ে ব্যস্ত হলে নিজেদের সময় কাটানো হবে কী করে!
***
আরমান আর মিরাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টের অংশে চলে আসে সায়েম এবং তুলতুল। মিতুল ওয়াশরুমে গিয়েছিল। ফারহানের কথাগুলো খুব গায়ে লেগেছে। ফারহান অবশ্য কড়া কথাগুলোর পরই আই লাভ ইউ বলেছে। অথচ লাইনটা শুনে মিতুলের গায়ে শিহরণের বদলে কানে সিসা ঢেলেছে। এখন তবে এমন ভাবেই ভালোবাসা পেতে হয়? কারও মনের মতো হয়ে মন পেতে হয়? মিতুল ফারহানকে কিভাবে বলবে, মিতুল জেদী, রাগী মেয়ে নয়। অভিমানী। অভিমানী মেয়েরা রাগী হয় না। ঝগড়ার সময়ও তাদের রাগী কণ্ঠের আগে চোখে পানি চলে আসে। মনে নিদারুণ কষ্ট, চোখের কোণে জল, আর কান্নায় লাল হয়ে যাওয়া নাক নিয়ে তারা অপেক্ষায় থাকে কখন মনে কষ্ট দেওয়া মানুষটা বুকে টেনে নেবে।
কিন্তু এই অভিমানী মেয়েগুলোই সবচেয়ে বেশি দৃঢ় হয়। মান অভিমানের পালা শেষে যদি তারা ভালোবাসা না পায়। তবে তাদের নরম কাঁদা মাটির মনটা পাথরের মতো শক্ত হতেও সময় লাগে না। এদের ভালোবাসা পেতে হলে ভালোবাসতে জানতে হয়। জোর খাটিয়ে আদায় করা যায় না।
(চলবে)