ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ২১
আরমান শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসে। মিরাকে এত আয়োজন করে দেখতে আসবে না
“আমার পছন্দ অপছন্দের কিছু নাই মা। তোমার যদি মনে হয় মেয়ে ভালো, এবং তোমার অপদার্থ ছেলেকে জেনেশুনে বিয়ে করতে রাজি। তাহলে আমারও কোনো আপত্তি নেই।”
“এসব কী কথা আরমান। তুই আবার পিছলাতে এসব বলছিস। একটা বার মেয়ে দেখ। কথা বল। ভালো না লাগলে জোর করব না সত্যি।”
আরমান মায়ের হাতটা ধরে বলে,
“মজা করছি না মা। সত্যি বলছি। আমার ভালো খারাপ লাগার কিছু নেই। আমাকে ভালো লাগে কিনা সেই প্রশ্ন হলে আমি অবশ্যই যাব।”
“তুই কি হেঁয়ালি শুরু করলি।”
“আচ্ছা চলো, তুমি যেহেতু আমাকে ছাড়া মানবেই না।
***
“মিরা আপনার সাথে আমার পরিচয় নেই। শেলী আপার বিয়ের সময় হয়তো এক দুই বার দেখা হয়েছ। পারিবারিক আয়োজনে হয়তো চোখাচোখি হয়েছে। কিন্তু সত্যি বলতে আপনার বিষয়ে আমার কোন ধারণা ছিল না। হয়তো আমার বিষয়েও আপনার কোন ধারণা নেই। হয়তো আমাদের দুজনেরই দুজনের বিষয়ে কখনো কোনদিন কোনো আগ্রহ ছিল না বলেই এমনটা হয়েছে। তবু আজ দুজন এমন একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হলাম আমি আপনাকে বলতে চাই যদি আপনার পরিবারের চাপ থাকে তাহলে আমাকে পরিষ্কার বলতে পারেন।”
“কী ধরনের চাপের কথা বলছেন? জোর করে বিয়ে দেওয়ার? এই বয়সের মেয়েদের আর জোর জবরদস্তি করতে হয় না। তারা নিজেরাই ভাবে বিয়ে করে বাবা মাকে উদ্ধার করি। ভাইকে চিন্তা মুক্ত করি। ভাবির ভ্রু কুঞ্চন থেকে মুক্তি পাই।”
“আমাদের দেশের মানুষের একটা সমস্যা আছে। বিয়ের একটা প্রাথমিক বয়স তারা মাইন্ড সেট করে ফেলে। সেই বয়সে সবচাইতে স্ট্যান্ডার্ড কিছু ক্রাইটেরিয়া তারা সেট করে। যে ক্রাইটেরিয়া ছাড়া পাত্র-পাত্রী মিলে না। মানে পাত্র পাত্রীর গুণ মিলে না। পাত্রী লম্বা ফর্সা সুন্দর ধর্মপরায়ণ আধুনিকা সুরাঁধুনি এসব গুন থাকতে হয় আর পাত্রের জন্য মূল ক্রাইটেরিয়া হলো তার ক্যারিয়ার। বিসিএস হলে সবচাইতে বেস্ট। এবারে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার না হয় ভালো ব্যবসায়ী। আপনাকে বলি আমি সেই ক্রাইটেরিয়া তে পড়িই না। বলার মত কোন কাজই করি না। তবে পেট চলে যায়। সেদিক থেকে ভাবলে আমার মত ছেলে কারও ড্রিমবয় টাইপ স্বামী হওয়া সম্ভব না। এভাবেই অ্যারেঞ্জ বিয়ে করতে হবে আমাকে। কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে তো বিষয়টা তা নয় আপনি কারো প্রেসারে পড়ে কিছু করার দরকার নেই।”
মীরা কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে তারপর আরমানকে বলে,
“আমার জন্য বিষয়টা আলাদা মনে হওয়ার কারণ?আদর্শ পাত্রীর যে বর্ণনা দিলেন সে অনুযায়ী তাহলে আমিওআদর্শ পাত্রীর ক্রাইটেরিয়াতে পড়ি না। আমার শ্যামলা বর্ণ, খাটো হওয়া কোনটাই বোধহয় আমার পারদ কে উঁচু করে না। পড়ালেখাও গড়পড়তা মানের। সব কোনোমতে চলে ধরনের। তবু পরিবার চেয়েছিল আপনার বর্ণনা মতে একজন আদর্শ পাত্রের সাথে বিয়ে হোক। সেই খোঁজে বেলা পার হয়েছে। এখন সূর্য অস্ত যাওয়ার আগেই তড়িঘড়ি করে বিবাহ উত্সব অনুষ্ঠিত করার প্রয়াস।”
“তাহলে কি তুমি সেজন্যই বিয়েতে রাজি? কেউ না পেলে কেউ হলেই চলবে বলে?”
“বলতে পারেন। আপনার জন্য হয়তো বিষয়টা তা নয়। ত্রিশ প্লাস বয়স ছেলেদের জন্য কিছু না।”
“কিন্তু পছন্দের মেয়ের পাণিপার্থী হওয়ার মতো যোগ্যতা আমার নেই।”
“তাহলে আমরা দু’জনই তবে দু’জনের জন্য যথাযথ। কেউ না পাওয়ার চেয়ে কেউ পেলেও ভালো।”
“কেন এতে লাভ কী হবে? ”
” এতে ক্ষতি বা কী? বিয়ে তো করতেই হবে। প্রথমে সবাই সেরাই খোঁজে।’
“না পেলে চলনসই হলেও নিতে রাজি?”
“ছেলেদের আবার চলনসই কী? ছেলেদের মুখে এসব কথা কখনো শুনিনি। রিজেকশন পেলে ছেলেদের অনুভূতি কেমন হয় আমি জানি না। তবে নারী হিসেবে আমার রিজেকশন পাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে আর তাতে দেখেছি বেশিরভাগ ছেলেরাই ভাবে সোনার আংটি বাঁকাও ভালো।”
“তাহলে আমি বাঁকা হলেও ভালো বলে মনকে বুঝ দিচ্ছেন? ”
“আপনিও তো আমাকে… ”
“থামলেন যে?”
“বাদ দিন। অন্য আরেকদিন।”
“আচ্ছা তাহলে অন্য আরেকদিন।”
***
“আপু, তোমার দেবরের কী খবর?”
“আরমান ভাইয়ের?”
“হুম। বিয়ে ঠিক?”
“হ্যাঁ বিয়ে তো ঠিকই।”
“হ্যাঁ বলে দিয়েছেন?”
“ওটা তো একরকম হ্যাঁই ছিল। বাকিটা ফর্মালিটি।”
“ওহ। বিয়ে কবে?”
“আগে তো এনগেজমেন্ট হবে।”
“কবে?”
“এই তো এই মাসের বাইশ তারিখ। ছোটো করে ঘরোয়া অনুষ্ঠান হবে। আসবি তো সবাই। বাসায় দাওয়াত দিবে। শেলী আপা তো খুশি। অল্পতে ননদ পার হচ্ছে। যা দেখলাম মেয়েদের অল্পতে পার করতে পেরে সবাই খুশি হয়। আচ্ছা এদের কথা বাদ দে। বাড়িতে এত কাহিনি হলো সে নিয়ে বল। আম্মু আর চাচীর কি মুখ দেখাদেখিও বন্ধ?”
“বন্ধই তো। ফারহা আপু এসে আমাকে কত কথা শুনিয়ে গেল। আমি নাকি হিংসা করে ঐ লোককে পটিয়েছি।”
“তুই কী বললি?”
“একবার ভেবেছিলাম সব ব্যাখ্যা করব। পরে বাদ দিলাম। বললাম ভাই যা ভেবে খুশি হও মনে শান্তি পাও তাই ভেবে নাও।”
“বাহ রে এত সহজে তুই ছেড়ে দিলি? দোষ না করে দোষী বানালো তুই কিছুই বললি না?”
“কী বলবো আপু। ফারহাপুর জায়গা আমি থাকলে আমিও বোধহয় এ ভাবেই রিয়েক্ট করতাম।”
“ছেলেটার সাথে ফারহার সম্পর্ক কেমন ছিল জানা উচিত। তোদের আর কথা হয়েছে?
” ফারহানের সাথে? হ্যাঁ নক করেছিল।”
“কী বললি?”
“বললাম বিষয়টা এভাবে জটিল না করলে ভালো হতো। আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে।”
“সে কী বলে?”
“বলে এসব তার চিন্তার বিষয় না। তাকে অনেকেই চায়। ভংচং এসব কথা। নার্সাসিস্ট একটা।”
“ছেলেটাকে খুবই ইনসেনটিভ মনে হচ্ছে। ফারহার সাথে আসলেই ঠিক হয়নি। আব্বু আম্মু তাও গোঁ ধরছে!”
“ছেলে মানুষ তো এমনই।”
“সেটাও ঠিক। সায়েমকেই দেখ না।”
“আপু সায়েম ভাইয়ের সাথে মিটমাট করবি না?”
“করব। ইনফ্যাক্ট করা শুরু করেছি।”
“গুড।”
“গুড ব্যাডের কিছু নেই। বনে বেঁচে থাকতে হলে শিকারি হতেই হয়।”
“মানে?”
“মানে পালিয়ে পালিয়ে চললে নিজেই শিকার হয়ে যাব। তাই শিকারি হয়েই মাছ শিকার করব।”
“তোমার কথা কিচ্ছু বুঝি না। বিয়ের পরে আর রহস্যময়ী হয়ে যাচ্ছে। ”
“আমি বুঝে ফেলেছি।”
“কী?”
“পুরুষের দুর্বলতা।”
“মানে?”
“সায়েমের নখরামি স্বভাব পূরণ করার জন্য মা বোন আছে। কিন্তু দরজা বন্ধ হলে অন্য আরেকটা দুনিয়া। এই দুনিয়ায় ওর আমাকে প্রয়োজন। আমারও এখন প্রয়োজন থেকে প্রিয়জন হতে হবে। যেহেতু বের হয়ে আসবো না। তাই সেখানেই থাকার জায়গা বানাতে হবে। ”
“আপু একটা কথা বলব?”
“জানি কী বলবি। তুই আমাকে কী বুঝবি আমি নিজেই নিজেকে বুঝতে পারছি না। আচ্ছা আগে সফল হই তারপর তোকে বুঝিয়ে বলব। ঠিক আছে?
“আপু আমি ফারহানকে বিয়ে করতে চাই না। অথচ আব্বু আম্মুর কেমন রোখ চেপে গিয়েছে। চাচার উপর রাগ করে হলেও এখানে বিয়ে দিবে।”
“অপেক্ষা কর।”
“কিসের?”
“পরিস্থিতি কোন দিকে যায়। আগে কিছু বলার দরকার নেই। তোর যেহেতু কোনো পছন্দ নেই তাই আগে কিছু বলতে যাস না। বাকিটা অপেক্ষা কর।”
“যদি সত্যি সত্যি বিয়ে হয়ে যায়?”
“শোন বিয়ে যদি করতেই হয় এমন ছেলে কে করবি যে অন্যের কথাও চলে না, নিজের জিদেও চলে না। যার একটা ভালো মন আছে। যে সম্মান দিতে জানে। যে অন্যের মতে চলে তার পা অন্যের মর্জিতে চলে। যে নিজের জিদে অন্যকে চালিত করে সে স্বার্থপর হয়। জীবনসঙ্গী সহমর্মী হওয়া উচিত প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। খুব কষ্ট বিষয়টা। আমার খুব কষ্ট হয়। তুই এই কষ্টটা পাস তা আমি চাই না।”
“আমিও না আপু। কিন্তু আমি যাকে চাই সে যদি আমাকে না চায় তাহলে তো নিয়তি কে মেনে নিতে হয়।
“তুই কাকে চাস?”
“কথার কথা।”
“সত্যি?”
“সত্যি।”
(চলবে)