#ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে
পর্ব ২
ফারহান বিরক্ত মুখে ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। নিচে এত শোরগোলের ভেতর বিরক্ত লাগছিল। এসব প্রোগ্রামে এলে মেয়ে মহলের অতিরিক্ত আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকে ফারহান। ফারহানের তো তাই মনে হয়। সবাই গায়ে ঢলে পড়তে রেডি। সামনে দিয়ে বারবার হেঁটে যাবে। হি হি হা হা করবে। রঙচঙ মেখে সবাই নিজেকে সুন্দরী দেখাতে অতি সচেষ্ট। ফারহান তাই মাকে বলেছে, যাদের দেখানোর, তাদের ছাদে পাঠাতে। হ্যাঁ একজন নয়, ফারহানের মা যে পরিবারে কথা বলেছেন, সেখানে বিবাহযোগ্যা কুমারীর সংখ্যা একাধিক। তার মাঝে এগিয়ে আছে ফারহা নামক এক তরুণী। এই সেন্টারে দুটো বিয়ে হচ্ছে। ফারহানের আম্মু, দুপক্ষেরই আত্মীয়। তবে মূলত অপরপক্ষের কাছের। তাই সেই বিয়েতেই আসা। ছেলের জন্য উপযুক্ত কন্যা সন্ধান করছেন, এই কথা আত্মীয় মহলে জানিয়ে দিয়েছিলেন। আগ্রহী বিবাহযোগ্য দুই কন্যা এই আসরেই ছেলেকে দেখানোর পরিকল্পনা করায় আজ ফারহানকে সাথে নিয়ে এসেছেন। প্রথমজনকে খুব একটা মনে ধরেনি ফারহানের। গতানুগতিক মধ্যবিত্ত তরুণী। সাজ পোশাকে স্মার্ট নয়। ফারহাকে ভালোই লেগেছে। তবে ফারহা আবার ওভারস্মার্ট। যে পরিমাণ সাজগোজ করেছে, যেন নিজেই কনে। তার মাঝে কথাবার্তাও আহ্লাদী। ফারহান আহ্লাদ পেয়ে অভ্যস্ত, দিয়ে না।
ফারহান ছাদের এককোনায় এসে সিগারেট ধরায়। এসময় বিয়ের অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে কেউ ছাদে আসবে না জানে। সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু এখন খাবারের টেবিলকে ঘিরে। প্রথম ব্যাচ দখল করার লড়াইয়ে এমন ভাবে নামবে মনে হয় যেন জীবনে ভালোমন্দ খায়নি। খাওয়ার জন্যই বিয়েতে আসা। ফারহান সব জায়গায় লাঞ্চ, ডিনার করে না। হাইজেন মানে কিনা কে জানে। মাকে আগেই বলে রেখেছিল তাকে খাবার জন্য জোর করতে না। আসার পথে স্যান্ডুইচ খেয়ে এসেছে। মা বাবাকে নিয়ে বাসায় ফিরে লাঞ্চ করবে। ছাইপাঁশ ওয়েলি খাবার খাওয়ার কোনো ইচ্ছেই তার নেই। খাবারের ব্যাপারেও সতর্ক ফারহান। জিম ট্রেইনারের ঠিক করে দেওয়া মেনু আর ক্যালোরি চার্টের বাইরে সাধারণত কিছু খায় না সে। সিগারেটটা ছাড়া প্রয়োজন, কিন্তু পারছে না। তবে সবার সামনে সিগারেট ধরায় না। নিজের গুডবয় ইমেজ নিয়ে ভীষণ সতর্ক ফারহান। এই যে সবজায়গা খায় না, সেটাও সে হজমে সমস্যা হচ্ছে, এসডিটি হচ্ছে এই বাহানায় এড়িয়ে যায়। তাকে কেউ রুড বলুক, তা তার পছন্দ নয়।
সিগারেট নিয়ে একটু আড়ালে চলে যায় ফারহান। চট করে কেউ উপরে আসলে ওকে দেখতে পাবে না। কিন্তু সে ঠিকই দেখতে পাবে। প্রয়োজন মনে করলে সিগারেট ফেলে দিবে। একমনে সিগারেটের ধোঁয়া ওড়াতে থাকে ফারহান। রুনুঝুনু শব্দ হচ্ছে। কেউ আসছে। ফারহান সিগারেট ফেলে পা দিয়ে পিষে ফেলে। একটা মেয়ে একটা ছেলেকে নিয়ে উঠে এসেছে। কান্না করছে। চোখের পানিতে কাজল লেপ্টে গিয়েছে। এক হাতে একটা সাদা জুতো। বোধহয় জুতার হিল ভেঙে গিয়েছে।
“ছোটো আপা কান্না কইরো না তো। সুপার গ্লু আনছি। জোড়া লাগবে দেইখো।”
“রাতুল, ভাই আমার প্লিজ হিলটা ঠিক করে দে। হিল ভাঙলো কিভাবে বুঝতেছিনা। চাচী কী ভাববে। ফারহা আপুও রাগ করবে তাই না?”
“ভাঙা জুতাই ছিল বোধহয়।”
“আম্মা কি এটা শুনবে? বলবে আমি ভাঙছি। কেন নিলাম ফারহা আপুর জুতা।”
রাতুল দ্রুত হাতে হিল ঠিক করে। ছোটো আপার ভয় যৌক্তিক। চাচীর শাড়ি নেওয়াই মায়ের পছন্দ ছিল না। এখন ফারহা আপুর জুতা ভাঙলো। গ্লু দিয়ে ঠিক হলেই হলো। ফারহান সামনে আসে না। মেয়েটা মনে হচ্ছে ফারহা মেয়েটার আত্মীয়। এই মেয়েটাকে তো দেখানো হয়নি। বিয়ের বয়স তো এরও হয়েছে। ফারহান ফোন বের করে একটা ছবি তুলে নেয়।
****
হিল আপাততঃ জোড়া লেগেছে। মিতুল সাবধানে হাঁটছে। ফারহা মিতুলকে চোখে চোখেই রাখছিল। মাঝে কিছুক্ষণের জন্য মা সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। মিতুলের হিল ভেঙে সবার সামনে পড়ার দৃশ্যটা ফারিহা নিজের চোখে দেখতে চাইছিল। এর আগেও আকার ইঙ্গিতে বলেছে তার জিনিস ধরতে না। তুলতুল, ফারহার কিছুতে হাত না দিলেও মিতুলটা ইচ্ছে করে বোকা সাজে। যেন ইঙ্গিত বোঝে না। ঠিকই মায়ের সামনে এসে সহজ সরল ভাব নিবে। আর মা দয়ায় শরীর সব পারলে হাতে তুলে দিবে। হিলটা পা হড়কে টান লেগে আগে থেকেই নড়বড়ে হয়ে ছিল। ফারহা সাধারণ গাম দিয়ে কোনোরকমে আটকে রেখেছিল। ভেবেছিল পরে সময় করে ঠিক করবে। কিন্তু এত জুতো আছে, এটা আর ঠিক করা হয়নি। মিতুলের জন্য ইচ্ছে করে এই জুতো দিয়েছে। আশা ছিল বিয়ের দৌড়ঝাঁপে হিলটা ভাঙবে। মিতুলকে আচ্ছা মতো বকাও খাওয়ানো যাবে, একটা শিক্ষাও দিতে পারবে। কিন্তু এখনও তেমন কিছু দেখলো না বলে হতাশ। সে যখন ছিল না তখন কিছু হয়েছে? কিন্তু হলে মিতুল হিল ঠিক করলো কী করে? ধ্যাত, ফারহার বিরক্ত লাগছে। যদিও তার মন ভালো। ফারহানকে তার পছন্দ হয়েছে। ফারহানেরও তাকে অপছন্দ হওয়ার কারণ নেই। তবে ফারহার মা বলেছেন ফারহান সম্ভবত অন্য আরেকটি মেয়েও দেখেছে। এখানে বিয়ের উপযুক্ত কয়েকটি মেয়ে আছে। আর কোন মেয়েকে দেখতে পারে ফারহা মনে মনে মিলিয়ে নিচ্ছে। তাই নিচের বিয়েতে গিয়েও ঘুরে এসেছে। তবে সে নিশ্চিত হয়েছে এখানে তার মতো স্মার্ট আর কাওকে লাগছে না। ফারহানকে দেখে বোঝাই যাচ্ছিল তার সাথে ফারিহার মতো কাউকেই চাইবে। বেশ সপ্রতিভ ফারহান। লম্বা, শরীর সচেতন বলে শারীরিক গঠনও ভালো, স্মার্ট। যেমনটা ফারহার পছন্দ। তাদের দু’জনের নামও কত মিল। মনে করে হাসি খেলে যায় ফারহার মুখে।
***
মিতুলের নজর খুঁজছে অন্য আরেকজনকে। নাম না জানা লোকটাকে ধন্যবাদ দেওয়া হয়নি। তবে তিনি এই বিয়েতে আগত অতিথিদের কেউই হবেন। নায়কোচিত কেউ নন। গড় উচ্চতার, ছিপছিপে শরীরের একজন। সাধারণ একটা পাঞ্জাবি পায়জামা পরেছেন। ক্লিন সেভ নয়, মুখে হালকা দাঁড়িও আছে। চুল খুব যত্নে আঁচড়ানো না। হালকা করে ব্রাশ চালানো। একেবারেই কেতাদুরস্ত কেউ নন। বয়সেও বেশ ম্যাচুয়র মনে হলো মিতুলের। কিন্তু তারপরও একটা আকর্ষণ আছে। চোখজোড়া ভীষণ সুন্দর। সুন্দর চোখের মেয়েদের মতো, সুন্দর চোখের ছেলেরাও খুব আকর্ষণীয় হয়। ধুপধাপ করে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় হিল ভেঙে আরেকটু হলে পড়ে পা ভাঙতো মিতুল। কোথা থেকে জানি লোকটা সামনে চলে এলো। একদম সিনেমার ঘটনা যেন বাস্তবে ঘটে গেল। মিতুল পা মচকে একটু ব্যথাও পেয়েছিল। কিন্তু ব্যথায় নয় হিল ভাঙার ভয়েই তার কান্না চলে আসলো। ভাগ্য ভালো রাতুল সাথেই ছিল। লোকটা রাতুলকে সাথে করে নিয়ে কোথা থেকে সুপার গ্লু জোগাড় করে দিলেন। ভাগ্যিস, না হলে আজ মিতুলের খবরই ছিল।
এতক্ষণ উত্তেজনায় পায়ের ব্যথা টের মা পেলেও এখন ভালোই ব্যথা হচ্ছে মিতুলের। পা ফেলতে কষ্ট হচ্ছে। স্টেজে গিয়ে তুলতুলের পাশে বসে থাকবে ঠিক করে। স্টেজের কাছে গিয়েই চমকে উঠে। ঐ লোকটা সেখানেই আছে।
(চলবে)