ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ২৪
“মিতুল, কী হইছে তোর?”
“কী আম্মু?”
“তোর চেহারার এমন হাল কেন? এমনি তো সবসময় সাজগোজের মাতামাতির শেষ নাই। রান্নাঘরে যা পাবি নিয়ে মুখে মাখবি। এই জন্য মানা করি সব মুখে দিতে না। ব্রণ উঠছে কয়টা দেখছিস? নাকের ডগায় ব্রণ বসে আছে। সারারাত মোবাইল টিপিস। চোখের নিচে কালি পড়ছে কেমন। চুল আঁচড়াস না কয়দিন?”
“পরীক্ষার চাপ আম্মু। রাত জেগে পড়ছি।”
“কী পরীক্ষা?” জীবনে কোনোদিন এমনে পড়ালেখা করতে দেখি নাই। এসএসসি এইচএসসি পরীক্ষার মত পরীক্ষার আগে তোকে কখনো এরকম রাত জেগে পড়তে দেখছি মনে পড়ে না। কত চিল্লাইসি পড়ার জন্য। এখন অনার্সে কী এমন লেখাপড়া করতেছিস? সত্যি করে বল মিতুল তোর কোনো কাহিনী আছে? মতিগতি আমার ভালো ঠেকতেছে না ক্যান?”
“আমার আবার কিসের মতিগতি? আর এখন পড়ালেখা করলে খারাপ? এইচএসসির সময় পর্যন্ত পড়ার জন্য মার খেলাম। সেই পড়ালেখার চেয়ে এখন চেহারা দামী? তাহলে তখন ভালো রেজাল্টের জন্য মারতে কেন?”
“পড়ালেখা করা খারাপ এই কথা তো বলি নাই। তোর চালচলনের কথা বলছি। কী বুঝাইছি তুই বুঝতে পারিস নাই এই কথা বলিস না। তোরা দুই বোন অ বললে অজগর বুঝিস। মিতুল সত্যি করে বল কলেজে কারো সাথে কোনো সম্পর্ক হয়েছে তোর? বিয়ের কথা শুরু হওয়ার পর থেকে এমন মরা চেহারা করে আছস। অথচ তোর এসব নিয়ে বেশি লাফালাফি করার কথা ছিল।”
“তাহলে এখন আমি আমার নিজের বিয়ে নিয়ে লাফালাফি করব? তখন তোমরাই বলবা আমি বেশরম।”
“শোন মিতুল, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দেই তুই আর এটা ভাবিস না যে তুলতুলের বাহানায় তুই আমাদের চাপ দিবি। তোর ইচ্ছামত কাজ হবে। শোন, বাবা-মা কখনো খারাপ চায় না। তুলতুলের খারাপ কিছু হইছে? শুরুতে যা একটু সমস্যা হইছে সেটা তুলতুল নিজের ঘ্যাড় তেড়ামির কারণেই হইছে। এখন কী সুন্দর সংসার করতেছে। বাবা-মার কথা শুনলে কেউ খারাপ থাকে না।”
“আপু তাহলে ভালো আছে? যদি ভালো থাকার মানে এটা হয় যে বাবার বাড়ির পথে ভুলে যাওয়া, কথা বলতে ভুলে যাওয়া। তাহলে আপু ভালই আছে। আর আমিও তাহলে ভালোই থাকব। আপনাদের কাছে যদি ভালো থাকা এটাই হয় আমারও কোন সমস্যা নাই। আমরা অ তে অজগর বুঝি আর যাই বুঝি, আপনারা তো বোঝেন আমাকে নিয়ে সন্দেহ করার কিছু নাই আম্মু।”
“না থাকলেই ভালো। শোন আমি না, রাতুল তোর সাথে যাবে।”
“রাতুল তো ছোটো মানুষ।”
“সেটাই তো। কিন্তু ফারহান বাবা মনে হয় মুরুব্বী কেউ যাক চায় না।”
“এই কথা কি উনারাই জানিয়েছেন?”
“ফারহানের মা বললেন। ফারহান এখন একটু একা কথা বলতে চায়। আমিও বললাম একদম একা তো পাঠাতে পারব না। রাতুলকে দেই।”
“রাতুল না আম্মু। আমি গেলে আপুকে সাথে করে নিয়ে যাব।”
“এটা ভালো বলছিস।তাহলে তুই তুলতুলের সাথে কথা বলে দেখ। আমিও তাহলে মনে হয় শান্তি পাই। একদম একা পাঠাতে চাই না। আমার তো এসব ঢং ই ভালো লাগে না। বিয়েশাদিতে মুরুব্বিরা যা ঠিক করবে তাই তো শেষ কথা। ফারহানের মাও কেমন গা বাঁচিয়ে চলে।”
“এসব ঢং মনে হলে বাদ দেওয়া যায় নাআম্মু? এমনিতেও তো এই প্রস্তাব নিয়ে দেখ কত অশান্তি। চাচা চাচী তো আমাদের ঘর আসাই বন্ধ করে দিয়েছেন একরকম। ফারহা আপু আমার সাথে আগের মতো কথা বলে না।”
“না বললে নাই। জেসমিন সারা জীবন বহুত নাটক দেখাইছে। আমি চুপচাপ দেখছি না। এখন সেও একটু দেখুক। একটু ভালো চাকরি, পড়ালেখা করে যে ভাব নিতো। আমি অল্প শিক্ষিত, গৃহিণী। আমি দিন দুনিয়ার কিছু জানি না। এমন ভাব যেন তার মেয়ে কোনো রাজকন্যা। দেখুক এখন, আমার মেয়েরাও কম না।সেদিন কত কথা শুনালো আমাকে। হইছে কে কী ভাবতেছে এসব তোর লাগবে না। তুই তুলতুলকে ফোন দে। মাথায় একটু তেল দিয়ে শ্যাম্পু টেম্পু কর। চুল তো চুল, চেহারা কেমন দেখা যাইতেছে তোর।”
চাচী আর মায়ের মাঝে এই দূরত্ব মিতুলকে যতটা না অবাক হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি অবাক হচ্ছে নিজের নরম সরম মায়ের এই রূপ দেখে। ফরিদা বেগম যে মনে মনে জেসমিনের প্রতি এমন একটা মনোকষ্ট পুষে রেখেছেন, হাসিমুখের আড়ালে তা চাপা দিয়ে রেখেছেন। আজ বুঝতে পারছে।
***
আরমান, মিতুলের ছবিগুলো ডিলিট করতে গিয়েও পারিনি। নিজের বিয়ে ঠিক হয়েছে, যার ছবি দেখছে দু’দিন পর সেই মেয়েও অন্যের স্ত্রী হবে। এভাবে তার ছবি দেখা অন্যায়। অথচ ডিলিট বাটন টিপতে গিয়েও পারে না। থাকুক কিছু সুন্দর স্মৃতি। ল্যাপটপের কোনো এক গোপন ফোল্ডারে।
মিতুলের চোখের উপর আঙ্গুল বুলিয়ে যায় আরমান। যদি বাস্তবেও এই চোখের পাতা ছুঁয়ে দেওয়া যেত। সেদিন বৃষ্টিতে মিতুলের চোখের পাতা ছুঁয়ে জল নামছিল। আরমানের অবাধ্য দু ঠোঁট তা ছুঁয়ে দিতে উন্মাতাল ছিল। কিন্তু নিজের অন্যায় খায়েশের লাগাম টানতে জানে আরমান। তবুও সেই তৃষ্ণা তো ভোলা যায় না। ফিতে কাটা টেপরেকর্ডারের মতো মাথার ভেতর বারবার সেই মুহুর্ত ঘুরতে থাকে। মিরার কথায় মন দেওয়া হয় না। বিয়ে নিয়ে মিরা আলোচনা করতে চায়। আঙটির জন্য আঙ্গুলের মাপ চাই। শেরওয়ানির রঙটা কেমন হবে? শাড়ি কি লাল নেবে না সোনালি। অথচ নতুন সূচনার এই গান নয়, বিচ্ছেদের বেহালার সুরই শুধু কানে বাজে।
এই শহরটাই বিচ্ছেদের। এখানে ধরে রাখার চেয়ে মানুষ ছেড়ে বাঁচাটাই আগে শিখে। প্রিয়র হাত আঁকড়ে ধরে রাখতে চাওয়া ব্যক্তিটাই এই শহরে সবচেয়ে নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। ধরে রাখতে গেলেই এখানে ব্যথা পেতে হয়। নিঃস্ব হতে হয়। তাই এখানে মানুষ ছেড়ে দেওয়াটাই আগে শিখে। বেঁচে থাকা তখন সহজ হয়ে যায়।
***
“ম্যাসেনজার দেখেননি?”
“না তো। কেন?”
“আঙটির ডিজাইন পাঠালাম। কোনটা পছন্দ হয় দেখেন। একসাথে গিয়ে কিনতেও পারেন। বিকেলে স্বর্ণের দোকানে যাব।”
“আমি এসব বুঝি না। তাছাড়া ছেলেদের এমনিও গোল্ড পরা নিষেধ।”
“কিন্তু এনগেজমেন্টের জন্য তো লাগবে। আকদ হয়ে যাবে ঐদিন। ফর্মালিটির জন্য তো লাগে। আচ্ছা আমার আঙুলের মাপও দিয়েছি। আমার আঙুল ভারী। মাপ মতো না নিলে হবে না। শুনছেন কী বলছি?”
“হ্যাঁ। আসলে এসব তো মা দেখবেন।”
“আপনি আসবেন না? বসুন্ধরায় যাব।”
***
“কী ভাই? হঠাৎ আজ আমাকে ফোন?”
“ভাই এই কথা বলো না। কাজিনদের ভেতর একমাত্র তুমিই সেই যার সাথে নিয়মিত কথা বলি।”
“হুম। সেটা তখন যখন তুমি মিয়া কোনো চিন্তায় থাক।”
“তুমি তো জানো, আমার ঐ ভাবে কখনো কোনো বন্ধু হয়ই নাই। আম্মা এত বেশি আগলে আগলে রাখেন স্কুলে। এরপর কলেজ, ভার্সিটি পর্যন্ত সেই রেশ টেনে গেলাম। যা দরকার আম্মা করে রাখতেন। বাকি বিষয়গুলো আপা দেখতেন। আমি কবে এমন একা হয়ে গেলাম নিজেই বুঝিনি। তুমি ব্যস্ত হলে থাক।”
“আরে সায়েম। আমি মজা করলাম ভাই। কী হয়েছে বল। স্যরি স্যরি।”
“না ঠিক আছে ভাই। তোমারও সামনে বিয়ে। কাজ আছে অনেক।”
“কোনো কাজ নাই। এমনিতে আমার নিজেরও কারও সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল।”
“তোমার কী হয়েছে? বিয়ে নিয়ে আপত্তি আছে?”
“এমনি গল্প করতে ইচ্ছে করতে পারে না? কিন্তু বারবার বিয়ের কথা টানার কারণ কী? ভাবির সাথে কোনো সমস্যা?”
“সমস্যা আমার নিজের। আসলে তুমি তো জানো। আম্মু, আপা সবসময় এত আদরে রাখছেন। আমি আসলে আহ্লাদ পেয়ে অভ্যস্ত। বিবাহিত জীবনটা এমন মনে হচ্ছে না।”
“হওয়ার কথাও না। সারাজীবন লেখাপড়া নিয়ে থাকা, কোনো প্রেম ঘটিত ঘটনায় না থাকা তুমি আইডিয়াল ছেলে। কিন্তু মেয়েদের কাছে আইডিয়াল স্বামী হওয়ার ক্রাইটেরিয়া মনে হয় এটা না। এ বিষয়ে যদিও আমার কোনো অভিজ্ঞতা নাই। আমার অবস্থা তোমার চেয়েও খারাপ। কিন্তু এটা বুঝি, মা বোনের ভালোবাসা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আসে। পার্টনারের ভালোবাসাটা অর্জন করে নিতে হয়। তেমার মনে যেহেতু ভালোবাসার চাহিদা জেগেছে এ পর্যায়ে এসে। তাহলে দাম্পত্যে তুমি তার কমতি অনুভব করছ। সময় দাও ভাই নিজেদের। স্ত্রীকে সময় দেওয়ার মানে মা বোনকে অবহেলা না। ভাবি তোমার সময় ডিজার্ভ করে। আজ তো ছুটিরদিন। বাইর কোথাও যাও।”
“আমিও তাই ভাবছি। কেমন জানি একটা মানসিক দূরত্ব। তুলতুল মেয়ে খারাপ না। আমিও ভাই ছেলে খারাপ না। কিন্তু মাঝেমাঝে রাগের বশে হার্ট করে ফেলি।”
“রাগটা কোথায় দেখাও এটাও বিষয়। আমার মনে হচ্ছে তুমি চাচী, শেলী আপা ওনাদের সামনে ভালো থাকতে স্ত্রীর উপর চোটপাট কর। ভুল বললাম? এটা কর না। সবারই আত্মসম্মান আছে।”
“থ্যাংক ইউ ভাই। মন হালকা লাগছে। আজ এমনিও বাইরে যাওয়ার সুযোগ আছে। তুলতুলের ছোটো বোন মিতুলের বিয়ের কথা চলছে। আজ বিকেলে যমুনায় যাওয়ার কথা। আঙটি পছন্দ করবে, ছেলে একটু বসে কথাও বলতে চায়। এটা ভালো আসলে। আমার বিয়ের সময় এসব বুঝিই নাই। আম্মু আর আপা পছন্দ করলেন। গিয়ে বিয়ে করে ফেললাম। আজকাল কেউ এমন করে? অন্ততঃ ফোনে তো কথা বলা দরকার ছিল। সম্পর্কের শুরুই হলো মানসিক দূরত্ব দিয়ে।”
“যনুনায় যাচ্ছ তাহলে? কোন জুয়েলার্স?”
“জড়োয়া হাউসে।”
“আমারও তো মিরার সাথে যাওয়ার কথা। আঙটি দেখতে।”
“তাই? ভালোই হলো। দেখা হবে হয়তো তাহলে।”
“হ্যাঁ দেখা হবে।”
ফোন রেখে আরমান মিরাকে টেক্সট করে, “বসুন্ধরা না, চলেন যমুনায় যাই। জড়োয়া হাইসে। ওখানে চা কফি খাওয়ার ভালো প্লেস আছে। দূরে মনে হলে আপনি চাইলে সাথে কাউকে নিয়ে আসতে পারেন।”
মিরা ফিরতি টেক্সটে জানায়, “আপনি বাইক নিয়ে এসে নিয়ে যেতে পারবেন না? আমি মেইন রোডেই দাঁড়ালাম।”
“ওকে।”
(চলবে)