ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-১২

0
115

ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে
পর্ব- ১২

সায়েম তুলতুলের উপর রাগ করে লম্বা সময় কথা বলছে না। তুলতুল কী করবে বুঝতে পারছে না। রাগ করার কথা ওর, ভুল আচরণ তার নয় সায়েমের ছিল। অথচ সায়েম এমন ভাব করছে যেন তুলতুলই দোষ করেছে। এই বাড়িতে সায়েমেই তুলতুলের সবচেয়ে আপন, নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর জন্য ওর সায়েমকে প্রয়োজন। অথচ সায়েমই যেন আরেক পরীক্ষার নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

“আপনি আমার সাথে কথা বলছেন না কেন?”

“কী বলব?”

“না মানে সকাল থেকে মনে হচ্ছে আমাকে এভয়ড করছেন। রাগ দেখাচ্ছেন।”

“এমন কেন মনে হলো? আমি কি তোমাকে বকেছি? ”

“বকেননি, কিন্তু কথাও তো বলছেন না। সারা দুপুর আলাদা থাকলেন।”

“আলাদা থাকলাম মানে? আপু আজ সন্ধ্যায় চলে যাবেন। আম্মুর রুমে ভাইয়া আর আপুর সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম। আলাদা থাকা মানে কি? বিয়ে হয়েছে মানে কী এখন রাত দুপুর সবসময় তোমার সাথে দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকব?”

“আমি তাই বলেছি! আমাকেও ডাকতে পারতেন। আমিও আপনাদের আড্ডায় শরীক হতাম।”

“ডাকতে হবে কেন? তুমি কি মেহমান? নিজে এসে বসতে পারো না? আপু কত মনে কষ্ট নিয়ে বললো যে আজ চলে যাবে অথচ তুমি রুম থেকেই বের হও না।”

“আমি নতুন বৌ। আপনারা ডেকে না নিলে আমি নিজ থেকে গিয়ে বসে থাকতে পারি? আর সারাদিন আমি সবার সাথেই ছিলাম। দুপুরে খাবার খাওয়ার পর রুমে এসেছি।”

“তুলতুলে, তুমি ভীষণ তর্ক বাজ। মুখে মুখে উত্তর দিয়েই যাচ্ছ। যাই হোক, এটিচিউড না বদলালে আমার সাথে কথা বলতে আসবে না।”

তুলতুল মাথা পুরোই ফাঁকা হয়ে যায়। সে কি সায়েমকে স্যরি বলবে? কিন্তু কেন বলবে? করেছি কী? উচিত কথাটা বলেছে এই তো।

শেলী অবশ্য বিদায় নেওয়ার আগে আর নতুন করে কিছু করে না। জান্নাত আরাকেও স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। শেলী আর যুবায়েরের বিদায়ের পর জান্নাত আরা কিছুক্ষণ রেস্ট নিবেন ঠিক করেন। সায়েম নিজের রুমে না এসে মায়ের রুমেই গিয়ে বসে। তুলতুল যখন ও ঘরে যায় দেখে সায়েম মায়ের পাশে আধশোয়া হয়ে গুটগুট করে গল্প করছে। তুলতুলের শ্বশুর বাইরে হাঁটতে গিয়েছেন। তুলতুলকে ঢুকতে দেখে সায়েম কথা বন্ধ করে দেয়।

“কী তুলতুল, কিছু বলবা?”

“না এমনি আপনাদের সাথে গল্প করতে আসলাম। আপু চলে গেলেন আপনার নিশ্চয়ই মন খারাপ।”

“মেয়ে তো এখন মেহমান। বেড়াতে আসবে যাবে এই স্বাভাবিক। তোমার বিয়ে হয়েছে তুমিও বুঝবা। বাবার বাড়ির মায়া না কমালে স্বামী, শ্বশুর বাড়িকে আপন করা যায় না৷ স্বামীর মান,শ্বশুর বাড়ির মান এসব মেয়েদের বুঝতে হয়। আমার মেয়েকে তো আমি সেই শিক্ষা দিয়েছি। ছিল তো তোমার চোখের সামনে। দেখেছ তো স্বামীকে কেমন মাথায় তুলে রাখে। তুমি বিয়ের দুইদিনও না যেতে মুখেমুখে তর্ক করো, ভুল ধরো। আসলে এক দুই দেখায় মেয়ে পছন্দ করতে হয় না। খানদানি মেয়ে না হলে আসলে স্বামী শ্বশুর বাড়ির সম্মান যে নিজের সম্মান তা বোঝে না।”

তুলতুল থ হয়ে যায়। এতক্ষণ রাগ করেনি, অভিমান করেনি বললেও ঠিকই মায়ের কাছে সময় মতো নালিশ করেছে। নিশ্চয়ই দুলা ভাই সামনে থাকায় বোনের কানে তুলতে পারেনি। কিন্তু এখন সুযোগ পেয়েই মায়ের কানে তুললো।

“আমি কি কিছু করেছি মা? অজান্তে ভুল হলে ক্ষমা চাইছি। কিন্তু আমার জানামতে আমি স্বামী, শ্বশুর বাড়ির অসম্মান হয় এমন কোনো আচরণ করিনি।”

জান্নাত আরা উঠে বসেন।

“তুমি সায়েমের সাথে রাগ দেখাওনি? তোমাদের বাড়ির দুটো সমস্যার কথা মুখ ফুটে বলতেও পারবে না সায়েম। তোমার মা বাবাকে তো বলে নাই। আমাদের বলছে। এই শিক্ষা আমার ছেলেমেয়েকে দিয়েছি। তারা অন্যের বাড়িতে গিয়ে এমন আচরণ করে না।”

“আচ্ছা।”

“কী আচ্ছা?”

তুলতুল চেয়ার টেনে বসে।

“এখন থেকে রাগ,অভিমান, বদনাম যা করার রাস্তায় গিয়ে করব। এখানে করা যাবে না।”

“এর মানে কী?”

“না মানে তাহলে আমি এগুলো করব কোথায়? আমি তো মা কিছুই বুঝতেছি না। মা, দাদী বিদায় দিতে গিয়ে বললো এখন থেকে এই আমার বাড়ি। স্বামী, শাশুড়িই আমার আপন। আবার এখানে শুনছি এটা শ্বশুর বাড়ি, রাগ দেখাতে হলে নিজের বাড়িতে গিয়ে করতে। অথচ নিজের বাড়ি তো নাই। আপাততঃ কখনো খুব কষ্ট পেলে, রাগ হলে রাস্তায় গিয়ে কতক্ষণ চিল্লাচিল্লি, কান্নাকাটি করে আসব।”

সায়েম আধশোয়া থেকে উঠে বসে, “বলছি না আম্মু, অসম্ভব তর্কবাজ মেয়ে। ঠান্ডা মাথায় কেমন উত্তর দেয় দেখ। তুমি বলছিলা ঠান্ডা স্বভাবের। কিন্তু একেই বলে মিচকে শয়তান।”

***

বিয়ের কয়েকদিন না যেতেই তুলতুলের বিচার বসতে সময় লাগে না। রফিক সাহেব, ফরিদা আর মাকে নিয়ে মেয়ের শ্বশুর বাড়ি আসেন। চেয়েছিলেন ভাইকেও বলতে। কিন্তু ফরিদা দেয়নি। যতবেশি মানুষ জানবে তত কথা ছড়াবে। এমনি তুলতুলকে দেখতে দাদীর খুব ইচ্ছে করছে, এই বাহানা দিয়ে এসেছেন। যদিও মিতুলের চাচী কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছন কোনো সমস্যা কিনা। ফরিদা হেসেই উড়িয়ে দিয়েছেন। মিতুল, রাতুলকে নিয়ে আসা হয়নি। মিতুল বুঝতে পারছে কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। কিন্তু কী, তা বুঝতে পারছে না।

“শোনেন বেয়াই সাহেব, আমার যখন বিয়ে হয়, আমার বয়স তখন মাত্র সতেরো বছর। আমার তিন ননদের দুই ননদ বয়সে আমার বড়ো ছিল। তাদের বিয়ে হয়েছে আমার বিয়ের পর। এই যে আপনার সামনে সায়েমের বাবা আছেন, জিজ্ঞেস করেন তিন ননদ নিয়ে কতবছর সংসার করেছি। সবার মন জুগিয়ে চলেছি। নিজের দোষ থাক না থাক, যখন কেউ শাসন করেছি মেনে নিয়েছি। এই যে শাশুড়ি তো সামনেই আছেন। বলুক মিথ্যা বলছি না সত্য। অথচ আপনার মেয়ে এ বাড়িতে আসার সপ্তাহ পার হয়নি, এখনই মুখেমুখে তর্ক করে। স্বামী মানে না, শাশুড়ি মানে না। ছেলে মা বোনের সাথে সময় কাটাবে তা পছন্দ করে না। এসব নিয়ে আমার ছেলের সাথে রাগ দেখায়। বলেন তো, বড়োলোক ঘরের দুলালী বৌ করো আনিনি। যৌতুক নেইনি।।শুধু চেয়েছি একটা ভদ্র ছেলের বৌ। তাহলে পেলাম টা কী? আমাদের একমাত্র ছেলে, কত প্রস্তাব হাতে ছিল। কত সুন্দরী, উচ্চশিক্ষিত, ধনী পরিবারের মেয়ের বাবারা মেয়ে দিতে বসে ছিল। কিন্তু শেষে তো আমরাই ঠকে গেলাম। এমন বৌ আনলাম যে স্বামীকেও মানে না। আমার ছেলের কাছে আমি নিজেই ছোটো হলাম। মেয়ে তো আমার পছন্দের ছিল। ভুল তো আমি করছি।”

রফিক সাহেবের মাথা ভোঁভোঁ করছে। তুলতুল এত বেয়াদব, মুখরা, জেদী এসব তিনি বাবা হয়ে এই তেইশ বছরে বোঝেননি, যতটা এনারা কয়েকদিনেই বুঝে ফেলেছেন!

ফরিদা মেয়েকে বাদ দিয়ে মেয়ের জামাইয়ের দিকে তাকান। সায়েম মায়ের পাশে পিট সটান করে বসে আছে। বিচারকের ভঙ্গিতে। শ্বশুর বাড়িতে স্বামী নিজের না থাকলে মেয়েদের আর কিছুই থাকে না। এখানে ওনার মেয়েটার তাহলে আপন কেউই নেই।

তুলতুল নিঃশব্দে কাঁদছে। একদিন আগেও যে আত্মবিশ্বাস তার নিজেকে নিয়ে ছিল। তা গুঁড়িয়ে দিতেই যেন আজ এই বিচার সভা। বাবা মায়ের লালনপালন, শিক্ষা যত প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, ততটাই মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে তুলতুল।

“আব্বু, আমি বাসায় যাব।”

***

রফিক সাহেব খেতে বসেছেন। খাওয়া গলা দিয়ে নামছে না। সে বাসায়ও তেমন কিছু মুখে দিতে পারেননি। মেয়ের বিচার বসলে সেখানে বসে খাওয়া যায় না। মেয়েদের খুব আদরে বড়ো করেছেন তা নয়। কিন্তু হেলাফেলা অবহেলা করেছেন সেটাও নয়। হ্যাঁ তিনি মেয়েদের বিষয়ে হিসেবি মানুষ ছিলেন। এরজন্য মেয়েরা মাঝেমাঝে অভিমান করলেও কোনোদিন অভিযোগ করেননি। রাতুলের জন্য অতিরিক্ত কিছু বাসায় আসলে হিংসা করেনি। সাধ্যের বাইরে কিছু চেয়ে জেদ করেনি। সেই মেয়ে হঠাৎ বেয়াদব, জেদি, হিংসুটে তকমা পেয়ে যাওয়াটা ওনার জন্য একটা বিস্ময়ই। মেয়েটা কী বেদনার্ত কণ্ঠে বলেছিল, “আব্বু, আমি বাসায় যাব।”

তিনি মেয়েকে না নিয়েই চলে আসলেন। মেয়েটা নিশ্চয়ই কত কষ্ট পাচ্ছে মনে। কিন্তু তুলতুলের মা আর দাদী তুলতুলকে আনতে দিলেন না। ওনাকে কথাই বলতে আটকালেন। বরং মেয়ে অবুঝ, না বুঝে হয়তো এমন করেছে। আর এমন মুখেমুখে তর্ক করবে না বলে সায়েম আর জান্নাত আরার মন ভুলিয়েছেন। তুলতুলকে সায়েমের কাছে ক্ষমা চাইতে বলা হলো। শেষমেষ সায়েমের বাবা আর দাদীর হস্তক্ষেপে ক্ষমা পর্ব সমাপ্ত হয়। সায়েমের দাদী তুলতুলের মুখ আঁচল দিয়ে মুছে জড়িয়ে ধরে রুমে নিয়ে গেলেন। এমন হুট করে বিচার সভা ডাকায় জান্নাত আরাকে ভৎসনাও করেছেন। বোঝাই যাচ্ছে জান্নাত আরা আর সায়েমের ইচ্ছায় এই বিচারসভা বসেছে। সায়েমের দাদীকে এসব জানানার কোনো প্রয়োজন তিনি ভাবেননি। আর সায়েমের বাবার মুখ স্ত্রীর সামনে কতটা খোলেন, বোঝাই গিয়েছে।

বাসার পরিবেশ থমথমে দেখে মিতুল কিছু জিজ্ঞেস করে না। কিন্তু জানার জন্য ছটফট করতে থাকে। বোনের কাছে ফোন না দিয়ে ম্যাসেজ করে। সবকিছুনা বুঝতে পারলেও তুলতুলের ফিরতি ম্যাসেজ থেকে জানতে পারে আজ কী হয়েছে। বোনের সাথে কথা বলতে মিতুলের মনটা অস্থির হয়ে আছে। বুঝতে পারছে তুলতুল কষ্ট পাচ্ছে। খুব কষ্ট পাচ্ছে।

***

তুলতুল দাদী শাশুড়ির রুমেই ছিল লম্বা সময়। ইচ্ছে করছে রাতে ভাত না খেতে, নিজের রুমে না যেতে।

“নাত বৌ, তোমারে বুদ্ধিমান ভাবছিলাম। তুমি আমার কথার মানে বুঝ নাই। তুমি ভাবছ সায়েমরে তুমি রাগ দেখাইয়া, চোখে চোখ রাইখা শায়েস্তা করবা। তা সম্ভব না। একসময় তোমার শাশুড়ির জায়গায় আমি আছিলাম। আমার তিন মাইয়া আছিল। একমাত্র পোলার বৌ, মাইয়াগো বিয়া দেওনের বাকি। পোলার তাড়াতাড়ি বিয়াতে আমার মত আছিল না। কিন্তু তোমার শ্বশুর বিয়া ঠিক করলো। আমি না করতে পারি নাই। বৌ আসলো, আমার খেয়াল ছিল ছেলে বৌয়ের নেওটা জানি না হয়। সফলই আছিলাম। মাইয়াগো বিয়া দিলাম। শরীরের শক্তি কমলো। তোমার শাশুড়ির হাতে সংসার গেল। তোমার শাশুড়ি চালু মাইয়া আছিল। সে বুঝছে শাশুড়ি কাছ থেইক্কা পোলারে আলাদা করার চাইতে, স্বামীরে নিজের করা সহজ। আমার পোলাও আরেক সায়েম আছিল। মা বইনের উপর নির্ভরশীল। মা যখন দুর্বল, বোনরা দূরে, আস্তে আস্তে বৌয়ের উপর নির্ভরশীল হইয়া গেল। তখন মায়ের সামনে বৌয়ের জন্য জবান ছুটতো না। এরপর বৌয়ে উপরও আর জবান চলে না। কিন্তুক একটা ভুল সেও করছে। ছেলেরে মা বইনের উপর নির্ভরশীল বানাইছে। আমারে দেইখাও শিক্ষা নেয় নাই। এই রকম পোলারা মেরুদণ্ড ছাড়া হয়। এরা কোনোদিন কালারে কালা, ধলারে ধলা কইতে পারে না। এদের সাথে টিক্কা থাকতে হইলে কৌশলী হইতে হইব।”

তুলতুল এরপর উঠে নিজের রুমে চলে যায়। বুঝতে পারছে দাদী ওকে গুটি হিসেবে ব্যবহার করছেন আসলে। শাশুড়ি বৌয়ের মানসিক দ্বন্দ্বের গুটি হিসেবে তুলতুলকে জান্নাত আরার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে জান্নাত আরাকে তারই ঔষধের স্বাদ দিতে চাইছেন।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে