ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-২৩

0
73

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ২৩

(এই পর্বকেও রোমান্টিক বলাই যায়? নাকি মান অভিমানের?)

“চা খাবে?”

“চা? আচ্ছা দাও।”

তুলতুল নিজ থেকে চা দিতে চাওয়ায় সায়েম অবাক হয় একটু। ইদানীং খেয়াল করছে শুরুর দিনগুলোর মতো তুলতুল আর গায়ে পড়ে সায়েমের কোনো কাজ করে না।
না সেই ক্ষুব্ধ ভাব, অভিমানী চোখ, অযথা ঠোঁটের ভাঁজে রাগের কিছুই আর নেই। বরং বড়ো বেশি শান্ত, নির্মোহ, নিস্পৃহ। যেন সায়েমের কাছে নিজেকে আলাদা করে প্রকাশ করার কিছু নেই। অথচ বিরহে আছে তাও নয়। গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে তুলতুলকে চুল আঁচড়াতে দেখেছে বহুবার। তুলতুলের দীঘল কালো চুলে নাক ডুবিয়ে সেই গান শুনতে সায়েমের মনে যে কখনো খায়েশ হয়নি তা নয়। সে তো সাধুসন্ন্যাসী নয়। কিন্তু শারীরিক বিষয়ে তুলতুলের সেই রূপ খুঁজে পায় না। না ঠেলে সরিয়ে দেয়, না প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরে। স্ত্রীর কাছ থেকে গভীর আলিঙ্গনের সময় পাওয়া এমন নিষ্প্রাণ আচরণ মাঝেমাঝে সায়েমকে বিরক্ত করে তোলে, কখনো হতাশ। অথচ অন্য সময় তুলতুলকে এমন লাগে না। ছবি দেখছে, হাসছে সবকিছু স্বাভাবিক। তার জীবনে যেন সায়েমের আলাদা করে কোনো প্রয়োজন নেই। সায়েম না থাকলেও সে যেমন খুশি, সায়েম থাকলেও তেমন। সায়েমের উপস্থিতি আলাদা কিছু নয়। সায়েম সন্দেহ করার মতো কিছু পায় না। তবুও গোপনে ফোন ঘাটে। তুলতুলের ফোনে যেন গোপন কিছুই নেই। কোনো পাসওয়ার্ড দেওয়া নেই। চ্যাটবক্সে মিতুলের সাথে ফোনে কথা বলার হিস্ট্রি। বান্ধবীদের কাছ থেকে ক্লাস নোট নেওয়ার ছবি। এর বাইরে কিছু নেই। তুলতুলের ফেসবুকেও যেন নেই সায়েম। সেই বিয়ের ছবিটা প্রোফাইল পিকচারে দেওয়া। বাকি নৈমিত্তিক সব গাছ, ফুল, নিজের দৈনন্দিন জীবননামা। যাতে সায়েমের অস্তিত্ব নেই।

অবশ্য সায়েম কিছু করতে বললে তুলতুল অবহেলা করে না। কিন্তু ঐ যে বলতে হয়। বললেই শার্ট প্যান্ট আয়রন হয়। আলমারি গুছিয়ে দেয়। চা বানিয়ে আনে, পানির জগটা ভরে এনে কামরার দরজা লাগায়। না বললে দরজাটাও লাগায় না। সারাদিন হাট করে খোলা থাকে। যেন তাদের মাঝে প্রাইভেসির কোনো বালাই নেই, প্রয়োজন নেই।

“চা।”

তুলতুলের বাড়ানো চায়ের কাপে সায়েমের ধ্যান ভাঙে।

“আজ কী হলো হঠাৎ। না চাইতেই চা। এমনিতে তো এই রুমে যে একজনের অস্তিত্ব আছে। তুমি বোধহয় তাই ভুলে যাও।”

“এমন কেন বলছেন? কিছু লাগবে? বললেই তো করে দেই। চা দিতে মা বললেন। বললেন জিজ্ঞেস করতে চা খাবেন কিনা?”

“তাই তো বলি, তুমি নিজ থেকে কেন খেয়াল করবে। চাইতে হবে। কাজ থেকে আসি যখন মাথা ভার হয়ে থাকে। চা পেলে ভালো লাগে।”

“আপনি চান খেয়াল রাখি? চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পছন্দ হলো না যে। প্রথম প্রথম নিজ থেকে চা বানিয়ে আনতাম। মা বিরক্ত হতেন। অসময়ে সন্ধ্যায় চা খেলে আপনার ঘুম হবে না বলতেন। আপনি তো তখন বলেননি যে চা খেলে ভালো লাগে। অথচ আমার মনে হতো অফিস থেকে ফিরে এককাপ চা পেলে আপনার ভালো লাগবে। কিন্তু বুঝেছিলাম ভুল ভাবছি। এরপর দেখতাম আপনিই চা চান। কিন্তু আমার কাছে না, মায়ের কাছে। মা আমাকে বানিয়ে দিতে বলে। আমি বানিয়ে আনি। বাকি বিষয়গুলোও তাই। খেয়াল ভেবে যা করি, তা বিরক্তির কারণ হয়ে যায়। গুছিয়ে রাখলে খুঁজে পান না। মা হাত না দিলে তা ঠিক মনে হয় না। এভাবে খেয়াল রাখা যায়?”

সায়েম একটু বিব্রত হয়ে যায়। মনে পড়ে একদিন একটু রাগ দেখিয়েই বলেছিল, ওর কাজগুলো করার আগে তুলতুল মাকে দেখিয়ে নেয় না কেন। জিনিস নতুন জায়গায় রাখলে সায়েম খুঁজে পায় না। তুলতুল বলেছিল সায়েম কী কিভাবে চায় তা বললে সে সেভাবে অবশ্যই করবে। কিন্তু সায়েমই এ নিয়ে আগ্রহ দেখায়নি। ঘরোয়া কাজ মেয়েলী মনে হয়। তুলতুল নিজ থেকে করতে গেলে জান্নাত আরার ঠিক মনে হয় না, একই কাজ ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে নেড়ে চেড়ে বলবেন এবার ঠিক হলো। তাই এখন তুলতুল না বললে হাতই দেয় না।

জান্নাতের আরা ভেবেছিলেন তুলতুল শাশুড়ির সাথে পাল্লা দিতে স্বামীর কাজে ভাগ চাইবে। যেভাবেই হোক সায়েমের পছন্দের রান্না, সায়েমের কাজগুলো করে হলেও সায়েমের কাছাকাছি যেতে চাইবে। যেভাবে দশজন মন জেতার চেষ্টা করে। কিন্তু তুলতুল সেদিকে হাঁটলই না। শাশুড়ির সংসার নিজের করে পাওয়ার চেষ্টা অথবা সায়েমকে জয় করার লড়াইয়ে নামার বদলে বরং নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত হলো। এমন না যে সংসারের কাজ করে না। কী করতে হবে তা নির্ধারিতই থাকে। বাকিসময় নিজের মতো করে রুম গোছায়। জান্নাত আরা সেখানেও হাত দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তুলতুল কোনো চাদর বিছালে বলতেন মানায়নি। অযথাই বদলাতেন। অথচ তুলতুলকে দেখে মনেই হতো না এতে তার কিছু আসে যায়। অযথাই জান্নাত আরার পরিশ্রম পণ্ডশ্রম। অবসরে বারান্দার গাছের যত্ন নেয়। নিড়ানি দেয়, পানি দেয়। সায়েমের সাথে গল্প করার যেন কোনো আগ্রহই আর বাকি নেই। সায়েম মায়ের রুমে গিয়ে গল্প করে। মাঝেমাঝে আগ্রহ নিয়ে দরজায় তাকিয়ে দেখে তাদের গল্পের মাঝে অনাহূত অতিথি হয়ে তুলতুল কি আসতে চায় কিনা। কিন্তু না, তুলতুল সেই সময়টা পড়তে বসে। মাঝেমধ্যে জান্নাত আরা নিজেই ডেকে এটা সেটা দিতে বলেন। তুলতুল দিয়ে চলে আসে। দাদী শাশুড়ি তুলতুলকে বোঝার চেষ্টা করেন। নাত বৌয়ের এই নিরামিষ আচরণ দেখে হতাশও হন। ভেবেছিলেন বৌ শাশুড়ি ভালো দ্বন্দ্ব দেখবেন। অথচ এই মেয়ে যেন উল্টো পথে হাঁটে।

স্বস্তিতে জান্নাত আরা নিজে আছেন তাও নয়। তুলতুল কয়েকদিন নিজের মতো রাঁধতে গিয়েছিল। আগে কিছুই বলতেন না। খেতে বসলে বলতেন সায়েম এই খায় না, তিনি আজ এটা খাবেন না মুখে রুচি নেই, একটু জলদি ভর্তা করে নিতে। এখন কী রান্না হবে তুলতুল তা জান্নাত আারাকে আগেই জিজ্ঞাসা করে নেয়। সায়েমকে ম্যাসেজ করে জানায় এই এই রান্না হবে, খাবে কিনা না অন্য কিছু রাঁধবে। বিষয়টা আপাত দৃষ্টিতে স্বস্তিদায়ক মনে হলেও ঠিক তা নয়। এ যেন মুখোমুখি না দাঁড়িয়েও এক ধরনের বিরোধিতা করা। অপরপক্ষে যতই কোমরে আঁচল গুঁজে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হোক না কেন এ পক্ষ ততটাই নিঃস্পৃহ।

“তুলতুল, দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে এসো। আচ্ছা না থাক। তুমি বসো। আমিই লাগিয়ে দিচ্ছি। আজ তোমার সাথে চা খাই।”

এসময়টা চা হাতে সায়েমের মায়ের ঘরে গল্প করতে যাওয়ার কথা। সায়েমের জন্য চা বানানোর সময় নিজের জন্যও এককাপ বানায় তুলতুল। পড়তে পড়তে চা খেতে ওর ও ভালো লাগে। নিজেকে ভালো রাখার এই পথগুলো তুলতুল নিজেই আবিষ্কার করে নিয়েছে। সেদিনের সেই রিকশাওয়ালা মামার কথার পর থেকে তুলতুলের মাঝে অনেক পরিবর্তন এসেছে। যাদের কাছে তার চোখের পানির মূল্য তৈরি হয়নি, তাদের নেক নজর পাওয়ার জন্য কান্না করে অর্থ শুধু নিজের উপর জুলুম করা।

“আজ আমার সাথে চা খাবেন যে?”

“চা খাব না। গল্প করব। তুমি তো অনেক গল্প করতে পারো। তোমার বান্ধবীরা বলেছিল তুমি নাকি মারাত্মক বুদ্ধিমতী, বাকপটু। এত মজা করে গল্প বল যে হেসে পেটে খিল ধরে। মিতুলের সাথে ফোনে গল্প করার সময় কী চমৎকার করে হাসো। আমার সাথে তো এমন করো না। তাছাড়া বিয়ের এতোদিনেও তুমি করে বললে না। কেন?”

“কেন? আমি যদি বলি আজ হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন? কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম। সেটা বেয়াদবি হিসেবে গণ্য হলো। আমার বুদ্ধি আমারই জন্য কাল হলো। বেশি বোঝা শুরু করলাম। কিন্তু সঠিক সময়ে তার লাগাম আপনিই টেনেছেন। আপনিই বুঝিয়েছেন আপনার উপর আমার অধিকার কতটুকু। ততটুকু যতটুকু না দিলে আপনি থেকে তুমিতে আসা যায় না। আমাদের কথা বলার জন্য ঘরের দরজা বন্ধ করার দরকার কোনোদিনই ছিল না। কেননা সম্পর্কের ভেতর কিছু আগল থাকলেই চলে। আমার জন্য আপনার শাসন বারণ এই দরজার এপাশেই সীমাবদ্ধ থাকতে পারতো। তাকে ড্রয়িং রুমে নিয়ে গিয়ে সবার কিন্তু আপনিই করেছেন।”

“তুমি তাহলে মনের ভেতর এসব পুষে রেখেছ?”

“পুষে রাখিনি। তবে নিজের সীমা কতটুকু তা মনে রেখেছি।”

“এতো অভিযোগ হলে এত কাছাকাছি থাকা কেন। একই বিছানায়। বাহুডোরে? ভালোবাসা নেই তাতে?”

“সেই বাহুডোরে ভালোবাসা টের পান? কিছু বিষয় দায়িত্বের সাথে সাথে। অধিকারের সাথে আসে। আর তাতে ভালোবাসা আছে কিনা তা জোর গলায় বলা যায় না। প্রত্যেকটা মানুষের ভালোবাসার একটা আলাদা রূপ আছে। কেউ ঝগড়ার মাঝেও ভেজা চোখে ভালোবেসে যায়। কেউ দৈনন্দিন সব কাজের ফাঁকে নিজের মানুষটার চোখে একটু ভালোবাসার খোঁজ পেতে নানা ছুতোয় বারবার সামনে আসে। অযথাই কপালের টিপটা ঠিক করে। আঁচড়ানো চুল আবার আঁচড়ায়। ঘর্মাক্ত নিজের মানুষটা যখন দিনশেষে ঘরে ফিরে, তার কপালে জমে থাকা ঘামের ফোঁটায়ও কিন্তু ভালোবাসা থাকে। ভালোবাসার জন্য শরীর কাছে আসা লাগে না সবসময়। তবে হ্যাঁ গভীর ভালোবাসার পর যখন শরীর কথা বলে, তার ভাষা অনেক বেশি সুন্দর হয়। আহ্লাদী তরুণী হোক, বা বাস্তবতার আঘাতে ক্লিষ্ট তরুণ। দিনশেষে সবাই ই নিজের মানুষটার কাছ থেকে শুধু শারীরিক স্পর্শ না, বরং উষ্ণ অভ্যর্থনা চায়। একটা আদুরে আলিঙ্গন চায়। সবার সামনে প্রয়োজন নেই। ভালোবাসা লোক দেখিয়ে করতে হয় না। আড়ালেই একটু জড়িয়ে ধরা, কপালের ঘামটুকু মুছে দেওয়া, কখনো একটা নির্দোষ চুমু। এইটুকু নিয়েই জীবন কাটানো যায়। রোজ ঘড়ি ধরে গল্প করতে হয় না। কাজের ফাঁকে একটু খুনসুটি, এক কাপ চা খেতে খেতে দুটো ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করতে পরিবারের বাকিদের ভুলেও যেতে হয় না। হানিমুনে না নিলেও চলে। কিন্তু মাঝেমধ্যে বাইকের পেছনে বসিয়ে একটু বাইরে গলি পর্যন্ত নিয়ে যেতে, হুড খোলা রিকশায় বসে বৃষ্টি বিলাস করতে, ছাদে বসে চাঁদ দেখতে কিংবা মোড়ের টং এ চা খেতে খরচ লাগে না। লাগে একটু ইচ্ছে। এইটুকু করতে পারলে ভালোবাসা কারও চেয়ে নিতে হয় না। এমনিই আসে। হুড়মুড়িয়ে বর্ষার হঠাৎ বৃষ্টির মতো।”

তুলতুল উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয়।

“যান, মা ডাকছে। অপেক্ষা করছেন আপনার।”

ডাকটা সায়েমের কানেও গিয়েছে। কিন্তু আজ কেন জানি উঠে যেতে ইচ্ছে করছে না। নিজের হেলায় সুন্দর কিছু অনুভূতি কি জীবন থেকে হারিয়ে ফেলছে?

এতদিন মনে হতো নারীদের অস্ত্র হলো অযথা দুর্বোধ্য অভিমান, আর চোখ ভরা জল। অথচ আজ মনে হচ্ছে কিছু অভিমানের ভাষা বোঝা খুব কঠিন কিছু না। তবে একটু সময় নিয়ে চিনতে হয়। যদি একটু নরম হলে, একটু আদরে জড়িয়ে নিলে কিছু অভিমান ইতি হয়। তবে সেইটুকু না করাটাই অপরাধ।

সঙ্গমের সময় সঙ্গীকে বুকে জড়িয়ে নেওয়াটাই ভালোবাসা নয়। বরং মাঝেমধ্যে এমনিতে বুকে জড়িয়ে সঙ্গীর না বলা শব্দগুলো বুঝে নিতে হয়। এতে সম্পর্ক সহজ হয়, একে অপরকে তখন ভালোবাসতে শুরু করে। সম্পর্কে পালতে হলে ভালোবাসাটাই পালতে হবে, অভিমান নয়। এতে বরং সম্পর্কটা ক্ষয় হয়।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে