ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ২২
মিতুল কলেজের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। রাস্তায় একটাও খালি রিক্সা পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ বাসায় তাড়াতাড়ি যাওয়া দরকার। মায়ের শরীরটা ভালো না। আজ কলেজে আসতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার ডেট ছিল আজ। ডেট মিস করলে মার্কস কাটা যাবে। তাই বাধ্য হয়ে এসেছে। ভেতরে ভেতরে একটু অস্থিরতা বোধ করছি মিতুল। গতকাল রাতে রফিক সাহেব জানিয়েছেন ফারহান মিতুলের সাথে আলাদাভাবে কথা বলতে চায়। কোনো একটা রেস্টুরেন্টে বসতে চায়। মিতুলকে ফরিদা বেগম নিয়ে যাবেন।
যদিও আলাদা করে কথা বলার কী আছে রফিক সাহেব বোঝেন না। বিয়ে-শাদীর ব্যাপারে মুরুব্বিরা যা ঠিক করবেন তাইতো হবে। হ্যাঁ ছেলের অবশ্যই মেয়ে পছন্দ করার বিষয় আছে। কিন্তু এই ছেলে মেয়ে আলাদা করে কথা বলার তর তরিকা উনার পছন্দ না। কিন্তু তুলতুলের ঘটনার পর জোর গলায় নাও করতে পারছেন না। যদিও এখন মনে হচ্ছে স্ত্রী ফরিদা ঠিকই বলেছেন। এসব তো ভাগ্যের বিষয়। কার স্বামী রগচটা না হয়ে ঠান্ডা হবে কার স্ত্রী শুধু দেখতেই ভালো না, সাথে গুণবতীও হবে, এগুলো তো মানুষের হাতে থাকে না। কিছু জিনিস কপালেও থাকে। আর সায়েম তো খারাপ ছেলে নয়। বরং ছেলে মানুষ তো এমনই হয়। আজকাল মেয়েদের ভেতরেই বরং ধৈর্য কমে গেছে। এই যে এখন তুলতুল ধৈর্য ধরে সংসার করছে, সব কী সুন্দর ঠিক হয়ে গেছে। তুলতুলের কোনো অভিযোগ নাই, ওকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ির নালিশ নাই। মিতুলের ক্ষেত্রেও তাই হবে যদি মিতুল ফারহার বিষয়টা গুরুত্ব না দিয়ে বিয়ের পর স্বামীকে নিজের করে নিতে পারে। তাহলে অন্য কিছুতে কিছু যায় আসে না। মিতুল আর ফারহার আলাদা জায়গায় বিয়ে হয়ে গেলে কয়েকবছর পর এসব কারও মনেও থাকবে না। দেখাই হবে কয়দিন। আপন বোনে দেখা হয় না মাসে। এখানে তো চাচাতো বোন। শুরু শুরুতে একটু পারিবারিক গ্যাদারিং গুলো এড়িয়ে গেলেই হবে।
আর ভাই ভাই একদিন এমনিতেই আলাদা হয়। তিনি আর শফিক সাহেব তো আগেই আলাদা হয়েছেন। এখন সামান্য মন কষাকষিতে কী যায় আসে। যার যার আলাদা পরিবার। বরং ফারহানের পরিবারের জাঁকজমক দেখে মনে মনে রফিক সাহেব সন্তুষ্ট। সায়েমের চাইতেও ভালো পরিবারে বিয়ে দিচ্ছেন ছোটো মেয়ের। সায়েমের পরিবার তো নিজেদেরকে হনু ভেবে একটা ভাব দেখাচ্ছিল। এখন তারাও বুঝবেন তাদের চাইতেও ধনী পরিবার, যোগ্য ছেলে উনার মেয়েদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক করতে আগ্রহী। এটা কি কম বড় জবাব দেয়া হলো? বাকি অন্যদের ইচ্ছা অনিচ্ছাটা এখানে বড় কোন বিষয় না। তারপরও ছেলে যখন চাইছে আলাদা করে বসুক একদিন। মিতুলের মা না হয় সাথে যাবে। ছেলেও কি আর একা আসবে? পরিবারে কেউ তো সাথে আসবেই নিশ্চয়ই। তাই নিমরাজি হয়েছেন।
এদিকে মিতুলের অবস্থা খারাপ। এটা কি প্রেম নাকি শুধুই পাগলামি অনুভূতি জানা নেই। তবু সেই অজানা অনুভূতির জ্বালায় মিতুলের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছে। সেদিনের পর থেকে আরমানের নামের পাশে সবুজ বাতি জ্বলে না। যখন তখন হুটহাট ম্যাসেজ আসে না। মিতুল এলোমেলো কথা লিখে, একা একা বিশাল বিশাল রচনা লিখে, ঝগড়া করে গদ্য লিখে। কিন্তু সেন্ড বাটনে চাপ দেওয়া হয় না। আরমানের মনে কষ্ট দিয়েছে, ক্ষমা চাওয়া উচিত। কিন্তু স্যরির কথা লিখতে গেলেই কেমন ভালোবাসার কথামালা হাত জড়িয়ে নাকি কান্না করতে থাকে।
“ওদিন আমি কথাটা এভাবে বলতে চাইনি। আমার ভুল হয়েছে। আপনাকে মনে কষ্ট দিয়ে থাকলে মাফ করে দিয়েন।” এই লাইন লিখতে গিয়ে মিতুল লিখে,
“এই ব্যাটা, এত ভাব কেন? কী এমন বলছিলাম যে ভাব নিচ্ছ? জানো না মেয়েদের সাথে ভাব নেয় কাপুরুষেরা। মেয়েরা রাগ করলেও তাদের সাথে গরম হতে নেই। এই কথাটা কেউ আপনাকে বলেনি? আমি তো রেগে ছিলাম। আপনি বুঝি একটু ভালোবেসে কথা বলতে পারেননি। আমাকে ক্ষেপিয়ে দিয়ে এলোমেলো কথা বলানোর দরকার ছিল? এখন আবার কথা বন্ধ রেখেছেন। আমার কষ্ট হয় না? আমায় অন্য কেউ নিজের করে নিয়ে গেলে তখন বুঝবেন। অবশ্য কী আর বুঝবেন। আপনি তো এখন মিরার স্বপ্নে বিভোর।”
এসব কী লিখছে দেখে হতভম্ব হয় মিতুল। অতঃপর ম্যাসেজও আর পাঠানো হয় না।
*** মিতুল রাস্তা ধরে এগিয়ে যায়। মেইনরোডে গিয়ে দেখতে হবে কী আছে। ছাতার পক্ষে এই বৃষ্টির ছাট আটকানো অসম্ভব। ভিজে যাচ্ছে মিতুল। হঠাৎ একটা বাইক এসে পাশে ব্রেক কষে। মিতুল ভয় পেয়ে যায়। বখাটে কেউ নয়ত? মাথা থেকে হেলমেট খুলে আরমান বলে,
“কিছু পাবে না এখন। বাইকে উঠো। নামিয়ে দেই।”
মিতুলের মন চায় লোকটাকে দুটো লাগাতে। অথচ বিনা বাক্য ব্যয়ে সুর সুর করে বাইকে উঠে বসে।
“একদিন বোধহয় শিখিয়েছিলাম, বাইকে কিভাবে বসতে হয়। ভুলে গিয়েছ বোধহয়। অবশ্য সামনে চার চাকার মালকিন হবে। বাইকে বসা না শিখলেও চলবে।”
মিতুল নেমে দাঁড়িয়ে যায়।
“ঠিকই বলেছেন। আপনি বরং মিরাকে শেখান।”
আরমান মিরার কথা শুনে অবাক হয়। মিতুল মিরাকে হিংসে করছে?
“সে তুমি বিয়ের পর শিখে নিও। আমিও যাকে শেখানোর শিখিয়ে নেব। এখন আপাততঃ এই দুই চাকার বাইকে বস।”
মিতুল সামনের দিকে হাঁটা শুরু করছে দেখে আরমান মিতুলের হাতটা টেনে ধরে। বিদ্যুৎ চমক খেলে যায় মিতুলের দেহ মনে। এক মুহূর্তের জন্য অবশ লাগে শরীর।
“আই অ্যাম স্যরি। আচ্ছা আর কিছু বলব না। যেভাবে বসার বস। আসো নামিয়ে দেই। তুমি বৃষ্টির পানি সহ্য করতে পারো না। নির্ঘাত জ্বর বাঁধাবে।”
এরপর আর না করা যায় না। মিতুল উঠে বসে। আরমান বাইক টান দিতেই শার্টের কোনা খামছে ধরে।
“এই জন্য ঠিক করে বসতে বলেছি। ব্যাগটা মাঝে দিয়ে বস। গায়ে গা লাগবে না। তুমিও অস্বস্তি অনুভব করবে না। আমিও নিজের মতো চালাতে পারব। ভয় পেও না, আমি তোমাকে পড়তে দেব না।”
মিতুল মনে মনে বলে, “আমি তো পড়তেই চাই। প্রেমে পড়তে চাই। অথচ আপনিই মাঝে দেওয়াল তুলে দিয়ে বলছেন পড়তে দিবেন না। ঠিক আছে দিয়েন না।”
মিতুলের মনের কথা তো আর আরমানের শোনা হয় না। বাইকের গ্লাসে শুধু এক তরুণীর বৃষ্টি ভেজা নির্মল মিষ্টি মুখ আড় চোখে দেখে আর ভাবে,
“আমি ভবঘুরে একজন মিতুল। আমার সাথে তেমার জীবন অনিশ্চিত ভেলা। তোমার সিদ্ধান্তই সঠিক। এত মিষ্টি সুন্দর একটা মেয়ে তুমি। তুমি এমন কাউকেই ডিজার্ভ কর যে এমন বৃষ্টির দিনে তোমাকে লং ড্রাইভে নিয়ে যেতে পারবে। বৃষ্টির একটা ছাটও তোমার গায়ে লাগতে দিবে না। ভিজে জ্বর উঠতে দিবে না। তবু আজ এই বৃষ্টির দিনের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। রোজ তোমার কলেজের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকার কী এক অদ্ভুত রোগে পেয়েছিল। হয়তো আজকের এই দিনটির জন্যই। এমন একটা দিন পাব বলেই। এক তরফা ভালোবাসতে সবাই পারে না মিতুল। তবে আমি খুব ভালো করেই পারব। হয়তো একটা সময় আমাদের সমস্ত যোগাযোগ পথ বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের সম্পর্ক কোনো নাম পাওয়ার আগেই শেষ হয়ে যাবে। তবু তখনও আমি তোমাকেই ভালোবেসে যাব।’
***
” আপনি এখানে কী করছিলেন?”
“একটা অকাজে এসেছিলাম।”
“অকাজে? বুঝেছি। আচ্ছা আপনি আমার সাথে স্বাভাবিক কথা বললে কী হয়?”
“আরে সত্যি অকাজে এসেছিলাম। এক বন্ধুর বাসায় আড্ডা দিলাম। আমার অনেক ফ্রি টাইম যে।”
“আপনার পেজ দেখেছি। অনেক সুন্দর হয়েছে আলতা দীঘির ছবিগুলো। আপনার তো অনেক ফলোয়ার।”
“আমার না, ছবির ফলোয়ার।”
“ছবি তো আপনার তোলা। আপনি ছবি তোলা পেশা হিসেবে নেন না কেন?”
“নিয়েছি তো। তবে আমার পেশাটা আলাদা। আমার রুটিন জব ভালো লাগে না। আমি যাযাবর ধরনের মানুষ।”
“যাযাবর রা তো সংসারী হয় না। আপনি তো বিয়ে করছেন।”
“বিয়ের পর বৌ যায়াবরের সংসার হবে। বেদেদের মতো একবার এক জায়গায় খুঁটি গাড়ব।”
মিতুলের খুব কান্না পায়। বলতে ইচ্ছে করে, “এই খারাপ লোক শোনেন। ছোটোবেলা থেকে আমারও খুব জিপসি হওয়ার শখ। আমাকে আপনার সঙ্গী করে নেন। আপনার সাথে সূর্য ডোবা দেখব। আলতা দীঘি দেখব। খোলা মাঠের শিশিরে পা ভিজিয়ে হাঁটব। এমন বৃষ্টির দিনে খুব ভিজব। ভিজে জ্বর বাঁধাব। আপনি আমাদের অস্থায়ী কুটিরে আমার মাথায় জলপট্টি দিয়ে সেই জ্বর নামাবেন। আমার চার চাকা চাই না। আপনার সাথে এই দুই চাকার বাহনেই সংসার পাতব।”
(চলবে)