ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-১৭

0
73

ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে
পর্ব ১৭

“আরমান, কই ছিলি তিনদিন?”

“ছবি তুলতে গিয়েছিলাম।”

“ছবি তুলতে গিয়েছিস জানি। কোথায় গিয়েছিলি?”

“আলতা দীঘি।”

” আলতা দীঘি! এ আবার কোন জায়গা?”

“খুব সুন্দর একটা জায়গা মা। বলা যায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের একটা নীড় ছিল আলতা দীঘি। কিন্তু আমরা মানুষেরা সেটাও নষ্ট করে ফেলছি। দীঘির জায়গা ভরাট করে উদ্যান করা হচ্ছে।”

“বলিস কী? জায়গার নাম আলতা দিঘী। আর সেই দীঘি ভরাট করে উদ্যান হচ্ছে! তুই কি বেড়াতে গিয়েছিলি?”

“বেড়াতে যাইনি মা। মৃত প্রায় দীঘিটাকে বাঁচানোর একটা চেষ্টা করতে গিয়েছিলাম।”

“এই না বললি ছবি তুলতে গিয়েছিস?”

” হ্যাঁ ছবিই তো তুলেছি। যেন বাঁচাতে পারি।”

“তোর এসব কথার কোন মানে বুঝি না। কী করছিস, কেন করছিস আল্লাহ জানেন। ছবি তুলে দিঘী বাঁচানো এগুলো কোন কাজ? এসব করে কি জীবন চলবে?”

“জীবন কিসে চলে মা? সবাইকে বিসিএস ক্যাডার হতে হবে। না হলে বড় কর্পোরেট চাকরি করতে হবে এমন তো নয়। পৃথিবীতে হাজারটা পেশা আছে। আমার পেশাও তেমনই একটা।”

” তুই যে দীঘি, খাল বিলের ছবি তোলাকে পেশা হিসেবে নিয়েছিস সেটাকে কি কেউ পেশা বলে? মানুষ জিজ্ঞেস করে এত পড়াশোনা করে কি শেষ পর্যন্ত তুই বিয়ের ভিডিওগ্রাফি করিস? মানুষের অনুষ্ঠানের ছবি তুলিস?”

“অনুষ্ঠানের ছবি তোলার জন্য অসংখ্য প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার আছে মা। এবং এটাও বর্তমানে খুব জনপ্রিয় পেশা। আমি প্রকৃতির ছবি তুলি সেটাও একটা পেশা।”

“এটাই যদি পেশা হবে তাহলে লেখাপড়া করলি কেন?”

“মা তুমি কিন্তু একটা পেশাকে খাটো করে দেখছ। লেখাপড়া সব পেশার জন্য প্রয়োজন। আমি যখন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাথে কথা বলি, কাজ করি, তখন আমার এই পড়ালেখাটাই কাজে দেয়। আমি অনেকদিন তোমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু কিছু কিছু বিষয় আমাদের বোঝার বাইরে। না আমি তোমাকে বোঝাতে পারবো না তুমি কোনদিন বুঝতে পারবে। আমি কি তোমার কাছে টাকা পয়সা চাই? আমার হাত খরচ থেকে শুরু করে কোন খরচ আমি তোমার কাছ থেকে নেই না। তাহলে তো তুমি বুঝতেই পারছ আমি আয় করি। এই বাড়িটা আমাদের নিজেদের। কোন ভাড়া লাগে না বরং আমি যদি সংসারের জন্য খরচ করতে চাই তুমি মানা কর। বল বাবার পেনশনে ভালোই যাচ্ছে। অন্য জায়গা থেকেও আমাদের টুকটাক আয় আসে। বলো তোমার সংসার খরচের প্রয়োজন নেই। আমি নিজে শখ করে কিছু টাকা তোমার হাতে দিলে তুমি খরচ না করে রেখে দাও। তোমার টাকার প্রয়োজন হয় না। তাহলে অভাবটা কোথায়? আমাকে কেন গতানুগতিক চাকরি নয়তো ব্যবসা করতে হবে? শুধু কি সবার কাছে বলার জন্য?”

“হ্যাঁ সবার কাছে বলার জন্য। কারণ সবাই জানতে চায় তুই কী করছিস। আমি তো বলতে পারি না আমার গ্রাজুয়েট ছেলে ছবি তোলে। না তার কোনো ইভেন ম্যানেজমেন্টের কোম্পানি নেই। সে আগানে বাগানে গিয়ে, দীঘির পাড়ে গিয়ে ছবি তোলে। তুই বল সমাজে এই জিনিসের কোনো দাম আছে? মানুষের কথা শুনতে তো ভালো লাগে না।”

“তো শোনার প্রয়োজনটা কী? মানুষের কথা শুনতে হবে কেন? তুমি বলে দিও আমার ছেলে ভবঘুরে। কিছুই করে না। হেঁটে হুটে খায়।”

“এই কথা বললে পাত্রীপক্ষ তোর কাছে পাত্রী দিবে?”

“পাত্রী চায় কে?”

“আমি চাইছি। আমার একটা মাত্র ছেলে। আমি ছেলের বউ দেখব না? নাতি নাতি দেখবো না? সারা জীবন নিজের মত চললি এই একটা আবদার কবে থেকে তোর কাছে করে যাচ্ছি। সেটাও তুই আমার রাখবি না?”

“বিয়ের বাহানায় তুমি আমাকে গৃহবন্দি করতে চাচ্ছ মা। কিন্তু জেনে রাখ কেউ যদি গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী হতে চায় তাহলে তাকে বিয়ে নামক বন্ধনে বেঁধে ঘরে ফেরানো যায় না। পথিক যখন তার গন্তব্য জানে তখন সে হারায় না। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া পথিককে তুমি কখনোই গন্তব্যের ঠিকানা দিতে পারবে না।”

“তাহলে কি তুই কোনদিন বিয়ে-শাদী করবি না? চিরকুমার থাকবি?”

“কেন করব না? যার সাথে ঘর বাধতে ইচ্ছা করবে তেমন কাউকে পেলে অবশ্যই করব।”

“শোন বাবা, আমার শরীরটা ইদানীং ভালো থাকে না। আমার একটা অনুরোধ রাখ। মিরার সাথে একটু দেখা কর। মেয়েটার বয়স তোর কাছাকাছি। দেখতে শুনতেও খারাপ না। ভালো ফ্যামিলির মেয়ে আমার ধারণা তোর সাথে বনবে ভালো। তুই অগোছালো বাঁধনহারা। মিরা পরিণত বয়সের মেয়ে। হয়তো সংসারী হয়ে এই সংসারটাকে আগলে রাখতে পারবে।”

“মিরাটা কে?”

“শেলীর ননদ।”

“শেলী আপার ননদ! তাকে তুমি পেলে কই?

” শেলী ফোন দিয়েছিল। মানে শেলী না ঠিক। জান্নাত দিয়েছিল।”

“কী বললেন আন্টি? আন্টি তো আমাকে খুব একটা নেক নজরে দেখেন বলে মনে হয় না। সেখানে মেয়ের ননদের জন্য আমাকে পাত্র মনোনীত করেছেন! বিস্ময়কর ব্যাপার স্যাপার। পাত্রী অন্ধ না তো? নাকি কানে শুনে না? দাঁড়াও দাঁড়াও দ্বিতীয় তৃতীয় বিয়ে নয়তো?”

“এমন কিছু না।”

“এমনি এমনি সিঙ্গল পিস কোনরকম খুঁত ছাড়া পাত্রী আমার মত অকর্মার ঢেঁকির জন্য আন্টি আর আপা চাইছেন? শেলী আপার আপন ননদ? নাকি উনার শ্বশুরের আব্বার দূর সম্পর্কের মেয়ে?”

“চুপ কর ফাজিল। দূর সম্পর্কের মেয়ে মানে কী? মেয়ের কোন খুঁত নেই। সব ঠিক। বয়স আটাশ বছর। ওরা একটু ছেলে নিয়ে বাছবিচার করছিল শুরুতে। এখন বয়স যাচ্ছে বেড়ে, কিন্তু পাত্র মেলাতে পারছে না। তাছাড়া শেলীর স্বামী যুবায়ের তোকে নাকি খুব পছন্দ করে। সেই শেলীর কাছে বলেছে। তোর নাকি কী পেজ টেজ দেখেছে। আরও কী বললো অনেক ফলোয়ার না কী। ওর নাকি তোকে গুণী মনে হয়েছে। প্রথমে তো শেলীও অবাক হয়েছিল। যুবায়েরের আগ্রহে তোর জন্য জান্নাত কথা আগালো।

” আহ্ আমি তো ধন্য। পরিবারের ভেতর কারও তো মনে হলো আমি গুণী। তবে আটাশ বছর এমন কোনো বয়স না। পাত্র মিলাতে পারছে না মানে? আজকালকার মেয়েরা ত্রিশের পরেও বিয়ে করে। ঘটনা অন্য মা, ঘটনা অন্য। তোমার এই ডিফেক্টেড ছেলের জন্য পাত্রী চাওয়ার বিষয়টা স্বাভাবিক না।”

“এক কথা বারবার বলবি না তো। কিসের ডিফেক্টেড? তুই ই তো মাত্র বললি যে মেয়ে বোবা না কালা? তা তুই অন্ধ না বোবা কালা? তোর কী ডিফেক্ট?”

“দেখো মা, অন্ধ হওয়া বা কানে না শোনা, এমনকি পঙ্গু হওয়াও ডিফেক্ট না। মানুষ সর্বোত্তম সৃষ্টি। আমি তো মজা করেছি। তবে হ্যাঁ চরিত্র ভালো না হওয়া, মন ভালো না হওয়া, মানুষ ভালো না হওয়া অবশ্যই ডিফেক্ট। তুমি আন্দাজে আমাকে জোর করো না। আগে খোঁজ নাও।”

“অবশ্যই খোঁজ নেব। তুই আমার একমাত্র ছেলে। তোকে নিয়ে কি আমি পথে পড়েছি যে যেনতেন মেয়ের সাথে আমি তোর বিয়ে দিয়ে দিব? তুই কোনো কাজ করিস না তো কী হয়েছে? ঢাকা শহরে আমাদের একটা বাড়ি আছে। কয়জনের ঢাকা শহরে বাড়ি থাকে? তুই যদি কোনো কাজ নাও করিস তোর বউ চালানোর মতো ব্যবস্থা আমাদের আছে। কিন্তু যদি খোঁজ নিয়ে দেখি মেয়েটা ভালো তাহলে তুই বিয়েতে না করবি না। আমি কিন্তু সত্যি সত্যি অনশনে বসব। তোর এই ছন্নছাড়া জীবন আমার আর ভালো লাগে না।”

“এখনই এমন চাপ দিও না মা।”

“এখনই চাপ মানে? আর কত সময় প্রয়োজন বল? ত্রিশ বছর বয়স পার হয়ে গিয়েছে। আর না হলে তুই মেয়ে দেখা। দেখিতো কত ভালো মেয়ে তুই পছন্দ করতে পারিস। যদি না পারিস তাহলে আমি যেখানে বলব সেখানেই তোকে বিয়ে করতে হবে।
কথা দে।”

“কথা দিলাম।”

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে