#ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে
পর্ব ৪
বরপক্ষকে খাবার বেড়ে দিচ্ছে মিতুলের চাচা। বাবা পাশেই আছেন। বর সায়েমের একপাশে বোন আর মা বসেছেন, অন্য পাশে তুলতুল। মিতুল, ফারহাসহ অনান্য শ্যালকশ্যালিকা তুলতুলের মুখে খাবার তুলে দিতে বলছে। তারাও অপেক্ষায় আছে দুলাভাইয়ের সাথে সাগরানার প্লেট থেকে খাবার খাওয়ার। মিতুলের হাতে হাত ধোয়ানোর জন্য বাটি আর সাবান, ফারহার হাতে জগ। দুলাভাই গেটে টাকা নামমাত্র দিয়েছেন। মাত্র তিন হাজার। অবশ্য দুলাভাই না, টাকা দিয়েছেন তার বড়ো বোন শেলী আপা। আপার জাদরেল কণ্ঠের কাছে এই বাচ্চা বাচ্চা মেয়েরা কিছু বলতেই পারেনি। চুপচাপ টাকা নিয়ে গেট ছেড়ে দিয়েছে। এখন এই হাত ধোয়ানো, জুতা চুরির মাধ্যমে তা শোধ করতে হবে।
“এই তোমার নাম কী যেন?”
সায়েমের মা জান্নাত আরা প্রশ্ন করেন।
“মিতুল খালাম্মা।”
“খালাম্মা কী। আন্টি বল। তা তোমার বোন নিজ হাতে খেতে পারে না?”
মিতুলের গলা ভয়ে শুকিয়ে যায়। জান্নাত আরা এমন ধমকে কথা বলছেন কেন?
“জি পারে।”
“তাহলে সায়েমকে খাইয়ে দিতে বলছ কেন? ভাই সাহেব এসব কী আদিখ্যেতা? সমাজ নাই? মুরুব্বিদের সামনে এসব ঢং করবে? আপনি না বলেছেন আপনার মেয়েরা খুবই লক্ষী, ভদ্র?”
মিতুলের বাবা রফিক সাহেব মিতুলকে এখনি সবার সামনে একটা রামধমক দিবে মিতুল জানে। ইতোমধ্যে ফারহা জগ নিয়ে গায়েব। সায়েমের বাবা জলিল সাহেব স্ত্রীকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করেন।
“আরে থাক না জান্নাত। ছোটোমানুষেরা শখ করছে।”
“রাখ শখ। আবার সাবান, জগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পদ পদে দুলাভাইয়ের কাছ থেকে টাকা বের করার ধান্দা। পেটে পেটে এত বুদ্ধি। এই শোনো জুতা টুতা চুরি করার কোনো নাটক ফাটক করবানা বলে দিলাম।”
“আন্টি আমিই বলেছি। ছবি তুলছি তো।”
আরমান খাবার টেবিলের কাছে চলে এসেছে ক্যামেরা হাতে। মায়ের মেজাজ খারাপ হচ্ছে দেখে সায়েম ইশারায় আরমানকে ডেকে নিয়েছিল।
“তুমি না খেতে বসলা?”
“হ্যাঁ, কিন্তু আপনাদের সার্ভ করে ঐ টেবিলে খাবার দিবে। আমি ভাবলাম সাগরানার ছবি তুলে ফেলি। ওনাদের বললাম আপনারা হাত ধোয়ান। আমি ছবি তুলব। জামাই, বৌকে খাওয়াচ্ছে, আপনি ছেলে বৌমাকে খাওয়াচ্ছেন এমন ছবিও তুলবো। বিয়ের স্মৃতি থাক।”
জান্নাত আরার মুখের রেখা স্বাভাবিক হয়। শেলী অবশ্য বলে,
“যেই না সাগরানা, তার আবার ছবি। মানুষ এখন সাগরানায় গোটা ছাগল বসিয়ে দেয়। এখানে কয়টা মুরগী দিয়ে কাজ সেরেছে। দায়সারা বিয়েতে আরও ভালো আয়োজন থাকে। আমার একটা মাত্র ভাই। এখনই এই অবস্থা, জামাই আদর কপালে কতটুকু আছে বোঝা হয়ে গিয়েছে।”
তুলতুল আর মিতুলের মনটা খারাপ হয়ে যায়। তাদের বাবা একটু কৃপণ মানুষ ঠিক। কিন্তু বিয়ের আয়োজন একদম যা-তাও করেননি। সাগরানার প্লেটে আটটি গোটা মুরগী আছে, মাছ, ডিম আছে। আর কী থাকবে! মিতুলের চাচা বলেন,
“আমরা মা ছাগল রাখতে চেয়েছি। আপা মানা করলেন। বললেন জামাই বাবা ছাগলের গন্ধ সহ্য করতে পারে না।”
শেলী মায়ের দিকে তাকায়। জান্নাত আরা মাথা নাড়েন। শেলী তাও দমে না।
“হ্যাঁ সায়েম খায় না। আমার জামাই তো খায়। ও এখনো নতুন জামাইয়ের মতো মূল্যায়ন পায়। তার একমাত্র শ্যালকের বিয়ে।”
শেলীর স্বামী জুবায়েরের বিরস চেহারা দেখে অবশ্য ঘটনা সত্য কিনা বোঝা গেল না।
“ভুল হয়ে গিয়েছে মা। অযথা আর রাগ রেখ না।।খাওয়া শুরু কর। আমি এখানে ডাবল খাসির রেজালার ব্যবস্থা করছি।”
রফিক সাহেবকে এত কোমল কণ্ঠে কথা বলতে খুব কমই শুনেছে তুলতুল। বাবার প্রতি সমস্ত অভিমান পানি হয়ে যায়। বিয়ে পড়ানো হয়ে গিয়েছে। সদ্য বিবাহিত মেয়ের নতুন জীবনের শুরুটা কোনোরকম কটুকথা দিয়ে না হোক, তাই চান। নিজের মেয়ে হলে এতক্ষণে ঠাটিয়ে চড় বসিয়ে দিতেন। এর চেয়ে কত তুচ্ছ কারণে তুলতুল, মিতুলকে শাসন করেছেন। কোনোদিন চোখ তুলে তাকায়নি। অথচ আজ বাবা মা সবার সামনে এই মেয়েটা কেমন বেয়াদবি করে চলছে। তারা কেউ মেয়েকে আটকাচ্ছে না শুধু বরপক্ষের দাম বজায় রাখতে। অনেক খবর দেখেন, যেখানে খাওয়ার জন্য বিয়ে বাড়ি কুরুক্ষেত্র হয়ে যায়। রফিক সাহেব সম্মানি মানুষ। এমন কোনো ঘটনা ঘটুক তা চান না।
আরমান ছবি তুলতে থাকে। মিতুল একাই দুলাভাই এর হাত ধোয়ায়। ফারহা তো কখনই সরে গিয়েছে। সায়েম পকেটে হাত দিতে গেলে তুলতুলের না করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু টাকা দেওয়ার আগেই মিতুল দ্রুত সরে যায়। সায়েমের ইচ্ছে থাকলেও ডাক দেয় না। বোনের আচরণে এমনিতেই বিব্রত সে। জান্নাত আরা ছেলেকে খাইয়ে দিয়েছেন। শেলী ভাইকে খাইয়ে দিলো। সায়েম হাতে লোকমা তুললেও তুলতুলের খেতে ইচ্ছে করে না। মুখটা তেতো হয়ে গিয়েছে। ভেবেছিল বাবার বাড়ির শাসন থেকে মুক্তি পেয়ে স্বামীর বাড়ির ফড়িং হবে। কিন্তু এখন দেখছে স্বামী নিজেই মা বোনের আঁচলে বন্দী। তাদের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে সামান্য রা করার সাহসও নেই।
আরমান কাপল ছবি তোলার জন্য চেষ্টা করেছিল।।কিন্তু তুলতুলকে ওঠানোই গেল না। কত কষ্ট করে জান্নাত আরাকে রাজি করিয়েছে ছাদের ফটোশুটের জন্য। অবশ্য তারা একা যাবে না। শেলী আর জুবায়েরও ছবি তুলবে৷ শেলীর ইচ্ছে। অথচ এখন তুলতুল যাবে না।
“আমি হিল পরে হাঁটতে পারছি না। পায়ে ব্যথা। আপনি আপা দুলাভাইকে তুলে দেন।”
খুব নিচু স্বরে জবাব দেয় তুলতুল।
“হিল খুলে চলেন ভাবি। ছবি তোলার সময় পরবেন।”
তুলতুল চোখ তুলে আরমানের দিকে তাকায়। তুলতুলের চোখে জিদ ছিল না, ছিল একরাশ অভিমান আর কষ্ট। আরমান বুঝতে পেরে আর কথা বাড়ায় না। সায়েম অবশ্য খুব বিরক্ত হয়। কত শখ ছিল তার ছবি তোলার। এমন কী পায়ে ব্যথা!
***
বিদায় বেলায় দুই বোনের চোখ যেন বাঁধ মানছিল না। বোনের বিয়ের আনন্দের সাথে রুমও মিতুলের একার হয়ে যাবে, সেই খুশিতে বিভোর ছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই সব আনন্দ বৃথা। মিতুলের দাদী বলতেন, গাঙে গাঙেও দেখা হয়, বিয়ের পর বোনে বোনে আর হয় না।
সত্যিই কি বোনকে আর আগের মতো কাছে পাবে না মিতুল? যদি আপুর শ্বশুর বাড়িটা ভালো হতো, মিতুল এই কষ্ট মনেই চেপে রেখে দিতো। কিন্তু এখন তো ভয় ভয় লাগছে। সায়েম ভাইয়ার মা বোনকে সুবিধার লাগছে না। তারচেয়েও খারাপ লাগছে সায়েমের চুপ থাকা। মিতুলের চোখ অজান্তেই চলে যায় আরমানের দিকে। এমন একজন লোক কেন হলো না আপুর স্বামী। এই লোকটা কী চমৎকার করে পরিস্থিতি সামলে নেন। তখনও হাত ধোয়ার ঘটনা সামলে নিলেন। চাইলে সায়েম ভাইয়াও কি পারতেন না?
ভরাট চোখে এদিকে চেয়ে আছে আরেকজনও। ফারহান। ছেলের চোখ কোন মেয়ের দিকে গিয়েছে তা সরাসরি দেখতে চেয়েছেন ফারহানের মা। মাকে নিয়ে তাই এখানে হাজির ফারহান। ফারহানের মা শর্মিলা আহমেদ ভেবেছিলেন মেয়ে বোধহয় আধুনিক চলাফেরার কেউ হবে। ফারহাকে সেজন্যই পছন্দ করেছিলেন। ছেলের পছন্দ সম্পর্কে ধারণা আছে । ফারহানের বন্ধুমহলের মেয়েরাও সব অতি আধুনিক চলাফেরা করা। সেখানে মিতুলের মতো একটা সহজ সাধারণ মেয়ে দেখে অবাকই হোন।
এদিকে ভীড়ের ভেতর শর্মিলা আহমেদ আর ফারহানকে দেখে মিতুলের চাচী খুশি হয়ে যান। ধরেই নিয়েছেন ফারহাকে আরেকবার দেখতে এতক্ষণ অপেক্ষা করেছেন।
***
রাত প্রায় একটা বাজে। তুলতুল বুঝতে পেরেছে আজ রাতে সায়েম রুমে আসতে পারবে না। জান্নাত আরার প্রেশার উঠেছে। মাথা তুলতে পারছে না। শেলী রাত জাগতে পারে না। বাচ্চা ডিস্টার্ব করে। মাথা ব্যথা করে। এই বাহানায় শুয়ে পড়েছে। জলিল সাহেব বলার চেষ্টা করেছিলেন, সায়েম রুমে যেতে নববিবাহিতা স্ত্রী ঘরে একা। জান্নাত আরা কেঁদেকেটে এক করেছেন। তিনি নাকি মারা যাবেন এমন মনে হচ্ছে। মারা গেলে আদরের ছেলের হাতের উপরই মরতে চান। এরপর আর কথা থাকে না। তুলতুল একবার গিয়ে দেখতে চেয়েছিল। দরজা পর্যন্ত গিয়ে জিজ্ঞেসও করেছে কিছু করতে হবে কিনা। সায়েম কিছু বলার আগেই জান্নাত আরা বলেছেন,
“এখন থেকে সারাজীবন তো একই ঘরে থাকবা। একটা রাত আজ একা থাকতে পারবা না? নির্লজ্জের মতো চলে এলে?”
জলিল সাহেব তাড়াতাড়ি বলেন, “যাও মা তুমি কাপড় পাল্টে শুয়ে পড়। আমিও ঘুমাব। জান্নাত ঘুমালে সায়েম চলে আসবে। ভয় পেও না। ঘরে কত মানুষ।”
জান্নাত আরার বিরক্ত লাগে স্বামীর কথায়। বাসাবাড়িতে কিসের ভয়? বাঘ খাবে না ভূত?
তুলতুল কাপড় পাল্টে এসে দেখে শেলী খাটে শুয়ে আছে।
“তুমি নাকি ভয় পাচ্ছ। তাই চলে আসলাম। ইসস ফুল দিয়ে বিছানার কী অবস্থা করছে। শলার ঝাড়ু আছে দরজার পিছে। ভালো করে ঝাট দিয়ে ফুল ফেলে দাও তো। দরজার বাইরে রেখে এসে লাইট বন্ধ করে দিও। ফুল থেকে পোকা না বের হয়।”
“আপা আপনার কষ্ট করা লাগবে না। আমি একাই ঘুমাতে পারবো। আপনি বাবু আর ভাইয়ার কাছে যান।”
“শোনো তুলতুল আমি কী করব সেটা আমাকে ভাবতে দাও। আমি তোমার জামাইয়েরও বড়ো। আম্মু ঘুমালে সায়েম আজ জুবায়েরের সাথেই শুয়ে নিবে। রাতে দরকার হলে আব্বু ডেকে নিবে। আসো আমরা শুয়ে পড়ি।”
তুলতুল বোকা নয়। বুঝতেই পারছে নতুন জীবনটা সহজ হবে না।
(চলবে)