ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-২০

0
73

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ২০

“তুলতুল।”

“জি আপু।”

“মুখ ফুলে গিয়েছ দেখি। আমাদের বাসার আলো বাতাসে মাশাল্লাহ স্বাস্থ্য ভালো হচ্ছে।”

“জি আপু আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আপু দেখেন হাত, পা, মুখ সব ফুললেও ওজন গিয়েছে কমে। বিয়ের আগে ছিলাম একান্ন কেজি। এখন আটচল্লিশ।”

“মেশিন নষ্ট নাকি দেখ।”

“চলেন দেখি।”

তুলতুল সত্যি সত্যি ওজন মাপার মেশিন নিয়ে আসে।

“আপু আপনার ওজন কত? মেপে দেখলে বুঝব মেশিন ঠিক আছে না ভুল।”

“বাদ দাও। আমি তো থাইরয়েডের রোগী। ডায়েট করলেও ওজন কমে না। আমার ওজন বেশিই দেখাবে। আর তুমি কিন্তু মোটা হও নাই।।বিয়ের পর মেয়েদের চোখমুখ একটু ফুলে, এতে আরও সুন্দর লাগে। তোমাকেও লাগছে।”

শেলীর বিরস মুখের প্রশংসা তুলতুল গায়ে মাখে না। মেশিনটা নিয়ে রেখে আসে। মানুষের চিন্তা করার অনেক সময় থাকে। তুলতুলের চিন্তা করার সময় হলো গোসলঘর। মাথায় ঠান্ডা পানি ঢালতে ঢালতে তুলতুল ঘটনাপ্রবাহ ভাবে। কী হলে কী হতে পারে। নতুন বিয়েতে মেয়েদের সবচেয়ে বড়ো আতংক এই থাকে যে কোন অপরাধে জানি বাবার বাড়িতো নালিশ পৌঁছে যায়, যার সর্বশেষ পরিণতি হতে পারে বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া না হলে চলে যেতে বাধ্য করা। যে অপরাধে এই শাস্তি এই সমাজে হয় সেই অপরাধের কিছুই না করে সেই ধরনের মানসিক শাস্তি ইতোমধ্যে পেয়ে গিয়েছে। বাবা মায়ের মনেও সর্বোচ্চ ভয় এটাই যে মেয়ে বাড়িতে ফিরে আসবে। তো এরচেয়ে খারাপ হওয়ার আর কিছু নেই। যখন সর্বোচ্চ খারাপের দর্শন আর অনুভব হয়েই গিয়েছে। তখন আর কিসের পরোয়া? বলে না ‘সমুদ্রে পেতেছি শয্যা শিশিরে কী ভয়’। নিজের সংসার খারাপ না করেই সায়েমকে বোঝাতে হবে শুধু মায়ের ছেলে হলেই ভালো ছেলে হওয়া যায় না। বোনের জন্য ভালো ভাইয়ের মতো স্ত্রীর জন্য যোগ্য স্বামীও হতে হয়।

***

“মিতুল, তোর চোখ মুখ ফুলে এ কী অবস্থা হইছে! ভাতও খাস নাই। বুঝছি বোন চলে যাওয়ায় খুব কষ্ট হইছে। এখন তুইও আমারেই দোষ দে। রাগ দেখা।”

“আম্মু, আপনার আর আব্বুর সাথে আমরা কোনো দিন আগে রাগ দেখাই নাই। এখনো দেখাব না। আপু কেন গিয়েছে জানেন না? আপুর শাশুড়ি কড়া হলেও সমস্যা ছিল না, যদি ভাইয়া আপুকে একটু বুঝত। আর ওনারা তো আপনাদের ডেকে নিয়ে বিচার বসায়। আপুর কত অপমান লাগে এসব। এজন্য চলে গিয়েছে। অযথা আপনাদেরও ছোটো করতে চায় নাই।”

“তোরা এখন কী চাস? আমরা সমানে সমান গলাবাজি করব? বয়স কম, বুঝ নাই। একপক্ষ আগুন হলে আরেকপক্ষ পানি হতে হয়। না হলে চলে না। যা হাতমুখ ধো। এত নরম হলে দুনিয়ায় চলবি কিভাবে?”

মিতুল স্বস্তি বোধ করে অবশ্য। মা যে তুলতুলের বিষয়টা ছাড়া অন্য কিছু ভাবেনি এতেই শান্তি। না হলে কান্নার কী ব্যাখ্যা দিত মিতুল। স্বস্তির স্থায়ীত্ব অবশ্য বেশিক্ষণ হয় না। মিতুলের দাদী বাড়ি ফিরেছেন থমথমে মুখে। ফিরেই ছেলে আর ছেলের বৌয়ের বিচার বসিয়েছেন। অভিযোগকারী মিতুলের চাচা চাচী। অপরাধী মিতুলের বাবা মা।

“আম্মা ঘটনা কী তাই তো বুঝলাম না? শফিক কী হইছে?”

“কী হয়েছে তা তো আপনি আর ভাবি জানেন বড়ো ভাই।”

“সেটাই তো জানতে চাইছি। বিষয়টা কী?”

“বিষয়টা বিশ্বাস ভাঙার। আমি কোনোদিন ফারহা আর মিতুলকে আলাদা চোখে দেখি নাই। ফারহার জন্য সুন্দর কিছু, ভালো কিছু কিনলে মিতুল আর তুলতুলকেও দেওয়ার চেষ্টা করছি। যেন না পেয়ে ওদের মন ছোটো না হয়। ফারহার জিনিস, আমার জিনিস কোনো ব্যবহার করতে দিয়েছি। যেন বোনে বোনে হিংসা না জাগে। বুঝতেই পারি নাই হিংসা তো অন্যদিক থেকেও আসতে পারে।”

“আহ্ জেসমিন। কী শুরু করলে। কোন কথা বলতে কোন কথা টানছ।”

শফিক সাহেব স্ত্রীকে থামিয়ে দেন।

“থামালে কেন ভাই। শুনি একটু। কী কী দয়া করলে তোমরা। ফারহার জন্য নতুন পুতুল আসলে পুরানো পুতুল ফেলে না দিয়ে মিতুল, তুলতুলকে দিয়েছ। জেসমিনের দামি শাড়ি পরতে দিয়েছ। কখনো কখনো ফারহার জামা জুতো একবেলা পরতে দিয়েছ। ফারহার জন্য কেনা দামি দামি জিনিস দেখতে দিয়েছো, ধরে খেলতেমদিয়েছ। আর কী?”

“আর কিছু না ভাবি?”

“আমি তো তাই জিজ্ঞাসা করলাম। আর কী?”

“আলাদা সংসার হওয়ার আগে-পরে আপনাদের দায়দায়িত্ব শফিক নেয়নি? বাসাও আপনাদের ছেড়ে দিলাম।”

“বাসা ছাড় নাই জেসমিন। পুরানা বাসায় থাকবা না বলে উপরে নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছ। আর এই সাজানোর টাকা পয়সা এই সংসারে বসে গুছিয়েছ। একসাথে সংসার থাকার সময় তুলতুলের আব্বা তোমাদের কাছ থেকে একটা পয়সা বাজার খরচ নেয় নাই। সেটা হিসাব করছ কয় টাকা হয়?”

“তুমি খাবারের খোটা দিচ্ছ ভাবি? অথচ সবাই জানে ভাইয়া কী হিসাবি মানুষ। আমাদের এমনি এমনি কেউ টানেনি। আমরা দু’জনই আয় করা মানুষ। দুই হাতে খরচ করছি। আমি এভাবে চিন্তাই করি নাই এই যে হিসাব রাখতে হবে। কিন্তু মনে করে দেখ আম্মার কয়দিন আগে অপারেশন হলো। পিত্তের পাথর ফেলা লাগলো। সেই টাকা কে দিয়েছে? আম্মার ওষুধের টাকা কে দেয়?

” হ্যাঁ এখন তোমরা দাও। অথচ এর আগে আব্বার সমস্ত চিকিৎসা তুলতুলের বাবাই করিয়েছেন।
আম্মাকেও নিয়েও ডাক্তারের কাছে কম দৌঁড়াদৌঁড়ি করছেন।”

“হুম কে যে কত করার মানুষ সবাই জানে। কার হাতের ফাঁকে দিয়ে পানি পড়ে না এই কথা অন্তত কারও অজানা না। ফারহার বাবা আম্মাকে প্রাইভেট চেম্বারে দেখায়। বিশ ত্রিশ টাকার টিকেটে সরকারি হাসপাতালে না।”

রফিক সাহেবের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। কথা যত বাড়ছে, এক অপরকে তত আঘাত দিয়ে নগ্ন আক্রমণ করছে। তিনি সইতে না পেরে একটা ধমক দিয়ে ফরিদাকে চুপ করতে বলেন। শফিক সাহেবও জেসমিনকে মুখ বন্ধ করতে বলেন। রফিক সাহেব ভাইকে বলেন,

“শফিক এ বাড়িতে মহিলাদের এত মুখ চলা কবে থেকে শুরু হলো? ভাইয়ে ভাইয়ে যদি কোনো সমস্যা হয় তাহলে ভাই ভাই কথা বলে সমাধান করি। আম্মা মুরুব্বি জীবিত আছেন। আম্মা বলুক কী হয়েছে। বাকিরা চুপ থাকবে। আম্মা আপনি বলেন কী সমস্যা?”

“ঠিক আছে আমি বলতেছি। তোরা আগে চুপচাপ শোন। তারপর বলবি কার কী কথা আছে। রফিক ফারহার জন্য যে ছেলে দেখতেছে জেসমিন আর শফিক সে কথা তুই জানোস?

রফিক সাহেবের আগে শফিক সাহেবই উত্তর দেন,

“জানার তো কথা। আমি তো ভাইয়ের সাথে আলোচনা করছিলাম।”

রফিক সাহেব মাথা নাড়েন।

“জি আম্মা বলছিল শফিক।”

“সেই ছেলে কে সেটা জানোস?”

“তখন জানতাম না। এখন জানি।”

“কবে থেকে জানোস? মিতুলের জন্য একই ছেলে দেখার আগে না পরে?”

রফিক সাহেব চুপ করে থাকেন। শফিক সাহেব বলেন,

“দেখলেন আম্মা, আমি বলছি না ভাইজান সব জানেন। আপনি বলেন এসব করা কি খুব দরকার ছিল? এক বোনের জন্য কথা চলার সময় গোপনে আরেক বোনকে দেখানো। এসব কেমন আচরণ?”

যদিও জেসমিনকে চুপ থাকতে বলা হয়েছিল তবুও জেসমিন উত্তর না দিয়ে পারেন না। বলেন,

“ভাইকে জিজ্ঞাসা না করে ভাবিকে জিজ্ঞাসা করেন। আমরা বাড়িতে থাকব না এমন দিনে উনাদেরকে ডেকে মেয়ে দেখানো এসব ঘরোয়া রাজনীতির বুদ্ধি মহিলাদের মাথা থেকে আসে, পুরুষের না।”

ফরিদাও সমান বেগে উত্তর দেন,

“আমি কোনো বুদ্ধিও করি নাই রাজনীতিও করিনি। উনারাই আমাদের সাথে যোগাযোগ করলেন। রাহেলা জানাইছে যে মিতুলকে উনাদের ছেলের বেশি পছন্দ হয়েছে। উনারা ফারহার ব্যাপারে আগ্রহী না। মিতুলকে ওনারা একটু বাসায় এসে দেখতে চায়। আমরাও না করতে পারি নাই। ফারহার সাথে কি কোনো পাকা কথা হইছে? না তারা পাকা কথা দিয়েছে? তাদের ফারহাকে পছন্দ হয় নাই। মিতুল আর ফারহা তো আপন বোন না। তারা যদি মিতুলকে পছন্দ করে এতে অন্যের জ্বলে কেন?”

কথায় কথা বাড়ে সমাধান আসে না। মিতুল বা ফারহা বড়োদের এসব কথার মাঝে আসে না ঠিকই। কিন্তু দু’জনের মনেই কেমন একটা বিপরীতমুখী বিতৃষ্ণা। ফারহার অপমানে অন্তর জ্বলে যাচ্ছে। এভাবে তাকে ছোটো করতে পারলো ফারহান। আর মিতুলের মনে হচ্ছে ঐ লোকটা প্রস্তাব পাঠালো কেন। ঘর তো বটেই, আরমানের সাথেও তার জটিলতা তৈরি হয়েছে তার জীবনে ফারহানের উপস্থিতিতে। তার জীবনে ফারহানের অস্তিত্ব না থাকলে আজ আরমানকে এই কথা বলতোই না। চারদিকে কেমন জানি অশান্তির জাল বুনেই চলছে।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে