ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ১৮
“চল ফুচকা খাই।”
“শুধু ফুচকা? আর কিছু খাওয়াবে না?”
“এক হাজার আছে ব্যাগে। কী খেতে চাস এর ভেতর?”
“পাগল! এক হাজার খেয়ে নষ্ট করব কেন? তিনশো টাকায় খাব। সাতশো দিয়ে জুতা কিনে দাও। তোমার বিয়ের সময় জুতা নিয়ে কী কেলেঙ্কারি হইছে জানো না তো।”
“কী হইছে, চল বসি। তারপর বলবি ডিটেইলসে। আর সাতশোয় ভালো জুতা পাবি না। এখন তো আমি মাঝেমধ্যেই আসব কলেজে। পরীক্ষাও দেব। তোকে মসজিদ মার্কেটে নিয়ে যাব। জুতা কিনব।”
“বাহ্ খুব বড়োলোক হইছ না? হাজার টাকায় খাওয়া, জুতা কিনে দেওয়া।”
তুলতুল হাসে,
“কেন, তুই না বলতি আমার বিয়ের পর এটা সেটা কতকিছু একমাত্র দুলাভাইয়ের কাছ থেকে আদায় করবি।”
“হ্যাঁ বলতাম কী, এখনো বলি।”
“করেছিস কিছু আদায়?”
মিতুল হাসি মুখেই জবাব দেয়,
“তো, নেবই তো। তুমি হিংসা করলেও নেব। সময় আসুক।”
মিতুলের অভিনয়ে তুলতুলের চোখ ভারী হয়ে যায়। তুলতুল ভালো নেই মিতুল জানে। এই দুলাভাই যে অযথা আব্দার করার দুলাভাই না এটা মিতুল বিয়ের দিনই বুঝেছে। এমনকি রাতুল পর্যন্ত বুঝে নিয়েছে। সারাদিন বোনদের পেছনে এটা সেটার জন্য ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকা রাতুল সায়েমকে কোনো বিরক্ত করেনি। অথচ সায়েম ওদের বাসায় আসার আগে রাতুল দুলাভাইয়ের সাথে কী কী করবে সব লিস্ট করে ফেলেছিল।
“সায়েম ছেলে খারাপ না মিতুল। আসলে ও পারিবারিক, সামাজিক বিষয়গুলো কম বোঝে। তোদের খোঁজ খবর আমার কাছে নেয়। অনেকদিন বলেছে রাতুলকে নিয়ে যেন আমার শ্বশুর বাড়িতে যাস। তোদের নিয়ে একদিন বেড়াতে যাবে। শেলী আপু আসবে সামনে। তখন ডাকব। আসিস।”
“আসব আপু। তোমার শ্বশুর বাড়ি যেদিন তোমার নিজের বাড়ি হবে সেদিন আসব। আর ভাইয়া ফোন দেয় না তো কী হয়েছে? আমিও তো দেই না। লজ্জা লাগে। লজ্জা ভেঙে গেলে দাবি দাওয়া নিয়ে হাজির হব। এখন খাওয়ায় কী খাওয়াবা। আমার কিন্তু ক্ষুধা নাই। এক প্লেট ফুচকা আর এক প্লেট চটপটি। ব্যস।”
মিতুল কেন দামী কিছু খেতে চাইছে না তুলতুল বুঝে ফেলেছে। তুলতুলের ব্যাগে কত টাকা থাকে সে আন্দাজ হয়ে গিয়েছে মিতুলের। বিয়ে হলেও পরিস্থিতি বদলায় নি। আগে বাবা গুণেগুণে টাকা দিতেন যেন সন্তান হিসাবে করে চলা শিখে। এখন স্বামী গুণে গুণে টাকা দেয়, যেন স্ত্রী অবুঝের মতো অপচয় না করে। ব্যাগের এক হাজার টাকা সায়েমের দেওয়া নয়। এটা বিয়েতা পাওয়া সালামির টাকা। সায়েম টাকা দেয়নি তা নয়। ভাড়া দিয়েছে দু’শ টাকা। সায়েম কোনো হাত খরচ দেয় না। কিছু লাগলে বলতে বলেছে। এনে দিবে। আলাদা করে হাতখরচের কী আছে? এই দু’শ টাকাও তুলতুল চায়নি। জান্নাত আরা জিজ্ঞেস করেছিলেন কী কী কাজ কলেজে। অনেকগুলো নোটস ফটোকপি লাগবে বলায় বললেন নোট নিয়ে আসতে বাসায়। সায়েম করিয়ে দিবে ফটোকপি। ভাড়া হিসেবে দু’শ দিয়েছেন। তুলতুল একবার ভেবেছিল নেবে না। কিন্তু জানে, না নিলে আরেক অশান্তি হবে। সময় মতো তুলতুল জবাব দিবে। এখন অযথা কলহ এড়িয়ে যাচ্ছে।
***
ফারহান মিতুলকে নক করেছিল। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে দেখলো, মিতুল তার সম্পর্কে কিছুই জানে না। ফারহানের ধারণা হয়েছিল এমন জায়গা থেকে বিয়ের প্রস্তাব এসেছে, ফারহানের মতো হ্যান্ডসাম ছেলে নিজ থেকে বিয়ে করতে আগ্রহী জানলে মিতুল খুশি হয়ে যাবে। ফারহানের ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট এক্সেপ্ট করেও সারাদিনে মিতুল কোনো রকম যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি ফেসবুকে। যেভাবে ফারহা নিজ থেকে এগিয়ে এসেছিল, মিতুলের ক্ষেত্রেও তাই আশা করেছিল। তবে মিতুলের তরফ থেকে কোনোরকম সাড়া না পেয়ে একটু অবাকই হয়েছিল। তবে কী মিতুল কিছু জানে না? নিশ্চিত হতেই ফারহান মিতুলকে নক দেয়।
“হ্যালো। আছেন?”
“আসসালামু আলাইকুম। জি আছি।”
“কেমন আছেন? কী করছেন?
“ভালো, আলহামদুলিল্লাহ। আমি অপরিচিত কারও সাথে আসলে কথা বলি না। আপনাকে ঠিক চিনতে পারছি না। ফারহা আপুর কমন ফ্রেন্ড দেখে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট এক্সেপ্ট করলাম।”
“তুমি সত্যি আর কিছু জানো না?”
“স্যরি। কিন্তু আমাকে হুট করে অচেনা কেউ তুমি বললে ভালো লাগে না। যদিও আপনি হয়তো আমার চেয়ে বড়ো। তবুও।”
“দুঃখিত। অনেকটা উত্তেজিত অবস্থায় তুমি বের হয়ে গিয়েছে। না হলে গায়ে পড়ে কোনো মেয়ের সাথে আমিও কথা বলি না।”
“এখন তো বলছেন।”
“এক্সকিউজ মি। তুমি আমাকে চেনো না। তাই এভাবে বলার স্পর্ধা করলে। আমিও তোমাকে মাফ করলাম। কেননা একদিক থেকে তোমার এই আচরণটা ভালো। আমি স্মার্ট মেয়ে পছন্দ করলেও, ওভার স্মার্ট পছন্দ করি না। সহজেই ছেলেদের গায়ে ঢলে পড়ার মেয়ে নয় বলে মনে হওয়ায় তোমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। না হলে ফারহান আহমেদকে মেয়ে খুঁজতে হয় না। মেয়েরাই ফারহান আহমেদকে খুঁজে নেয়।।বিশ্বাস না হলে তোমার কাজিন ফারহাকে জিজ্ঞেস কর। আমাকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে আছে।”
“তাহলে আমাকে বিয়ে করতে চাইছেন কেন?”
“আমার চয়েস। আমাকে কে বিয়ে করতে চায় সেটা আমার দেখার বিষয় না। আমাকে অনেকেই চায়।”
“কেন?”
“কেন? সেটা আমার সাথে সরাসরি কথা আর দেখা হলেই বুঝবে।”
***
মিতুল, তুলতুলকে অনেকটা জোর করে বাড়িতে ধরে এনেছে। তুলতুল তো আসবেই না। কিন্তু মাত্র এক ঘণ্টার জন্য বলে মিতুল তুলতুলকে নিয়ে এসেছে। যদিও তুলতুলের মনে অনেক অভিমান ছিল তবু বাবার বাড়ি, মা বাবা ভাইয়ের প্রতি মেয়েদের এক অদম্য ভালোবাসা কাজ করে। চাইলেও অভিমান ধরে রাখা যায় না। তুলতুলও তাই নিজের নেওয়া দৃঢ় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে বাসায় চলে আসে। ভাবছে অল্প কিছুক্ষণ থাকবে। নিজের পরিচিত বিছানায় ঘাপটি মেরে গুটিসুটি হয়ে। নিজের বিছানার ঘ্রাণ নেওয়া হয় না কতদিন। নিজের পড়ার টেবিল, গল্পের বইয়ের তাক, আলমারির দুটো ড্রয়ার যেখানে নিজের রাজ্যের জিনিস জমিয়ে রাখতো।।সবকিছু বড়ো বেশি মনে পড়ে। সেই মনে করার টানেই হঠাৎ চলে আসা হয়। তুলতুলকে এই অবেলায় হঠাৎ দরজার সামনে দেখে ফরিদা ভীষণ খুশি হয়ে যান। কতদিন পর মেয়ের চেহারা দেখা। তুলতুলকে আনতে লোক পাঠাতে চাইলেও, তুলতুলই মানা করেছিল। আজ কোনো খোঁজ খবর ছাড়া হাজির। কিন্তু পরমুহূর্তেই তিনি ভয় পেয়ে যান। তিনি তো আর জানেন না তুলতুলকে মিতুল নিয়ে এসেছে।
মিতুল, তুলতুল কারও কাছে ভাঙতি নেই। খুচরা টাকা খরচ করে ফেলেছে। মিতুল তুলতুলকে উপরে যেতে বলে সামনের দোকানে টাকা ভাঙতি করতে গিয়েছে। রিকশাওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে ভাঙতির জন্য। তুলতুল একাই উপরে উঠে এসেছে।
“তুলতুল, তুই এই ভরদুপুরে? কী হইছে? বাসা থেকে রাগ করে আসছিস?”
“মানে?”
“মানে কোনো খোঁজ খবর ছাড়া হঠাৎ এই সময় বাসায়? সত্যি করে বল শাশুড়ির সাথে ঝামেলা করে আসছিস না জামাই বাবার সাথে?”
“এমনও তো হতে পারে আম্মু যে তোমার জামাই বাবা বাসা থেকে এক কাপড়ে বের করে দিয়েছে।”
“ও তোকে এককাপড়ে বের করবে কেন?”
“বারে গতবার বললো না এরপর সালিশ বসবে না।এককাপড়ে বের করে দিবে।”
“তুই কী করছিস? আয় বয় আগে। আমাকে খুলে বল কী হইছে।”
“অনেক ক্লান্ত আম্মু। ঘরে যাই। হাতমুখ ধুই। তারপর বলি?”
“তুই এখন বল।”
তুলতুল মায়ের কথা অগ্রাহ্য করে ঘরের ভেতর চলে যায়। ফরিদার মাথায় হাত। মেয়ে কী করে আসছে আল্লাহ জানে। যদি ওরা আর ফেরত না নেয়! ছিছি মানুষ কী বলবে। কয়দিনও সংসার করতে পারলো না। ছোটোটার বিয়ে কিভাবে দিবেন? রফিক সাহেবকে কিভাবে জানাবেন? রান্না মাথায় উঠেছে ফরিদা বেগমের। শাশুড়ি বাসায় নেই। রফিক সাহেব দোকানে। কার সাথে আলোচনা করবেন?
***
“আম্মু, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছেলের পরিবারে দেখবেন, বৌ জামাইয়ের ঝগড়া হলে তারা মিটমাট করার জন্য আগাবেও না, শান্ত করা চেষ্টাও করবে না। ছেলের কোনো দোষ তো দেখবেই না। এমনকি বৌ থাকুক না থাকুক এটা নিয়েও খুব একটা মাথা ঘামাবে না।।বরং ছেলেকে বলবে শক্ত থাকতে। বৌকে পাত্তা দিতে না। গেলে যাক।
আর বেশিরভাগ মেয়ের বাড়িতে দেখা যায় উল্টা। তারা পারলে জামাইয়ের পূজা করবে। কোনো দোষ চোখেই দেখবে না। দেখলেও নিজেদের মেয়ের দোষই দেখবে। এবং যেভাবেই হোক, জোড়াতালি দিয়ে হলেও মিল করানোর চেষ্টা করবে। এটা এজন্য না যে তারা খুব চায় যে মেয়েটার সংসার হোক। বরং এজন্য যে মেয়ে এসে আবার কাঁধে না উঠুক। বিয়ে দিয়েছে মানে কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলেছে। ছেলের পরিবারে খুশি হয় যে যাই হোক ছেলেটা তাদেরই থাকুক। মেয়ের পরিবারে উল্টো। তারা ভাবে যাই হোক মেয়ে ফিরে না আসুক।।আসলেও কাফনের কাপড়ে আসুক। এর আগে মেয়ে যতই কষ্ট পাক, কান্না করুক তাদের কানে তালা পড়ে থাকে। এরপর একদিন টুক করে মরে গেলে তখন খুব লোক দেখানো কান্নাকাটি করে। অথচ মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভাবে, যাক বাবা আমার ছেলের সম্পদে ভাগ বসাতে জীবিত তো এসে হাজির হয় নাই।”
“তুই কী বলতে চাস?”
“তুমি ঠিকই বুঝেছ কী বলেছি। একটু আগে তোমার প্রেশার হাই হয়ে যাচ্ছিল। আব্বু দোকান থেকে রওনা দিয়ে দিয়েছেন। এখন যখন শুনলে যে এসব কিছু না। আমাকে মিতুল জোর করে আনছে, তুমি স্বাভাবিক হয়ে গেলে।”
“এটাই কি স্বাভাবিক না? আমি তোর ঘর ভাঙার চিন্তা করব না? মা বাবার চিন্তা কি বুঝিস?”
“না বুঝি না। মা হলে হয়তো বুঝব। তবে এইটুকু সন্তান হিসেবে বুঝে ফেলেছি যে আমি আসলে এখন আসতে হবে মেহমান হয়ে। মেয়ে হয়ে নয়।”
(চলবে)