-কেমন আছিস রুদ্র?
-ভাল আছি দোস্ত, তোর খবর কী?
-আমার খবর ভালই। তোকে খুঁজে বের করতে আমার প্রাণ যায় অবস্থা।
-এত বছর পর হঠাৎ এত খোঁজাখুঁজি কিসের?
-আরে, আমার ছোট বোনের বিয়ে। বিয়েটা উপলক্ষ মাত্র। আমি দেশের কিছু নেতাকর্মীদের এক করতে চাচ্ছি। আর কিছু কাছের বন্ধুবান্ধবদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। বেশিরভাগ পেয়ে গেছি। শুধু তোকে আর রনিকে পাইনি। আজ তোকেও পেয়ে গেলাম।
-ব্যাপার কী? রাজনীতি করিস নাকি?
-তা একটুআধটু করি। সামনে সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন করার ইচ্ছা আছে।
-ও, এতদূর এগিয়ে গেছিস, জানিই তো না।
-শালা, খোঁজ নিয়েছিস কখনো? তোকে আগেরদিন টিভিতে দেখে চিনতেই পারছি না। লেখক রুদ্র মাহমুদ। এত বড় রাইটার হয়ে গেছিস। আমাদের নিয়েও কিছু লিখিস।
-কী লিখব? ‘রাজনীতিবিদ আসিফ’ নাকি ‘আমার বন্ধু আসিফ’?
-যা ইচ্ছা লিখিস। কিন্তু বিয়েতে আসতেই হবে। এই নে কার্ড।
-বিয়ে হবে কোথায়? ঢাকায় নাকি গ্রামে?
-গ্রাম নাই এখন। মফস্বল হয়ে গেছে। ওখানেই।
-আচ্ছা, চেষ্টা করব দোস্ত।
-শালা, চেষ্টা কীরে? তুই না আসলে তোর লেখালেখি শেষ করে ফেলব কিন্তু।
-হাহাহা। আসব। এখন বল, চা খাবি নাকি কফি? এতক্ষণ তো বলার সুযোগই দিলি না। বকবক করেই যাচ্ছিস।
-চাকফি পরে খাব। ক্ষুধা লাগছে। চল, কিছু খেয়ে আসি।
আমি আর আসিফ কলেজ জীবনের বন্ধু। সে রাজনীতিতে নাম লেখালো আর আমি লেখালেখি জগতে পুরোপুরিভাবে ডুবে গেলাম। আজ প্রায় পনেরো বছর পর তার সাথে দেখা।
কার্ড খুলে দেখলাম গায়েহলুদ ২৭ সেপ্টেম্বর আর বিয়ে ২৯। সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলাম। যাবো।
২৮ তারিখে আমি ঢাকা থেকে একা রওনা হলাম। ড্রাইভার ছুটি নিয়েছে। আর আমি ঢাকার বাইরে গেলে তাকে রেখেই যাই। বিকেলের মধ্যেই আমি আমার নীড়ে পৌঁছে গেলাম।
স্থানীয় বন্ধুবান্ধবদের সাথে সময় দিলাম। বেশিরভাগ বন্ধুরা রাজনীতির সাথে যুক্ত। এদের দেখে যা বুঝলাম তা হল, যার কোন কাজ নেই, সেই রাজনীতি করে।
পরদিন বিকেলে বন্ধুর বোনের বিয়েতে গেলাম। অনেক মেহমান এসেছে। আরও আসবে। সন্ধ্যার পরে খাওয়াদাওয়া শুরু হবে। আমি মনে হয় একটু আগেই চলে এলাম। আসিফের সাথে দেখা হল। দেখলাম, বন্ধু আমার খুবই ব্যস্ত। রাজনৈতিক নেতা বলে কথা। তাকে বললাম, তুই ওদিকে দেখ। আমি ঘোরাঘুরি করি, সাজসজ্জা দেখতে থাকি। আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হওয়ার কিছু নাই। আমার কথায় সে কিছুটা স্বস্তি পেল। কলেজ লাইফের কিছু বন্ধুদের দেখা পেলাম। প্রাণের বন্ধু না, নামের বন্ধু। এদের বন্ধু বলা থেকে সহপাঠী বলাটাই শ্রেয়। যাইহোক, এদের পেয়ে ভালই হল। আড্ডা দিচ্ছি। সময় ভালই যাচ্ছে।
-এক্সকিউজ মি।
একটা মেয়ের কণ্ঠ আমার পেছন দিক থেকে আসছে। বন্ধুরা সবাই মেয়েটার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। আমি ঘাড় ফেরালাম।
-আমি কী আপনার সাথে একটু কথা বলতে পারি?
-আমাকে বলছেন?
-জ্বি।
-হ্যাঁ, বলুন।
-একটু ঐপাশে আসেন, প্লিজ।
মেয়েটার কথায় আকুতি ছিল কিন্তু মুখে দুষ্টামির হাসি। আমার বন্ধুরা এবার বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। যাইহোক, আমি মেয়েটার সাথে গেলাম। একটা রুমে গিয়ে বসেছি দুজন।
-আমি আপনার খুব বড় একজন ফ্যান।
অল্প বয়সী মেয়েদের কাছে এরকম কথাবার্তা শুনে আমি অভ্যস্ত। আগে বিরক্ত হতাম। কিন্তু ইদানীং বিরক্ত হতেও বিরক্ত লাগে। তাই একটা মেকি হাসি দেই।
-স্যার, আপনার বই আমি যখন প্রথম পড়ি, তখন ভেবেছিলাম আপনি বয়স্ক লেখক।
-জ্বি ধন্যবাদ।
-আমার একটা হেল্প করবেন স্যার?
-কী হেল্প?
-আমি একটা গল্প বলব। গল্প ঠিক না, একটা সত্য ঘটনা। আপনি এইটা দিয়ে একটা বই লিখবেন।
আমার মেজাজ চড়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাকে বুঝতে দেওয়া যাবে না। লেখক হলে এইসব হজম করতে হয়। এই ধরণের মেয়েদের স্কুল জীবনের কোন প্রেমের গল্প থাকে, তা দিয়ে লেখকদের উপন্যাস, গল্প লিখতে হবে।
-দেখুন, যেহেতু আপনি আমার বই পড়েছেন আপনি জেনে থাকবেন, আমি গতানুগতিক প্রেমের গল্প লিখি না। হ্যাঁ, তবে যদি গল্পের প্লট পছন্দ হয় আমি ভেবে দেখব। সংক্ষেপে বলুন।
-স্যার, আমাকে আপনি আপনি করে বলছেন কেন? আমি আপনার থেকে অনেক ছোট। আমাকে তুমি করে বলবেন।
-আচ্ছা। গল্প শুরু কর।
মেয়েটা গল্প শুরু করল। একটা মেয়ে তার মা আর ছোটবোনের সাথে খালাবাড়ি বেড়ানো শেষে ভ্যানে করে চলে যাচ্ছে। মেয়েটার বয়স তখন চৌদ্দবছর আর ছোটবোনের বয়স ছয়বছর। মেয়েটা খুবই সুন্দরী। হঠাৎ একটা ছেলে বাইসাইকেলে করে ভ্যানের পিছু নিল। ছেলেটা মেয়েটাকে দেখেছিল। ছোট মেয়েটা পেছনে বসায় সে ছেলেটাকে দেখছিল। ছোট মেয়েটাকে কয়েকবার ভেংচিও দিয়েছে ছেলেটা। বড় মেয়েটা এটা বুঝতে পেরে সে বারবার ছেলেটার দিকে তাকাচ্ছিল। ছেলেটা এইভাবে বেশ খানিক পথ আসে। পরে যখন ভ্যান অন্যদিকে চলে যায়, তখন ছেলেটা সোজা পথে অর্থাৎ কলেজের দিকে চলে যায়। মেয়েটা বারবার পিছন ফিরে ছেলেটাকে দেখে। মেয়েটা ঐ ছেলেটার প্রেমে পড়ে যায়।
গল্পের শুরুর দিকে বিরক্তি হলেও মাঝামাঝি এসে আমি খুবই চিন্তিত হলাম। কারণ প্রত্যেক মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত কিছু গল্প থাকে, যা কখনো কারও সাথে শেয়ার করা হয় না। আর এই মেয়েটার গল্পও ঠিক সেরকম একটা গল্প। আর ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে এই গল্পের সেই ছেলেটা আমি। কিন্তু ভেবে পাচ্ছি না, এই মেয়েটা আমার না-বলা গল্পটা কিভাবে জানল।
-আচ্ছা, তুমি এই গল্প কিভাবে জানলে?
-কারণ, ভ্যানের পিছনের পিচ্চি মেয়েটা আমিই ছিলাম।
আমি কী বলব ভেবে পাচ্ছি না। আমি সেই মেয়েটার মুখছবি আজও ভুলতে পারিনি। খুব মায়াভরা চোখ, তার হাসি। আমি যদি কোন চিত্রকর হতাম, তাহলে মেয়েটার ছবি এঁকে ফেলতাম। Love at first sight বা প্রথম দর্শনে ভালবাসা এরকম একটা ব্যাপার হয়েছিল। কিশোর বয়সের এইসব ভালবাসা, ভালোলাগার স্থায়িত্ব খুবই কম। কিন্তু কেন জানি, এই দিনের এই অল্প সময়ের স্মৃতিটুকু আমি সারাজীবন বয়ে বেড়িয়েছি। আমার একটা বিশ্বাস ছিল, জীবনে চলতিপথে কাউকে একবার দেখলে তার সাথে আরেকবার দেখা হবেই। নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়া এই কথাটা আজ সত্যি হতে চলেছে।
আমি কেমন যেন ঘোরের মধ্যে ছিলাম। ঘোর কেটে গেলে আমি মেয়েটাকে আমার সামনে দেখলাম না। দরজার পাশে সাদার উপর লাল ফুল আঁকা শাড়ি পরা কাউকে দেখতে পাচ্ছি। মুখ দেখা যাচ্ছে না। বুকটা ধকধক করছে। সেদিনের সেই মেয়েটা এরকম সাদার উপর লাল ফুল দেওয়া জামা পরে ছিল।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। দুপা এগিয়ে যেতেই শাড়ি পরা মেয়েটা এগিয়ে এল। সেই মুখ। আমি খুবই অবাক হলাম। কারণ আজ প্রায় চৌদ্দ পনেরো বছর পর এই মেয়েটার সাথে আমার দ্বিতীয়বার দেখা হল।
-কেমন আছেন?
-ভাল। আপনি?
ভাল। আচ্ছা, একটা অনুরোধ রাখবেন, আজকের দিনের জন্য আমরা কি তুমি করে কথা বলতে পারি না?
মেয়েটার এই কথারছুরিতে আমার ভিতরটা ঝাঁজরা হয়ে যাচ্ছে।
-না মানে…..
-তুমি একজন লেখক। আমতাআমতা করছ কেন? আমি গল্প-উপন্যাসের বই পড়ি না। সীমা পড়ে। ও একদিন তোমার বই পড়ছিল। কী মনে করে আমি লেখক পরিচিতিটা পড়লাম। তোমার ছবি দেওয়া ছিল। চিনতে পারলাম। তখন ওর সাথে সেদিনের ঘটনাটা শেয়ার করলাম।
-আমার এই বিয়েতে আসার পেছনে তোমার হাত আছে, ঠিক?
-হ্যাঁ, যেহেতু এখান থেকে দেখা হয়েছিল, তাই ভাবলাম আসিফ ভাইয়া হয়তো তোমাকে চিনবে। ভাইয়া বলল যে সে তোমার ক্লাসমেট। তখন বললাম ভাইয়াকে যে তার লেখক বন্ধুকে দাওয়াত করতে।
-তোমার নাম?
-এখন নাম জেনেই বা কী করবে?
-তাও ঠিক। তুমি বিয়ে করেছ?
-না করার কোন কারণ আছে? তোমাকে দেখে ভাল লেগেছিল। কৈশোরের ভাল লাগার স্থায়িত্ব কম। আমি বিয়ে করেছি আর আমার স্বামী হচ্ছে তোমার বন্ধু আসিফ।
-ও।
-আপনি তো একটা ভীতু। কাপুরুষ বলা উচিৎ হবে না। একজন লেখককে আর যাইহোক, কাপুরুষ বলা যায় না।
-আসলে, সেদিন তোমার পিছুপিছু যাওয়ার সাহস ছিল না। দেখা গেল, তোমার পিছুপিছু গেলাম আর তুমি পাড়ার দাদাদের দিয়ে পিটুনি খাওয়ালে।
-আমি তোমার দিকে তাকিয়ে হেসেছিলাম, সেই হাসিতে ভালোলাগার প্রশ্রয় ছিল।
-আমি তা বুঝতে পারিনি। আর আমি প্রতিদিন কলেজে যাওয়ার সময় এখানে এসে তোমাকে খুঁজতাম। একটা দিনও দেখা হল না।
-তুমি বিয়ে করেছ?
-না।
-কেন?
-আর কাউকে সেদিনের মত ভাল লাগেনি।
-ও। আসলে এইটাই নিয়তি। আর শোন, তুমি আর বিয়ে কর না।
-কেন?
-তাহলে আমার প্রতি তোমার ভালবাসা থাকবে।
-তোমার নামটা বলনি এখনো।
-তোমার বন্ধুর কাছ থেকে জেনে নিও।
-তোমার জানাতে সমস্যা থাকার কথা না।
-রূপা।
আমি দ্বিতীয়বারের মত ধাক্কা খেলাম।
-তোমার নামও রূপা?
-আমার নামও রূপা মানে? তুমি আর কয়জন রূপাকে জান?
-না, ঠিক তা নয়। তবে আমার লেখায় আমি এই নামটা বেশি ব্যবহার করেছি। আমার পছন্দের নাম রূপা।
-আচ্ছা। তুমি ওইদিকে সময় দাও। অনেক কাজ পড়ে আছে। উঠছি।
রূপা উঠে চলে গেল। আমি বসে রইলাম। নিজের পোড়াকপাল নিয়ে ভাবছি। কেন এমন হয়? কিছুক্ষণ পরে একটা ছেলে এসে বলল, আপনাকে আপনার বন্ধুরা ডাকে।
আমি বাইরে চলে এলাম। আলোকসজ্জা দেখে আমি স্তম্ভিত। দেখে মনে হচ্ছে একেকটা তারা খসে খসে পড়ছে।
আমার এক বন্ধু বলল, কীরে? ভিতরে এতক্ষণ কী করলি? পিচ্চি মেয়েটাকে পটিয়ে ফেললি? শালা তুই পারিসও বটে।
-আরে নাহ। সেরকম কিছু না।
-তাহলে এতক্ষণ করলি কী?
-একটা মেয়ের নাম জানলাম।
-ওই, লেখকগিরি দেখাবি না।
আরেক বন্ধু বলল, তা সেই ভাগ্যবতী মেয়ের নাম কী?
-রূপা।
আসিফ এসে আমাদের বলল, চল এখন তোরা খেয়ে নে। রাতে ড্রিঙ্ক এর ব্যবস্থা আছে আমার বাংলো ঘরে। বিদেশ থেকে একজন রেডওয়াইন পাঠিয়েছে। সব মেহমানদের বিদায় করে তারপর জমিয়ে আড্ডা হবে। ওকে?
অন্যান্য বন্ধুরা হুররে বলে চেঁচিয়ে উঠল। আমি চুপচাপ। আসিফ বলল, কী হয়েছে তোর? চুপচাপ কেন?
-লেখকদের কিছুকিছু ক্ষেত্রে চুপচাপ থাকতে হয়।
-ওই শালা, লেখকগিরি দেখাবি না।
আমি মনে মনে বললাম, সেদিন যদি সাহস করে ভ্যানের পিছু নিতাম, তাহলে তুই আমার শালা হতি।
খাওয়াদাওয়া করে রাতে বন্ধুর বাংলোতে আড্ডা দিলাম। রাত তিনটার দিকে আমি বিদায় নিয়ে চলে এলাম। আসার সময় বারান্দায় রূপাকে দাঁড়ানো দেখলাম। শুধু বললাম, ভাল থেকো।
রূপা কিছু বলল না। সে নীরবে নিভৃতে অভিমানমাখা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি গাড়িতে উঠে রেডিও ছাড়লাম। সেখানে গান হচ্ছে,
হতেও পারে আমাদের এই মিলনমেলা এক ইতিহাস
হতেও পারে তোমার শীতল শোকটাই যেন এক উচ্ছ্বাস
হতেও পারে বিষাদের এই জনপদ প্রণয়ের তীর্থ
হতেও পারে তোমার একটু নীরবতায় সে ব্যর্থ
হতেও পারে এই দেখা শেষ দেখা
হতেও পারে এই গানই শেষ গান।
©জাকারিয়া জ্যাক