ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যা পর্ব-০৩

0
23

#ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যা
পর্ব ৩

আরমান খামখেয়ালি মেজাজের ছেলে। নিজেকে নিয়ে অনেকটাই উদাসীন। এই যে একটা বিয়ের অনুষ্ঠান, যেখানে মোটামুটি সচেতন ভাবেই সবাই টিপটপ রেডি হয়ে এসেছে। সেখানেও আরমান নিতান্তই সাধারণ পান্জাবি পায়জামা পরে চলে এসেছে। খোঁচাখোঁচা দাঁড়ি অবশ্য অনেকদিনের সঙ্গী। এখন এতেই ওকে ভালো মানায়। এলোমেলো চুলে ব্রাশ চালালেও হেয়ার স্প্রে বা জেল দিয়ে বাধ্য করার চেষ্টা করে না। কেমন একটা ভবঘুরে ভাব আছে চেহারায়। সম্ভাব্য আকাঙ্খিত পাত্রের চাহিদায় তাই হুট করে আরমান কোনো পিতার নজরে আসবে না। কেতাদুরস্ত পাত্রীর চোখেও পড়বে না। অবশ্য আরমান এতেই স্বস্তি অনুভব করে। সবার নজরে আসা, আসরের মধ্যমণি হয়ে থাকার ইচ্ছা, আরমানের কখনোই ছিল না। এই বিয়েতে সে এসেছে মায়ের জোরাজোরিতে। সাধারণত এসব ফ্যামেলি ফাংশনে মা আনোয়ারা পারভীনই অংশ নেন। বাবা নেই আরমানের। আরমানের বাবা বেঁচে থাকতে সরকারি চাকরি করতেন। আরমান পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল। সবাই ভেবেছিল আরমান বাবার মতোই বড়ো কোনো চাকুরি করবে। কিন্তু পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর আরমান ঘোষণা দিয়েছে সে তথাকথিত চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে না। এসব ইঁদুর দৌড় তার পছন্দ না। আনোয়ারা পারভীন শুরুতে নানা ভাবে ছেলেকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। তারপর একসময় ক্ষান্ত দিয়েছেন। এখন আরমান কী করে তা আত্মীয় মহলের অনেকেরই ধারণা নেই। আরমানের কাজ নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলে আনোয়ারা পারভীন প্রথমে একরাশ বিরক্তি ঝাড়বেন। তারপর হতাশ ভঙ্গিতে বলবেন তিনি নিজেও নিশ্চিত না ছেলে কী করার চেষ্টা করছে। সারাদিন খটাস খটাস ছবি তোলে। কম্পিউটারে কী কী করে, তিনি বোঝেন না। অনেকে ভেবেছিল আরমান তবে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের হয়ে ছবি তোলে বোধহয়। দেখা গেল তাও না। আরমান তোলে পশুপাখি আর প্রকৃতির ছবি! এত লেখাপড়া করে একটা ছেলে এসব কেন করবে! কারও মাথায় ঢোকে না। ফলাফল পরিচিত মন্ডল আড়ালে আরমানকে অকর্মণ্য আখ্যা দিয়েছে। এজন্য অবশ্য আরমানকে দোষ দেয় না। বাবার মৃত্যুর পর আরমানের মাথায় কিছুটা গন্ডগোল দেখা দিয়েছে বলেই তাদের ধারণা। আরমানেরও এসব নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। নিজের জগতেই সে মগ্ন।

***

মিতুল স্টেজে আরমানকে দেখে অবাক হয়। আরমান কায়দা করে ছবি তুলছে। তবে কী দুলাভাই এর ঠিক করা ফটোগ্রাফার? তাই হবে হয়তো। এই জন্য এমন সিধেসাধা ভাবে এসেছেন। কিন্তু তারপরও লোকটাকে ভালো লাগছে। কী আশ্চর্য, লোকটার মাঝে ভালো লাগার কিছু নেই, বয়সেও মিতুলের চেয়ে বেশ বড়ো। তবু ভালো লাগার কী হলো? মিতুল নিজেকে শাসন করে স্বাভাবিক মুখে স্টেজে উঠে। আরমান পায়ের দিকে খেয়াল করতে বুঝতে পারে মিতুলের কষ্ট হচ্ছে। হাঁটছে খুঁড়িয়ে। মেয়েটার মাঝে ভীষণ রকম সারল্য আছে। এখনকার মেয়েদের ভেতর দুটো জিনিসের খুব অভাব লাগে আরমানের। প্রথমত সারল্য, দ্বিতীয়ত মায়া। এই মেয়ের মাঝে দুটোই আছে। আরমানের মনে পড়ে বিয়ের জন্য মা গত দুই বছর ধরে পেছনে পড়ে আছেন। কিন্তু মায়ের যেমন পাত্রী পছন্দ, তাদের বাবা মায়ের আবার আরমনকে পাত্র হিসেবে কাঙ্ক্ষিত মনে হয় না। আরমনাকে দেখলে তারা ভরসা পান না যে এই ছেলেটা কতটা সংসারের প্রতি দায়িত্বশীল হবে। মৃত বাবার পেনশন বন্ধ হলে চলার মতো কী করবে তা নিয়েও সন্দিহান থাকেন। যদিও আরমানের পৈত্রিক দোতলা বাড়ি আছে। তবুও পাত্রী পাত্রস্থ করার জন্য ছেলে কী করে সেটা একটা বড়ো প্রশ্ন হয়েই সামনে আসে। আনোয়ারা পারভীনের চেষ্টা তাই এখনো আলোর মুখ দেখেনি।

সহসা আরমানের মনে হয়, এমন একটা মায়া মায়া মেয়ে মা দেখালে জীবনসঙ্গী বানানোর কথা ভেবে দেখতো। মনে হতেই হাসি খেলে ঠোঁটের কোণে। এই মেয়েটা যে একটা বাচ্চা মেয়ে বোঝাই যাচ্ছে। আরমান হাসিটা মিতুলের দিকে তাকিয়ে দিলেও, মন ছিল সম্পূর্ণ অন্য দিকে। কিন্তু মিতুল ভাবলো আরমান তাকে দেখেই হাসছে। মিতুলের মনে হচ্ছে সে একটু আগে পড়ে গিয়েছিল, সেটা ভেবেই লোকটা হাসছে। আশ্চর্য, এত হাসার কী হলো? অথচ একটু আগেও মিতুল লোকটাকে কত ভালো ভাবছিল। লোকটা নিশ্চয়ই মিতুলের ভাঙা হিল আর পড়ে যাওয়ার কথা তার সহকারীদের সাথেও বলেছে। তারাও মিতুলকে দেখিয়ে নিশ্চয়ই মজা করছে। মিতুলের চোখে অভিমানে পানি চলে আসে। এ কী জ্বালা, মিতুল ফারহার মতো কোনো আহ্লাদী কন্যা নয়। তারপরও আজ তার কথায় কথায় কান্না কেন পাচ্ছে?

মিতুল ঠোঁট চেপে কান্না আটকায়। বোনের পাশে বসে হাসিহাসি মুখে পোজ দেয়। আরমান কিছু ছবি তুলে নেয় ক্যামেরায়।

****

সম্পর্কে আরমান বরের দূরসম্পর্কের ফুফাতো ভাই। তুলতুলের বর সায়েম আর আরমান ছোটোবেলায় একই স্কুলে পড়েছে। তারপর কলেজ আলাদা হয়ে গিয়েছে। একসময় সায়েম ভিন্ন বিষয়ে পড়ায় আরমানের সাথে দূরত্ব আরও বাড়ে। তবুও বিয়ের দাওয়াতের সাথে সায়েম বিয়ের ছবি তুলে দেওয়ার অনুরোধ করতে ভুলে না। আসলে সায়েমও এখন আরমানের প্রকৃত কাজ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। যেহেতু আরমান প্রফেশনাল ক্যামেরায় ছবি তোলেই, সেহেতু বিয়ের ছবিও আরমান তুলে দিলেই হয় ভেবেছে। সায়েমের মা বাবা এসব আধুনিক ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের খরচ অযথা অপচয় ভাবেন। বিয়েতে ভিডিও করার জন্য লোকাল একজনকে তুলতুলদের বাড়ি থেকে ঠিক করা হলেও প্রফেশনাল ক্যামেরা ম্যান কেউই ভাড়া করেননি। তাই আরমানকেই অনুরোধ করেছে সায়েম। নিজের মা বাবা বা বড়োবোনকে এ নিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করলে মা কষ্ট পেতে পারেন মনে হয়েছে। ইতোমধ্যে মা তিন-চার বার “ছেলে আমার রইলো না ” বলে ফিট খেয়েছেন। বিয়ের গাড়িতে ওঠার আগে মায়ের হাতে শরবত খেয়ে সালাম করতে গেলে মা এত কেঁদেছেন যে সায়েমের মনে হচ্ছিল সে বৌ আনতে যাচ্ছে না, বরং নিজেই বিয়ে করে শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে। কিন্তু মায়ের ব্যাপারে ভীষণ ইমোশনালও সায়েম। মা কষ্ট পাবে এমন কিছু করা তার পক্ষে সম্ভব না। তাই তো তুলতুলকে দেখার এত ইচ্ছে থাকলেও বিয়ের আগে একবারও সেই আর্জি পেশ করা হয়নি। ফোনে কথা বলা তো দূর। আজ স্টেজে সরাসরি দেখা। এবং দেখার পর আরেকবার মায়ের জন্য মন আদ্র হয়ে গিয়েছে। এত চমৎকার মায়াবী একটা মেয়ে সে নিজে খুঁজলে কোনোদিন পেত না। মায়ের নজর আছে বলতে হবে। হবু বৌয়ের সাথে শখ করে নানা পোজে ছবি তোলার অনেক ইচ্ছে সায়েমের কিন্তু মায়ের আর বোনের সামনে হচ্ছে না। আরমানকে আড়ালে বলেছে। আরমান বলেছে খাওয়ার পর সবাই যখন একটু রিলাক্স হয়ে বসবে, তখন ওদের একবাহানায় ছাদে নিয়ে যাবে।

খাওয়াদাওয়া নিয়ে আরমানের এত বাছবিচার নেই। যত্ন করে কেউ খাওয়ালে হোটেল সালাদিয়ায়ও সে তৃপ্তি করে খেতে পারবে। সালাদিয়া নামটা অবশ্য আরমান আর বন্ধুদের দেওয়া। ছালা বা বস্তা কেটে পর্দা দিয়ে রাস্তার পাশে যে ভাতের হোটেলগুলো বানানো হয়, তার নামই সালাদিয় বা ছালাদিয়া হোটেল। কিন্তু সমস্যায় পড়ে যায় এমন দাওয়াতে আসলে। যেখানে সবাই নিজের গ্রুপ নিয়ে চেয়ার দখল করে। সেখানে একা একজন নিভৃতে বসে শান্তি নিয়ে খাওয়া মুশকিল। আরমান ঠিক করে সায়েমের টেবিলেই বসবে। সায়েম আর তার মা বাবা ভাই বোন টেবিলের একমাথায় বসেছে। মেয়ে পক্ষের সবাই তাদের ঘিরে আছে। ইতোমধ্যে তারা বুঝতে পেরেছে সায়েমের বোনের ঘনঘন রাগ করার বাতিক আছে।তাই বোন যেন কিছুতেই না রাগ করে সে ব্যাপারে সবাই সচেষ্ট। বোনও খুব ভাবে আছেন।

আরমান চেয়ার টেনে বসতেই যাবে এমন সময় একজন চেয়ার ধরে ফেলে।

“আপনি এখানে কেন বসছেন? আক্কেল নেই নাকি?”

“আমাকে বলছেন?”

মিতুল ফিসফিস করে বলে,

“তো কাকে?”

“কোথায় বসব?”

“আপনাদের জন্য আলাদা বসার ব্যবস্থা আছেন। আপনার সহকারী কয়জন?”

আরমান বুঝতে পারে না।

“সহকারী?”

“হ্যাঁ। ভিডিও ম্যান বা লাইট ধরে এমন কেউ নেই?”

আরমান বুঝতে পারে মিতুল তাকে বিয়ে কাভার করতে আসা ফটোগ্রাফার ভাবছে।

“আমি একা। বরের বাজেট কম তো।”

“আসেন আমার সাথে।”

মিতুল আরমানকে নিয়ে একপাশের টেবিলে চলে আসে। সেখানে ভিডিও ম্যান আর চার সহকর্মী নিয়ে বসেছেন।

“ভালোই তো, আপনার সব কাজ একা করছেন। আমাদের ভিডিও ম্যান চারজন নিয়ে এসেছে সাথে। আব্বু তো সেই রাগ। উটকো লোকে খাওয়ায় টান পড়ে যদি।”

আরমান মজা পাচ্ছে। পুঁচকে ছিঁচকাদুনে মেয়েটা কেমন বড়োদের মতো পাকা পাকা কথা বলছে।মুখে অবশ্য তা প্রকাশ করে না।

“আমার সাথে আরেকজন আসার কথা ছিল। বয়স্ক মানুষ তো। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাই একাই আসলাম।”

মা আনোয়ারা পারভীনকে উদ্দেশ্য করেই কথাগুলো বলে আরমান। মিতুল অবশ্য বোঝে না। বোঝার কথাও না।

“কমবয়সী সহকারী রাখেন। বয়স্ক লোক এত দৌড় ঝাপ করতে পারে না। শুনেন একা তুলছেন বলে ছবি আবার খারাপ তুলবেন না কেমন।”

“না নিশ্চিন্ত থাকেন।”

মিতুল চলে যেতে গিয়েও আবার ফিরে আসে,

“আপনাকে ধন্যবাদ।”

“আপনি পায়ে ব্যথা পাচ্ছেন। হাঁটবেন না। ফুলে যেতে পারে। ব্যথার ঔষধ এনে দেব?”

মিতুল মাথা নাড়িয়ে চলে যায়। অবাক হয়, লোকটা তার খুঁড়িয়ে চলা খেয়ালও করেছে। তাহলে হাসছিল কেন? থাক অতটাও খারাপ না মনে হয়। সহকারী কেউ নেই মানে আর কাউকে মিতুলের পড়ে যাওয়ার কথা বলেনি। মনটা ভালো হয়ে যায় মিতুলের।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে