ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ১৯
“তোর আব্বু কষ্ট পাবে।”
“আমার তো আসার কথাই ছিল না। হুট করে আসলাম।”
“তুলতুল, খেয়ে যা অন্ততঃ। এত জেদ ভালো না। বিয়ের পর মাথা ঠান্ডা করতে হয়। তোর উল্টো গরম হয়ে গিয়েছে।”
“আম্মু, আগেও আমরা ঠান্ডা ছিলাম। এখনো ঠান্ডা। আর জেদি হলে যেতাম না। জেদি নয় বলেই যাচ্ছি। না বলে এখানে এসে যদি ও বাসায় ফিরতে দেরি হয়। তাহলে কত কথা শুনতে হবে সেটা আমিই জানি। আপনি আর দাদিই বলছেন, কথায় কথায় নালিশ করতে না। তাই কথা গিলে খাওয়ার অভ্যাস করছি।”
মিতুল নিচে নেমে আসে। তুলতুলকে রিকশায় উঠিয়ে দিয়ে চোখ মুছে দেয়।
“আপু খেয়ে গেলে পারতা। তুমি না খেয়ে চলে গিয়েছ জানলে আব্বুও খেতে পারবে না। তুমি জানো ঐ বাড়ি থেকে আসার পর থেকে আব্বু ঠিক মতো খেতে পারে না, ঘুমাতে পারে না। স্বীকার করেন না, কিন্তু বোঝা যায়। আম্মু কী বলল না বলল তাতে তুমি রাগ করে চলে যাচ্ছো?”
“ধ্যুত। তোর মনে হয় আমি রাগ করে যাচ্ছি? আমাকে এমনিতেই যেতে হবে। বাসায় বলা হয়নি। দেরি হলে সমস্যা হবে। শেলী আপু আসবে তার ননদের বিয়ের আলোচনা করতে। তুই জোর করলি আমিও হুট করে চলে আসলাম। এভাবে আর এখন আসা উচিত না। মিতুল, তোর সাথে অনেক কথা আছে। ফারহানের সাথে কথা বলতে সাবধান হু হ্যাঁ ছাড়া উত্তর দিবি না। কলেজে আবার আসলে দেখা হবে তোর সাথে।”
“বাহ তোমার ননদের ননদের বিয়ে তা এবাসায় কেন? উনাদের বাসায় হবে না?”
“বিয়ে না, বিয়ের আলোচনা। আরমান ভাইয়ের সাথে। আরমান ভাই সায়েমের কাজিন হয় না। আচ্ছা আর কথা বলার সময় নেই। পরে কথা হবে।”
***
তুলতুল চলে গিয়েছে শুনে রফিক সাহেব খুব মনে কষ্ট পেয়েছেন স্ত্রী ফরিদাকেও ঝাড়লেন কিছুক্ষণ।
“মেয়েটা বাসায় ঢুকতে না ঢুকতে তোমার এসব বলার দরকার ছিল?”
“আমি খারাপ কী করছি? আপনি আর আপনার মেয়ে তো মনে হয় যেন আমাকেই দোষী করতেছেন? বিয়ে আমি দিয়েছি? নিজে পাত্র ঠিক করেছেন। আজ যদি সত্যি সত্যি তুলতুল রাগ করে চলে আসতো? তাহলে তখন আপনার মা আমাকেই দোষ দিতেন। বলতেন মেয়ে মানুষ করতে পারি নাই। মেয়েদের কড়াকড়ি দিলেও দোষ, না দিলেও দোষ। এখন মেয়ের কাছেও খারাপ, মেয়ের বাপের কাছেও খারাপ।”
দুপুরে রাগ করে কেউই খেল না। মিতুলও খায়নি। ফরিদা ভাবলেন মা বাবা খায়নি দেখে মিতুলও খেতে পারছে না। রাতুল শুষ্ক মুখে ঘুরছিল দেখে ডেকে খাইয়ে দিলেন। মিতুলকেও খেয়ে নিতে বললেন। মিতুল এমনিতে খিদে সইতে পারে না। অথচ আজ কেমন খিদে মরে গিয়েছে মনে হচ্ছে। আরমানের বয়স হয়েছে। বিয়ে হবে এটাই স্বাভাবিক। তারও তো বিয়ের কথা চলছে। দু’জনের মাঝে নেই কোনোরকম সম্পর্ক। অথচ মিতুলের বুকে কেমন চাপ চাপ কষ্ট হচ্ছে। ফেসবুকে গিয়ে শেলীর প্রোফাইল খোলে। শেলীর প্রোফাইল থেকে তার ননদের খোঁজ পায়। ভালোই দেখতে শুনতে। মিতুলের চেয়ে বড়ো। ফারহান, যাকে মিতুল চেনেই না। সে নাকি মিতুলকে পছন্দ করে বসে আছে। আর এই লোকের সাথে এত কথা হলো, অথচ সে…।
নিজের উপর বিরক্ত লাগছে মিতুলের। এত উতলা হওয়ার কিছু নেই। আসলেই কিছু নেই। তাহলে তার বিরক্ত লাগছে কেন? আরমানকে ফোন দিয়ে দুটো কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে। কী হাস্যকর!
***
আরমানের ম্যাসেজ দেখে মিতুলের গা জ্বলে যায়।।ফটকা লোক একটা। সব পুরুষ এক। একসাথে কয়েকটা মেয়ের সাথে কথা না বললে চলে না।
“কী করছ? কোনো খোঁজ খবর নেই। নক করলাম কয়েকবার।”
রিপ্লাই দিবে না দিবে না করেও রিপ্লাই দেয়।
“তাই? খেয়াল করিনি। ব্যস্ত ছিলাম।”
“বাহ্ এত কী ব্যস্ততা?”
“ফারহানের সাথে কথা বলছিলাম।”
ইচ্ছে করে ফারহানের নাম টেনে আনে মিতুল। যদিও সে মোটেও ফারহানের সাথে কথা বলছিল না।
“ফারহান। কে উনি?”
“আমার জন্য যে পাত্র দেখা হচ্ছে। তিনিই ফারহান। আসলে তিনি আমার কাজিন ফারহা আপুকে দেখতে এসে আমাকে পছন্দ করে ফেলেছেন।”
আরমান ম্যাসেজ বাদ দিয়ে কল দেয়। মিতুল ইতস্তত করে উঠে রুমের দরজা বন্ধ করে। তারপর ফোন রিসিভ করে।
“হ্যালো।”
আরমান কুশল বিনিময়ের দিকে যায় না।
“এ কেমন কথা! কাজিনকে দেখতে এসে তোমাকে পছন্দ করেছে মানে?”
“মানে আমাকে বেশি সুন্দর লেগেছে।”
“আর তুমি তাতে গর্ব অনুভব করছ?”
মিতুল থমকে যায়। আরমানের গলার স্বর কেমন অন্য রকম লাগছে।
“গর্বের কী দেখলেন?”
“তাহলে তুমি আত্মসম্মানহীন একটা মেয়ে। অথচ আমি অন্য রকম ভেবেছিলাম।”
“আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন?”
“আত্মসম্মান থাকলে তুমি খুশি খুশি এই কথা বলতো পারতে? তোমার বোন, হোক কাজিন। তোমার বোনের জন্য দেখা পাত্র তোমাকে পছন্দ করেছে। তোমার তাতে সমস্যা যদি না থাকে তাহলে হয় তুমি আত্মসম্মানহীন লোভী। না হলে অন্যকে ছোটো করে আত্ম অহামিকায় ভুগছ। তুমি খুব মূল্যবান মিতুল। কারও কাছে নিজেকে সস্তা করা কি ঠিক? হয়তো সেই ব্যক্তি ভালো চাকরি করে অথবা ধনী ঘরের ছেলে। হয়তো খারাপ কেউ নয়। কিন্তু তার মানসিক দৃঢ়তার সমস্যা নিশ্চয়ই আছে। একজনের জায়গায় আরেজনকে জীবনসঙ্গী করতে চাওয়া একধরনের ছলনা।”
“ছলনার কী? ওনার তো ফারহা আপুর সাথে প্রেম ছিল না। ওনার পরিবার ফারহা আপুকে পছন্দ করেছিল। আর ওনার আমাকে পছন্দ হয়েছে।”
“এন্ড ইউ আর ওকে উইত দিস এটিটিউট?”
“আপনিও তো আমার সাথে কথা বলেন। কিন্তু বিয়ে করছেন শেলী আপুর ননদকে?”
“কী?”
“ভুল বললাম? আজ আপনার বিয়ের আলোচনা হওয়ার কথা না?”
“কিন্তু আমার সাথে তো তোমার বিয়ের আলোচনা চলছিল? আমি তো তোমাকে বিয়ের আশ্বাস দিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করতে যাচ্ছি না। আচ্ছা তুমি কি এমন কিছু ভেবে মাথা গরম করে আছ? সত্যি কর বলো।”
“আপনাকে বিয়ে করব কেন? আপনি চাকরি বাকরি কিছু করেন না। আপনার সাথে আমার বয়সের গ্যাপও কত বেশি। দশ বছর! আমি এমন কিছু কেন ভাবব। আমি রাখি।”
“তুমি ঠিকই বলেছ মিতুল। আই এম স্যরি। যা ভেবেছিলাম সব ছিল ভুল, ক্ষমা করে দিও মিতুল।”
মিতুল থতমত খেয়ে গিয়েছিল আরমানের প্রশ্নে। কী উত্তর দেবে এমন সরাসরি প্রশ্ন। উল্টো তার রাগ উঠে যায়। আরমানের এত কর্কশ করে কথা বলার কী আছে। সে তো সত্যি সত্যি ফারহানকে বিয়ে করার জন্য মরে যাচ্ছে না। হঠাৎ ঝোঁকের বশে আরমানকে এসব বলে বসলো। মনে হয়েছিল আরমান জেলাস হবে। যদিও সে কেন আরমানের জেলাসি চায় নিজেই জানে না। আরমান তার সাথে কোনো ছলনা করেনি। বরং সত্যি বলতে ফারহান আসলেই ফারহার সাথে একধরনের ছলনাই করছে। কিন্তু এখন কী করবে। কী এসব আজেবাজে কথা বলে ফোন রেখে দিলো। আরমান হয়তো আর কখনোই তার সাথে কথা বলবে না। মিতুলের চোখে বাঁধ ভেঙে জল নামে। কী অজানা কারণে এত কষ্ট হচ্ছে, কার জন্য কষ্ট হচ্ছে জানা নেই। তবু কষ্টে মিতুলের বুকটা ভেঙে যাচ্ছে।
***
তুলতুল আজ পুরো রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে এসেছে। রিকশা ওয়ালা এলাকার মুখ চেনা। মিতুল, তুলতুলকে নিয়মিত কলেজে নিয়ে যেত। তাই তুলতুলকে এভাবে কাঁদতে দেখে কয়েকবার অবাক হয়ে পেছন ঘুরে দেখে। তারপর বাসার কাছাকাছি এসে রিকশা থামায়।
“কী হলো মামা এখানে রাখলেন কেন? বাসা আরও ভেতরে।”
“পানি আইনা দেই মামা। মুখে একটু পানি দেন।”
“দিন মামা।”
তুলতুল মুখ ধুয়ে ধাতস্থ হয়।
“ধন্যবাদ মামা।”
“মামা, নতুন নতুন বিয়া হইলে বাপের বাড়ির লাইগা পরাণ পোড়ে। মাইয়া কান্দে। কিনতুক আপনের কান্দন পরাণ পোড়নের কান্দন না। শুনেন এখখান কথা কই। চোখের পানির দাম মেলা। যারে তারে এই পানি ফেলতে দিয়েন না।”
তুলতুল অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। এক পলকে অর্ধশিক্ষিত একজন রিকশাচালক মামা ওর কষ্টটা বুঝে ফেলেছে। অথচ ওর নিজের মানুষেরা বুঝতে পারছে না। আসলেই তাদের জন্য কান্না মানায় না। শক্ত হতে হবে। অনেক শক্ত।
(চলবে)